“আরে না না, এখনো ওকে তোদের বৌদি ভেবে নেওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। আর এবার না ঘুমোলে ভোরে মহালয়া টা মিস হয়ে যাবে কিন্ত্তু্।” খুড়তুতো ভাইবোনদের খোঁচাখুঁচিতে অতিষ্ঠ হয়ে অমিত বলে উঠলো।
রাত তখন সাড়ে ১২ টা। বাবা মা-র সাথে সন্ধ্যায় কলকাতা ফিরেছে অমিত। বছর পাঁঁচেক পর পূজোর ছুটিতে কলকাতা ফিরলো সে। ১০ বছর বয়স থেকে লন্ডনে বাবা-মার সাথে বড়ো হয়েছে অমিত। তবে প্রতি বছরই পূজোয় বাবা-মার সাথে কলকাতা চলে আসতো। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর পূজোয় কলকাতা আসার ছুুটি আর পায়নি সে। লন্ডনে বাঙালিরা দূর্গাপূজা করে। কিন্তু কলকাতার মতো আনন্দ সেখানে পেতোনা অমিত। মনে মনে খুব মিস করতো কলকাতাকে। এই বছর ইউনিভার্সিটির কোর্স শেষ হয়েছে। তাই এবার মহালয়ার ঠিক আগের দিন চলে এসেছে কলকাতা। ছোটোবেলার মতো রেডিওতে মহালয়া শোনার অনেকদিনের ইচ্ছে যে তার। তবে এবার কলকাতার বাড়িতে ফেরার পর থেকে সবার আকর্ষণের কেন্দ্র অমিতের সাথে আসা ওর ইউনিভার্সিটির বন্ধু মেরী।
লন্ডনের মেয়ে মেরী থম্পসন-এর সাথে অমিতের আলাপ ইউনিভার্সিটিতে বছর তিনেক আগে। খুব তাড়াতাড়ি ওদের বন্ধুত্ব জমে ওঠে। অমিতের সাথে মেরী লন্ডনের দুর্গাপূজায় যায় প্রতি বছর। বাংলাটাও অমিত প্রায় শিখিয়ে দিয়েছে মেরীকে। বাংলা বলতে না পারলেও ভালোই বুঝতে পারে মেরী। এছাড়াও ফোটোগ্রাফির খুব শখ মেরীর। সে অমিতের কাছে কলকাতার পূজোর ছবি দেখেছিলো। তাই যখন জানতে পারে যে অমিত পূজোর ছুটিতে কলকাতা আসছে, সেও আসতে চায় অমিতদের সাথে। অমিত ঠিক সাহস পাচ্ছিলোনা বলে মেরী তার বাবা-মার সাথেও অমিতের কথা বলিয়ে দিয়েছিলো। মেরী ঠিক করেছিলো কলকাতার কোনো হোটেলে স্টে করবে। কিন্তু অমিতের বাবা আবার তাতে রাজী হয়নি। তাই মেরীও কলকাতায় অমিতদের বাড়িতেই উঠেছে। আর সেই বিদেশিনীকে দেখে অমিতের খুড়তুতো ভাইবোন সৌম্য আর সুমি তার পেছনে লাগা শুরু করেছে। যতক্ষণ মেরী তাদের সাথে বসেছিলো, ততক্ষণ মাঝেমাঝেই ওরা গেয়ে উঠছিলো, “আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী !!!” অমিত আরচোখে ওদের নিষেধ করছিলো। ওরা তো আর জানেনা যে মেরী বাংলা বোঝে। মেরী বসে হাঁসছিলো। অমিত জানে যে মেরী যা বুদ্ধিমতী, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। ডিনারের পর মেরী চলে গেলো তার জন্য রেডি করা গেস্ট রুমে। আর তারপরেই আড্ডায় সৌম্য অমিতকে চেপে ধরলো, “কিরে দাদা, তুই যতোই বলিস… বিশ্বাস হচ্ছেনা। শুধুমাত্র ছবি তুলতে আর পুজো দেখতে একটা ইংরেজ মেয়ে এতোদূর একা একা চলে এলো! আসলে ও তোকে ছাড়া থাকতে পারবেনা, তাই এসেছে।”
সুমি আরেকধাপ এগিয়ে গিয়ে বললো, “দাদা, এই সুযোগ। আমাদের হবু বৌদীকে প্রোপোজ করেই দে।”
অমিত সেইরাতের মতো সব হেঁসে উড়িয়ে দিয়ে ঘরে এসে শুলো। কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই মেরীর মুখটা ভেসে উঠলো। সত্যিই মেরীর মধ্যে যেনো এক অদ্ভূত আকর্ষণ। সে যেনো তার বয়সী আর সব মেয়ের থেকে আলাদা। এমন সুন্দর শান্ত স্বভাব,এতো অল্প কথা বলে। কিন্তু যা কথা বলে, একদম হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তেমনি মিষ্টি নিষ্পাপ মেরীর হাসি। হঠাৎ মেরীর কথা কেনো এতো মনে হচ্ছে। তার ভাইবোনের ব্রেনওয়াশের জন্য নাকি সে সত্যিই মেরীর প্রেমে পরেছে !!! কিন্তু মেরী কি ভাবে তার সম্পর্কে কে জানে !!!
হঠাৎ অমিতের মোবাইল-এর রিংয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। মেরী ফোন করছে। ফোন ধরতেই মেরী বললো, “হে, কাম আউটসাইড ফাস্ট।”
ধরমর করে ঘুমভাঙ্গা চোখে দরজা খুলে বেরিয়ে অবাক হয়ে গেলো অমিত। দেখলো, বারান্দায় টেবিলের উপর রাখা রেডিওটা চালানোর চেষ্টা করছে মেরী। ঘড়িতে ৪টে বেজে ৫ মিনিট। সে গিয়ে রেডিওটা চালিয়ে দিলো। মহালয়া শুরু হয়ে গেছে। ওরা দুজনে দুটো চেয়ারে বসে শুনতে থাকলো। ঘুমে অমিতের চোখ মাঝে মাঝে জুড়িয়ে আসছিলো। মেরী কিন্তু চেয়ার থেকে উঠে তার ক্যামেরা নিয়ে বারান্দায় ঘুরে ঘুরে বাড়ির ছবি তুলতে লাগলো। ঘুম চোখেই সে অবাক হয়ে দেখছিলো মেরীকে। ভাগ্যিস মেরী ওকে ডাকলো। নাহলে তো এবারো তার মনের ইচ্ছাটা অপূর্ণ রয়ে যেতো। সে মনে মনে ঠিক করলো যে আজকে মেরীকে নিয়ে কলকাতা দেখাতে বেরোবে যাতে সে অনেক ভালো ভালো ছবি তুলতে পারে।
ব্রেকফাস্ট করতে করতে মেরীকে বললো অমিত, “মেরী, চলো আজ আমরা কলকাতা ঘুরতে যাবো। ওকে?” শুনেই মেরীর চোখে মুখে আনন্দ ফুটে উঠলো। সে হেসে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘড় থেকে বেরিয়ে এসে সুমি বলে উঠলো, “কিরে দাদা, আমরা বাদ !!! চলনা কুমোরটুলি যাই। মেরী, ইট ইস দ্য বেস্ট প্লেস ফর ফটোগ্রাফি বিফোর পূজা।”
শুনতে পেয়ে সাথে জুড়লো সৌম্য, “হ্যাঁ রে দাদা, আমার ডিএসএলআর টাও নিয়ে বেরোবো।”
অমিত ওদের না বলতে যাচ্ছিলো। মেরী ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “ইয়েস অমিট, লেট্স গো টুগেদার।”
অগত্যা দুপুরের খাওয়া সেরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ওরা। সুমি তো মেরীকে কাছছাড়াই করছেনা। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছে আর মেরীও হাসিমুখে ওর ছবি তুলছে। এভাবে হাঁঁটতে হাঁটতে ওরা পৌঁছে গেলো কুমোরটুলির ঠিক সামনে গঙ্গার ঘাটে। অমিত বললো, “মেরী, তুমি এখানে বেস্ট সানসেট শট পাবে। বাট ইউ হ্যাভ টু ওয়ে…”
কথা শেষ করার আগেই থেমে গেলো অমিত। মেরী কুমোরটুলির ভিতরের রাস্তা দিয়ে হাঁটা দিয়েছে। পিছন পিছন ওরা তিনজনও চললো। দুইপাশে সারি দিয়ে পরপর দুর্গা প্রতিমা। ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে চলেছে মেরী। হঠাৎ বাঁদিকে একটা সরু গলিতে ঢুকে গেলো। এই গলিতে পরপর ঝুপড়ি রয়েছে। কোনোটাতে প্রতিমা রয়েছে আর কোনোটা কুমোরদের বাড়ি। সুমি ফিসফিস করে অমিত কে বললো, “দাদা, ওকে থামতে বল। ছবি তুলতে তুলতে ও তো কারোর বাড়িতে ঢুকে যাবে।”
অমিত মেরীকে ডাকার আগেই মেরী ডানহাতের একটা ছোটো বাড়ির দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো। অমিত দৌড়ে এগিয়ে গেলো। দেখলো দরজার উপর একটা পুরোনো ময়লা সাদা বোর্ডে লাল রঙ দিয়ে একটা নাম লেখা। লেখাটা অনেকটা উঠে উঠে গেছে। সে কষ্ট করে পড়লো নামটা, ‘শ্রী রমেশ চন্দ্র পাল’।
দরজা ঠেলে ঘড়টায় ঢুকলো অমিত। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে মেরী। আর ঘরের এককোণে মাটিতে বসে একটি ছোটো প্রতিমা গড়ছেন একজন বৃদ্ধ মানুষ। চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা। হঠাৎ ঘরে দু’জন ঢুকে পড়ায় তিনি একটু অবাক হয়েছেন।
বৃদ্ধটি জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার? আমি দুর্গাঠাকুর গড়িনা। আর লক্ষীপ্রতিমার বায়না করতে এসে থাকলে আগেই বলে দিই যে বেশী বড় প্রতিমা আমি গড়তে পারিনা। একাহাতে হয়না। বয়েস হয়েছে।”
মেরী আস্তে করে অমিতকে বললো, “টেল হিম দ্যাট আই ওয়ান্ট টু টেক এ শর্ট ইন্টারভিউ রিলেটেড টু হিস প্রফেশন অ্যান্ড ফ্যামিলি।”
কি হচ্ছে ঠিক বুঝতে না পারলেও সিচুয়েশন ম্যানেজ করার জন্য অমিত বৃদ্ধটিকে বললো, “এই ম্যাডাম লন্ডন থেকে এসেছেন। উনি আপনার পেশা,পরিবার, দৈনিক জীবন সম্পর্কে একটু জানতে চান। উনি ফিল্ম বানাচ্ছেন কুমোরটুলির উপর। আপনি ৫-১০ মিনিট একটু যদি বলেন।”
মেরী ক্যামেরা রেডি করে ফেলেছে ভিডিও করার জন্যে। বৃদ্ধ কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলতে শুরু করলেন, “আমি রমেশ চন্দ্র পাল। ছেলেবেলায় বাংলাদেশ থেকে এসে এখানেই বাবার সাথে ঠাকুর গড়া শুরু করি। আস্তে আস্তে এটাই আমার পেশা হয়ে ওঠে। বিয়ে করে সংসার শুরু করি এই ঘরে। এরকমই এক মহালয়ার সকালে একটা ছেলে হয়। ছেলের নাম রাখি মহেশ। ঐ দেয়ালে আমাদের তিনজনের ছবি আছে। ছোট্টবেলা থেকেই ছেলেটার ঠাকুর তৈরীর খুব ঝোঁক। তেমনই ভক্তি তার। তখন আমার কাছে প্রচুর নামকরা বড়ো বড়ো দুর্গাপ্রতিমার জন্য বায়না আসতো। আমরা এই কুমোরপাড়াতেও ধুমধাম করে দুর্গাপূজা করতাম সবাই মিলে। কিন্তু হঠাৎ সব পাল্টে গেলো। ইংরেজি ‘৯২ সাল। সেবার আমাদের পাড়ায় শেষবার পুজো হয়েছিলো। বিসর্জনে এই সামনের ঘাটে ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হতো। সেবারও তাই হয়েছিলো। আমার ১২ বছরের ছেলেটাকে সেই শেষবার দেখেছিলাম। কি উচ্ছ্বাস ছিলো। ঠাকুর-এর সাথে গঙ্গা র ঘাটে নাচতে নাচতে গেছিলো। বড়োদের সাথে চিৎকার করতে করতে বলছিলো, ‘আসছে বছর আবার হবে, বলো দুগ্গা মাই কি, আসছে বছর আবার হবে’। ঠাকুর জলে ভাসানোর পর ভিড় একটু খালি হতেই ছেলেটাকে আর দেখতে পেলামনা। চারিদিক খুঁজলাম। কিছুক্ষণ পরে ঐ দুর্গার কাঠামোর পাশে ভেসে উঠলো ছেলের নিথর দেহ … তার সেই ‘আসছে বছর’ আর এলোনা। মা দুর্গা তাকে নিজের সাথেই এনেছিলো। ১২ বছর পর নিজের সাথেই নিয়ে চলে গেলো। গিন্নীর বছর খানেকের মধ্যে ক্যানসার ধরা পড়লো। টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে পারিনি… সেও চলে গেলো। সংসারটা শেষ হয়ে গেলো। রাগে আমি দুর্গাপ্রতিমা বানানো বন্ধ করে দিলাম। আমাদের এখান থেকে ঠাকুর নিয়ে গিয়ে সারা শহর আনন্দ করে। কিন্তু আমাদের এখানেই কোনো আনন্দ নেই। আমাদের খবর কেউ নেয়? কেউ নেয়না। তাও আজ এত্ত বছর আপনারা এয়েছেন খবর নিতে। নিজেদের দরকারে হলেও জানতে তো চাইলেন।”
মনটা ভারী হয়ে গেলো অমিতের। দরজার কাছে সৌম্য-সুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেরী ক্যামেরা বন্ধ করে ব্যাগ গোছালো। দেয়ালের ছবিটা অনেকক্ষণ দেখলো। তারপর বৃদ্ধর সামনে গিয়ে বসল। তার হাত ধরে বললো, “থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্কস এ লট। ইট ওয়াস জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট।”
বৃদ্ধর ছলছল করা চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেরী সেই জল হাত দিয়ে মুছে দিল। বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বললো, “এভরিথিং উইল বি ফাইন।” তারপর উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। অমিত বৃদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললো, “আসছি”। চোখ মুছতে মুছতে উনি যেনো বহুদিন পর একটু হাঁসার চেষ্টা করলেন।
গলি থেকে বেরিয়ে এসে ওরা দেখলো, মেরী গঙ্গাঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসে আছে। মেরীর প্রতি শ্রদ্ধা অনেক বেরে গেছে অমিতের। ঐ বৃদ্ধর দুঃখ কমানোর কিছু টা হলেও চেষ্টা তো করেছে মেয়েটা। আজকাল সেটাই বা কে করে। আজ অমিত মেরীকে তার মনের কথা বলবে।
সুমি নিজে থেকেই বললো, “দাদা, তুই মেরীর কাছে যা। আমরা বরং ওদিকটায় একটু ঘুরে আসি।”
মেরীর পাশে গিয়ে বসলো অমিত। মেরী জলের দিকে তাকিয়ে আছে। অমিত বুঝেছে সে রমেশবাবুর ছেলের কথাই ভাবছে। অমিত আস্তে করে মেরীর হাতে হাত রাখল। মেরী অমিতের দিকে তাকালো। অমিত দেখলো মেরীর চোখে জল।
“মেরী, কি হয়েছে? আচ্ছা, হঠাৎ কেনো ঐ লোকটার কাছে গেলে? আর ইউ রিয়েলি প্ল্যানিং টু মেক সাম ডকুমেন্টারি?”
“অমিত, আই ওয়ান্ট টু সে ইউ সামথিং।”
“আমিও তো তোমায় কিছু বলবো ভাবছিলাম। আচ্ছা, ইউ টেল ফার্স্ট।”
মেরী ওর ব্যাগের ভিতর থেকে একটা ফাইল বের করে অমিতকে দিল। অমিত ফাইলটা খুলে দেখলো, একাধিক সাইকিয়াট্রিস্ট আর সাইকোলজিস্ট-এর দেওয়া কিছু প্রেসক্রিপশন আর রিপোর্ট। পেশেন্টের নাম মেরী থম্পসন। রিপোর্টগুলো পড়তে শুরু করলো অমিত। রিপোর্ট বলছে, মেরী খুব ছোটো বয়স থেকেই ঘুমের মধ্যে অন্য ভাষায় কিছু কথা বলে। সারা বছর খুব কম হলেও প্রতি বছর অক্টোবর মাস নাগাদ এটা খুব ঘন ঘন হয়। বিভিন্ন ডাক্তার দেখিয়ে কোনো লাভ না হওয়ায় শেষে সাইকিয়াট্রিস্ট কন্সাল্ট করা হয়। অনেকদিন ট্রিটমেন্ট চলার পর ডাক্তার ব্রেনের কোনো সমস্যা পায়নি। ২০০৫ সাল নাগাদ মেরীকে এক নামী সাইকোলজিস্ট-এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পরও ডাক্তাররা কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে এর কোনো সমাধান করতে পারেনি। শেষে তারা হিপনোটিসম্ এর সাহায্যে মেরীর মনের গভীরে ঢুকে এই নির্ণয়ে পৌঁছয় যে পূর্বজন্মের কোনো ট্রমা বা অপূর্ণ ইচ্ছে এর জন্য দায়ী। ফাইলটার একদম শেষে মেরীর হাতে আঁকা একটা ছবি। ছবিটা আসলে পরিস্কার বাংলা হরফে লাল রঙে লেখা ‘শ্রী রমেশ চন্দ্র পাল’। ছবিটায় তারিখ লেখা ১০ই অক্টোবর, ২০০৬।
অমিত অবাক হয়ে মেরীর দিকে তাকালো। মেরী তার মোবাইল খুলে একটা ভিডিও অমিতের দিকে এগিয়ে দিলো। অমিত ভিডিওটা চালালো। দেখলো ৫-৬ বছর বয়সী বাচ্চা একটি বিদেশী মেয়ে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। শব্দ বাড়িয়ে অমিত শুনলো, বাচ্চা মেয়েটা পরিষ্কার বাংলায় বলছে, “আসছে বছর আবার হবে, আসছে বছর আবার হবে”। তারপর একটা আর্তনাদ করে মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গে গেলো আর মেয়েটা কাঁদতে শুরু করলো। এরপর ভিডিওতে দেখাচ্ছে একটা ১৩-১৪ বছরের মেয়ের হিপনোটিসম্ । এই মেয়েটা যে মেরী, অমিত চিনতে পারছে। ডাক্তার-এর প্রশ্ন অনুযায়ী মেরী চোখ বন্ধ করে একটা রাস্তার বিবরণ দিচ্ছে। যে রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই অমিতরা মহেশবাবুর বাড়ি থেকে এই ঘাট অবধি এসেছে।
হতবাক অমিত পাশে ফিরে দেখলো মেরী নেই। সে কখন যে উঠে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেছে খেয়াল করেনি। মেরী নিচে দাঁড়িয়ে সানসেটের ছবি তুলছে। অমিতের সামনে এখন পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার। এ যেনো অদৃষ্টের এক অদ্ভুত পরিহাস। মহেশ ফিরে এসেছে মেরী হয়ে অপূর্ণ ইচ্ছে পূর্ণ করার জন্য।
অমিত সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলো মেরীর কাছে। মেরী জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে জলের দিকে তাকিয়েই অমিতকে বললো, “ইট ওয়াস অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট। আই ফেল ডাউন দিস স্টেয়ার্স অ্যান্ড ড্রাউন্ড। আই ক্যান রিমেমবার নাউ ক্লিয়ারলি। এ সারকেল ইস কম্পলিটেড টুডে। সো মাচ রিলিফ।”
কিছুক্ষণ থেমে অমিতের দিকে তাকিয়ে বললো মেরী, “অমিট, থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং। গড হ্যাস সেন্ট ইউ ইন মাই লাইফ ফর দিস্ পার্পাস। ইউ অলসো ওয়ান্টেড টু টেল মি সামথিং অমিট ?”
অমিত মেরীর দিকে তাকিয়ে হাসলো। মনে মনে বললো, ‘মেরী, আমি তোমার জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে তোমায় সাহায্য করেছি, এটাই তো অনেক বড় ব্যাপার আমার কাছে।একজনের জীবনে আরেকজন তো কোনো পার্পাসেই আসে। কিন্তু আমার জীবনে তুমি কেনো এসেছো, সেটা যে এখনো জানা হয়নি। তবে তোমার মুখে এই অমিট ডাকটা যে আমি সারাজীবন শুনতে চাই।’
মেরী আবার বললো, “অমিট ?”
অমিত এবার বললো, “মেরী, আসছে বছর আবার হবে তো? তুমি কি আমার সাথে এখানে আসবে প্রত্যেক বছর পুজোর ছুটিতে ? তোমার তো এখানেও বাড়ি আছে। রমেশবাবু আছেন।”
মেরী ঘাড় নাড়লো। সাথে সেই মিষ্টি হাসি। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বললো, “আমি আসবো।”