ছায়াসঙ্গী

ছায়াসঙ্গী

— আবির তোমায় একটা কথা বলতে চাই। অনেকদিন ধরেই কথাটা বলবো ভাবছিলাম।

ছোটবেলা থেকেই আবিরের একটা সমস্যা আছে, তা হচ্ছে জুতার ফিতা ঠিকমতো বাঁধতে না পারা। আবিরের জুতার ফিতা কেমন করে যেন খুলে গেছে। রোদেলার পাশে বসে আবির মনযোগ সহকারে জুতার ফিতা বাঁধার চেষ্টা

করছিলো। এমন সময় রোদেলার কথা শুনে আবির সোজা হয়ে বসলো। তারপর রোদেলার কপালের মাঝখানে আলতো করে টোকা দিল।

— এতো ঢং করার দরকার আছে নাকি? কি বলবে বলে ফেলো।

একথা বলেই আবির আবার নুয়ে পড়লো জুতার ফিতা বাঁধার জন্য। আবিরটা এমনই, রোদেলার কোন কথাকেই সিরিসায়ভাবে নেই না। তাই রোদেলা আবিরের উপর মাঝেমাঝেই অভিমান করে থাকে। আজকেও হয়তো অভিমান করেই থাকতো, কিন্তু আজ একটা ব্যাপার অাবিরের কাছে খুলে বলতেই হবে। তাই রোদেলা বললো,

— আবির আমার ব্রেন টিউমার হয়েছে । কিছুদিন পরেই আমার অপারেশন হবে। হয়তো আর বেশিদিন তোমার পাশে থাকতে পারবো না।

আবির সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। রোদলা কি আবিরের সাথে মজা করছে নাকি? হ্যাঁ রোদেলা কিছুটা ফানি এবং দুষ্টু স্বভাবের মেয়ে। তারমানে এটা নয় যে সে ব্রেন টিউমার নিয়ে মজা করবে। তারমানে কি সত্যিই রোদেলার!

— রোদেলা কি বলছো এসব? সকাল সকাল আমার মাথা গরম করার চেষ্টা করবে না বলে দিলাম।
— আবির সত্যিই আমার ব্রেন টিউমার হয়েছে। কিছুদিন আগে আমি খুব অসুস্থ ছিলাম মনে আছে?
— হুম।

— সেই সময় আমার ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। অনেক ইচ্ছে ছিলো তোমায় নিয়ে বাঁচার। কিন্তু বিধাতা হয়তো চায় না আমরা একসাথে থাকি।

রোদেলার কোন কথাই আবিরের কান দিয়ে ঢুকছে না। মস্তিস্কে হঠাৎ করেই নিউরন ঝড় উঠলো বোধহয়। চোখে আবির সবকিছুই ঝাঁপসা দেখছে। এমন সময় রোদেলার ফোঁপানোর শব্দ শুনে চমকে আবির তাকালো রোদেলার দিকে। ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গেছে রোদেলার।

— আরেহ পাগলী মেয়ে, কান্না করার কি আছে? অপারেশন হচ্ছে না? সব ঠিক হয়ে যাবে।

— আবির আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আর পারলে আমাকে ভুলে যাও। আমার জীবনের সাথে তোমার জীবন জড়িয়ে কষ্ট পাওয়ার মানে নেই।

রোদেলার এমন কথা শুনে আবির প্রচন্ড রেগে গেল। খপ করে রোদেলার চুলগুলো মুঠো করে ধরে রোদেলার মুখটা আবিরের মুখের কাছে নিয়ে আসলো,

— শোন মেয়ে, তোকে আমি ভালবাসি। তোর টিউমার হোক ক্যান্সার হোক অথবা এরচেয়ে খারাপ কোন রোগ হোক, তোকে আমি ছাড়ছি না। যেকোন পরিস্থিতিতেই আমি তোর সাথে ছায়ার মত থাকবো। এই কথাটা যেন তোর মনে থাকে।

রোদেলা ছাদে কাপড় শুকাতে এসে হঠাৎ করেই অতীতের সেইদিনের কথা মনে করে একচোট হাসলো। আবির বলেছিল সবসময় পাশে থাকবে। কিন্তু আসলে আবির পাশে থাকেনি। সেদিন রোদেলা আবিরের ভালবাসা পরীক্ষা করার জন্য ব্রেন টিউমারের নাটকটা করেছিল। রোদেলা দেখতে চেয়েছিল আবির কি সত্যিই রোদেলাকে মনে প্রানে ভালবাসে কিনা।

টিউমারের নাটকের পর কয়েকদিন আবির অনেক বেশিই কেয়ার করতো রোদেলার। তারপর হঠাৎ একদিন আবিরের ফোন বন্ধ হয়ে গেল। শত চেষ্টা করেও রোদেলা আবিরকে আর খুঁজে পেল না। রোদেলা বুঝতে পারলো যে ব্রেন টিউমারের কথা শুনে আবির কেটে পড়েছে। আবিরের এমন অন্তর্ধানে রোদেলা একপ্রকার খুশিই হয়েছিল। কারন মুখোশ পরা ভালবাসার কাছথেকে তো মুক্তি লাভ করেছে সে।

— কিরে রোদেলা কাপড় শুকাতে এসে কি নিজেকেই রোদে শুকানোর চিন্তা করছিস?

অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে রোদেলা বারবার হাসছিল। এমন সময় রোদেলার মা ছাদে এলো, তারপর উপরের কথাগুলো বললো। রোদেলা খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল।

— না মানে আকাশ দেখছিলাম।
— এই কাক মরা রোদে কিসের আকাশ দেখিস তুই? যা নিচে যা।
— তুমি যাও আমি আসছি।

রোদলার মা চলে যাওয়ার পর রোদলা আবারো অতীতে ডুব দিলো। আবিরের অন্তর্ধানের কিছুদিন পরেই রোদেলার পুরো পরিবার রাজশাহী চলে আসে। রোদেলার বাবা সরকারী চাকরি করে। তাই বদলী হয়ে তারা রাজশাহী চলে গেল।

ইদানিং রোদেলা একা ঘরে থাকতে খুবই ভয় পাচ্ছে। কারনটা হচ্ছে একা থাকলেই রোদেলার মনে হয় কেউ যেন তাকে আড়চোখে দেখছে। আর আরেকটা ব্যাপার রোদেলাকে খুব করে ভাবাচ্ছে। আর এই ব্যাপারটা হচ্ছে ছায়া!
সেদিন দুপুরে শুকিয়ে যাওয়া কাপড় ছাদ থেকে নিয়ে আসার সময় হঠাৎ করেই পানির ট্যাংকের উপর একজন মানুষের ছায়া দেখতে পেল সে। কিন্তু ছাদে রোদেলা ছাড়া আর কেউ নেই। তাহলে ছায়া আসলো কোথা থেকে?
এটাই শেষ নয়, এরপরেও কয়েকবার রোদেলা এমন ছায়া দেখতে পায়। কিছু একটা রহস্য তো অবশ্যই আছে এই ছায়ার মধ্যে।

মাঝরাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যায় রোদেলার। তখন সে বেলকনিতে গিয়ে কিছুক্ষন বসে। আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। আজ আকাশে থালার মত বড় একটা চাঁদ উঠেছে। চারদিকে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে সাদা রঙ দিয়ে চারদিক মেখে দেয়া হয়েছে।

কানে হেডফোন লাগিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে রোদেলা চোখ বন্ধ করে রাখলো। হঠাৎ টুং করে একটা শব্দ হলো। রোদেলার কানে হেডফোনে ফুল ভলিউমে গান বাজছে। এই শব্দটা রোদেলার শোনার কথা নয়। তবুও রোদেলা শুনতে পেল এবং খুব স্পষ্টভাবেই শুনতে পেলো।

রোদেলা চোখ মেলে তাকালো এবং তাকিয়েই চমকে উঠলো। বেলকনির কিনারায় ফুলের টবের পাশে কেউ একজন চুপ করে বসে আছে। এই ফকফকে চাঁদের আলোর মাঝেও সেই অজানা একজনের চেহারা দেখা যাচ্ছে না।

তবে এটা বোঝা যায় যে অবয়বটা একটা পুরুষের। অবয়বটা কাঁপছে, অনেকটা বাতাস বইলে নদীর পানিতে যেই ঢেউ সৃষ্টি হয় তেমন ভাবেই কাঁপছে।

রোদেলা হঠাৎ করেই আআআআআআ করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে অবয়বটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল টুকরো টুকরো হয়ে, অনেকটা হাতের থেকে আয়না পড়ে গেলে যেভাবে টুকরো হয় সেভাবে।

রোদেলার চিৎকারে রোদেলার বাবা মা আর ছোট ভাইটা দৌড়ে উপরে চলে গেল। ততক্ষনে রোদেলা অচেতন।

এই ঘটনার কিছুদিন পরের কথা। রোদেলাকে ডাক্তাতের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর কয়েকদিন রোদেলা বাসায় শুয়ে বসে কাটিয়ে দিল।

তারপর হঠাৎ একদিন রোদেলার এক বান্ধবী রোদেলার সাথে দেখা করতে আসলো। বান্ধবীর সাথে অন্য একটা মেয়েও ছিল যাকে রোদেলা চেনেনা।

— কিরে রোদেলা তুই নাকি রাতে ভূত দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি? তা ভূত কি তোর সাথে ডেটিং করতে এসেছিল নাকি?

— দেখ মজা করিস না। এমনিতেই সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থেকে মেজাজ গরম হয়ে আছে। কোন সময় তোর চুলের মুঠি ধরে…

— থাক থাক আর মেজাজ খারাপ করতে হবে না। রোদেলা এ হচ্ছে আমার কাজিন নীলা। দুইদিন আগে ঢাকা থেকে আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছে।

রোদেলা তাকালো মেয়েটার দিকে। মেয়েটা এতক্ষন হা করে রোদেলার দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ করেই মেয়েটা বলে উঠলো,

— আরে তুমি আবির ভাইয়ের গার্লফ্র্যান্ড না ?

রোদেলা চমকে গেল। আবিরের কথা নীলা কিভাবে জানলো? তাছাড়া রোদেলা যে আবিরের গার্লফ্র্যান্ড ছিল একথাই বা নীলা কিভাবে জানলো?

— তুমি আবিরকে কিভাবে চেনো?
— আবির ভাই আমাদের সিনিয়র ছিল। মাঝে মাঝেই তোমাকে দেখতাম আবির ভাইয়ের সাথে ঘুরতে।
— ও আচ্ছা।

রোদেলার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আবিরের কথা মনে হলেই রোদেলার মন মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যায়।

— যেদিন আবির ভাই মারা গেলেন সেদিন তো তোমাকে হাসপাতালে দেখলাম না। কোথায় ছিলে তুমি সেদিন?
রোদেলার মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। আবির মারা গেছে মানে?

— কিহ? আবির মারা গেছে? কবে? কখন?
— ওমা তুমি জানোনা?
— আমি কিচ্ছু জানিনা।

— একদিন রাতের বেলা ছাদে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খায় আবির ভাই। তাদের ছাদটা নির্মানাধীন ছিল। আবির ভাই সরাসরি চোখা রডের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। একেবারে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায় উনার বুক।

রোদেলা হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠে। তার কান্নার গতি বাড়তে থাকে দ্রুতবেগে। আবির মারা গেছে, কিন্তু রোদেলা কিছুই জানেনা। উল্টো আবিরকে এতদিন স্বার্থপর ভেবে এসেছে।

রোদেলার মা ছুটে এলো অন্য ঘর থেকে। এসেই রোদেলাকে জড়িয়ে ধরলো।

— কিরে মা কি হয়েছে এভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর?
রোদেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তার মা। জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের রোদ ঘরের মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। ঝাঁপসা চোখে রোদেলা দেখতে পেল সেই ছায়াটা স্থীর হয়ে আছে রোদের মধ্যে।
আবির রোদেলাকে সেদিন বলেছিল,

— তোর টিউমার হোক ক্যান্সার হোক অথবা এরচেয়ে খারাপ কোন রোগ হোক, তোকে আমি ছাড়ছি না। যেকোন পরিস্থিতিতেই আমি তোর সাথে ছায়ার মত থাকবো।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত