চাপা গুনগুন, হাসি, মেটালিক আওয়াজ বাইরে থেকেই শুনতে পাচ্ছে দিশা। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই রাতের সশব্দ মৌতাত হুড়মুড়িয়ে গায়ে এসে পড়ল, সাথে জোরালো ফ্লোর লাইট, ডিজের ননস্টপ হিটস।
সাবিয়া হাত ধরে চাপা টান দিল, “চল!”
রোমি হাত নাড়ল পাঁচ জনের ছোটখাটো ভীড় থেকে। দিশার কপালে হাল্কা ঘাম। সাবিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। দিশা পিছিয়ে পড়ছে।
প্রায় সবাই নতুন মুখ। তিন বছর থাকার পরেও কলেজের দেওয়াল, ঘর, করিডোর যত আপন হয়েছে, ছেলেমেয়েগুলো নয়। দিশা হোস্টেলেও ঘর সাজিয়েছে একাকীত্ব দিয়ে। মনের কোথাও একটা পাহাড় জমে উঠেছিল কোন ছোটবেলা থেকে, সেটা ডিঙিয়ে যাবার কথা ভাবেও নি কখনও।
পাতলা কাঁচের গ্লাসটার গোল বৃত্ততে আঙ্গুল চালাচ্ছে ঋষি। ওয়াইনের মখমলী রঙটা আবেশ ধরাচ্ছে চোখে। একটা ঘোর সারা শরীরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বুদবুদের মতো। একটা ভালোলাগার পালতোলা নৌকা নীলজলে ভেসে যাচ্ছে একভাবে, যাকে বলে স্মুদ সেইলিং। ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল ঋষির। দিশা, সাবিয়া, রোমি এগিয়ে আসছে এদিকেই।
লম্বা ফ্লোয়িং ড্রেসটা সাবিয়ার, দিশা কিছুতেই পড়তে চাইছিল না, জোর করে পড়িয়ে ছেড়েছে। এসব পড়ার অভ্যাস নেই। অস্বস্তিতে মরে যাচ্ছে দিশা। আবার ঋষির চোখের চাহনি পড়ে লজ্জাও লাগছে খুব। কোনও ছেলের চোখে নিজেকে মোহময়ী দেখার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। এই প্রথম দিশার ভিতরে একটা ভালোলাগা তোলপাড় হচ্ছে। সাবিয়ার কাঁধটা ধরে নিজেকে আড়াল করল একটু দিশা।
চুরি করে একটু দেখতে গিয়ে ঋষির সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল দিশার। কান গরম হয়ে গেল সাথে সাথে। সাবিয়া আর রোমি বকেই যাচ্ছে এর ওর সাথে। দিশার কানে যাচ্ছে না কিছুই।
গত সপ্তাহে আবিষ্কার করেছে যেন ঋষি, দিশাকে। এতদিন কলেজে থেকে চোখে পড়ে নি। একদিন শেষ বিকেলের নরম আলোয় লেকের ধারে কাঠের বেঞ্চে একা দেখেছিল উদাস দিশাকে। কোলে একটা বই নিয়ে গালে হাত দিয়ে দূরে তাকিয়েছিল। কি যেন একটা হয়ে গিয়েছিল মনের মধ্যে ঋষির সেদিন। মনে হয়েছিল, এইই সেই মেয়ে। তারপর থেকে কথা বলার চেষ্টা করেছে কয়েকবার। পারে নি। শুধু চোখাচোখি হয়েছে অনেকবার। মেয়েরা বুঝে যায় চট করে। দিশাও পড়তে পেরেছে নিশ্চয়ই তার চোখের কথা।
ফ্লোরের লাইটস ডিম হয়ে গেছে, ডিজে এখন স্লো রোম্যান্টিক নাম্বারস শুরু করেছে। একে একে হাত ধরাধরি করে জোড়ায় জোড়ায় নাচের জায়গায় তাল মেলাতে শুরু করেছে ছেলেমেয়েরা। দিশা হটাৎই টের পেল, সে একা। সাবিয়া আর রোমি নেই আশেপাশে কোথাও। আর যে ভয়টা পাচ্ছিল, তাইই হল। ঋষি এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল, মে আই?
না, নাচতে পারবে না দিশা, কিছুতেই না। কিন্তু ঋষিকে না বলার ক্ষমতা তার নেই। ভীষণভাবে চাইছে তার সারা শরীর ঋষির সাথে তালে তাল মিলিয়ে ভাসিয়ে দিতে নিজেকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাঁহাতটা বাড়িয়ে দিল দিশা।
নিস্পলক চাহনিতে চোখে চোখ রেখে কত কথা, আকুতি বিনিময় হচ্ছে ঝরণার মতো। যেন কোনও বিরাম নেই এর। এভাবেই ঘন হয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় এক শতাব্দী। ভয়টা কোন ফাঁকে পালিয়ে গেছে দিশার খেয়াল নেই।
খুব ধীরে দিশার বাঁহাতে নিজের আঙ্গুল জড়ালো ঋষি। তারপর কোমর জড়িয়ে টেনে নিল আরও কাছে। এত কাছে যাতে নিঃশ্বাসের শব্দ, হৃদয়ের শব্দ – সব শোনা যায় পরিষ্কার। সময় থেমেছিল অনেকক্ষণ। আসলে মুচকি হেসে আঘাতের জন্য ঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিল মহাকাল।
দিশার ডান হাতটা একসময় ধরল ঋষি। বাঁহাতটা ছিল নরম পেলব, অথচ ডান হাতটা এরকম শক্ত কেন? ঋষি অল্প আলোতে হাতটা সামনে তুলে দেখতে যাচ্ছিল, দিশা যেন হুঁশ ফিরে পেল, ফিরে পেল নিজেকে। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গেল দরজার দিকে।
হতভম্ব ঋষির হাতে ধরা রয়ে গেল কিছু একটা। দরজা থেকে চোখ ফিরিয়ে হাতের দিকে দেখতেই শিউরে উঠল ঋষি। একটা প্রস্থেটিক হাত, কবজি অবধি। আতঙ্কে একটা চিৎকার বেরোল ঋষির মুখ দিয়ে, গোঙানির মতো শব্দে।
বাইরে অন্ধকারে নিজের হাতে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তখন দিশা, আর ফিরে ফিরে দেখছিল শূন্য দরজার দিকে।