খুনসুটি

খুনসুটি

– আমার চুল ছাড়, তা না হলে বেশী ভাল হবে না বলছি।
– আগে আমার নাক ছাড়, না ছাড়লে আমিও ছাড়ব না বলছি।
.
– তুই এমন শয়তান ক্যারে? নিজের বোনের সাথে কেউ এমন করে?
– তুই এমন ডাইনি ক্যারে? নিজের ভায়ের সাথেও কেউ এমন করে?
.
– কিহ! আমি ডাইনি? আম্মা শুনে যাও তোমার ছেলে কি বলে।
– হ্যা, তুই ‌ডাইনিই তো।ডাইনি না হলে কেউ শরীর থেকে রক্ত বের করে?
– বেশ করেছি।আমাকে ডাইনি বলছিলি ক্যারে?
.
– তুইও তো আমাকে শয়তান বললি; তাই বলে আমি তোকে কিছু করেছি?
– তুই তো এখনও চুলটা ছাড়লি না।আবার বলিস কিছু করিস নি?
– ঠিক আছে ক্ষমা করে দে! তোকে আর কখনও বিরক্ত করব না, জ্বালাব না, মারব না।
.
কথাটা মাওয়ার মনে ধাক্কা লাগে।মনে খুব কষ্ট পায়।তার ভাইয়া এতো কষ্ট পাবে বুঝতে পারেনি।

এখন তার কি করা উচিৎ? ভাবতে পারছে না।তাওহীদ মন খারাপ করে ছাদ থেকে চলে যায়।

আর মাওয়া! বিষন্ন মনে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে।

রাতের আকাশে চাঁদের সাথে তাঁরারা খেলা করছে।তাওহীদ চাঁদ ও তাঁরারার খেলা দেখছে।

আর চুরি করে আনা বোনের আচার আপন মনে খেয়ে যাচ্ছে।মনে মনে বলে, আহ কি শান্তি কি শান্তি।

বোনের আচার চুরি করে খাওয়া মজাই আদালা।
.
পাশের ফ্ল্যাট থেকে ফারাহ এই দৃশ্যটা দেখে রাগতে থাকে আর জ্বলতে থাকে।মনে মনে বলে, বদ ছেলে, বজ্জাদ ছেলে, খারাপ ছেলে।

আমাকে কষ্ট দিয়ে কি মজা পায় সে? বিকাল থেকে এখন পর্যন্ত ফোনটা একবারও ধরল না, একটা মেসেজেরও রিল্পে দিল না।

আমাকে কষ্ট দিয়ে অশান্তিতে রেখে নিজে শান্তিতে আকাশ দেখছে আর আচার খাচ্ছে! রাখো ভাল করে আচার খাওয়াচ্ছি।
.
– আম্মা ভাইয়া কোথায়? ভাইয়াকে দেখছি না যে!
– কেন? সন্ধার পর থেকে কি ঝগড়া করা হয়নি? আবার ঝগড়া করার জন্য মনটা আনচান করছে?
– উফ! বেশী কথা বলো না তো, বলবে ভাইয়া কোথায় গেছে?
– আমি জানি না।পারলে নিজে খুঁজে নে।
.
আবার মনটা খারাপ হয়ে যায়।সন্ধার পর থেকে একবারও ভাইকে দেখতে পায়নি।অনেক খুঁজেছে, তবুও পায়নি।

দিন-রাত যাই কিছু করুক না কেন।ভাই-বোন এক সূত্রে আবদ্ধ হবেই।খোঁজতে খোঁজতে ছাদে যায়।

সে দেখে, তার ভাই আকাশে দিকে তাকিয়ে আছে।তার মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে।
.
কিন্তু ওর আচার চুরি করে মনের আনন্দে যে খাচ্ছে, তা তো সে জানে না।

মাওয়া কিছু বলতে যাবে এমন সময় তাওহীদ বলে, বোনের হাতের আচার চুরি করে খাওয়া মজাই আলাদা।

মাওয়া যে মুখ হা করেছিল এভাবেই আছে।ভায়ের প্রতি রাগতে থাকে আর ফুলতে থাকে।

তার এখন মনটা চাচ্ছে ভাইকে ধরে একটা আছার দিতে।

ফারাহ মুখ ফুলিয়ে নাক টেনে টেনে মনে নানা রকমের প্লেন করে মাওয়াদের বাসায় আসে।

এসে দেখে, তার আন্টি বেডরুমে বসে খবর শোনছে।

নরম সুরে ফারাহ বলে…..
.
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি ভালো আছেন?
– ওলাইকুম আসসালাম হ্যা মা ভালো আছি তুমি ভালো আছো?
– হ্যা আন্টি আমি ভালো আছি।আন্টি মাওয়া কোথায়?
– রুমে দেখো।যদি না পাও তাহলে ছাদে যাও ঐখানে পাবে?

বাঘিনীর মতো হংকার দেয়।
– ভাইয়ায়ায়া—-
তাওহীদ ভয়ে চুপসে যায়।মনে মনে বলে, ইয়া আল্লাহ রক্ষা করো মুরে।অবুঝ শিশুর মতো বলে
– কি হয়েছে আপু? এভাবে ভয় দেখাচ্ছ কেন আমাকে? কি করেছি আমি?(এমন ভাবে বলল সে যেন কিছুই করেনি)
.
ফারাহ রুমে না পেয়ে ছাদে আসে।এসে দেখে, ভাই-বোন ঝগড়ায় মেতে আছে।

সে যে তাওহীদের সাথে ঝগড়া করতে এসেছিল সেটা ভুলে যায়।সে দাঁড়িয়ে তাদের ঝগড়া উপভোগ করতে থাকে।
.
– বাহ বাহ ভালোই ভাব ধরতে জানো।আমার সব আচার খেয়ে এখন বলছ কি করেছি আমি? ভালো মানুষ সাজার নাটক করছ না?
– কিহ আচার! আমি আচার খেয়েছি? কখন?
তাওহীদের এমন ডাহা মিথ্যা কথা শুনে ফারাহ বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে।
.
– একদম মিথ্যা কথা বলবে না, মিথ্যা কথা বলা আমি পছন্দ করি না।
কান্না সুরে বলে
– কিহ! আমি মিথ্যা কথা বলছি? আম্মা দেখে যাও তোমার মেয়ে আমাকে মিথ্যাবাদী বলছে।
.
– মিথ্যা কথাটাও তো ঠিক করে বলতে পারো না।নিচে বড়ইয়ের বিচির বাগান বানালে।

আবার আমার সাথে অনরগল মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছ এভাবে?
তাওহীদ অপরাধী ভাব নিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকে।
.
তাওহীদের এই রুপ দেখে ফারাহ হা করে তাকিয়ে থাকে।তাওহীদের এই রুপটা ফারাহর জানা ছিল না।

ওর এমন অবস্থা দেখে তার মুখে হাসি চলে আসে।
.
– আমার সাথে এমনটা করলে কেন?
– ——–
– চুপ করে থেকো না, আমার কথার উত্তর দাও।
– ———
– আচ্ছা ঠিক আছে কিছু বলতে হবে না, শুধু আমাকে স্যরি বলো তাহলেই চলবে।
.
– কেন আমি কি করেছি? আমি বলতে পারব না।
– না বললে, বেশী ভালো হবে না কিন্তু!
– না বললে কি করবি তুই?
ফারাহ দেখে, বিষয়টা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে।তাই থামাতে এগিয়ে আসে।
.
– স্যরি বলো বলছি।
– না, বলব না।তোর যা ইচ্ছা কর
– স্যরি বলো বলছিছিছি—–
– ঠাসসসসস(রাগে থাপ্পড় মারে)
.
ফারাহ গালে হাত রেখে অবুঝ বাচ্চার মতো তাকিয়ে আছে আর চোখের পানি ফেলছে।

আর তাওহীদ! অপরাধী লুক নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।সে নরম সুরে বলে….
.
– এটা কি হলো? মারলাম মাওয়াকে লাগল তোমার গালে! কিন্তু কিভাবে?
.
পাশে তাকিয়ে দেখে, মাওয়া ছাদের মেঝেতে পড়ে আছে।অবুঝ শিশুর মতো একবার ফারাহর দিকে, একবার মাওয়ার দিকে তাকাচ্ছে।

এখন সে কি করবে? বুঝতে পারছে না।
– ভাইয়া! এই তুমি কি করলে? তুমি তোমার হবু বউকে মারলে?
.
তাওহীদ অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে।ফারাহ কান্না ভেজা চোখে রাগী লুক নিয়ে তাওহীদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তাওহীদ ভয়ে কাচুমুচু হয়ে যায়।
.
– ফারাহ! এভাবে তাকিয়ে থেকো না, বিশ্বাস করো আমি মাওয়াকে মেরেছিলাম।কিন্তু তোমার গালে কিভাবে লাগলো?

কি থেকে কি হয়ে গেল আমি বুঝতে পারলাম না।
.
মাওয়া চিৎকার দিয়ে তাওহীদকে বলে
– তুমি আর কোনো কথা বলো না।এমনেতেই এক অপরাধ করে বসে আছো।আবার আরেকটা করলে, তোমার কোনো ক্ষমা নেই।
বিষন্ন মনে তিনজন তিন দিকে তাকিয়ে থাকে।তাওহীদ চিন্তা করছে কিভাবে কি করবে।

আস্তে আস্তে বোনের কাছে যায়।তাওহীদকে দেখে মাওয়া অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
– আপু! এই আপু! এই যে দেখো কান ধরেছি ক্ষমা করে দাও।
– ——–
– জানোই তো ভাইটা কিছু বোঝে না।কখন কি বলে ফেলে, কখন কি করে ফেলে।সে নিজেই জানে না।
– ——–
.
ফারাহ আড় চোখে ভাই-বোনের মান-অভিমান দেখছে, আর কান পেতে তাদের কথা শোনছে।
– এই আপু! চুপ করে থেকো না, ভাইটা এতো করে বলছে ক্ষমা করে দাও না! ভাইটা তো বলছে আর কখনও এমন করবে না।
– ———
– আপু! তুমি চুপ করেই থাকবে? ও আমি তো ভালো না, আমি তো খারাপ।তাই আমাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না।

আচ্ছা ক্ষমা করতে হবে না।আমার মতো ভায়ের বাঁচার কোনো অধিকার নেই।আমি মরলেই ভালো।

তাতে অন্তত একটা বোন শান্তিতে থাকতে পারবে।
.
কথাটা শুনে মাওয়া কেঁদে ফেলে।
– মরার কথা কখনও বলবে না, কে বলছে তুমি ভালো না? কে বলছে তুমি খারাপ?

তুমি আমার সব থেকে ভালো ভাইয়া।তোমার থেকে ভালো ভাইয়া কেউ হতে পারবে না।
.
– তাহলে ভাইয়াটাকে এভাবে কষ্ট দিলে কেন?
– ভাইয়াটাও বোনটাকে এভাবে কষ্ট দিল কেন?
চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে
– আর কখনও কষ্ট দিবে না, এই যে প্রমিস করছে।
ভায়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে
– বোনও আর কখনও কষ্ট দিবে না, প্রমিস করছে।
.
ফারাহর চোখে পানি এসে যায়।মনে মনে বলে, যদি আমারও একটা ভাই থাকতো! তাহলে মনে হয় এভাবেই আমার রাগ-অভিমান ভাংগাতো।
.
– এখন বোনের রাগ অভিমান ছাড় হবু বোউয়ের রাগ-অভিমান ধরো।যাও গিয়ে তার রাগটা ভাংগাও।আমি রুম থেকে একটু আসছি।

ফারাহর পাশে এসে দাঁড়ায়।তাকে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
– ফারাহ জানি আমার এই অন্যায়ের ক্ষমা নেই।তবুও এই বদ ছেলেটাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না?
– ——-
– এই ফারাহ! আল্লাহ তো মানুষকে একটা সুযোগ দেয়।তুমি আমাকে একটা সুযোগ দেও না!

তুমি দেখো কখনও তোমার কথা অমান্য করব না।কখনও তোমার মনে আঘাত দিব না।
– ———-
.
ফারাহকে তার দিকে ফিরায়।তাওহীদ দেখে, ভেজা চোখ ও গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে।তার হৃদয়টা হু হু করে কেঁদে ওঠে।
.
– ঠিক আছে।আমাকে আর কখনও তোমার ক্ষমা করতে হবে না।আমি মরে গেলেই ভালো।

তাহলে তোমাকে কেউ বিরক্ত করতে আসবে না।তোমাকে কেউ জ্বালাতে আসবে না।
.
– মরলে মরেন কার কি? কিন্তু মরার আগে আরেকটা মেয়েকে খুন করে মরবেন।
কথাটা বলে কান্না করতে থাকে।চোখের পানি মুছে তাওহীদ বলে
.
– অবুঝ মেয়ে এভাবে কেউ কান্না করে? তুমি কান্না করলে জানো না আমার বুকে কষ্ট বাড়ে।আর একদিন তো মরতেই হবে।
.
– আর একবার মরার কথা বললে! প্রথমে আপনাকে খুন করব তারপর নিজেকে খুন করব।বুঝছেন? কখনও এসব কথা বলবেন না।
.
– ভালোবাসি খুব ভালোবাসি।ভালোবাসি ছাড়া তোমাকে আর কিছু বলব না আমি।
.
ফারাহ হৃদয়ের মাঝে অন্যরকম এক শান্তি অনুভব করে।
– সে চোখের পলক ফেলে ফেলে তাওহীদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাগ-অভিমান ভুলে দু’জন দুজনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ আইসক্রীমের কথা মনে হতেই; তাওহীদ আইসক্রীম খোঁজতে থাকে।
– কি খোঁজছেন?
– আইসক্রীমের বক্স।মনে হচ্ছে সব আইসক্রীম গলে গেছে।
– কিহ! আইসক্রীমের বক্স? কার জন্য কিনেছিলেন?
.
– হ্যা, আইসক্রীমের বক্স।আচার চুরি করে আনার সময় মাওয়ার জন্য দুইটা আইসক্রীমের বক্স কিনেছিলাম।
– কিন্তু আচারের সাথে আইসক্রীমের কি সম্পর্ক?
.
– আমি জানতাম মাওয়া টের পেয়ে যাবে এবং রেগে যাবে।কিন্তু তার রাগ যতই থাকুক না কেন!

আইসক্রীম দেখলে, তার রাগ আইসক্রীমের মতো গলে পানি হয়ে যায়।
.
– বোনকে এতো ভালোবাসেন তাহলে মারতে গিয়েছিলেন কেন?
– কি করব বল! রাগ উঠলে নিজেকে সামলাতে পারি না।
.
– আচ্ছা বিকাল থেকে আমার ফোন ধরেননি; মেসেজের রিল্পে দেননি।আমি কি কারণটা জানতে পারি?
– এমনেতেই মনটা ভালো ছিল না।তাই ইচ্ছা হয়নি।
.
– মানুষে বলে, আপন মানুষদের সাথে কথা বললে মন ভাল হয়ে পরে।আর আপনি? যান আপনার সাথে কোনো কথা নেই।
.
– ঠিক আছে কথা বলো না।আইসক্রীম খেয়ে রাগ-অভিমান পানি না করে থেকো না।
.
মাওয়া ছাদে এই দৃশ্য দেখে, সে বলে
– হবু বউকে পেয়ে বোনকে ভুলে গেলে? আবার হবু বউকে আদর করে আইসক্রীম খাওয়ানো হচ্ছে!

ভালই তো, আমি এসে মনে হয় বিরক্ত করলাম? আমি বরং চলে যায়।
.
ফারাহ নিজের অভিমান ছেড়ে হবু ননদের রাগ ভাংগাতে এগিয়ে আসে।
– হবু ননদীনি গাল ফুলিয়ে চলে গেলে অনেক কিছু মিস করবে।রাগ-অভিমান রেখে চলো আইসক্রীম খাবে।
.
– না আমার আইসক্রীমের দরকার নেই।আমি কি আইসক্রীম পছন্দ করি? আমি তো আইসক্রীম ঘৃণা করি।আমার আইসক্রীম খেতে হবে না।
.
– একদম চুপ আর কোনো কথা শোনতে চাই না।কে আইসক্রীম পছন্দ করে, কে আইসক্রীম ঘৃণা করে আমার জানা আছে।

এখন লক্ষী মেয়ের মতো হা করো।আমি আইসক্রীম খাইয়ে দিচ্ছি।
.
তাওহীদ দূর থেকে তাদের আদর-ভালোবাসা দেখতে থাকে।মনের আনন্দে তার চোখের কোণে পানি চলে আসে।
– দু’জনেই খেয়ে যাবে? আমি কি খেতে পাবো না?
– তোমার খেতে হবে না, আমাদের খাওয়া তাকিয়ে দেখো আর পেট বড়।
অভিমান করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে তাওহীদ বলে
.
– ঠিক আছে।আমার খেতে হবে না।আমি খেলেই কি না খেলেই কি কারো তো কিছু আসে যায় না।
– ওলে বাবালে বাবা! এতো রাগ কইত্তে আসে? হা করেন আমরা খাইয়ে দিচ্ছি।
.
তারা একে অপরকে খাইয়ে দিতে থাকে রাগ-অভিমান ও খুনসুটি চলতে থাকে।

সময় যেতে থাকে তাদের হৃদয়ের মাঝে ভালোবাসার গভীরতা বাড়তে থাকে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত