অতীতের কাঁটা

অতীতের কাঁটা

আদিবা একটু পরপরই মোবাইলের দিকে তাকিয়ে সময় দেখছে। চারটা বেজে একুশ মিনিট হয়ে গেল, কিন্তু এখনো আবির আসেনি। ছেলেরা সবসময় দেরী করেই মেয়েদের সাথে দেখা করতে আসে। এটা নিশ্চয়ই প্রকৃতি আজীবনের জন্য ঠিক করে রেখেছে।

যদিও নদীর পাড়ে বসে থাকতে আদিবার খারাপ লাগছে না। তবুও একা একটা মেয়ে কারো অপেক্ষায় বসে থাকাটা একটু কষ্টকর বটে। তাই অাদিবা উশখুশ করছে। এদিকে মোবাইলে ব্যালেন্স নেই, নয়তো আবিরকে ফোন করা যেত।

আরো পাঁচ মিনিট পরে আবিরকে দেখা গেল, হাতে কিছু একটা রয়েছে। আদিবা জানে আবিরের হাতে কি রেয়েছে!
আদিবা চকলেট খেতে খুব পছন্দ করে, এই ব্যাপারটা আবির ভাল করেই জানে। তাই যেদিনই আদিবার সঙ্গে দেখা করতে আসে সেদিনই আবির চকলেট নিয়ে আসে আদিবার জন্য। আর আদিবাও আবিরের দেয়া উপহার আনন্দের সাথে গ্রহন করে।

অাগামী মাসে আদিবা এবং আবিরের বিয়ে। পারিবারিকভাবেই তাদের বিয়ে হচ্ছে। যেহেতু তারা কিছুদিনের মধ্যেই স্বামী স্ত্রী হতে যাচ্ছে সেহেতু তারা একে অপরকে ভাল মত জানতে চায়, একে অপরের ভাল লাগা মন্দ লাগাগুলো বুঝতে চায়। তাই সময় পেলেই তারা এই নদীর পাড়ে দেখা করতে চলে আসে। আজকেও ঠিক তেমন একটা দিন।

— আমি দুঃখিত আপনাকে এখানে বসিয়ে রাখার জন্য। আসলে আমি!

আবির হয়তো দেরী করার কারন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু আদিবা হাত উঁচিয়ে আবিরকে থামিয়ে দিলো। আদিবা কোন কৈফিয়ত তলব করেনি আবিরের কাছে।

— থাক আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। আজকে তো আবহাওয়া মোটামুটি শীতল। তবুও এতো ঘামলেন কেন?
আবির বসে পড়লো আদিবার পাশে। যতবারই আবির আদিবাকে দেখছে ততবারই আবির মুগ্ধ হচ্ছে। রুপে, গুনে আর ব্যবহারে আদিবা অন্য সব মেয়ের চেয়ে একটু আলাদা।

— এই নিন টিস্যু, ঘাম মুছে নিন। ঘামযুক্ত অবস্থায় আপনাকে বিশ্রী লাগছে খুব।

আবির হাত বাড়িয়ে টিস্যু গ্রহন করলো। ঘাম মুছতে মুছতে হাতে থাকা চকলেটের প্যাকেটটা আদিবার দিকে বাড়িয়ে দিল। আদিবা কোন কথা না বলে চকলেট গ্রহন করলো। এবং সাথে সাথেই চকলেট খাওয়া শুরু করলো।
আবির মুগ্ধ হয়ে আদিবার চকলেট খাওয়া দেখছে। বাতাসে বারবার আদিবার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে চকলেট খেতে বারবার বাঁধা পাচ্ছে সে। চুল এলোমেলো হওয়ায় আদিবা বিরক্ত না, সে বিরক্ত তার চকলেট খাওয়ায় বারবার বাঁধা পড়ার কারনে।

— উফ এই বাতাসের জ্বালায় একটু বসতেও পারছি না। চকলেটটাও আরাম করে খাওয়া যাচ্ছে না।
— চকলেট কি আপনি একাই খাবেন?
— আমি চককেটের ভাগ কাউকে দেইনা। এই কথাটা সবসময় মনে রাখবেন।
— আচ্ছা ঠিক আছে মনে থাকবে।

আদিবা চুপ হয়ে গেল, আবির নিজেও এখন চুপ হয়ে গেছে। নদীর এই শান্ত পরিবেশ তাদের মনটাকেও শান্ত করে দিয়েছে। আজকে আদিবা একটু অন্যরকম করে সেজেছে। আদিবা কখনো টিপ দেয় না, কিন্তু আজ দিয়েছে। সবসময় ওর হাত খালি থাকে, কিন্তু আজ হাতে কাঁচের চুড়ি।

— আচ্ছা আজকে কয় তারিখ?

আদিবার মুখে এই প্রশ্ন শুনে আবির একটু হকচকিয়ে গেল। সত্যি বলতে আবির জানেনা আজকে কয় তারিখ। তাই সে তাড়াহুড়ো করে মোবাইলে তারিখ দেখলো।

— আজকে ছাব্বিশ সেপ্টেম্বর।
— ওহ তাই? একবছর আগে আজকের তারিখে একজন মেয়ের জীবনের জবনিকাপাত হয়েছিল।
— মানে বুঝলাম না আপনার কথার।

অাদিবা আবিরের কথায় কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর আবিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

— আচ্ছা আপনি কি সত্যিই আমাকে বিয়ে করবেন?
— হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
— যেটা প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দিন আগে।
— অবশ্যই আপনাকেই বিয়ে করবো। কারন আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
— আচ্ছা।

আবার আদিবা চুপ, এবার আবিরও চুপ। অাদিবার কথাগুলে আবির ভালমত বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষন এভাবেই নিরবে কেটে গেল। তারপর আদিবা নীরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো,

— আচ্ছা আপনাকে একটা গল্প শোনাই। মনযোগ দিয়ে শুনতে হবে। তারপর আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো। প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ভেবেচিন্তে।

— আচ্ছা ঠিক আছে।

আবারো আদিবা কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর বলতে শুরু করলো।

” মেয়েটা তখন ক্লাস টেনে পড়তো। খুবই চঞ্চল এবং দুষ্টু প্রকৃতির ছিল মেয়েটা। যতক্ষন ক্লাসে থাকতো ততক্ষন পুরো ক্লাসে রাজত্য করতো মেয়েটা।

স্কুলের সব শিক্ষক – শিক্ষিকাদের চোখের মনি ছিল মেয়েটা, পড়ালেখায় খুবই দুর্দান্ত ছিল সে। একই সাথে প্রচন্ডরকমের সুন্দরী ছিল মেয়েটা। যেকোন ছেলে মেয়েটাকে দেখলেই কিছুক্ষনের জন্য দাঁড়িয়ে যেত, ভাবতো এতো সুন্দর কোন মানুষ হতে পারে?

মেয়েটার স্কুলের সাথেই আবার কলেজ ছিল। যার ফলে কলেজের অনেক বড়ভাইদের কাছথেকে প্রেম প্রস্তাব পেয়েছিল সে। কিন্তু কোন প্রস্তাবেই সে রাজী হয়নি। পড়ালেখা আর বন্ধুবান্ধব নিয়েই তো ভাল আছে মেয়েটা, প্রেম নামক প্যারায় জড়ানোর কি কোন দরকার আছে?

মেয়েটার দিন কেটে যাচ্ছিল অানন্দ ফুর্তিতেই। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় সবসময় আদর যত্নেই থাকতো সে। পড়ালেখা নিয়ে বাসা থেকে কোন চাপ আসতো না, কারন হচ্ছে সে অনেক মেধাবী।

এভাবেই সরল নদীর মতই দিনগুলো কেটে গেলে ভাল হতো। কিন্তু বিধাতা মাঝে মাঝে সরল নদীর মাঝেও এক অভাবনীয় বাঁক রেখে দেন। মেয়েটার সহজ সরল জীবনেও এমন একটা বাঁক ছিল।

মেট্রিক পরীক্ষা খুবই কাছাকাছি চলে এসেছে। মেয়েটা এখনো আগের মতই হাসিখুশি। পরীক্ষা নিয়ে কোন চিন্তা তার নেই। হঠাৎ এই নিশ্চিন্ত জীবনে গলার কাঁটা হয়ে আবির্ভাব ঘটে নিশানের। কলেজের সবচেয়ে বাজে ছেলে, এবং একই সাথে এলাকার সবচেয়ে ধনী পরিবারের সন্তান।

মেয়েটাকে প্রথম দেখায় ভাল লেগে গেল নিশানের। তারপর কোন প্রকার ভনিতা না করেই সরাসরি মেয়েটার সামনে গিয়ে প্রোপোজ করলো সিনেমার হিরোর মত।”

এতটুকু বলেই আদিবা থামলো কিছুক্ষনের জন্য। আকাশে কালো মেঘ জমে আকাশটা থমথমে হয়ে আছে। আবির কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। আদিবা আবার শুরু করলো।

” অন্যসব ছেলেদের মত নিশানের প্রস্তাবটাকেও ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিলো মেয়েটা। কিন্তু মেয়েটা কি জানতো যে এই ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেওয়াটাই একসময় ঘূর্ণিঝড় হয়ে ফিরে আসবে?

মেয়েটার না করা স্বত্বেও নিশান ঘুরঘুর করতে লাগলো মেয়েটার পিছুপিছু। দিনরাত মেয়েটাকে উত্যক্ত করতে লাগলো রাস্তার মোড়ে, স্কুলের সামনে, কোচিংয়ের রাস্তায়। দিনদিন মেয়েটার জীবনটাই অতিষ্ঠ করে তুলতে লাগলো নিশান।

তাই একদিন সহ্য করতে না পেরে অনেক মানুষের সামনেই নিশানকে কষিয়ে একটা চড় মেরে দিল। চড়ের দাপটে নিশান প্রায় ছিটকে পড়ে গেল। চড় মেরে মেয়েটা নিজেই অবাক হয়ে গেল। বাহ তার শরীরে এতো শক্তি এলো কোথা থেকে?

কিন্তু মেয়েটা কি জানতো এই শক্তি একসময় শিকল হয়ে তাকে অাষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে?
তারপরের ঘটনা অতিরিক্ত পরিমানে সংক্ষিপ্ত। নিশান তার কয়েকজন বন্ধু মিলে সন্ধ্যায় কোচিং থেকে ফেরার পথে মেয়েটাকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয়।

তারপর সারারাত ধরে চলন্ত বাসেই চলতে থাকে গনধর্ষন। পরদিন সকালে মেয়েটার রক্তাক্ত আর নগ্ন দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় খালের পাড়ে। হয়তো মেয়েটা মরে গিয়েছিল, নয়তো মেয়েটা বেঁচে আছে এখনো অতীতের এক বিশ্রী কাঁটা মনে গেথে নিয়ে। নিজের জন্মস্থান রাজশাহী ছেড়ে কোন এক ইট পাথরের শহরে পালিয়ে আজো বেঁচে আছে।”

আদিবা এবার পুরোপুরি থেমে গিয়ে জমাট কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। আর আবির বিস্ফোরিত চোখে আদিবার ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই গল্পটা কি সত্যি? নাকি এমনি এমনি বললো আদিবা?
— আচ্ছা আপনাকে বলেছিলাম যে কয়েকটা প্রশ্ন করবো। কয়েকটা প্রশ্ন নয়, শুধু একটা প্রশ্ন করি?
— আগে বলুন ঘটনা কি সত্যি? মেয়েটার নাম কি ছিল?
— আচ্ছা মেয়েটার নাম বলছি, তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
— প্রশ্ন করুন।

— ধরুন ওই মেয়েটার বাবা মা তার জীবনের এই অন্ধকার অতীতটাকে ঢেকে রেখে মেয়েটাকে আপনার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আপনি একসময় জেনে গেলেন পুুরো ব্যাপারটা। তখন কি আপনি মেয়েটাকে বিয়ে করবেন?
এক মিনিট, দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট। আবির প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। কি উত্তর দেয়া উচিত? এই ঘটনায় মেয়েটার তো কোন দোষ ছিল না। সব দোষ তো ওই নিশানের।

কিন্তু তারপরেও কি এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করা যায়? যে কিনা বিয়ের আগেই ধর্ষিত হয়েছে? নাহ এমন মেয়েকে কখনোই কোন পুরুষ জীবনসঙ্গিনী হিসেবে চাইবে না। কথাটা শুনতে তেতোঁ হলেও এটাই চরম বাস্তবতা।

— নাহ আমি তখন মেয়েটাকে কখনোই বিয়ে করতাম না। এই ঘটনায় মেয়েটার কোন দোষ না থাকলেও মেয়েটাকে বিয়ে করতাম না।

— ওহ আচ্ছা। কষ্ট করে উত্তর দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আবারো কিছুক্ষন নিরবতা। নিরবতা ভাঙ্গার আগেই আকাশ ভেঙ্গে ঝুম বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। পাশেই একটা ছোট্ট চালাঘরের মত দেখা যাচ্ছে। আবির আর আদিবা দৌড় দিলো সেদিকে। চালার নিচে যেতে যেতে তারা মোটামুটি ভিজে গেল।

— আচ্ছা এবার মেয়েটার নাম বলবেন?
— ওহ হ্যা অবশ্যই। মেয়েটার নাম… আদিবা ফেরদৌস।

আদিবা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, এই বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য তাকে আকৃষ্ট করেছে, আর আবির বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে আদিবার ভাবলেশহীন চেহারার দিকে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত