-ধুর অপয়াটা আবার বিয়ে ভেঙ্গে দিছে।
-বেশ্যাগিরি করলে এমনই হবে।
-পতিতালয়ে দিয়ে দেয়া উচিৎ এক পোলার লগে তো পলাইছিলই!না জানি কি কি নষ্টামি কইরা আইছে!
-মাইয়া ভালা হইলে পোলারা এমনিতেই বিয়া কইরা নিতো।লুইচ্চামি করলে কেউ রাজি হবে নাকি!
-লজ্জা থাকলে এতোদিন মইরা যাইতো!
বাজার থেকে গোছল করার জন্য শ্যাম্পু আনতে যেয়ে একটা চায়ের দোকানে কথাগুলো শুনলাম।বুঝলেন না তো?একটু পরেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে!
কথাগুলো বলেছিলো আমার চাচাতো বোন মনিকে নিয়ে।আজকেও একটা বিয়ে ভেঙ্গে দিছে।একজনের থেকে আরেকজন এভাবে নেটওয়ার্ক বিজনেসের মতো যেকোনো ঘটনাই পুরো সমাজ জেনে যায় আর তারপরই চায়ের দোকানে,বাড়ির উঠোনে শুরু হয় সমালোচনা।তুমি যতই নিখুঁত হও এই সমাজ খুঁত ধরবেই।ঠিক যেমন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লকারের সোনা হঠাৎ করে তামা হয়ে যাওয়ার মতো।
আর মনি বেচারির কি দোষ বর পক্ষ মোটা টাকার যৌতুক ছাড়া বিয়ে করতে চায় না।একটাই কারণ একবার একটা ছেলের সাথে পালাইয়া গেছিলো বাড়ি থেকে।যদিও ছেলে ফিজিক্যালি কিছু করে নি কিন্তু মনি বাড়ি থেকে যা যা নিয়েছে সব নিয়ে ভাগছে।আর এগুলা নেওয়ার জন্যই হয়তো রাতে একটা হোটেলে উঠেছিলো আর মনি ঘুমিয়ে গেলেই ছেলে ভেগে যায় সবকিছু নিয়া!কিন্তু সমাজের ভাবনায় নেগেটিভ ঘুরপাক খায়!কেউ বলে রুমে ক্যামেরা থাকলে সব ধরা খেতো!সত্য আর সতীত্ব এই দুই স’ তে কেউই বিশ্বাস করতে চাইলই না!
সেই থেকে বরপক্ষ দেখতে আসলেই সমাজে কানা-ঘুসা শুরু হয়ে যায়!আর বরপক্ষ এসব জানতে পারলে কেউ রাজি হয়না।রাজি হলেও আবার মোটা যৌতুক দাবী করে।ছোট কাকা রাজিও হয়ে গিয়েছিলো যৌতুক দিতে।মনি নিষেধ করে দিছে।প্রয়োজনে সারাজীবন অপয়া নাম শুনেই বাঁচবে তবুও টাকার পন্য হবে না।ও কাকাকে বলে দিয়েছে যে ওকে ভালোবেসে বিয়ে করতে পারলে করবে না করলে নাই।আমার দাম কি দশ লক্ষ টাকার জন্য নাকি?যেদিন ওই টাকা ফুঁড়ায়ে যাবে সেদিন ওরা আমাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিবে নতুবা বাড়িতে বউয়ের যায়গায় কাজের মাইয়ার মতো খাটাইবে।মনির এমন জবাব শুনে চুপ হয়ে থাকে ছোট কাকা।
মনির বয়স তেইশ।আর গ্রামদেশে মেয়েদের বিয়ে দিতে হয় সতেরো-বিশ বছরে নতুবা সবাই বলে অপয়া,অলক্ষ্মী।
মনি আমার দুই বছরের ছোট হলেও আমাকে তুই করেই বলে।ছোটবেলায় একমাত্র আমিই ওর খেলার সাথী ছিলাম।বলতে গেলে এখনও বেষ্ট ফ্রেন্ডের মতো।
-বাবা!
-কি?
-একটা কথা বলবো?
-বল।
-যদি ছোট কাকার মেয়েকে আমি…
-কি বলছিস!জেনে বুঝে বলছিস তো!
-হুম বাবা!আর তুমিও বিশ্বাস করো আমাদের বংশের মেয়ে এটা করতে পারে!তুমি মনিকে আর দশজনের মতোই ভাবো?
-না বাবা।আমি জানিনা নয়ন তোকে কি বলবো।সত্যিই তুই আমার ছেলের চাইতে অনেক বেশি কিছু!
তারপর সবার মতেই আমাদের বিয়ে হলো।আমি ওইদিন চায়ের দোকানের সমালোচনা শুনে মনিকে বিয়ে করি যদিও ওকে আগে থেকেই ভালোবাসতাম না।একটা মেয়ে এতোটা অপমানিত হতে পারে আমি নিজ কানে না শুনলে জানতেই পারতাম না।কিন্তু ওকে বিয়ে করার পর এখন মনে হচ্ছে আমিই সেলিব্রেটি হয়ে গেছি!তা নয়তো কি!সমালোচনা তো তারই হয় যে সেলিব্রেটি যার বিষয়ে আলোচনা হয় তাকে নিয়েই সমালোচনা হয়।করুক!আমার কি!পাছেঁ লোকে কিছু বলে কবিতার মতো ওদের কথায় কান দিয়ে শংসয়ে না পড়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
-নয়ন!
-হুম।
-তোকে একটা কথা বলি?
-কি?
-তুই কি আমাকে বিয়ে করেছিস আমার উপর দয়া দেখিয়ে?
-না তো।
-কিন্তু তুই তো আমায় ভালোবাসিস না।শুধুই বন্ধু ভাবিস!
-আমি তোকে আমার বন্ধু ভাবতাম কিন্তু যাকে ভালোবাসবো সে আমার বউ!
-সত্যি?
-হুম।তোর ভালোবাসাগুলা আমায় দিবি আমি যত্নকরে আগলে রাখবো!
-হুম।সবগুলা।
-তোর ভালোবাসার চাঁদরে আমায় জড়াবি?সমালোচনা আর লজ্জা ঢাকার কাপড় হবো!
-হুম।
বলেই মনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।আমিও দুহাতে জড়িয়ে নিলাম।
মনি ঘুমিয়ে পড়লে আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম!এতো সুন্দর মায়াবী একটা চেহারায় যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে কিন্তু এই সমাজ যে কি করে এর সমালোচনা করে তা উপরওয়ালাই জানে।ওর ঘুমের মধ্যেই আমি ওর চুলগুলা মুখ থেকে সরিয়ে দিলাম।
ভালোবাসার খুনসুটি গুলা ভালোই যাচ্ছিল নয়ন-মনির!তুই থেকে সম্পর্কটা তুমিতে চলে এসেছে।বাবা-মাও আমাদের এই সম্পর্কে অনেক খুশি আর কাকা-কাকিমার রোজকার জামাই আদরের কমতি নেই!
দুইবছর পর।আমাদের মিনি এলো অনেক কিউট দেখতে।সবাই বলে একদম আমার মতো দেখতে নাকি মায়া মায়া চোখ,ঠোট নাকি মনির মতো পাতলা গড়নের গাড় গোলাপি!নাম অনি।
-ছাড়ো।কি করছো!অনি দেখছে তো!
-দেখুক।তাতে কি!অনির পাপা অনির মাকে আদর করবে না কাকে করবে?
-যাও!ফাজিল!
-তারপর!
-কিছুনা।
বাবা-মা এখন সারাক্ষণ অনিকে নিয়ে মেতে থাকে।আর মনিও নিজের সংসার খুব ভালোভাবে গুছিয়ে নিয়েছে।আসলেই সমাজ যাকে অপয়া বলে তাচ্ছিল্য করে তার মধ্যেও স্বামী আর সংসার গুছানোর অসাধারণ প্রতিভা আছে!নারী!আসলেই এক অনন্যা প্রতিভার নাম!সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে যেকোনো সমাজে যতই থাকুক ইভটিজিং,সমালোচনা কিংবা লাঞ্ছনা-বঞ্চনা!
আরো তিন বছর পর!এখন আর আমাদের নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে না!নিজের মন থেকেও সেলিব্রেটি সেলিব্রেটি ভাবটা উধাও হয়ে গেছে!একটা রাইটার্সেরও যেমন দশটা গল্প ভালো করার পর একটা গল্প ফ্লপ খেলে অনেক বাজে কমেন্ট শুনতে হতো ঠিক তেমন।কিন্তু যারা সমালোচনা করে তাদের দিলে কুলাবে না এতো সময় নিয়ে রাত জেগে ওই ফ্লপ খাওয়ার মতো একটা গল্প লিখে দেখাতে!যাই হোক আগেই বলেছি অন্ধকার রাত্রিতে সমালোচনা তাদেরই হয় যারা সারাদিন আলোচিত!
অনি এখন হাঁটতে শিখেছে।ওকে হাত ধরে শপিংয়ে নিয়ে যাচ্ছি ওর জন্য আর পুরো পরিবারের জন্য কেনাকাটা করবো বলে!সাথে মনিও আছে।একটা মুদি দোকানের থেকে কানে লাগার মতো আওয়াজ এলো যাক অপয়াটাকে শেষ অব্দি ছেলেটার সাথে বেশ মানাইছে!মনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে,আমি দাঁত দিয়ে আমার ঠোট কামড়ে ধরলাম!হাসি পাচ্ছিল যে!
আমি এখন ভাবছি ভাগ্যিস অপয়া,বেশ্যা,পতিতা,ধর্ষিতার পুরুষ বাচক শব্দ নেই,থাকলে এরকম সমালোচিত মেয়েকে বিয়ে করে সমাজের সমালোচনায় আমার যে কি হতো!