তন্বীর দিকে তাকিয়ে

তন্বীর দিকে তাকিয়ে

সামনের ক্যানভাসটার দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে আছে তন্বী। মুখে কিছুটা বিরক্তির ছাপ। চোখের নিচের রংটা কিছুতেই ঠিক মতো দিতে পারছে না। বারবার কেমন কালো কালো হয়ে যাচ্ছে। শান্ত যখন কাজ করতে করতে ঘুমাতে ভুলে যায়, তখন ওর চোখের নিচে এমন কালি পড়ে। ছেলেমানুষী মুখটাতে কেমন একটা বয়ষ্ক ভাব এসে যায়। তন্বীর ইচ্ছে করে বকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কিন্তু কোনোভাবেই শান্তর উপর রাগ করতে পারে না। চোখের দিকে তাকালেই আর রাগ ধরে রাখা যায় না।

অনেকগুলো পেইন্টিং ছড়ানো চারপাশে। বেশিরভাগ তেল রঙের। কিছু জল রঙ। সারাদিন বাসায় একা একা থেকে পেইন্টিং করে তন্বী। বেশিরভাগ সময় কাটে বাসার ভেতর এই ছোট্ট স্টুডিওটাতেই। মানুষের ছবি কখনোই ভালো আঁকতে পারে না। তারপরও ভেবেছিলো শান্তকে আজকে ছবিটা উপহার দিবে। কিন্তু চোখের নিচের রংটা কোনোভাবেই ঠিক করতে পারছে না। মুখ দিয়ে বিরক্তির একটা শব্দ করে উঠে দাড়ালো। এক কাপ চা বানিয়ে আনবে। চা খেয়ে শুরু করলো আবার।

সারাদিন চেষ্টা করেও ছবিটা কোনোভাবেই ঠিক করতে পারলো না। শান্তকে বলেছিলো আজ একটু তাড়াতাড়ি আসতে। কিন্তু শান্ত এলো রাত নয়টায়। ক্যানভাসটাকে খালি ক্যানভাসগুলোর আড়ালে লুকিয়ে রেখে দরজা খুলে দিলো। ও চায় না ছবিটা শেষ করার আগে শান্ত দেখুক। এমনিতে শান্ত অবশ্য তন্বীর স্টুডিওতে ঢোকেনা। কিংবা বলা যায় ঢোকার সময় পায়না। তবুও ছবিটা কোনোভাবেই শান্তকে দেখতে দিতে চায় না ও।

দরজা খুলে হাতে কিছু একটা দেখবে ভেবেছিলো। কিন্তু শান্ত এসেছে খালি হাতে। তন্বীর দিকে তাকিয়ে দায়সারা একটা হাসি দেয়ার চেষ্টা করলো। কাপড় চেঞ্জ না করেই হাতের কাগজগুলো নিয়ে আবার বাসার ল্যাবে ঢুকে গেলো।

তন্বীর মাথার ভেতরটা ফাকা লাগতে শুরু করলো হঠাৎ মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়। এই শান্তকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো সে। অথচ আজ তাদের প্রথম এনিভার্সারীটাও শান্তর মনে নেই। প্রচন্ড অভিমানে চোখে পানি চলে আসে ওর। আটকানোর চেষ্টাও করছে না। ভেতরের সমস্ত কষ্টগুলো বাষ্পের মতো চোখে এসে জমা হচ্ছে। অঝোর ধারায় ঝরে পড়ছে গাল বেয়ে। আবার স্টুডিওতে ঢুকলো। সাদা ক্যানভাসগুলোর আড়াল থেকে টেনে বের করলো শান্তর ছবিটা।ছেলেমানুষী মুখটার দিকে তাকিয়ে আরো খারাপ লাগছে। ক্যানভাসটা স্ট্যান্ডে বসিয়ে আবার রঙ গুলে নিলো। কিন্তু তুলি দিয়ে কিছুতেই কিছু করতে পারছে না। চোখ দুটো বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। ক্যানভাসটা একটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখে উঠে গেলো।

মন খারাপ হলেই গোসল করে তন্বী। অনেকক্ষন ধরে ঠান্ডা পানির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। আজকেও দাঁড়িয়ে আছে। ঝর্ণার অবিরাম জলধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওকে। চোখ থেকেও অবিরাম ধারায় গড়াচ্ছে অশ্রু। ঝর্ণার পানি ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে অশ্রুগুলোকে। মিশে গিয়ে এক হয়ে যাচ্ছে। আলাদা করে কারো কোনো অস্তিত্ব নেই। আবার কাউকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। হারিয়ে যাচ্ছে অশ্রুগুলো। যেমন করে তন্বী হারিয়ে গিয়েছিলো শান্তর মাঝে। নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলো। অথচ সেই শান্ত আজ তন্বীর চোখে জল মুছে দেয়ার জন্য কাছে নেই। কত কাছে অথচ কত দূরে। ও এখানে দাঁড়িয়ে ভিজছে , শান্ত হয়তো ল্যাবে বসে নোট নিচ্ছে। অথচ এই শান্তই একসময় বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ভিজেছে ওকে নিয়ে। একবার। বারবার। অনেকবার। অসংখ্যবার। মনে হতে তন্বীর কেমন যেন আবার কান্না পাচ্ছে। ভেজা চোখদুটো ভিজে যাচ্ছে আবার।

শাওয়ার শেষ করে আবার কিচেনে এসে ঢুকলো ও। আধভেজা চুল বেয়ে তখনো ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে পানি। অনেকপক্ষণ কাঁদার সুফল হিসেবে লাল হয়ে আছে চোখ দুটো। পানি গরম হতে দিয়ে চা পাতার কৌটার দিকে হাত বাড়ালো।জায়গামতো নেই। যাবে কোথায়? বাসায় তো কেউ নেই। শান্ত তো চা খায় না। আর কোনোবভাবে যদি খেতে ইচ্ছে হয়ও, শান্ত কিচেনে এসে চা বানিয়ে নেবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। দুপুরে কোথায় রেখেছিলো মনে করার চেষ্টা করলো। জায়গামতোই তো রেঝেছিলো।

শেষমেষ পেলো কোটাটা। চুলার দিকে তাকিয়েই একহাতে। চামিচ দিয়ে পাতা নিতে গিয়ে কেমন যেনো ঠেকলো। তাকিয়ে দেখে ভেতরে একটা কাগজ। দলা পাকানো। এটা এখানে কোত্থেকে এলো? মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে শান্তর ল্যাব নোটের একটা ছেঁড়া অংশ। দলা পাকিয়ে চা পাতার কোটার ভেতর ঢুকানো। শান্তর সেই বিশ্রী প্যাঁচানো হাতের লেখা দেখা যাচ্ছে।

ফেলে দিতে গিয়েও কি মনে করে খুলে দেখলো। শান্তর লেখাই। পরিষ্কার করে বোঝার কোনো উপায় নেই। আবার দলা পাকাতে গিয়ে একটা শব্দে চোখ আটকে গেলো। “পাগলী”। শান্ত আদর করে তন্বীকে মাঝে মাঝে পাগলী বলে ডাকতো। অনেকদিন এই নামে ডাকেনা। খুলে পড়তে শুরু করলো। পড়তে রীতিমতো কষ্ট হয়। তারপরও বিশ্রী লেখাগুলো পড়তে শুরু করলো।

হইছে পাগলী। এখন রাত দুপুরে আর একা একা চা খাওয়া লাগবে না। দুই কাপ কফি বানিয়ে ল্যাবে নিয়ে এসো। একসাথে খাবো।

পুনশ্চ ১ : গিফট আনতে মনে নেই।

পুনশচ ২ : ছবিটা একদম ভালো হয়নি। আমার চোখের নিচে মোটেও আলকাতরা গোলানো রঙ না।

পুনশ্চ ৩ : একটা নীল পাড় সাদা শাড়ি পরে আসতে পারবে? অনেকদিন তো সাজতে দেখিনা। আজকে একটু সাজো প্লিজ

পুনশ্চ ৪ : হাতের লেখা দিনদিন আরো খারাপ হচ্ছে। কি করা যায় বলো তো?

পুনশচ ৫ : একেবারে ভূলে যাবো ভাবলে কি করে? ভালোবাসি তো।

এক হাতে চিঠিটা ধরে রেখেই কাঁপা কাঁপা আরেক হাতে কফির পটটা খুঁজতে শুরু করলো তন্বী। চোখ দুটো ভিজে আসছে আবার।

♥বেচে থাকুক এমন সত্যিকারের ভালোবাসা♥

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত