যার ছায়া পড়েছে

যার ছায়া পড়েছে

স্বাভাবিক নিয়মটা হয়তো এমন যে, মানুষ ছোটবেলায় বোকা থাকে আর বড় হলে চালাক হয়। কিন্তু আমার ফুফাতো ভাই তামিম আর আমি তার উল্টো। ফুফু, মা সবাই বলে তামিম নাকি ছোটবেলায় খুবই চালাক আর জেদী টাইপ ছেলে ছিল আর আমি একদম শান্ত প্রকৃতির। বড় হয়ে কেমন যেন ছেলেটা চুপসে গেছে আর আমি মেয়েটা দজ্জাল টাইপ হয়ে গেছি। তামিম এখন সবার অগোচরে থাকতে পছন্দ করে। কারোর মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। কেউ যদি ওর গালে ঠাস ঠাস করে দুটো লাগিয়ে দেয় তাহলে সে চুপ চুপ করে মাথাটা নিচ দিকে দিয়ে চলে আসে। আমার আর তামিমের ছোটবেলার একটা মজার ঘটনা আছে। তামিমের ছোট ভাইটার যখন জন্ম হলো, তখন ও ফুপিকে খুব জ্বালাতো। সেজন্য ফুপি ওকে সকালে উঠে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দিত। সারাদিন সে আমার সাথে খেলা করতো, স্কুলে যেত, রাত হলে কখনও আমরা দাদুর দুইপাশে দুজন ঘুমিয়ে যেতাম আর কখনও বা ফুপা এসে রাতে ওকে নিয়ে যেত। যাইহোক, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের সৌরভ, সায়েম, মুমুও আমাদের সাথে খেলতো। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল বর-বউ খেলা। বর-বউ খেলাতে আমি যেদিন বউ হতাম সেদিন তামিম অন্য কাউকে বর হতে দিত না। অন্য কেউ হতে চাইলে ও চোখ-মুখ রাঙিয়ে বলতো,

– রিচিতা কেবল আমার বউ হবে।
আবার অন্য কেউ বউ হয়ে যদি তামিমকে বর হতে বলতো, তখন সে বলতো,
-আমি কেবল রিচিতার বর হবো।
আমি কখনও নিজ থেকে কিছু বলতাম না বলে তামিম চোখ রাঙিয়ে মাঝেমাঝে বলতো,
-যখন তোমাকে ওরা বউ হতে বলে আর সায়েম সৌরভ বর হতে চায়, তখন তুমি কিছু বলো না কেন?
আমি বোকা বোকা চোখে তা মিমের দিকে তাকিয়ে বলতাম,
– কী বলবো?
-বলবে, তামিম, কেবল তামিম আমার বড় হবে।

তামিমের এই আচরণটার কথা কিভাবে কিভাবে যেন আমাদের পরিবারের বড়রা জেনে গেল। তারপর সবাই এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব হাসাহাসি করতো। আমরা দুজন একসাথে হলেই কথাটা বেশি উঠাতো দাদু।

পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পরই আমার আর তামিমের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। কারণ তামিমকে তখন ময়মনসিংহে ওর চাচার বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় পড়াশুনার জন্য আর আমি সিলেটেই থেকে যাই। সাত বছর আমি ওকে প্রায় ভুলেই ছিলাম।ভার্সিটিত

এডমিট হয়ে তামিম সিলেটে চলে আসে। আর আমার জীবনে আবারও তামিমের আবির্ভাব হয়। আর তখনই আমি টের পেলাম যে, ছোটবেলার চঞ্চল তামিম এখন খুবই সহজ সরল আর চাপা স্বভাবের হয়ে গেছে। আর আমি হয়ে উঠেছি প্রচন্ড বদমেজাজি আর খিটখিটে রাগী স্বভাবের। এক কথায় বলতে গেলে আমাকে রিনা খান খেতাব দিলে ভুল হবে না।

গল্পটা সেই আবির্ভাব থেকে শুরু না করে তার আরেকটু পর থেকে বলা শুরু করি।
একদিন গভীর রাতে তামিম ফোন দিয়ে মেয়ে মানুষের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললো,

-রিচিতা, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তুমি কিছু একটা করো প্লিজ। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।
আমার তালু আর জিহ্বায় ঠেকা লাগলো। অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করলাম আমি। একটা ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে আর আর সে তার গার্লফ্রেন্ডকে ফোন দিয়ে বলছে, কিছু একটা করতে। আমি মাত্রাতিরিক্ত বিষ্মিয় হওয়ায় মোবাইল কানে ধরে বসে রইলাম মুখ হা করে। কিছু বলতে পারছি না। তামিম অনর্গল একটানা কাঁদতেই থাকলো। আমার কোন রেসপন্স না পেয়ে বললো,

– তুমি কিছু বলছো না কেন? আমি তোমাকে না পেলে সত্যি সত্যি মারা যাব কিন্তু।
আমি নীরবতা ভেঙে বললাম,

-তামিম, আমার পক্ষে কাউকে বলা সম্ভব না। তুমি তোমার মুখে আমাদের অভিভাবকদের জানাও।

– তুমি তো জানই আমি বেকার। আর সেজন্যই তো বাবার মুখের উপর কিছু বলতে পারি না। বাবা তার বন্ধুর মেয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে আমার ভালো চাকুরির ব্যবস্থা করতে চায়। মেয়ের বাবার স্খানীয় এম পি’র সাথে হাত আছে। চাকুরি বানানো নাকি কোন ব্যাপার না। ভ্যাঁএএএএ।

-আশ্চর্য তামিম, তুমি বাচ্চাদের মত কাঁদছো কেন?

-কাঁদবো না তো কি করবো? আমি তোমাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। আমি রিচিতা ছাড়া অন্য কারো বর হবো না।
তুমি বাসায় বলো যে, তুমি তামিম ছাড়া অন্য কারো বউ হবে না।

-তামিম, এটা ছোটবেলার খেলা না।

-ছোটবেলাতেও শত বলেও তোমার মুখ থেকে এই কথাটা বের করতে পারিনি কখনও। তোমার অন্য কারও বউ হওয়ার ব্যাপারটা আমাকেই আটকাতে হতো।

-আমার এই মুহুর্তে কিছু করার নেই।

-অবশ্যই করার আছে। আমি কিছু করি না, তাতে কী? তুমি তো জব করো। তুমি আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাও। আমি তোমার হাত ধরে জাহান্নামে যেতেও রাজী আছি।

-তামিম, আর ইউ ম্যাড? তুমি একটা ছেলে মানুষ। আমি তোমাকে নিয়ে কোথায় পালাবো? পালায় তো ছেলেরা মেয়েদের নিয়ে।

-ঐ একই তো কথা হলো। যে যাকে নিয়েই পালাক না কেন, দুজনে তো একসাথেই পালাবো।
-কোথায় পালাবো?
-পালাবো বলতে আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করবো তারপর আলাদা একটা বাসা নিয়ে থাকবো।
-আমার বাবা মা কে কষ্ট দিব আমি? আমি পালিয়ে বিয়ে করলে বাবার মান ইজ্জত থাকবে?

তামিম কোন উত্তর না দিয়ে আবার হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো। আমার মেজাজ চড়ে গেলো। তামিমকে ধমক দিয়ে বললাম,

-এই তুমি কান্না থামাবে নাকি আমি ফোন রেখে দিব?
-প্লিজ রিচি, তুমি আমাকে এভাবে ফিরিয়ে দিও না। তুমি ছাড়া অন্য কোন মেয়ে আমার শরীরে…
-হোয়াট? তোমার শরীরে কি?
– না মানে ইয়ে, কি কি কিছু না।

-তামিম, তুমি একটা ছেলে মানুষ। ছেলে মানুষ মানে পুরুষ মানুষ। কিন্তু তুমি কি পুরুষ মানুষের অর্থ বুঝো? তাদের কতটা এক্টিভ থাকা উচিত সেটা বুঝো?

-এখন আমার এতকিছু বুঝার টাইম নেই। তুমি আমাকে বিয়ে করবে কি না বলো? আজ বুধবার। বাবা বলেছে কালই আমার গায়ে হলুদ দিবে। আর শুক্রবারে বিয়ে।

-তো ভালো তো। মাস্টার্স পাশ বেকার ছেলে। বিয়ে করে ফেলো। সরকারি চাকুরি পাবে। সাথে বউও পাবে।
-আমার চাকুরির দরকার নেই। আমার বউ হলেই হবে।
-তাহলে তোমার শ্বশুড় কে বলো যে, তুমি কেবল তার মেয়েকেই চাও, চাকুরি লাগবে না।
-তুমি আমার সাথে মজা নিচ্ছ? আমার শুধু তোমাকে চাই। আর কাউকে না।
-তামিম এখন অনেক রাত। তুমি ফোন রাখো। আর ঘুমাও। সকালে ভাববো কি করা যায়।
তামিম আরও কিছু বলতে চায়ছিলো কিন্তু আমি সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিয়ে অফ করে দিলাম।

বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু সফল হলাম না। ঐ বোকা বোকা ছেলেটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার। এখনও পৃথিবীতে এত সহজ সরল ছেলে হয়? সেই বোকার মত আমার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। কখনও মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস করতে পারেনি। আমার রাগ সম্পর্কে সবার ধারণা ছিল। তাই আমার সাথে প্রেম করার কথা কোন ছেলে কল্পনাও করতে পারতো না। কত চালাক আর ওভার স্মার্ট ছেলেরা ফেইল মারলো কিন্তু এই বোকা সোকা ছেলেটা আমার শত বকা অপমান সহ্য করেও আমার পিছনে পড়ে রইলো। বড় হওয়ার পর আমাদের বাসায় আসতে চাইতো না খুব একটা। ওর নাকি লজ্জা করে। আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে পাগলটা যে কত জ্বর বাঁধিয়েছে! বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে ও ঘুম থেকে উঠেই আমার বাসার সামনে একটা গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতাম আর ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তার অসামান্য সুন্দর হাসিটা দিয়ে দিন শুরু করতো। আমি ভিতরে ভিতরে বেশ খুশি হলেও ওকে খুব বকে বাসায় পাঠাতাম। ও মুখ ভার করে বাসায় গিয়ে ফোন দিয়ে বলতো,

-তুমি সব সময় আমাকে বকো কেন?
আমি অল্প হেসে বলতাম,
-তুমি আমার ময়না পাখি যে তাই।

-ময়না পাখি তো মেয়ে। ময়না মেয়েদের নাম। এটা ছেলেরা মেয়েদের বলবে। মেয়েরা ছেলেদের কেন ময়না বলবে?
আমি তখন কণ্ঠে প্রচুর ঝাঁজ নিয়ে বলতাম,

-তোরে কে বলছে ময়না মেয়ে পাখি? ঐ গাধা, তোরে কে বলছে এটা? অন্যসব পাখিদের মতো ময়নাদের মধ্যেও পুরুষ ময়না আর মহিলা ময়না আছে। তুই আমার পুরুষ ময়না পাখি,বুচ্ছস?

ও তখনও মুখ ভার করে বলতো,
-তুমি আমাকে তুই তুকারি করো কেন? আমি তো তোমার…
-কি সাহেব, আপনি আমার কি, হুম?

-আমি তোমার, আমি তোমার। আমি তোমার ময়না পাখি। পুরুষ ময়না পাখি। এ পর্যায়ে দুজনই হেসে উঠতাম। আর আমি বলতাম,

-এই যে একবার তুই বললাম আর আরেকবার আপনি বললাম, দুটো কাটাকাটি হয়ে তুমি হয়ে গেছে। এখন আমার সাহেবের রাগ কমেছে কি?

তামিম তখন আস্তে করে বলতো,
-হুম।

এই বোকা ছোলেটাকে কত বকেছি, কত কাঁদিয়েছি। সব সময় ওর ঘারে একটা পা তুলে রেখেছি। ও সব মেনে আমাকে নীরবে ভালোবেসে গেছে। অথচ ফাইনালি এ ছোলেটা আমার থেকে কান্না উপহার পাবে সেটা ভাবিনি।
নিজের অজান্তেই দু চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। কলিজাটা যেন বুকের ভিতর কেমন তড়পাচ্ছে। বাবা বোনের ছেলে বলে কোনরকম মানলেও মা মানার তো প্রশ্নই আসে না। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলাম কতক্ষণ। মা অনেক্ষণ যাবৎ কান্নার কারণ জানতে চাইলো কিন্তু বললাম না। ল্যাপটপের স্ক্রিনে তামিম আর আমার সেই ছবিটা বের করলাম, যে ছবিটার সাথে একটা মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আমাদের সম্পর্কের তিন বছর পর একদিন তামিম একটা চিরকুটে লিখে জানালো,

-সে আমার হাতটা একটু ধরতে চায়। মুখে অনেকদিন চেষ্টা করেও বলতে পারেনি তাই লিখে জানালো। স্বাভাবিক নিয়মানুসারে এই চাওয়ার অপরাধে ওকে আমি প্রচুর ধমকালাম তারপর রেগে বাসায় চলে এলাম। কিন্তু কেন যেন বাসায় আসার পরও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তামিমকে বললাম বিকেলে বাসার সামনে আসতে। ও এসে বোকার মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলো মাথা নিচের দিকে দিয়ে। ওকে শুধু হাত ধরতে চাওয়ার অপরাধে যে বকা দিয়েছি, আমার বান্ধবীদের বয়ফ্রেন্ড হলে মিনিমাম এক সপ্তাহ ফোনই ধরতো না। কিন্তু আমার বোকাটা ঠিকই বোকা বোকা লুকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমি নিচে নেমে গেলাম। ওর চোখ দুটি লাল হয়ে ফুলে গেছে। অনেক কান্না করেছে বুঝাই যাচ্ছিলো। আমি ওর সামনা সামনি খুব কাছে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে হুট করেই ওকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরেই আবার পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে উপরে চলে এলাম। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আবার আমার বোকাটার দিকে তাকালাম। দেখি তানিম ওর মুক্ত ‘র মত দাঁতগুলো বের করে একটা হাসি দিয়ে ব্যালকনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি পবিত্র সে হাসি! কি মায়া ঐ মুখটাতে! ওর হাসি হাসি মুখের গাল বেয়ে তখন সুখের অশ্রু ঝরছিলো। শুনেছি মানুষ খুব বেশি আনন্দিত হলে একসাথে হাসেও আবার কাঁদেও। তামিমের বোধ হয় তখন সেই অবস্থাই হয়েছিল। আমার মতো বদমেজাজী মেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে পারে সেটা বোধ হয় কল্পনা করেনি কখনও। আমি ব্যালকনি থেকে ফোনের ক্যামেরা জুম করে সেদিন ওর এই ছবিটা তুলেছিলাম। ছবিটার দিকে তাকাতেই আমার আবারও খুব কান্না পেলো। ল্যাপটপ অন রেখেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।

আমরা সবাই বিয়েবাড়িতে চলে গেলাম। ফুফা-ফুফু বেশ খুশি। ছেলেকে অনেক ভালো জায়গায় বিয়ে করাচ্ছে। তামিমের গায়ে হলুদের সময় আমি ওর কাছে যাচ্ছিলাম না। দূর থেকে উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখছিলাম কেবল। ওর দুটি চোখ এপাশ-ওপাশ করে কাউকে খুঁজছিলো। আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, ও আমাকেই খুঁজছে। সহজ-সরল বোকা ছেলেগুলা’র কপালে এমনই থাকে। ভালেবাসলে ছিনিয়ে আনতে জানতে হয়, ডাকাত হতে হয়, বেহায়া হতে হয়। এগুলো না হতে পারলে সারাজীবন

ভিতরে ভিতরে জ্বলে-পুড়ে নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। আচ্ছা, আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? আমার বুকে অনেকগুলো পাথরের অস্তিত্ব অনুভব করছি কেন আমি। ওগুলো কী পাথরের ভার নাকি ভালোবাসার? এতদিন তো এত ভারী লাগেনি। তাহলে আজ লাগছে কেন? আমি আমার ভালোবাসা চিরতরে হারিয়ে ফেলছি বলে নাকি তামিমের মতো একটা বোকাসোকা ছেলের পাশে দাঁড়াচ্ছি না বলে! আমি কিছু ভাবতে পারছি না।

তামিমকে বর সাজানো হয়েছে। এক্ষুনি ও ফুলে সাজানো গাড়িটাতে চেপে বসবে। আমাকে বরযাত্রী যেতে হবে। তামিম গাড়িতে গিয়ে বসলো। ফুফু আমাকে গাড়িতে উঠে বসার তাগেদা দিলো। আমিও উঠে বসলাম। বাকীরা এখনও উঠেনি বরের গাড়িতে। আমি ভয়ে ভয়ে তামিমের দিকে তাকালাম। ওর চোখ দুটো অসম্ভব রকম ফুলে

গেছে। বেশ কান্না করেছে বুঝাই যাচ্ছে। আমার ভিতর থেকে একটা কান্নার দলা এসে গলায় আটকে গেল। তামিমকে ডাকলাম আস্তে করে। ও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। অনেক ক্ষেপে আছে আমার উপর। ও ওর কষ্টটাই অনুভব করছে। আমার ভিতরেও যে সাইক্লোন টাইপ কিছু একটা হচ্ছে সেটা ও বুঝতে পারছে না।

আমি নিদারুণ কষ্টে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললাম। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছে। তামিমের হাতে একটা কলম দিয়ে কাজী সাহেব সিগনাচার করতে বললো। তামিম কি অনায়সেই সিগনাচার করে দিলো। ওর হাতও কাঁপলো না

একবার। আমার চোখে জলে টলমল। এবার তামিমের আলহামদুলিল্লাহ বলার পালা। সে তিনবার আলহামদুলিল্লাহ বলার সাথে সাথে আমি ফুফুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আর বলে উঠলাম “তামিম কেবল আমার বর হবে”।

ফুফুর কথায় আমার ঘোর কাটলো। ফুফু কখন যেন গাড়িতে আমার পাশে এসে বসেছে আর আমি কল্পনাতে তামিমেরর বিয়ে পড়িয়ে এলাম। ফুফু আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে ড্রাইভারকে বললো, ড্রাইভার গাড়ি চালাও। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাইওয়ে ধরে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে আমি জানি না। তবে মনে হচ্ছে ফুফু তামিমের ব্যাপারটা আগেই টের পেয়েছিল। কিভাবে কি হলো বা হবে আমি কিছু জানি না। ফুফু আছে সাথে। ফুফুই সব করবে। আমি ফুফুর সামনেই তার বোকা ছেলেটার গা ঘেঁষে বসলাম। ছেলেটা এখনও অভিমান করে আছে। আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমি শক্ত করে ডান হাতে ওর একটা হাত চেপে ধরলাম। ছল ছল চোখে আমার দিকে তাকালো সে। গাল বেয়ে টপ টপ পানি পড়তে শুরু করলো মুহুর্তেই। আমি ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুঁটিয়ে বাম হাতে ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললাম,

-সেদিন জড়িয়ে ধরেছিলাম। হাতটা কিন্তু ধরা হয়নি। আজ তোমার সেই ইচ্ছাটা পূরণ করে দিলাম। তামিম তখনও কাঁদছে। ফুফু আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, “এই বোকাটাকে দেখে রাখিস গোটা একটা জীবন”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত