অনেক্ষণ যাবত ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।কে কান্না করছে তা ঘেটে দেখার ইচ্ছা গালিবের নেই।
তবুও পরিস্থিতির তাগিদে গালিব পাশের ছাদে উঁকি দিলো।অদ্ভুত হোক বা কাকতালীয়,সেখানে আফরিন একা দাঁড়িয়ে।
হাতে তেতুলের আচার।আচারের অনেকটা নিচে পড়ে আছে।হয়তো এর জন্য মেয়েটা মরা কান্নায় মেতে উঠেছে।
ব্যাপারটা মজার দেখে গালিব জিজ্ঞাসা করলো “কান্নার কারণ কি আচার?”
আফরিন হুরমুড়িয়ে তাকালো।চারিপাশ একবার দেখে নেওয়ার পর অভিমানী সুরে জবাব দিলো “হুম,আমার সব আচার পড়ে গেছে।”
– আমি তো দেখছি অর্ধেক পড়েছে।
– জানি,এখন আমি কি খাবো![কান্নার সুরে]
– বাসায় রান্না করেনি?
– ফাজলামো করবেন নাতো।কত স্বাদ করে আম্মুকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আচার বানিয়ে দিতে বলেছি।এখন অর্ধেক পড়ে গেলো।
– ইসস,কত্ত ক্ষতি হয়ে গেছে মেয়েটার।
– এই আপনি মজা নিচ্ছেন!
– আরে পাগলী,এটা কি মজার বিষয়?
– মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক খুশি হয়েছেন।
– সে আর বলতে।মানে আপনি ফেস রিডিং পারেন?
– ধ্যাত!
আফরিন রেগে চলে গেলো।দাঁড়িয়ে রইলো গালিব।
আকাশে কালো মেঘ বিরাজ করে আছে।এই বুঝি বৃষ্টি নামবে।হালকা বাতাস বইছে।
মাঝে মধ্যে মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।গালিবের মনে হলো,আরো কিছুক্ষণ থেকে প্রকৃতির স্বাদ গ্রহণ করা যাক।
কিন্তু তা হয়ে উঠলোনা।খালাতো বোন স্নেহা ছাদে এসে রাগারাগি শুরু করে দিলোঃ
– আকাশের অবস্থা দেখেছিস?এই সময় কেউ ছাদে থাকে?মাথায় বজ্রপাত পড়লে কি অবস্থা হবে খেয়াল আছে?চল এক্ষুণি আমার সাথে নিচে চল।
– তুই যা আমি আসতেছি।
– আমি থাকলে তোর সমস্যা হচ্ছে?
– না।
– ভালো।
– হুম।
– একটা কথা বলি?
– বল।
– কাল তোর বাইকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাবি?
– না।
– প্লিজ!
– আমি ভালো বাইক চালাতে পারিনা।এক্সিডেন্ট করলে সোজা উপড়ে চলে যাবি।
– তুই আমার পিছু পিছু আসলে হবে।
– মানে!
– কিছুনা।
– মন খারাপ?
– না,কেন?
– এভাবে কথা বলছিস যে!
– কিভাবে?
– বাদ দে,তাহলে ওই কথা রইলো।
– কোন কথা?
– কাল তোর বাইকে ভার্সিটিতে যাচ্ছি।
– না।
– ওকে,আন্টি বুঝবে বাকিটা।এখন চল রুমে যাই।গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
– হুম চল।
মেঘলা আকাশ,হালকা বাতাস এবং গুড়িগুড়ি বৃষ্টি।প্রকৃতির এই নিয়ম অনেকের পছন্দ।কিছু সংখ্যক মানুষ মুহূর্তটায় ছাতা হাতে হাঁটতে পছন্দ করে।
কেউ বা কম্বল গায়ে বসে চায়ে চুমুকের সাথে বাহিরে তাকিয়ে থেকে নিজেকে অনুভব করতে পছন্দ করে।
তবে বেশিরভাগ নারী কফি হাতে জানালা অথবা বেলকনিতে বসে থাকতে অধিক পছন্দ করে।জগৎ সংসারে নারীর নিয়ম সম্পূর্ণ ভিন্ন।তাঁরা কখন কি করে তাদের নিজেরই অজানা।
গালিব ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকালো।সময় প্রায় সাড়ে আটটা।ভার্সিটিতে ক্লাস সাড়ে দশটায়।প্রায় দু’ঘন্টা সময় হাতে আছে।এবার সে ঘুমাবে কি ঘুমাবে না চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো।
ভাগ্যের পরিহাসে ভাবনার অন্তি ঘটিয়ে স্নেহা হাজির।
– ওই ওঠ।
– হু!
– তারাতারি ফ্রেস হ।ভার্সিটিতে যাবো।
– ভার্সিটিতে যাবি যা,আমায় ফ্রেস হতে বলছিস কেন?
– কাল কি বলেছিলাম মনে নেই!আন্টির থেকে অনুমতিও নেওয়া শেষ।
– কিন্তু আমি তোকে নিয়ে যেতে পারবোনা।
– ওকে..ওকে।খুব ভালো,নিয়ে যেতে হবেনা।আমি বরং আন্টির কাছে সিগারেটের কথা বলে দিই।
– ব্লাকমেইল!
– কিছুই করার নেই।
– শয়তান ছেমরি।
– যা যা,উঠে ফ্রেস হ।
– তুই গিয়ে ময়দা মাখা শুরু কর।
– আমি ময়দা মাখি না।
– ওলে বাবা লে,তাহলে আয়নায় সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে মুখে ঘষিস ওটা কি?
– মেকআপ।মূর্খদের মতন কথা বলিস কেন?ময়দা আর মেকআপ এর ফারাক বুঝিস না।
– হুম,ছেলেরা সব মূর্খ আর মেয়েরা সবাই এক একটা জ্ঞানের সাগর..সরি সাগরি।
– সকাল সকাল ঝগড়া করছিস কেন?
– তুই তো শুরু করলি।
– হুহ্।
স্নেহা ভেংচি কেটে চলে গেল।
গালিব অবাক হয়ে বসে ভাবতে লাগলো,ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি ভেংচি কাটে।এর কারণ কী?মেয়েদের মাঝে কি বাচ্চামো স্বভাব অনেকদিন পর্যন্ত বিরাজমান!ছেলেদের বেলায় কেন এমন নয়?
উত্তর জানতে গালিব চেচিয়ে স্নেহা বলে ডাক দিলো।প্রথম ডাকে বালিকা হাজির।
– কি হয়েছে বল।
– তুই আমায় ভেংচি কাটলি কেন?
– আমার ইচ্ছা।
– আচ্ছা ভেংচি কাটার আগে কি তোর মধ্যে কোনো অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব হইছে?
– মানে?
– সোজা প্রশ্ন,ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভেংচি বেশি কাটে কেন?
– আমি কি জানি!পাগলের মতন কথা বাদ দিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়।
– ওকে।
গালিব ওয়াশরুমে চলে গেলো।মাথায় তখনো একটা কথাই ঘুরছে।
স্নেহা গালিবের বাইক থেকে নামলো।ঠিক তখন আফরিন সামনে হাজির।
কোনো কারণে আফরিনকে মন খারাপ দেখেচ্ছা।আশ্চর্য বিষয় কিছুক্ষণ আগেও মেয়েটা হাসিখুশি ছিলো।
স্নেহা আফরিনের দেখা পেয়ে বললোঃ
– সরি দোস্ত,আজ তোর সাথে আসতে পারলাম না।আসলে আন্টি জোর করে গালিবের সাথে আমায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
– ইটস্ ওকে।
– চল ক্লাসের দিকে যাই।
– না,আমি একটু পরে যাবো।
– কেন?কি করবি?
– কাজ আছে।
– কি কাজ?
– পরে বলবো।
– এখন বল।
– ইচ্ছা করছেনা।
– ওকে,থাক তুই আমি গেলাম।
স্নেহা একপ্রকার রেগে ক্লাসের দিকে হাঁটা দিলো।অপরদিকে আফরিন তেলে বেগুনে জ্বলে গালিবের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
গালিব প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে ঠিক বুঝতে পারলো।কিন্তু মূল কারণ তখনো তাঁর কাছে অস্পষ্ট।
– স্নেহা তো আপনার বোন?
– খালাতো বোন।
– গুড,তো ওর সাথে এভাবে ভার্সিটিতে আসার মানে জানতে পারি?
– না।
– ও,ওকে।আচ্ছা মিস্টার গালিব আপনার ওয়াইফ বা গার্লফ্রেন্ড যদি খালাতো মামাতো বা ফুফাতো ভাইয়ের সাথে ঘুরে বেরায় তাহলে কেমন ফিল করবেন?
– জেলাস।
– গুড আন্সার,আচ্ছা তখন আপনি আপনার ওয়াইফ অথবা গার্লফ্রেন্ডকে কি শাস্তি দিবেন?
– সম্পর্ক ছিন্ন করে দিবো।
– আর যদি ছিন্ন করে থাকতে না পারেন?
– নো এক্সপ্রিয়েন্স।
– আমি কি শাস্তি দিবো জানেন?
– না।
“ঠাসসস”
চরের শব্দে ক্যাম্পাসের সবাই আঁতকে উঠলো।
গালিব অবাক।
গালে হাত দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে,হয়ে যাওয়া কাণ্ড কিভাবে ঘটলো!
– মাথায় ঢুকছে কিছু?
– চর মারলেন কেন?[অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে]
– তুই স্নেহার সাথে বাইকে ভার্সিটিতে আসলি কেন?
– আমার পার্সোনাল বিষয় নাক গলানোর আপনি কে?
– আমি কে?আমি তোর গার্লফ্রেন্ড।ক্লাস সেভেনে থাকতে প্রপোজের কথা ভুলে গেলি?এই ছিলো তোর ভালবাসা!
– প্রপোজ!ভালবাসা!অধিকার পরে দেখান ম্যাডাম।ফুল মুখে ছুড়ে মারার কথা ভুলে গেছেন নাকি?
– ভুলিনি আবার মনেও রাখিনি।বাট তুই যেদিন আমায় প্রপোজ করেছিলি সেদিন থেকে আমি তোর গার্লফ্রেন্ড হয়ে গেছি।
– বাহ্,দারুণ তো।আচ্ছা যেই আপনায় প্রপোজ করে আপনি কি তারই গার্লফ্রেন্ড হয়ে যান?
– মুখ সামলে কথা বলেন।
– ফালতু মেয়ে।
আফরিন জবাব দিতে পারলোনা।মুখটা মলিন করে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করলো।
ব্যাপারটায় গালিবের কেমন চাপা ব্যথা অনুভব হচ্ছে।
কিন্তু এমন কেন হচ্ছে?
গালিব তো আফরিন নামে শব্দটা মন থেকে মুছে ফেলেছে।যদিও সেখানে অন্য নাম লেখা হয়নি।তবে কি মুছে যাওয়া নাম আবার আগের রূপ ধারণ করছে।
উত্তর পেতে সে আফরিনকে উদ্দেশ্য করে বললো “আমি আপনায় এখনো ভালবাসি?”
মেয়েরা আচমকা মজার কিছু শুনলে হেসে দেয়।তবে অভিমান করে থাকলে কিছুটা অপ্রকাশ্য রাগ দেখায়।
আফরিন চোখের পানি মুছে জবাব দিলো “ভালবাসলে যাকে তাকে এভাবে বাইকে নিয়ে ঘুরতেন না।”
– আপনি আমায় ভালবাসেন?
– মানে?
– কবে থেকে ভালবাসেন?
– যেদিন প্রপোজ করেছিলেন।আমি আপনার প্রপোজ রিজেক্ট করে দেওয়ার পর খুব কেঁদেছি।কেন কেঁদেছি জানিনা।এরপর প্রতিদিন আপনায় লুকিয়ে দেখতাম।আপনি আমার দিকে তাকালে লজ্জা চোখ নামিয়ে নিতাম।তারপর একদিন ভাবলাম মনের কথা বলে দিই।কিন্তু ভয় হতো,যদি প্রতিশোধ নিতে রিজেক্ট করে দেন।
– আপনি তো আমার চেয়েও এগিয়ে।
– গালে খুব লেগেছে তাইনা?
– কিছুটা।
– চলো বরফ লাগিয়ে দিই।
গালিব বড় বড় চোখ করে আফরিনের দিকে তাকালো।আফরিন গালিবের চাহনি দেখে মুচকি হাসলো।
তারপর হাতে হাত রেখে চলার পথে তাল মিলিয়ে উদ্দেশ্যহীন রওনা হলো।
অপর দিকে দূরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনার একমাত্র সাক্ষী হয়ে রইলো স্নেহা।কোনো না কোনো ভাবে ব্যাপারটা তাঁর চোখ এড়াতে পারেনি।
হয়তো এভাবে নীরবে চাওয়া গুলো হারিয়ে যায় এবং সৃষ্টি হয় কিছু নতুন সম্পর্ক।
সমাপ্ত