“তুমি কি জানো তুমি একটা অসুস্থ মেয়ে। তোমার কাজকর্ম গুলো ছেলেদের মত?” আদনান ভাইয়া যখন এই কথা গুলো বলছিল আমি তখন মাথা নিচু করে থাকি। ভাবি আসলেই আমি মানুষটা কেমন যেন।এই বিকেল বেলা বাসায় নাক ডেকে আমার ঘুমানোর কথা কিংবা ছাদে পায়চারি করে আকাশের বুকে উড়ে যাওয়া কাক দেখা অথবা বারান্দার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কবিতা বা গল্প পড়া। কিন্তু আফসোস এই মুহুর্তে আমি আদনান ভাইয়ার বাড়ির গেইটের পাশে অবস্তান করছি।আমি কি বলবো জানি না।আমার চুপ থাকা দেখে উনি একটু জোরেই বললেন “আমার দিকে তাকাও বলছি মেয়ে।” আমি আস্তে আস্তে মুখ তুলে উনার দিকে তাকাই। অন্য সময় আমি যখন উনাকে দেখি আমার ভিতরে একটা ভালো লাগার মোহ কাজ করে।আমার ভিতরে এই অনুভূতিটা কেন হয় আমি বুঝি না। উনি বললেন “তুমি যে এইভাবে আমার বাড়ির আশেপাশে অবস্থান করো, টঙ্গের দোকানে বসে চা খাও, আমাকে ফলো করো, এই গুলা করে তোমার কি লাভ হয়? এইগুলা কারা করে জানো? এইগুলা ছেলেদের কাজ।তুমি না একটা মেয়ে?” আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললাম “ছাগলের মত কথা বলেন কেন? আপনি যদি এইগুলা করতেন তাহলে কি আমার করা লাগতো? বলেন?” আমার মুখে এমন কথা শুনে উনি একটু অবাক হলেন বটে।উনি শুধু একটা বিরক্তিকর আওয়াজ করে আমার সামনে থেকে হাটা দিলেন। আমি বিষন্ন মন নিয়ে উনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি।কাউকে ভালো লাগার অনুভুতিটা মানুষের ভিতরে কি করে তৈরি হয় এটা আমি বুঝতাম না।ভাবতাম এটা নিছক একটা পাগলামো ছাড়া কিছুই না। কিন্তু এই পাগলামোটা যখন আমার ভিতরে জায়গা করে নিল তখন নিজের অন্তরালে আমি অনুভব করলাম ঝগঝগে নীল আকাশ আর বৃষ্টিকে। বিকেল বেলার রোদ্দুর আলোটা জাফর চাচার চায়ের টঙ্গ ছাড়িয়ে গলির শেষ মাথায় পৌছে গিয়েছে।আস্তে আস্তে হেটে চাচার দোকানের সামনে আসতেই উনি বললো “আজকে চা খাইবা না মা?” আমি চাচার দিকে তাকিয়ে বলি “বদমাইশ ছেলেটা মন খারাপ করে দিয়েছে। আজ আর খাওয়ার ইচ্ছা নেই।” চাচা আর কিছু বলেনি।আমি সেই বিষন্ন মন নিয়েই আবার ফিরে আসি বাসায়।
আজকাল আমার কিছুই ভালো লাগে না।ভালো না লাগার এই নিয়মটা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।চুল ছেড়ে দিয়ে বারান্দার সামনে যখন মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা দেখছি তখন তিথিমনি আমার কাছে এসে বললো “ফুফি কি করো?” আমি তিথিমনির দিকে তাকিয়ে ওকে কোলে নিয়ে বলি “মেঘ দেখি মা, দেখবি?” সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সুচক ইশারা দেয়। আমি তাকে মেঘ দেখাই। মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা কেন এই থমথমে রুপ ধারন করে আছে তার গল্প শোনাই। গল্প শোনাই আমাদের মানুষের মত আকাশও কাঁদতে পারে।মানুষ যখন কাঁদে তখন তার মনে কষ্ট হয়, কষ্টে তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে, গাল ভিজে। কিন্তু আকাশ যখন কাঁদে তখন পুরো শহরটাকে ভিজিয়ে দেয়।তিথিমনি আমাকে বলে “মানুষ কেন কাঁদে ফুফি?” আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম “মানুষ ব্যথা পেলে কান্না করে।তুমি গতকাল শিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যেমন ব্যথা পেয়ে কান্না করেছো তেমন। এই ব্যথাটা অনেক রকম হয় মা।মাঝে মাঝে আমরা মানুষেরা খুশিতেও কান্না করি।” আমি তিথিমনিকে এর থেকে ভালো করে বুঝাতে পারি না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি পুনরায় আকাশের দিকে তাকাই।মাঝ রাতে একটা শূন্যতা এসে আমার ঘরের চারপাশে যখন ভর করে তখন আমার কেমন যেন একটা ভয় কাজ করে। আমি অনুভব করি এই শূন্যতাটা কিসের?
ক্লাসে থাকা অবস্থায় বাহিরে মুখ করে আমি যখন বৃষ্টিকে দেখার এক সৌন্দর্য্য উপভোগ করছি তখন ফিরোজা ম্যাডাম আমার কাছে এসে বললো “কিছু হয়েছে অহনা?” আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বললাম “কিছু না ম্যাডাম।” ম্যাডাম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “মন খারাপ?” আমি কিছু না বলে মাথা দিয়ে না সুচক ইশারা দিলাম।ম্যাডাম আমাকে ক্লাস শেষে দেখা করতে বলে। অবাক করা ব্যাপার হলো ফিরোজা ম্যাডাম কেমন যেন। আমাকে তার নিজের মেয়ের মত মনে করে।আমার মত উনার একটা মেয়ে আছে। নাম পুষ্প।পুষ্প নামের এই চমৎকার মেয়েটা এখন মানসিক প্রতিবন্ধি।কিভাবে এমন হলো উনি আমাকে কখনো বলেননি। এই রকম এক বৃষ্টির দিনে আদনান ভাইয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়। সেদিন ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে কিছুটা পথ হাটতেই বৃষ্টি শুরু হয়। একবার নিজেকে এই বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো একটু পাগলামো করলে কেমন হয়? নাদিরার সাথে নিজেকে বৃষ্টির মাঝে মেলে ধরলাম।যেন আকাশের বুক থেকে ছিটকে পড়া ফুল গুলো আমাদের শরীরে এসে পড়ছে। আর তার স্নিগ্ধতা আমরা অনুভব করছি। এর একটু পরেই একটা ছেলে ছাতা মাথায় দিয়ে এসে আমাদের ধমকের সুরে বললো “সব ন্যাকা।
এতো ন্যাকা আল্লাহ তোমাদের ভিতর কিভাবে দিছে আমি ভাইবা বুঝি না।বৃষ্টিতে ভিইজা গায়ে জ্বর আনবা, বাবা মায়ের রাত্রের ঘুম হারাম করবা, তারপর ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিবা অনেক জ্বর দোয়া কইরো ফ্রেন্ডস। এসব ন্যাকামির অনুভুতিতে না জড়ালে হয় না? যাও ও পাশে।” আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারপর চুপচাপ ভদ্র মেয়ের ক্যাম্পাসের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এই কান্ডটা যারা যারা দেখেছিল সবাই হেসেছিল।আমার তখন কি অনুভুতিটা হয়েছিল আমি জানি না।শুধু মাথাটা ঝিম মেরে ছিল আর মনে মনে ছেলেটাকে গালি দিচ্ছিলাম।জানতে পারলাম ছেলেটার নাম আদনান।আমাদের সিনিয়র। রাজনীতি করে। কিন্তু এই রকম ঘটনাটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। এর পরদিনই উনার কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম “এই যে শুনুন, বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসলে আসুক, আমার বাবা মায়ের ঘুম হারাম হোক কিন্তু আপনি বলার কে? এইভাবে কেন বলেছেন? ভয় পাইনা বুঝি? আপনি একটা খারাপ।” বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এই কথা গুলা বলেই আমি ভো দৌড়। উনাকে কিছু বলার সুযোগ দেইনি। এর পরের তিন দিন ভয়ে আমি ভার্সিটিতে যাইনি। এরপর অনেকটা দিন কেটে গেছে।মধ্যরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যেত। ভাবতাম আমি কি করে এমনটা করলাম? ভার্সিটিতে যখন যেতাম তখন আমি উনার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়িয়েছি। কিন্তু উনার সামনে যেদিন হঠাৎ করেই সামনা সামনি হলাম উনি আমাকে দেখে হাসতে হাসতে বললো “তুমি তো একটা পাগলি মেয়ে।এমন পাগলামি করো কেন?” আমি হাসবো না কাঁদবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।তারপর পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে হাসি দিয়ে বললাম “আপনিও কম না। পাগল একটা।
আমাদের নিয়ে কত ভাবেন।বৃষ্টিতে ভিজলে আমাদের জ্বর হবে কি হবে না তা নিয়ে কত চিন্তা আপনার।” কিন্তু মনে মনে ঠিকি ইতর বদমাইশ বলছিলাম।এরপর আরও অনেকটা দিন কেটে গেছে।এই অনেকটা দিন পেরিয়ে মাস বদলায় একের পর এক। এই মাস অতিক্রম হওয়ার সময় আমি উনাকে প্রায় খেয়াল করতাম উনার আচার আচরণ গুলো। রাজনীতি বলতেই আমরা এখন বুঝি মারামারি কাটাকাটি। কিন্তু আদনান ভাইয়া এমন না। উনি যতটা পারতেন অন্যদের বুঝাতেন। রাজনীতি হলো একটা আর্ট। এটা সবাইকে দিয়ে হয়না।তুমি এমন রাজনীতি করো যেন দেশটা বদলে যেতে পারে। দেশটা উন্নতির দিকে যেতে পারে।মানুষ তোমাকে যেন ভালোবাসে।তোমার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারে। তোমাকে অনুসরন করতে পারে। তোমার নাম যেন যুগযুগ ধরে মনে রাখতে পারে। কিন্তু এই আর্টটা তেমন সবাই অর্জন করতে পারে না। কারো রক্তের প্রয়োজন হলে আমি দেখতাম উনি ম্যানেজ করার জন্য কিভাবে ছুটাছুটি করতেন। একদিন সন্ধ্যা বেলা আমার বাসায় একটা ছেলে পাঠায়। আমাকে বললো “আপা চলেন যেতে হবে।আদনান ভাই বলেছে।” আমি অনেকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম এইভাবে বলাতে। তারপর ছেলেটা বুঝিয়ে বলে ভয়ের কারন নেই। একজন গর্ভধারিনী মাকে রক্ত দিতে হবে।আমি আর একটুও দেরি করিনি। আমার বাসার নিচে আদনান ভাইয়াকে যখন দাঁড়ানো অবস্থায় দেখলাম আমি জানি না আমার বিশ্বাসটা কতদুর পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিল।আমি অনুধাবন করলাম হ্যাঁ এই পাগল ছেলেটাকে বিশ্বাস করা যায়। আমার রক্তের গ্রুপ ছিল (এ নেগেটিভ)। এ নেগেটিভ রক্ত তেমন পাওয়া যায় না। পরে যখন আদনান ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম “আমার রক্তের গ্রুপ কি সেটা কিভাবে জানলেন?” উনি একটা হাসি দিয়ে বললেন “ভাসিটির সব ছেলে মেয়ের তথ্য আমার কাছে আছে।রাজনীতি কি এমনি এমনি করি বলো? তোমার বাসা কাছে তাই সরাসরিই তোমার বাসায় চলে গিয়েছি।” আমি চুপ করে উনার হাসিটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।এমন শুভ্র মাখানো হাসিটা দেখে আমার অদ্ভুত ভালো লাগার মোহ কাজ করছিলো। আচ্ছা ছেলেদের হাসিতে কি শুভ্র মাখানো থাকে? জানি না।
কিন্তু আমি সেদিন খুঁজে পেয়েছিলাম। ততদিনে আদনান ভাইয়ার প্রতি আমার ভিতরে জমানো রাগ গুলো হারিয়ে গিয়েছে।উনার একটা বদ অভ্যাস ছিল সিগারেট খাওয়া। একদিন উনার কাছে গিয়ে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিলাম। ততদিনে চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস হয়েছে। তারপর বললাম “আপনি সিগারেট খাবেন না।” উনি অবাক হয়ে বললো “এই কথা বলার কারণ কি?” আমি কি প্রত্যুত্তর দিব বুঝতে পারছিলাম না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললাম “পরিবেশ দূষিত হয়।খেয়ে যে ধোয়া গুলো ছাড়েন এতে কি পরিবেশ দূষিত হয় না? আপনি না রাজনীতি করেন? দেশের জন্য ভাবেন? এই কাজটা করা কি আপনাকে মানায় বলুন।” উনি কি বলবে হয়তো ভেবে পায়নি। শুধু আমার দিকে চুপ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। এরপর আরও অনেকটা দিন কেটে যায় মাস যায় ঋতু বদলায়। এরপর উনাকে আমি আর সিগারেট খেতে দেখিনি।খেয়েছে কিনা জানি না। অন্তত আমি দেখিনি। হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম ইদানিং আমি আদনান ভাইয়াকে নিয়ে ভাবি। এই ভাবার কারণ কি? ভয়ানক ব্যাপার, তাকে কি আমার ভালো লাগে?এটা কখনো হতে পারে না।এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি অনেকটা বিরক্ত আর ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম এবং অনুধাবন করলাম ভালোলাগা কি বলে কয়ে আসে? তারপরই শুরু হলো আমার এই পাগলামোর উদ্ভট কাজ। উনাকে ফলো করতাম। উনার বাড়ির গেইটের সামনে ঘুরঘুর করতাম একটা মেয়ে হয়েও। জানি এই ছেলের প্রতি আমার ভালো লাগার কাহিনী শুনলে অনেকে হাসাহাসি করবে। বলবে সব ন্যাকামী, জীবনে এই রকম মেয়ে আছে নাকি? আমি বলবো হ্যাঁ আছে। আমি নিজেই তার প্রমান। আর কে কি ভাবলো আমি এতে কান দেই না। কিন্তু এই ছেলে আমাকে অবজ্ঞা করে চলে। সে জানে আমি কেন তার পিছন ঘুরঘুর করি।
ফিরোজা ম্যাডামের কাছে যখন গেলাম উনি আমার দিকে পানির বোতল বাড়িয়ে বললেন “পানি খেয়ে নাও মেয়ে।” আমি পানি খেয়ে ম্যাডামের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকি।উনি কিছুটা সময় নিয়ে বললেন “চিন্তা, উদাসীনতা, এই দুটো জিনিস তোমার মাঝে ইদানিং লক্ষ্য করছি।আমরা মানুষেরা অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ি, হতাশা ভোগ করি।একটা ভয়ংকর ব্যাপার কি জানো মেয়ে? তোমার চোখে একটা শূণ্যতা লুকিয়ে আছে। আমরা নারীরা হচ্ছি মায়ের জাত। এই মায়ের কাছে তার সন্তানের কোন কিছুই লুকিয়ে থাকে না। এই শূণ্যতাটা কিসের? কারো চোখে বৃষ্টি আর নীল আকাশ দেখার শূণ্যতা?” ম্যাডামের কথায় আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমার চুপ থাকা দেখে ম্যাডাম আবার বললেন “ভালোবাসা এমন একটা জিনিস এর মূল্য কেউ ঠিক মত দিতে পারে না। এর গভীরতায় কেউ পৌছাতে পারে না। খুব কম সংখ্যক মানুষ আছে যারা এর গভীরতা পরিমাপ করতে পারে।তোমাদের এই ইন্টারনেট যুগে ভালোবাসা হচ্ছে একটা মোহ। গুগুলে সার্চ দেওয়ার মত হয়ে গেছে। খুব সহজে ভালোবাসা পেয়ে যাও। কিন্তু আমাদের চিঠির যুগে ভালোবাসা ছিল একটা পবিত্রতা। এই পবিত্রতার ছোয়া সহজে কেউ পেত না। আমার মেয়ের কথাই ধরো। ছেলেটাকে খুব ভালোবাসতো খুব।তাদের সম্পর্কটা আমি মেনেও নিয়েছিলাম।কিন্তু ভালোবাসার অপর পিঠ যে খুব কষ্টের হয় আমার মেয়ে হয়তো জানতো না।পুষ্পের টাইফয়েড জ্বর হয়ে মাথার চুল পড়তে শুরু করে। চেহারাটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।সময় আর দিন যত পার হতে লাগলো এই শহরের আলো বাতাস যেন পুষ্পের কাছে পরিবর্তন হতে লাগলো।আমার মেয়েটা হঠাৎ একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো “ভালোবাসাটা এমন কেন আম্মু?” কথাটা শুনেই আমি যেন একটা ধাক্কা খেলাম।কি বলবো আমি বুঝতে পারছিলাম না। ছেলেটা আমার
মেয়েটাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। তারপর আমার মেয়েটার কি থেকে কি হলো আমি কিছুই জানি না।” ম্যাডাম এইটুকুই বলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু কাঁদলো। আমার কি বলা উচিৎ আমি শুধু ভাবছি।আমি ম্যাডামকে
জড়িয়ে ধরে বললাম “ভালোবাসা আসলেই এমন কেন ম্যাডাম?” উনি আমাকে কিছু বলেনি শুধু জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আটটা দশ। আজকে ভার্সিটিতে নজরুল জয়ন্তী প্রোগ্রাম আছে। দেরি করে ঘুমালে এমনতো হবেই। আমি তড়িগড়ি করে ওঠে কি করবো ভেবে পাই না। সারা রাত ধরে ভেবে রেখেছি শাড়ি পড়ে যাবো।ভার্সিটিতে যখন পৌছালাম তখন নয়টা বিশ ছুই ছুই। নাদিরা আমাকে দেখেই বললো “এই তোর দায়িত্ব পালন করা নবাবজাদী? কতবার কল করেছি দেখেছিস?” আমি কান ধরে আলতো করে বুঝালাম মাফ চাই বোইন।
দুপুর বেলায় প্রোগ্রাম শেষ করে আমি ক্লান্ত হয়ে পুরো ক্যাম্পাসে আদনান ভাইয়াকে খুঁজতে খুঁজতে যখন দেখতে পেলাম তখন মনে মনে বললাম “আমি পাইলাম, তাহাকে পাইলাম, ব্যাটাকে পাইলাম।” কিন্তু এই পাওয়া সব পাওয়া না এটা ভেবেই দিশেহারা হয়ে উনার কাছে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। উনি আমাকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো “কিছু বলবে?” আমি মাথা নেড়ে না সূচক ইশারা দিয়ে বুঝালাম কিছু না। উনি বললেন “তো কি চাই?” আমি তারপরও চুপ করে রইলাম কিন্তু একটু পর ইতস্তত করে বললাম “আমাকে কেমন লাগছে?” আমার কথা শুনে উনি হাসতে লাগলেন। এই হাসিটা যে অবজ্ঞার সেটা আমি অনুভব করলাম। হাসতেই হাসতেই উনি বললেন “এই কথা বলার জন্য এখানে আসছো? তুমি এই গুলা বলে কি বুঝাতে চাও আমি জানি। আচ্ছা লজ্জা ব্যাপারটা কি তোমার ভিতরে আছে? এটা কি কাজ করে না? এটাকে আপডেট করো বুঝলে মেয়ে।” এটা বলেই আমার সামনে থেকে চলে যায়। মুহুর্তেই আমার মনে মন খারাপের আভা প্রবেশ করে। কথাটা শুনেই নিজের ভিতরে প্রচন্ড ঘৃনা অনুভব করলাম। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে অনুধাবন করলাম কেন আমার প্রার্থনায় তাকে চাইতে হবে? কেন আমার আঁকা আল্পনায় তার নাম লিখতে হবে? কে দিয়েছে এই অধিকার আমায়? আমার ভিতরের আঁকা স্বপ্নগুলো জলরাশিতে পরিনত হয়ে চোখ দিয়ে বেয়ে বেয়ে পড়তে চায়।হঠাৎ করেই আমার মাথাটা প্রচন্ড ঝিমঝিম করতে লাগলো। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না, কিছুই না।
সবুজ রঙ্গের ছোট্ট মাপ ফড়িং তিথিমনি কোথা থেকে ধরে এনে আমাকে বললো “ফুফি কি সুন্দর দেখো না?” আমি তিথিমনির দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে বললাম “এটা কোথা থেকে ধরেছো তিথিমনি?” তিথিমনি তার সুন্দর ধবধবে সাদা দাঁত গুলোর হাসি দেখিয়ে বললো “আম্মুর সাথে ছাদ থেকে কাপড় আনতে গিয়েছিলাম। এটা ফুলের টবে ছিল।জানো ফুফি ওর না একটা পাখা কাজ করে না। আচ্ছা ও কি আমার বন্ধু হবে?” কথাটা শুনে আমার ভিতরটা ধক করে ওঠে। সবুজ রঙ্গা এই ছোট্ট মাপ ফড়িং এর মত আমিও খুব ছোটাছুটি করতাম।কারও প্রিয় মানুষ হতে চেয়েছিলাম, কারো জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে চেয়েছিলাম, যে বন্ধুর সব সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করতে চেয়েছিলাম কিন্তু ছেলেটা আমার হয়নি। আমি তিথিমনিকে কিছু বলতে পারিনা। তিথিমনি আমার প্রত্যুত্তর উপেক্ষা করে সে তার আম্মুর কাছে চলে যায়। আমি অনুভব করি সেদিনের পর কিভাবে তিন মাস পার হয়ে গিয়েছে। এই তিন মাসের মধ্যে আমি কেমন যেন হয়ে গেছি।এখন ঝগঝগে নীল আকাশ আর বৃষ্টিকে দেখে আমার ভিতরে মোহ কাজ করে না। হয়তো এই ঝগঝগে নীল আকাশ আর বৃষ্টি আমার ছিলই না। এই তিন মাসে আমি একটা বারও আমার প্রার্থনায় ছেলেটাকে চাইনি। কেন চাইবো আমি? যে আমার না।
ইদানিং রাত্রের শহরটার মাঝে আমার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। রাত্রে বেলা শহরটা কেমন যেন চুপ হয়ে যায়।এই চুপ হয়ে যাওয়া শহরটার মাঝে আমি তখন এক মুগ্ধতা অনুভব করি। যে মুগ্ধতার নাম অবজ্ঞা।এসব যখন ভাবছি তখন আমার মোবাইলে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। আমি রিসিভ করার পর আমাকে অনুরোধ করে ছাদে যেতে। এই রাত্রে বেলা আমার ছাদে যাওয়ার ইচ্ছা নেই।আমি যখন তার পরিচয় জানতে চাইলাম “কে আপনি? আপনি ভুল নাম্বারে ডায়াল করেছেন” তখন ওপাশ থেকে বললো “অহনা, আমি আদনান।” এটা বলেই ফোনটা রেখে দেয়। আমার বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। এই ছেলের কথা আমি কেন শুনবো? আমি ভিতরে ভিতরে রাগতে লাগলাম কিন্তু তারপরও আমি ছাদের দিকে পা বাড়ালাম। ছাদের দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখি কিছু একটাতে লিখা
“একটু বাম দিকে আসো” আমি আস্তে আস্তে হেটে যাই। তারপর আর একটা কাগজ দেখি ওখানে লিখা “আজ কোন অবজ্ঞার সুরে বলবো না। আজ আমি তোমাকে এক মুগ্ধতার গল্প শুনাবো। শুনবে? তাহলে আকাশে তাকাও।” আমি আকাশে তাকিয়ে দেখি আকাশ জুড়ে ফানুস।কমলা হলুদ রঙ্গের জ্বালানো এই ফানুসে রাত্রের আকাশের এমন সৌন্দর্য্য আমার সহ্য হয় না। আমি কাগজের লিখা গুলা আবার পড়তে থাকি। “নজরুল জয়ন্তীতে যেদিন বললে তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে? আমি কেন যেন সত্যটা বলতে পরিনি।কিন্তু জানো সারাটা প্রোগ্রাম জুড়ে আমি তোমাকে দেখছিলাম।আমি তোমাকে যত কষ্ট দিয়েছি, যত অবজ্ঞা করেছি বিয়ের পর তুমি সবকটার প্রতিশোধ নিও কেমন? কথা দিচ্ছি বিয়ের পর তোমার সাথে আমি জমিয়ে প্রেম করবো ততদিন পড়াশুনায় মনোযোগ দাও মেয়ে। এমন রাত্রির আকাশে দুজন ফানুস উড়াবো। ততদিন আমাদের ভিতর এক অদেখা ভালোবাসা তৈরি হোক।যে ভালোবাসার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো।শুভ জন্মদিন প্রিয়।” এই অবস্থায় আমার ভিতরে কেমন অনুভুতি হচ্ছে আমি জানি না। আমার দু চোখে প্রচন্ড আবেগের জল।এই জলের প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়বো ছেলে। তোমাকে যে আমি ছাড়ছি না