আয়নার সামনে দাঁড়াতেই সমস্যাটা আবার শরু হলো টুইয়ের । সেই অদ্ভূত সমস্যা । কেমন যে একটা যণ্ত্রণা ! বোঝানো যায়না কাউকে । শুধু বুকের ভেতর ব্যথাটা দলা পাকাতে থাকে । এত অদ্ভূত যন্ত্রণা কেনো এলো তার জীবনে . . .খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার । একবার যদি মন খুলে কাঁদা যেত । মনের ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে । আলোর সব জানালা বন্ধ হয়ে গেছে ।
এই টুই ! কতক্ষণ লাগাবি আর ? খাওয়া নিয়ে বসে আছিতো ! ‘
ভুলেই গেছিলো টুই । হাত মুখ ধুতে ওয়াশরুমে এসেছে সে । চোখে অনেক পানি দিলো সে । অনেএএক পানি । কষ্টের প্রতিটা চিহ্ন যেনো সে মুছে ফেলতে চায়. . .মেয়ের দিকে তাকিয়ে কি যেন বোঝার চেষ্টা করছেন সায়মা । অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন । প্রাণবন্ত মেয়েটা , হাসিখুশী । কিন্তু কোথাও যেন তবু কিছু একটা ঠিক নেই . . .
মাহি , জুমানা হাঁটছে .. পাশাপাশি । মাহি , জুমানা আর টুই । আড়চোখে টুইকে দেখলো কয়েকবার মাহি । কেমন যেনো অস্বাভাবিক ।
টুই . . .
তাকালোওনা টুই ।
তুই কি উনার প্রেমে পড়েছিস টুই ?
চমকে পেছনে তাকালো টুই । চোখের পাতা কেঁপে উঠলো দু’তিন বার । ভীত হরিণীর মতো চোখ সরিয়ে নিলো সে ।
এই ভুল তুই করিস না টুই ।
আমি কি করলাম ? আমি কিছু করি নাই …
টুইয়ের চলে যাওয়ার পথের দিকে অবাক তাকিয়ে থাকলো জুমানা আর মাহী ।
আসবো ?
আরে টুই পাখি যে ?? এসো এসো ।
ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলো টুই ।
কেমন আছেন আপনি ?
আমার আর থাকা ! এক পা তো কবরে দিয়ে বসে আছি । বেঁচে থাকাটাই অনেক এখন !
আপনি এটা কেনো বলছেন ? আপনি এভাবে বলতে পারেন না ।
অবাক হয়ে দেখলেন আরশাদ আহমেদ মেয়েটা কেমন তীহ্ম গলায় তীব্রভাবে প্রতিবাদ করলো ! ভ্রু কুঁচকালেন তিনি. . .
তিনি একজন লেখক । দেশে বিদেশে যথেষ্ট খ্যাতি তার । অনেক পাঠক ভক্তের অনেক পাগলামিতে তিনি অভ্যস্ত । কিন্তু এই মেয়েটা একেবারেই অন্যরকম । কেমন যেনো অন্যরকম । চার মাস হলো টুই কে চিনেন তিনি । চার মাস আগে টুইয়ের ইউনিভার্সিটির একটা প্রোগ্রামে স্পেশাল গেস্ট হিসেবে তার ইনভাইটেশন ছিলো । সাধারণত এসব ইনভাইটেশন খুব ভদ্রভাবে এভয়েড করেন তিনি । সেদিন ও করতেন ! টুই নামের এই মেয়েটা এসে কার্ডটা দেবার পর তিনি কিছু বলতে যাবার আগেই মেয়েটা বলে বসল –
জানি আপনি আসবেন না এবং আমাকে সূহ্মভাবে অপমান করার চেষ্টা করবেন । আর তারপর হয়তো খুব সুন্দর করে গুছিয়ে আপনার নেক্সট বইতে লিখবেন । আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসেনা । কিচ্ছু না । আমি এখন প্লীজ প্লীজ করে আপনাকে আসতে ইনসিস্ট ও করবো না । শুধু বলছি আপনি আসলে আমার ভালো লাগবে । খুউব বেশী ভালো লাগবে . . .
কঠিন গলায় কথাগুলো বলছিলো মেয়েটা । রূপবতী তরুণীর মুখে কাঠিন্য বেশ ভালোই মানায় । কিন্তু শেষ দু লাইন বলার সময় গলাটা কেমন কোমল হয়ে গেল । হঠাত্ž অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সে ।
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তিনি একটা সিগারেট ধরালেন । ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তিনি ঠিক করলেন যে তিনি যাবেন ।
মেয়েটার কথায় কেন জানি তার মন ভালো হয়ে গেছে । মন টন তেমন ভালো ছিলো না । শ্রাবণীর সাথে রীতিমত কুত্žসিত টাইপের ঝগড়া হচ্ছে ইদানিং । এই বয়সে ঝগড়া করতে ভালো লাগে না । বয়স প্ঞ্চাশ পেরিয়েছে । এখন একটু শান্তি স্বস্তি দরকার তার । এক সপ্তাহ হলো শ্রাবণী মেয়ের বাড়ি গিয়ে আছে । কোন যোগাযোগ ও নেই ।
ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা উদ্যোগ নিয়ে একটা মাঝারি সাইজের বইমেলার আয়োজন করেছিল । তাই নিয়ে প্রোগ্রাম। আরশাদ সাহেবকে ওখানে দেখে সবার চোখ কপালে উঠে গেছিলো । ঢোকার একটু পরে টুইকে দেখলেন তিনি । লাল পাড় দেয়া একটা হলুদ শাড়ি পরে নিচু হয়ে ফুল গুছাচ্ছে । চুলগুলো ছাড়া । নতুন বৌ বৌ লাগছে । ওর চোখে চোখ পড়তেই একটু হাসলেন তিনি । মেয়েটা কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে গেলো ।
চোখে পানি চিকচিক করে উঠলো এবং সে চোখের পানি লুকানোর কোন চেষ্টাও সে করলো না ।
তিনি ভেবেছিলেন মেয়েটা এসে থ্যঙ্ক ইউ বা এ জাতীয় কিছু বলবে । তিনি ওখানে প্রায় এক ঘন্টা ছিলেন । আর একবারও মেয়েটাকে আশেপাশে দেখেননি তিনি । কিছুটা অবাক হয়েছিলেন তখন ।
আরো অবাক হলেন যখন দেখলেন তিন দিন পর এক বিকেলে টুই তার বাসায় এসে হাজির ।
দরজায় দাঁড়িয়ে হড়বড় করে বললো –
এখানে একটা ফ্রেন্ডের বাসায় এসেছিলাম । ভাবলাম একটু দেখা করে যাই ।
আরশাদ সাহেব হেসে বললেন ,
তা বুঝলাম । বাট তুমি যেনো কে ?
মেয়েটার সারা মুখে রাগ জমা হতে লাগলো ।
আমি যাচ্ছি । ভুলে চলে এসেছি । আপনাকে বিরক্ত করার জন্য স্যরি ।
তার প্রায় পাঁচ ছদিন পর আবার এলো সে । এইবার মুখ হাসিহাসি ।
চিনেছেন আমাকে ?
হুমম । তুমি হচ্ছো টুই । টুইপাখি ।
মানে. . .
মানে সেদিন একটু মজা করছিলাম । তুমি অমন করবে ভাবিনি ।
খুব রাগ হচ্ছিলো ।
এই বয়সট এমনই হয় । একটুতেই খুব রাগ হয় , অজানা কারণে ভালো লাগে , অকারণে কষ্ট হয়. . .
এই বয়স সম্পর্কে খুব জানেন , না ?
এই দেখো আবার রেগে যাচ্ছো । আচ্ছা বলো তো , চা খাবে ? বা কফি ?
নাহ্ খেয়ে এসেছি ।
কোখ্খেকে ? এখানে তোমার যে ফ্রেণ্ড থাকে ওর বাসা থাকে তার বাসা থাকে ?
ফ্রেণ্ড ! এখানে তো আমার কোন ফ্রেণ্ডের বাসা নেই . . .
বলেই চমকে উঠলো টুই । আরশাদ সাহেব মুখ টিপে হাসলেন ।
শোন মেয়ে , অজুহাত দেয়ার দরকার নেই কোনো । তুমি এমনিই এসো । তোমার যখন ইচ্ছা হবে তুমি চলে এসো । তোমাকে আমার ভালো লাগে।
মূর্তির মতো বসে রইলো টুই । মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন তিনি । তারপর বললেন , বসো আমি চা করে আনছি । চা বানিয়ে এসে দেখলেন তিনি , ঘর খালি , দরজা খোলা . . .
টুই , তুই আজকেও ক্লাস করবি না ?
প্লিজ বৃষ্টি , তুই আমার সাইনটা একটু দিয়ে দিস ।
কিন্তু তুই প্রায়ই ক্লাস না করে কোখায় যাস বলতো !
কোথাও না ।
সত্যি করে বলতো , তুই কি আরশাদ আহমেদের বাসায় যাস ?
ফ্যাকাশে ভাবে একটু হাসলো টুই । বৃষ্টির মাখায় আকাশ ভেঙে পড়লো । কী করছে এই মেয়ে. . .
লেখার টেবিলে বসে আছেন আরশাদ । লিখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি । টুই তার সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
আজ দুপুরে কি খাবেন ??
হোটেল থেকে যা আসবে ।
আজকে আমি রান্না করি ??
করতে পারো । রান্নাঘর কোথায় তুমি জানো । ফ্রিজে কি আছে আমি জানি না । আদৌ কিছু আছে কিনা তাও জানি না ।
টুই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো । আরশাদ সাহেব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন । লেখা একটুও এগুচ্ছে না । তার হাতে একটা খাম । শ্রাবণীর পাঠানো । তাদের ডিভোর্স লেটার ।
আলুভাজি , ডাল আর পাবদা মাছের তরকারি । পরিপাটি করে টেবিল সাজানো । খাবার মুখে দিয়ে চমকালেন তিনি , টুইয়ের মতো আহ্লাদী আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়া আধুনিক এক মেয়ের রান্নার হাত এত ভালো হতে পারে তার ধারণা ছিলো না !
টুই , তুমিও বসো ।না । আমি ড্রইংরুমে বসছি । আপনি খান ।
ড্ইংরুমে কেনো ?
খাওয়ার সময় কেউ সামনে খাকলে আপনার অস্বস্তি লাগে তাই । আপনি শান্তি করে খান ।
তাহলে আমার রিডিং রুমে যাও । টেবিলের উপর একটা খাম আছে । খুলে দেখো ।
দুই মিনিটের মাথায় টুই আবার ডাইনিং এ আসে । তার চোখে এক রাশ বিস্ময় .
এর মানে কি ? আপনাদের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে !
আমাকে আর কিছু প্রশ্ন করো না। এ ব্যপারে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। ডিটেইলস পেপারে পড়ে নিও।
তীহ্ম চোখে তাকিয়ে রইলো সে।
তুমি কি খুশী এতে টুই?
এটা আপনি কি বল্লেন? আমি খুশী হবো কেন?
খুশী না হলে তো ভালই।
না আপনি বলেন আপনি কেনো একথা বললেন বলেন। বলবেন না? থাক বলতে হবেনা। আমি জানি। আপনি ভাবছেন আমি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি আসলে এমন কিছুই না।
আমিতো এমন কিছু বলিনি টুই । এতো উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছো কেনো? নরমাল হও।
আমি কোন দুঃখে আপনার প্রেমে পড়তে যাবো ? আমার জাস্ট আপনার লেখা অনেক ভালো লাগে তাই এখানে আসি।
আচ্ছা ঠিক আছে তো।
কিচ্ছু ঠিক নেই। আমি চলে যাচ্ছি। আর কোনদিন আসব না।
টুইয়ের ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। দুমদাম করে ব্যগ কাঁধে নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো সে।
একের পর এক দিন কাটছে । কেমন অদ্ভূত ভাবে এক বিষন্নতায় । দলা পাকানো কান্নাটা মেঘ হয়ে ঘুরে বেড়ায় ভিতরে ভিতরে । গলার কাছটায় আটকে থাকে । কিছুতেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে না । আর যায়নি টুই । এক দিন , দুই দিন , তিন দিন, চার মাস, পাঁচ মাস, ছয়মাস, এক বছর
এক বছর পরের এক বৃষ্টিভেজা রাত। প্রচণ্ড বৃষ্টি। কালবৈশাখী ঝড়ের মত তান্ডব। আরশাদ আহমেদ বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিলেন। কলিংবেলের শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। দরজা খুলে দেখলেন ভেজা শাড়িতে টুই দাঁড়িয়ে আছে উদ্ভ্রান্তের মতো
ভেতরে আসো টুই ইশ কি ভিজে গেছো! ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো।
দাঁড়াও তোয়ালে নিয়ে আসছি।
হাত বাড়িয়ে আরশাদ আহমেদের হাতটা ধরলো টুই। থরথর করে কাঁপছে সে। তার চোখের দিকে তাকালেন তিনি, প্রচণ্ড আহ্বান সে চোখে গাঢ় করে কাজল দেয়া মেয়েটার চোখে পানি। কি অদ্ভূত! সারা মুখে বৃষ্টির পানি , তবু সেই চোখের পানি আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে !
তিনি মেয়েটার গালে হাত রাখলেন। টুই চোখ বন্ধ করে ফেললো।
ঘোরলাগা কন্ঠে বলে চললেন তিনি
রাত অনেক হয়ে গেছে। এখন কোন কাজি অফিস খোলা থাকার কথা না। তবু খুঁজে দেখি চলো!