ক্ষণিকের ভাল লাগা ফুল

ক্ষণিকের ভাল লাগা ফুল

“সুন্দরীদের দেখলেই বুঝি এভাবে তাকিয়ে থাকতে হয়”? – প্রশ্নটি শুনেই চমকের ভাবটা কেটে গেল, একটু লজ্জাও পেলাম।

‘তুমি সুন্দরী, তাই চেয়ে থাকি প্রিয়া, সে কি মোর অপরাধ’? মনে মনে এটি বললেও কন্ঠস্বরটা যথাসম্ভব কঠোর করে বললাম, “তুমি কি খুবই সুন্দরী নাকি? নিজেকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে কর কেন?“ কথাগুলো শুনে সে কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়ল এবং লজ্জায় তার ফর্সা গাল লালাভ হয়ে উঠল। এটি লক্ষ্য করে আমার সহযাত্রী, হলের রুমমেট মাহমুদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে কেবল মিটি মিটি হাসলেন। এরপর সবাই একেবারেই চুপ।

টার্ম ফাইনাল পরবর্তী লম্বা ছুটির পর ০২ এপ্রিল, ২০০৩ তারিখে BUET খোলার সংবাদ পেয়ে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনযোগে ঢাকা যাচ্ছিলাম। ট্রেনের নির্ধারিত কামরায় উঠে যেখানে আমাদের সিটগুলি খুঁজে পেলাম, তার বিপরীত দিকেই ছিল সেই সুন্দরী মেয়েটি এবং সঙ্গে ছিলেন একজন ভদ্রমহিলা, যিনি মেয়েটির ভাবী- যা পরে কথোপকথনে জেনেছিলাম।

চানাচুর ওয়ালা আসার পর আমাদের আলাপন পুনরায় শুরু হল। ইঙ্গিতে চানাচুর ওয়ালাকে বুঝিয়ে দিলাম, মেয়েটি ও তার ভাবীকে চানাচুর দেয়ার জন্য। বেচারা মেয়েটির দিকে চানাচুর এগিয়ে দিতে গিয়ে খেল এক ধমক, “আমি কি তোমাকে দিতে বলেছি?” তখন সে হতচকিত হয়ে কেবল আমাকে দেখিয়ে দিল। আমি কিছু বলার আগেই মাহমুদ ভাই বললেন, “কেউ কোন কিছু সাধলে তা গ্রহন করাটা কিন্তু এক ধরনের ভদ্রতা।“ আমি ভেবেছিলাম, সে চটে যাবে, কিন্তু কোন কিছু না বলে সে ইতস্ততঃ ভঙ্গিতে গ্রহণ করল এবং তারপর ভাবী ও আমরা।

চানাচুর খেতে খেতে আমি আমার এবং মাহমুদ ভাইয়ের পরিচয় দিলাম। যদিও আমি BUET-এর সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, তবুও নিজেকে থার্ড ইয়ারের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিলাম ইচ্ছে করেই। প্রথমেই তাকে ‘তুমি’ সম্মোধন করায় সে বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। মনে হয়, সে এর প্রতিবাদও করত, করেনি হয়ত আমার প্রশ্নের ধরণ দেখে। তবে এটা ঠিক যে, অপরিচিত কাউকে প্রথমেই ‘তুমি’ সম্মোধন করাটা শিষ্টাচার বর্জিত। তাই সিনিয়রিটি বজায় রাখার স্বার্থেই আমার এরূপ কাজ। এটি দেখে মাহমুদ ভাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, কিছু বলেননি।

সেও তার নিজের এবং ভাবীর পরিচয় দিল এবং জানাল যে, তারা জামালপুর থেকে ঢাকায় যাচেছ। আমি তাকে দেখে ধারণা করেছিলাম, সে হয়ত ইন্টারমিডিয়েট লেভেল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্রী। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে সে জানাল, সেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থার্ড ইয়ারে অধ্যয়নরত, সাংবাদিকতা বিভাগে। থার্ড ইয়ারের কথা শুনে আমার কেমন যেন একটু খটকা লাগল; পরক্ষনেরই মনে হল, সে বাড়িয়েই বা বলবে কেন? আমি বাড়িয়ে বলেছি বলেই হয়ত তার সম্বন্ধেও আমার এমন মনে হচ্ছে। মেয়েদের বয়স রহস্য দুর্ভেদ্য বলেই জানতাম, কিন্তু এক্ষেত্রে দেখি – মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।

– “তাহলে তো তোমরা একই ব্যাচের“, তার পরিচয় পেয়ে মাহমুদ ভাই বললেন।
– “নিশ্চয়ই ঢাকায় ভাবীর এখানেই থাক তুমি?“ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

তখন এই প্রথম ভাবী মুখ খুললেন, “তাকে আমি কত বলেছি আমার এখানে থাকার জন্য, কিন্তু তার নাকি হলে’ না থাকলে লেখা পড়া হয় না।” আমি আলাপ চারিতায় তার হলের ঠিকানাও জেনে নিলাম।

কিছুক্ষণ আবার সবাই চুপ, সাঁ সাঁ শব্দে ট্রেন এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, শিউলী কৌশলে একবার জানালার বাইরে তাকাছে, আর একবার আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছে, আমি তাকে দেখছি কি – না, লক্ষ্য করছে। তখন মনে হল, গেয়ে উঠি-

“চেয়ো না সুনয়না, আর চেয়ো না এ নয়ন পানে,
জানিতে নাই তো বাকী, সই ও আঁখি কি যাদু জানে,
ও আঁখি কি জাদু জানে।”

সে কি করছে বা না করছে, তা আমি লক্ষ্য করলাম কিভাবে, কেনই বা করলাম, এর জবাব নাই বা দিলাম।
আমি হঠাৎ এক সময় জিজ্ঞাস করলাম, শিউলী, নজরুলকে তোমার কেমন লাগে”? নাম ধরে বলায় সে যেন একটু অবাক এবং সেই সাথে পুলকিতও হল।

– নজরুল তো এক আজব কারিগর, ভেবে পাইনা এমন অস্থির একজন লোক এত কিছু সৃষ্টি করলেন কিভাবে? সেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে।

– সবই God Gifted ব্যাপার। দুঃখ এই, আল্লাহ আমাদেরকে এর ছিটে ফোঁটাও দিলেন না, এমন কি সুন্দর চেহারাও না। চেহারার কথা শুনে আমার বিপরীত পার্শ্বের সহযাত্রী দুজন বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকালেন, সেই সাথে মাহমুদ ভাইও। তখন আমি যেন একটু লজ্জায় পড়ে গেলাম।

-নজরুল কে আপনি বুঝি খুব পছন্দ করেন?
-অবশ্যই, নজরুল তো আমার গুরু, আমার আদর্শ।
-প্রেমের ক্ষেত্রেও কি?

নিজেকে সপ্রতিভ মনে করলেও এ ধরনের প্রশ্নের জন্য একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু তা বুঝতে না দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, সে ক্ষেত্রেও; নজরুল তো বিশ্বপ্রেমিক, তাই তার প্রেম সর্বমুখী। আর তাছাড়া প্রেমের প্রকৃত স্বাদই তো পরকীয়ায়।“

“তাহলে তো তোমার কাজ থেকে সর্বদা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হয়”- ভাবী শব্দকে হেসে বললেন। তখন হাসির একটা রোল পড়ে গেল।

বুঝতে পারছিলাম, ট্রেনটি ক্রমশঃ Slow হচ্ছে, এক সময় এটি থেমেই গেল। “এটা আবার কোন ষ্টেশন”? শিউলী বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল। বাইরে লক্ষ্য করে বললাম, “Theoretical নয়, এটি একটি Practical ষ্টেশন।”

– সে আবার কি রকম?
– ট্রেন চালককে কিছু ধরিয়ে দিয়ে কয়েকজন যাত্রী তাদের বাড়ীর কাছে নেমে যাচ্ছে, এ আর নতুন কি?
এরপর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, নির্বাচনী অনিয়ম ইতাদি নিয়েও অনেক আলাপ আলোচনা হল। নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠতেই ভাবী বললেন, “নির্বাচন মানেই তো শিউলীর ব্যস্ততা শতগুন বেড়ে যাওয়া।”

– কেন, শিউলি কি নির্বাচনও করে নাকি? মজা করে আমি বললাম।
– না, তার ব্যস্ততা বাড়ে পর্যবেক্ষক হিসেবে। নির্বাচনে কার কোথায় কেমন অবস্থা ইত্যাদি জানা যেন তার জন্য একেবারে ফরয।
– এতে সমস্যার কি আছে?

– সমস্যা নেই মানে? গত ২০০১-এর নির্বাচনের আগে সামনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা থাকা সত্ত্বেও পড়াশুনা বাদ দিয়ে সে সংসদের বিভিন্ন আসনের নির্বাচনপূর্ব এসব পর্যালোচনা নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিল, আর নির্বাচনের দিন তো ভোট গণনা শুনতে শুনতে সে আর রাতে ঘুমায়নি।

ভাবীর একথা শেষ হতে না হতেই মাহমুদ ভাই বললেন, ২০০১-এ HSC পাস করলে শিউলীর তো থার্ড ইয়ারে পড়ার কথা না।” এটি শুনে ভাবী যতটা না শিহরিত হলেন, তার চেয়ে বেশী শিহরিত হল শিউলী। ভাবী তখন একটু হেসে বললেন, “শিউলী আসলে পড়ে সেকেন্ড ইয়ারেই, তোমাদের সাথে মজা করার জন্যই হয়ত সে থার্ড ইয়ারের কথা বলেছে।” শিউলীও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

নিজের কোন দুর্বলতা থাকলে তা গোপন করে অন্যের মাঝে তা আবিষ্কার করতে চেষ্টা করা মানুষের স্বভাব। তাই নিজেরটা না বলে আমি যথা সম্ভব গম্ভীর হয়ে চার্জ করার ষ্টাইলে বললাম, “এমনটি করা তোমার মোটেই উচিত হয়নি।” মাহমুদ ভাইও অনুরূপ কথাই বললেন। দেখলাম, শিউলীর মুখাবয়বে কালো মেঘের ঘনঘটা, ভাবীও যেন কিছুটা বিব্রত।

এরই মধ্যে ট্রেন কমলাপুরে পৌছেঁ গেল আমাদেরকে বুঝতে না দিয়েই। নামার পর যখন প্লাটফরম ধরে বেরোনোর জন্য অগ্রসর হচ্ছিলাম, তখন শিউলী বার বার দুঃখ প্রকাশ করল এবং আমরা যাতে কিছু মনে না করি, সেজন্য অনুরোধও করল। আমি তখন আমার ব্যাপারটা বলতে চেয়েও বলিনি, অপরাধীর মত তার বার বার ‘সরি’ বলা এবং অনুরোধ করা আমার কাছে বেশ ভালই লাগছিল। স্কুটারে উঠার আগে ভাবী তার বাসায় যাবার জন্যে বার কয়েক বললেন; আর শিউলী বলল, “যাই, যদি কিছু মনে নাই করে থাকেন, তবে হলে আসবেন, খুশী হব।” আমরাও সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লাম, মনে মনে বললাম “প্রিয়া, যাই যাই বলো না।”

তারা চলে গেলে মাহমুদ ভাই বললেন, “তুমি থার্ড ইয়ারের কথা বলতে গেলে কেন? সঠিকটা বললেই তো ভাল হতো, তাছাড়া শিউলী তো তোমার ব্যাচেরই, তাই শেষে বলে দিলেও পারতে।” আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম, সিনিয়রিটির ফলে যে সম্মানের আসনে আমি অধিষ্ঠিত হয়েছি, তা বিসর্জন দেই কিভাবে”?

– সে যাই হোক মেয়েটা কিন্তু চমৎকার, তার সাথে দেখা তো নিশ্চয়ই করছ?

– “হ্যাঁ, তা তো করবই”, আমি দৃঢ়ভাবে সম্মতি জানালাম, তাঁর কথার উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে।
কিন্তু শিউলীর মত অপরাধীর ভুমিকায় আমি কি নিজেকে দেখতে চাই? শ্রদ্ধার যে আসন আমি পেয়েছি, তা কি বিসর্জন দিতে চাই? ফুলকে তো বাগানে সুশোভিত থাকলেই বেশী মানায়, কাছে গেলে সে সৌন্দর্য ম্লানও মনে হতে পারে, ধরতে গেলে কাঁটার আঘাত পাবার সম্ভাবনা থাকে, আর ছিঁড়ে ফেলা তো সে সৌন্দর্যেরই বিনাশ। ভ্রমনকালীন এ ভাললাগা সময়ের প্রবাহে যদিও ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু মনোরাজ্যে তার স্থায়িত্ব চিরস্থায়ী না হলেও অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী। হোক না সে ক্ষণিকের ভাললাগা ফুল, তথাপি এর যে রূপ-রস আমি উপভোগ করেছি, তাই বা কম কিসে? ক্ষণকালের জন্যে এর স্থায়িত্ব বলেই হয়ত এর মূল্য অনেক বেশী।

– “কি ধ্রুব, ভাবের মধ্যে আছে মনে হয়”? মাহমুদ ভাইয়ের এ প্রশ্ন শুনে দেখালাম, স্কুটার শেরেবাংলা হলের গেটে দাঁড়িয়ে।

কিছু না বলে তখন ব্যাগটি কাঁধে বুলিয়ে হলের ভিতরের দিকে পা বাড়ালাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত