স্বাধীনতার উপহার

স্বাধীনতার উপহার

মা বাবার আদরের মেয়ে নীরা। মা – বাবা আর একমাত্র ছোট ভাইকে নিয়ে তাদের ছোট্ট সুখের সংসার। তারা থাকে আমেরিকার একটি ছোট অঙ্গরাজ্যে। নীরার বাবা বিয়ে করেই স্ত্রী সহ পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা।

ওখানে ছোটখাটো কাজ করতে করতে নীরার বাবা রহমান সাহেব একটি রেস্টুরেন্ট খুলতে সক্ষম হন। বর্তমানে স্ত্রী রাহেলা বেগম সহ মিলেমিশে নিজেদের রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছেন বেশ ভাল ভাবেই।

নীরা বর্তমানে পড়াশুনা শেষ করে একটা স্কুলে পড়ায় আর ওর ছোট ভাই নিলয় ভার্সিটিতে MBA করছে। ভাই বোনের খুব সুন্দর সম্পর্ক তাদের, যেন একেবারে হরিহর আত্মা।

রাহেলা বেগম প্রায়শই নীরার বিয়ের কথা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ইদানিং। কিন্তু, নীরা এখনো বিয়ে করতে চাচ্ছে না। তার খুব ইচ্ছা সে বিয়ের আগে তার মাতৃভুমি বাংলাদেশে যাবে, ঘুরে বেড়িয়ে দেশকে চিনবে। কারন, হয়ত বিয়ের পর তার স্বামী তাকে বাংলাদেশে নাও নিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু, রাহেলা বেগম মোটেও রাজী নন,যে নীরা বাংলাদেশে যাবে। তিনি এই কথা শুনলেই তেলেবেগুণে জ্বলে উঠেন। তখন নীরাও রেগে জানতে চায় এই না করার কারন। আর, এ, বিষয় নিয়ে প্রায়ই মা-মেয়ের মাঝে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ।আর তখনই মধ্যস্হতা করতে এগিয়ে আসতে হয় রহমান সাহেব কে। কারণ,নিলয় এর তো এর মাঝে কথা বলার কোন সুযোগই নেই।

একদিন নীরা চুপিচুপি বাবার কাছে জানতে চায়, “বাবা, মা কেন আমাদের বাংলাদেশে যেতে দিতে চায় না??
তখন রহমান সাহেব বলেন, “তোর মায়ের দেশে থাকার অভিজ্ঞতা খুব তিক্ত ছিল তো তাই সে চায় না তোরা সেখানে যাস। ”

নীরা বলে, ” কিন্তু, বাবা আমরা কি আমাদের দেশকে জানবো না? চিনবো না? ”
তখন রহমান সাহেব বললেন, “মা রে, এখান থেকেই চেষ্টা কর জানতে, চিনতে। ”
নীরা উত্তর দেয়, ” বাবা, দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? ”
তখন রহমান সাহেব চুপ হয়ে যান। এভাবেই তাদের দিন কাটতে লাগল।

একদিন নীরা ক্লাশ নিচ্ছে এমন সময় হঠাৎ খবর এলো যে, রহমান সাহেবের একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।নীরা তাড়াতাড়ি করে ছুটে হাসপাতালে গিয়ে দেখে ওখানে অপারেশন এর প্রস্তুতি চলছে। আর, ওর মা- ভাই বাইরে দাড়িয়ে কাঁদছে।

মায়ের কাছ থেকে নীরা জানতে পারলো, রেস্টুরেন্ট এর জন্য বাজার করে ফেরার পথে অপর পাশ থেকে এক মাতাল রহমান সাহেবের গাড়িতে ধাক্কা দেয়ার ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। পুলিশ ওই ড্রাইভারকে তাৎক্ষনিক ধরে নিয়ে যায়। ওরাই রাহেলা বেগমকে খবর দেয়।

এমন সময় ডাক্তার এসে জানায় যে, রহমান সাহেবের জন্য রক্তের প্রয়োজন কিন্তু, ওই গ্রুপের রক্ত তখন মজুদ না থাকায় সমস্যা হতে পারে। এ কথা শুনে সাথে সাথে তারা তিনজনই রক্ত দিতে প্রস্তুত হয়ে যান। ডাক্তার খুশি হয়ে তাদের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার জন্য নিয়ে যান। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক ব্যপার হল তাদের কারো সাথেই রহমান সাহেব এর রক্তের গ্রুপ মেলে না। রাহেলা বেগম ও নিলয় এর রক্তের গ্রুপ একই কিন্তু, নীরার রক্তের গ্রুপ একেবারেই আলাদা।

ঠিক তখনই খবর আসে রক্ত পাওয়া গেছে, তখন অপারেশন শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষন পর ডাক্তার এসে জানায় অপারেশন ভালভাবে শেষ হয়েছে, চিন্তার কোন কারন নেই।

সপ্তাহান্তে রহমান সাহেব কে বাসায় আনা হয়। এসে রহমান সাহেব দেখেন নীরা কেমন মনমরা হয়ে থাকে। কারো সাথে ভাল ভাবে কথা বলে না, খায় না। তখন উনি নীরাকে কাছে ডেকে জানতে চান যে, কি হয়েছে?? কিন্তু, নীরা কিছু না বলে এড়িয়ে যায়।

আরো এক সপ্তাহ পর রহমান সাহেব মোটামুটি সুস্হ হলে নীরা রহমান সাহেব কে একটা কাগজ হাতে দিয়ে জানতে চায়, ” আমি কে বাবা? কার সন্তান? ”

মেয়ের মুখের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন তিনি। বলেন, ” এসব কি ধরনের কথা? কি বলতে চাস তুই? ”
রাহেলা বেগম ও ছুটে আসেন তাদের কথা শুনে। জানতে চান, ” কি হয়েছে? ”

তখন রহমান সাহেব বলেন, ” দেখ তোমার মেয়ে পাগল হয় গেছে? সে জানতে চায় ” সে কার সন্তান? ”

একথা শুনে রাহেলা বেগম নীরাকে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেন। তখন নীরা বলে, ” তোমার হাতের কাগজটাও কি মিথ্যা, বাবা? ওটা আমার DNA পরীক্ষার রিপোর্ট। যাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে আমি তোমার সন্তান না। তোমার সাথে আমার জন্মগত কোন সম্পর্ক নেই।”

একথা শুনে রহমান সাহেব আর রাহেলা বেহম দু’জনেই ডুকরে কেঁদে উঠেন। কিন্তু, বলার মত কিছু খুঁজে পান না।
তখন নীরাই বলতে থাকে, ” যখন হাসপাতালে রক্ত দিতে গিয়ে দেখলাম আমার রক্তের গ্রুপ কারো সাথে মিলে না, তখন সন্দেহ হল।তাই, আমার DNA পরীক্ষা করতে দেই। আজ রিপোর্ট পেয়েই বুঝলাম এর আসল কারন। ”

” এখন বল আমি কে? কি আমার পরিচয়? কে আমার বাবা ? ”
” আমি কি পাপের ফসল ? ”

এসব কথা বলে নীরা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। তখন রাহেলা বেগম বলে উঠেন, ” জানতাম এসব কথা একদিন আসবেই, কিন্তু এভাবে আসবে কল্পনা ও করিনি। ”

” তুই সব সময় দেশের কথা জানতে চাইতি না? ”
” তো শোন, তুই হলি সেই দেশের দাম, স্বাধীনতার দাম। ”

” ওই নয়মাসের যুদ্ধে দেশ পেয়েছে স্বাধীনতা, আর আমি পেয়েছি তোকে। তখন যদি তোর বাবা যুদ্ধ থেকে ফিরে আমার হাত না ধরতো, তাহলে আজ আমি আর তুই কেউই বেচে থাকতাম না। তোর বাবা যদি কেউ হয়ে থাকে তো সে এই রহমান। আর কেউ নয়। ”

এ কথা শুনে নীরা রহমান সাহেবের বুকে ঝাপটে পড়ে ক্ষমা চাইতে থাকে। আর, বাবা, বাবা বলে ডাকতে থাকে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত