আব্বু আম্মুও চমকে গেছে আঞ্জুমানের কথায়। আঞ্জুমান আমার একমাত্র ছোট বোন। তার বিয়ের কথা বার্তা পাকা হয়ে যাচ্ছে।
আব্বু আম্মু আঞ্জুমানকে ডেকে বলতেছে….
“মা’রে আমরাতো তোর বিয়ে ঠিক করতেছি, তোর কোন আপত্তি আছে?”
—ভাইয়া সবকিছু দেখছে?
—হ্যাঁ, তোর ভাই সবই দেখছে। ছেলের পরিবার, বাড়িঘড় সবই।
—ভাইয়া আমাকে নদীতে ফেলে দিলে আমি সেখানেই হাসতে হাসতে চলে যাব।
.
এই কথা শুনে আব্বু আম্মু চুপ হয়ে গেল। আমিও দুই চোখের পানি আটকিয়ে রাখতে পারিনি। তারাতারি করে আমার রুমে গিয়ে মেয়েদের মত বিলাপ করে কাঁদতেছি। আম্মু গেছে…
— বাবা তোর কি হইছে?
— কিছুনা।
— এটাতো তোর গর্ব করার কথা, তোর বোন তোকে কতটা মেনে চলে কতটা নির্ভর করে একটাবার ভেবে দেখ।
— সেজন্যইতো কাঁদি, পরের ঘরে গেলে এই মায়াটা থাকবেতো?
— পাগল ছেলে।
.
আঞ্জুমান আসছে রুমে।
— দেখিতো আম্মু, যাও তুমি এখান থেকে। ওর কান্না বের করতেছি। এই শোন ভাইয়া, আমি যেমন তোর কথায় নদীতে যাব, তেমনি আমি বললেও আমার পছন্দমত নদীরপাড়ের পেত্নীকেই তোকে বিয়ে করতে হবে।
— ইশ, যা ভাগ। জানিস আঞ্জু কেন কাঁদি?
— কেন?
— তোর জামাইর টাক মাথা, এজন্য।
— কি? তোর সাথে কথা নাই। তোর জন্য বিশ টাকা রাখছিলাম, আর পাবিনা।
— না বোন আমার দে, তোর জামাই অনেক সুন্দর।
.
.
আঞ্জু আমার মাত্র দেড় বছরের ছোট, একই সাথে বেড়ে ওঠা। আর কোন ভাইবোন না থাকায় খুঁনসুটিগুলো তার সাথেই।
সবচেয়ে বেশী করতাম, আঞ্জু সুন্দর করে চুলের বেণী করত আর আমি চুলের বেণী ধরে টান দিয়ে দৌড় দিতাম। অথচ বোনটা আমার ওর পছন্দের সবকিছু আমাকে দিয়ে দিত।
মাঝেমধ্যেই বলত, শ্রাবু ভাই আয় তোরে মাইয়া সাজাই।
ওর কাপড় পড়িয়ে আমাকে লিপস্টিক আর হাতের নখে নেলপালিশ দিয়ে দিত। মাঝেমধ্যে ভূতের মত সাজিয়ে আম্মুকে ডেকে এনে দেখাত। আম্মুও অনেক হাসত আমাদের কান্ডকারখানা দেখে।
এখনতো আমি লেখাপড়া বাদ দিয়ে সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরে বেড়াই। আব্বু আমাকে যত দিত আঞ্জুকেও তত দিত। আমার টাকাতো শেষই, আঞ্জু টাকা খরচ না করে আমাকে চুপি চুপি দিত।
আম্মু কিছু বললে বলত,” ভাই সারাদিন বাইরে ঘুরাঘুরি করে ওর টাকার দরকার বেশী, আমার টাকা আমি দেই তোমাদের কি?
সেই বোনটা যখন আজ বলল ভাই যেখানে বিয়ে দেয় সেখানেই, তখন বুকটা কেঁদে ওঠল। বোনটা কত বড় হয়ে গেছে, পরের ঘরে চলে যাবে আমাদের ছেড়ে।
.
ঢাকা দোহারে বিয়ে দিলেও আঞ্জুর স্বামি নরসিংদী ফ্লাট নিয়ে থাকে। দশ টাকা রিক্সাভাড়া হলেই যাওয়া যায়, আমি যেতামনা। খুব লজ্জা করত, মনে হত অন্যের বাড়ি যাচ্ছি। তাই আব্বু আম্মুকে বলে সপ্তাহে দুবার আমাদের বাড়ি নিয়ে আসতাম।
.
২২ শে ফেব্রুয়ারী রাতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আঞ্জুর জন্মদিন ২৪ ফেব্রুয়ারী। পকেটে মাত্র নয় টাকা আছে। আব্বু আম্মুর কাছেও বলা যাবেনা। আব্বু আম্মুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে যদি আঞ্জুর জন্মদিনের উপহার কিনতে হয় তাহলে আমি কি দিলাম???
কাউকে না জানিয়ে ২৩ শে ফেব্রুয়ারী সকালে রাজমিস্ত্রীর হেল্পারের কাজ করতে চলে গেলাম। ২০১০ সাল, ২০০ টাকা হাজিরা। হঠাৎ পরিশ্রমের কাজ করাতে শরীর খুব দুর্বল। সন্ধা রাতে ঘুমিয়ে পড়েছি। সকালে ওঠেই কেক আর গিফট কিনে আনলাম।
আঞ্জুকে ফোন দিয়ে বলেছি, এখন বাড়িতে আয়। আঞ্জু তার স্বামিকে না বলেই চলে এসেছে।
কেক কেটে খাওয়ানোর সময় আম্মু আঞ্জু আর আমি আরেক দফা কেঁদে নিলাম।
আঞ্জুর স্বামি ফোন করাতে বেশীক্ষন থাকতে পারেনি।
.
.
একদিন ফোন করে আঞ্জু বলতেছে, ভাইয়া তোমাদের জামাই আমারে মারছে।
মাথায় রক্ত ওঠে গেল। মনে হচ্ছিল তখন সামনে পেলে তার স্বামিকে খুন করতাম। কত বড় সাহস, আমার বোনের গায়ে হাত তুলেছে। রিক্সা নিয়ে ছুটে গেলাম।
আবার আরেক রিক্সায় কান্না লুকাতে লুকাতে চলে এলাম।
আঞ্জুর স্বামি আমাকে বলে দিল এটা তাদের স্বামি স্ত্রীর ব্যাপার।
কাঁদতেছি আর ভাবতেছি, একটা অধিকার কত সহজে পরিবর্তন হয়ে যায়।
পরে অবশ্য আঞ্জুর স্বামি আমার হাত ধরে ক্ষমা চেয়েছে, কিন্তু আমার কষ্ট রয়েই গেল, বিয়ে হলেই কি বোনকে পর করা যায়?
.
.
আলহামদুলিল্লাহ, আঞ্জুর এখন সুখের সংসার। তার এক মেয়ে এক ছেলে। নামগুলো আমিই রেখে দিছি, রিয়া আর রিয়াদ।
ভাগনীর আড়াই বছর বয়সে আমি দেশের বাইরে বাহরাইনে চলে আসি। ভাগিনা হওয়ার পর ভিডিও কলে দেখেছি।
দুজনই মামা মামা বলে তারাতারি দেশে যেতে বলে। আঞ্জু মাঝে মধ্যে কেঁদে দিয়ে বলে, ভাইরে তোকে অনেকদিন দেখিনা। আমার জমানো টাকাগুলো তোকে দিব, তুই আসলে সব টাকা তোর।
.
আজ ফোন করে বলেছিলাম, আঞ্জু তোর কি লাগবে বোন? আমি পাঠাব এখান থেকে।
আঞ্জু বলল, ভাই আমার কিছু লাগবেনা। তোর দিতে ইচ্ছে হলে তোর ভাগনী ভাগিনাকে দিস।
আবারও কাঁদলাম আজ।
বোনরে, তোর ছেলে মেয়েকেতো দিবই। কিন্তু তোকে যে আজো কিছুই দিতে পারলামনা। সারাজীবন তুই শুধু দিয়েই গেলি।
.
আমার মত বোন যাদের আছে, বিয়ের আগেই যা দেয়ার দিও। বোনটি পরের ঘরে গেলে কি খায় কি পড়ে কিছুই দেখা যায়না। বিয়ের আগে না বুঝলেও বোনটির বিয়ের পর বুঝবে বোন কতটা মায়া ভালবাসায় জড়ানো থাকে।
মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে থাকুক পৃথিবীর সকল ভাই বোনের ভালবাসা……