কোর্ট ম্যারেজ

কোর্ট ম্যারেজ

— শ্রাবন, তুই কই? হাবীবার বাবা মা হাবীবাকে তার নানু বাড়িতে নিয়ে গেছে, কালকে নাকি তাকে বিয়ে দিয়ে দিবে, দোস্ত কিছু একটা কর।

— তুই চিন্তা করিসনা, আমরা আসতেছি।

কথা বলছিলাম ফোনে রিয়াদের সাথে, আমার ভাল বন্ধু। হাবীবা আর রিয়াদ চার বছর ধরে দুজন দুজনকে ভালবাসে। রিয়াদ ধনীর দুলাল, চারতলা বিশিষ্ট বাড়ি ওদের। পাশের বাড়ির হাবীবাকে ভালবাসে রিয়াদ। মেয়েটা দেখতে তেমন সুন্দরনা, আর দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হাবীবা। তাই রিয়াদের বাবা মা, ভাই কেউ তাদের সম্পর্ক মেনে নিচ্ছেনা। দুদিন ধরে দুই পরিবারের কথা কাটাকাটি হচ্ছে, আজ হাবীবাকে তার নানু বাড়িতে নিয়ে গেছে, তড়িঘড়ি করে বিয়ে দেয়ার জন্য।

আমি যাচ্ছিলাম ব্রিটিস টব্যাকো কোম্পানীতে চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে। দুষ্টুর নাটাই হিসেবে খ্যাতি অর্জন করায় বাবা এখানে চাকরীর ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য পাঠিয়েছে, রিক্সা ঘুরিয়ে রিয়াদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। ফোন দিলাম আরো চার বন্ধুকে, শামীম ভাল বন্ধু। টুটুল সিনিয়র ভাই, তবে অনেক কাজে পটু, রাসেল, দিনের বেলাতেই যাকে দেখা যায়না। খোকন, সাহসী ছেলে। গরুর গোস্ত কোপায়।

অন্যেরা রং নাম্বারে মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করে, আর রং নাম্বারে পরিচিত হয়ে রিয়াদটাই আমাদের ভাল বন্ধু হয়ে গেল। রিয়াদের বাড়িও নরসিংদী, আমারও।

রিয়াদের বাড়ির কাছে ছোট বাজারের চায়ের দোকানে বসে ফোন দিলাম রিয়াদকে। “রিয়াদ, বেরিয়ে আয়। সাথে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে আসিস। বলাতো যায়না কী হয়। ”

রিয়াদ মনে করছে হাবীবাকে নিয়ে সংসার করতে টাকা পয়সা লাগতে পারে, সাথে করে চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে আসছে।

আমরা ভেলানগর বাসস্ট্যান্ট থেকে বাসে ওঠলাম। যাব হাবীবার নানুর বাড়ি, ভৈরবের কাছে নারায়নপুর। রিয়াদ আগে থেকেই সব চিনে, প্রেম করলে প্রেমিকার চৌদ্দ গোষ্টির খবর রাখতে হয়। নারায়নপুর নেমে গ্রামের ভিতর দিয়ে দুই কিলোমিটার ভিতরে গেলাম। সেখানে একটি বাজার আছে, নাম জানিনা। বিকেল তখন ৫টা।আমরা ছয়জন বাজারে গিয়ে চা খেয়ে একটি চকে খড়-কুটা বিছানো মাঠে গিয়ে বসে বুদ্ধি করতেছি কী করা যায়। হাবীবাদের বাড়ি মাঠের পরেই, তবে কয়েকটাবাড়ি ভিতরে। আর এটাই হল সমস্যা। ছয়জন ঐ বাড়িতে গেলে ডাকাত বলে যে গণপিটুনি দিবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই ভিন্ন প্রন্থায় এগুতে হবে। ওদের চারজনকে বসিয়ে রেখে আমি আর খোকন রওনা দিলাম অপারেশনের প্রথম ধাপে। ভয়ে ভয়ে এগুচ্ছি, দুইজন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে, পর্যন্ত কেউ কোন প্রশ্ন না করবে সে পর্যন্ত এগুতে থাকব। পরিকল্পনা মত এগুচ্ছি, সামনেই চোখে পড়ল দু’জন মেয়ে বসে মাছ কাটতেছে। আমাদেরকে দেখেই ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে বলতেছে,,

— কেডাগো আমনেরা কেডা?
— আপা আমরা দূর থেকে এসেছি, আমাদেরকে একটু পানি খাওয়াবেন?
— আফনেরা খাড়ান, নিয়ে আসতেছি।
একজন চলে গেল বাড়ির ভিতরে পানি আনতে। দ্বিতীয়জন বসা। আমি ঐ মেয়েকে বলতেছি,
— আপু, আপনি আমার বোনের মতন, একটা উপকার করবেন?
— কী?

— আমরা নরসিংদী থেকে এসেছি একটা মেয়ের খোঁজে, মেয়েটির নানুর বাড়ি এখানে। সে আমার বন্ধুকে ভালবাসে, অথচ তাকে জোর করে এখানে বিয়ে দেয়ার জন্য নিয়ে এসেছে। মেয়েটির নাম হাবীবা।
— ও, হাবীবাকে চিনি। আমার সাথে এখানেই একই স্কুলে পড়ত। কলেজে ভর্তির জন্য নরসিংদী চলে গেছে।
— আপু, একটু উপকার করেননা। আপনি ওদের বাড়িতে গিয়ে হাবীবাকে শুধু বলবেন, রিয়াদ আর শ্রাবন আসছে। পরে কি বলে তা আমাদের জানাবেন। আমরা ঐ মাঠে আছি।
— আচ্ছা, পানি খেয়ে যান। নয়তো ভাবী সন্দেহ করবে।

সন্ধা হয়ে গেছে, মাঠে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতেছি। অবশেষে একটা ছোট ছেলে এসে বলতেছে, শ্রাবন ভাই কে?
আপু ঐ পুকুড় পাড়ে যেতে বলছে।

তাড়াহুড়া করে গেলাম। ঐ মেয়েটি বলতেছে,
— হাবীবা আপনাদেরকে গাড়ী রেডী রাখতে বলছে, রাতে ও চলে আসবে।
— আচ্ছা আপু, আপনি কাউকে কিছু বলবেননা। একটু উপকার করবেন, ওকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবেন।
— আচ্ছা।

নরসিংদী সেবা সংঘের মোড়ের মাইক্রো স্ট্যান্ডে ফোন দিয়ে গাড়ী আসতে বলে দিয়েছি। আমরা রাতের অন্ধকারে মশার সাথে যুদ্ধ করতেছি। একেকজন পেটের ক্ষিধায় অবস্থা সিরিয়াস, দুজন বাজারে গিয়ে কোন দোকান খোলা পায়নি, গ্রামের বাজার সন্ধায়ই সব দোকান বন্ধ। গাড়ী এসে বাজারটায় অপেক্ষা করতেছে। রাত সাড়ে এগারটা বেজে গেছে, কারো আসার নাম গন্ধ নেই। আমার মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে, চার্জ নেই। প্রতিটা মিনিট একেকটা মাস মনে হচ্ছে।

রাত দেড়টায় তিনজনকে আসতে দেখলাম, অন্ধকারে বুঝার উপায় নেই ছেলে না মেয়ে। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। একটু পর হাবীবা দূর থেকে ডাকতেছে, শ্রাবন ভাই। ভিতরের ভয় কেটে গিয়ে খুশিতে মনটা ভরে ওঠল। গিয়ে দেখি ঐ মাছ কুটতেছিল সেই ভাবীটা, মেয়েটা আর হাবীবা।
তারাহুড়া করে রওনা দিলাম গাড়ীর উদ্দ্যেশ্যে।

ড্রাইবার ভয় পেয়ে গেছে, বলতেছে ভাই আপনারা মেয়ে অপহরন করে নিয়ে আসছেন, ধরা পড়লে আমি শেষ। মালিকের গাড়ী। অনেক কষ্টে বেটাকে বুঝিয়ে গাড়ীতে ওঠেই গাড়ী টান।

নরসিংদী পৌছে রাত তিনটায় হাবীবাকে এক পরিচিত ভাবীর বাড়িতে ঘুমোতে দিয়েছি। রিয়াদকে নিয়ে এসেছি আমার বাড়িতে, বাকিদেরও সকালে আসার কথা বলে বিদায় দিলাম।

রিয়াদ আর হাবীবা দুজনই প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়ায় কোর্ট ম্যারেজ করাতে কোন সমস্যা হয়নি, তার পরেও কাজী দিয়ে আরেকবার বিয়ে পড়িয়েছি। আমাদের এলাকায় রুম ভাড়া করে কাপড় চোপড় হাড়ি পাতিল কিনে ওদের সংসার গুছিয়ে দিলাম। এবার তাহলে মোবাইলটা চালু করা যাক। ৫ মিনিট পরে রিয়াদের আম্মুর ফোন…

— শ্রাবন রিয়াদ কই?
— রিয়াদ কই মানে? কি হয়েছে আন্টি?
— সত্যি করে বলো তুমি কিছু জানোনা?
— না আন্টি, আমি মাত্র ঘুম থেকে ওঠলাম। আমার আম্মুর সাথে কথা বলে দেখুন। রিয়াদের কি হয়েছে আন্টি?
— রিয়াদ বাড়িতে নাই, ঐদিকে হাবীবার বাবা মা ফোন দিয়ে বলতেছে হাবীবাকেও পাওয়া যাচ্ছেনা। রিয়াদেরও ফোনও বন্ধ।

— কি বলতেছেন আন্টি? আচ্ছা আমি বন্ধু বান্ধব নিয়ে খোজ খবর নিয়ে দেখি। আপনি চিন্তা করিয়েননা আন্টি।
— বাবা, তাড়াতাড়ি দেখো। মান সম্মান বাঁচাতে হবে, হাবীবার বাবা মা আমাদের বাড়িতে আসতেছে, গাড়ীতে আছে।
— আচ্ছা আন্টি দেখতেছি।

ভাবতেছি নতুন কি বুদ্ধি বের করা যায়। দুই ঘন্টা পরে আমি আন্টিকে ফোন দিলাম।

— আন্টি, রিয়াদ ফোন দিয়েছিল। রিয়াদ আর হাবীবা বিয়ে করে ফেলেছে, তাও আবার কোর্ট ম্যারেজ করে। আপনারা মেনে না নিলে নাকি আর কোনদিন বাড়ি ফিরবেনা।

— ( কিছুক্ষন চুপ থেকে) বাবা জানো রিয়াদটাকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন ছিল।
— আন্টি, থাক। ছোটরাইতো ভুল করবে, আর বড়রা ক্ষমা করবেন।
— আচ্ছা, ওদের তাড়াতাড়ি আসতে বলো, আমি হাবীবার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতেছি।

একটাদিনও রুমে থাকতে পারলনা। একমাসের রুমভাড়া পরিশোধ করে রিয়াদ আর হাবীবাকে সাথে নিয়ে রিয়াদদের বাড়ি গেলাম। বাড়ি ভর্তি মানুষ। আমাদের দেখে সবাই চুপ, কেউ কোন কথা বলেনা। রিয়াদকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি আন্টি আঙ্কেলের পায়ে ধরে বসে থাক। হাবীবা আর রিয়ার গিয়ে ক্ষমা চাইতেছে। আন্টি কান্না করতেছে, বলতেছে যা এবারের মত মাফ করে দিলাম।

মনে মনে বলতেছি, আন্টি আর ভুল করবেনা, কাজতো সেরেই ফেলছে। আমিও গিয়ে বলতেছি, আন্টি আমাকেও মাফ করে দিয়েন।

— তোমাকে মাফ করব মানে?
— না, আমিওতো আপনার ছেলের মতই, তাই আরকি। (মনে মনে বলতেছি, আন্টিগো এই কার্যকলাপের শয়তানের নাটাইটাও আমি নিজেই)

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত