ভালোবাসার মায়াজাল

ভালোবাসার মায়াজাল

নিজের এলাকা ছেড়ে আজ ফাহিম অনেক দূরে চলে এসেছে। পেটে দুর্দান্ত ক্ষুদা দাপাদাপি করছে। কিছু একটা খাওয়া অতি জরুরি। কিন্তু ফাহিমের পকেট ফাঁকা। পকেট সবসময় ফাঁকাই থাকে ফাহিমের। মধ্যবিত্ত পরিবারের বেকার ছেলেদের পকেট এমন ফাঁকা থাকাই স্বাভাবিক।।

ফাহিমের চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠলো। সামনেই একটা বাড়ির ছাদে রঙিন কাপড় দিয়ে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। হয়তো বিয়ের প্যান্ডেল, কিন্তু আজ তো শুক্রবার না। বাংলাদেশে সচরাচর শুক্রবার ছাড়া ধুমধাম করে বিয়ে হয় না। ফাহিমের পেটের দুর্দান্ত ক্ষুদার একটা গতি হয়তো হয়ে গেল। এর আগেও কয়েকবার ফাহিম বিনা দাওয়াতে বিয়ে বাড়িতে খেয়ে গিয়েছে। তাই তার সমস্য হওয়ার কথা নয়। তাই সে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল বিয়ে বাড়ির দিকে।

“আজ নীলুফার বিয়ে”

ঠিক এমন একটা বোর্ড বা শোলা দিয়ে তৈরী জিনিস ঝুলছে বিয়ে বাড়ীর গেটে। তার মানে যার বিয়ে হচ্ছে তার নাম নিলুফা। যাক এই নামটা কাজে দেবে ফাহিমের।

ঠিক গেটের পাশে বসে আছে কয়েকটা কুকুর, তাদের চোখে লোলুপ দৃষ্টি। কখন সবার খাওয়া শেষ হবে আর কখন তারা হাড় গোড় খাবে, ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ঠ খাবে। এই

কুকুরগুলোর পাশেই বসে আছে দুটো বাচ্চা ছেলে। পরনে ময়লা ছেঁড়া শার্ট, মলিন তাদের চেহারা। তারাও হয়তো অপেক্ষায় আছে। কখন সবার খাওয়া শেষ হবে, আর কখন তারা মানুষের রেখে যাওয়া এঁটো খাবার খাবে। কুকুর আর মানুষ একই কাতারে। পৃথিবীর সেরা মর্মান্তিক দৃশ্য।

ফাহিমের পেটের ক্ষুদা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল। সেও বসে পড়লো সেই বাচ্চা ছেলে দুটোর পাশে। এখন ফাহিম নিজেও তাদের কাতারে।

” কিরে তোরা কখন থেকে বসে আছিস এখানে? ”

ওদের পাশে বসতে বসতে কথাগুলো বললো ফাহিম। ওরা এতক্ষন ভিতরে বসে খেতে থাকা মেহমানদের দিকে তাকিয়ে ছিল। ফাহিমের কথায় চমকে তাকালো ফাহিমের দিকে। ফাহিমকে দেখেই তাদের ভ্রু কুঁচকে গেল। একই সাথে তাদের চোখে ভেসে উঠলো হিংস্রতা।

” আপনারে কমু কেন? আর আপনে আমাগো লগে বইছেন কেন? ”

” আমিও তো অপেক্ষায় আছি খাবারের। তোরা যেমন অপেক্ষায় আছিস।”

ফাহিমের কথা শুনে ছেলে দুটো পরস্পরের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলো। তাদের চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা সংকিত। তাদের খাবারে ভাগ বসানোর জন্য অন্য একজনের আবির্ভাব ঘটেছে। তাছাড়া ফাহিমের গায়ের পোশাক দেখে এমনই তো মনে হওয়ার কথা। গায়ের পোশাক নোংরা, পায়ের জুতোর ফিতা ছেঁড়া এবং গায়ে বিকট ঘামের গন্ধ।

পাশে বসে থাকা কুকুরগুলোর মাঝেও একজন নতুন প্রতিদ্ধন্দী এসে হাজির। নতুন কুকুরটা দেখতে জীর্ণশীর্ণ। তবে একসময় প্রচুর শক্তিশালী ছিল, খাবারের অভাবে আজ কংকালসার।
ফাহিম, ছেলেগুলো আর কুকুরগুলো তাকিয়ে আছে বিয়ে বাড়ীর ভেতরে। সবাই হাপুস হুপুস করে, এমনভাবে খাচ্ছে যেন কয়েকদিনের অভুক্ত। আচ্ছা ছেলেগুলোর সামনে যদি

এমনভাবে ভাল ভাল খাবার দেয়া হয় তাহলে তারাও কি এমন হাপুস হুপুস করে খাবে? তারাই তো সত্যিকারের অভুক্ত।

” আরে ফাহিম তুই এখানে কি করিস? আর এখানে বসে আছিস কেন? ”

ফাহিমদের সামনে একটা কালো গাড়ি এসে থামলো। কালো রঙের দামী গাড়ি। ভেতরে মনে হয় এসি আছে। গাড়ীর ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে এলেন দুইজন মাঝবয়সী মহিলা, দুইজন মাঝবয়সী পুরুষ, কয়েকটা বাচ্চা কাচ্চা এবং সবার শেষে আদিবা।

আদিবা ফাহিমকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেছে। তাই সে ফাহিমকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিল।

” হাঁটতে হাঁটতে খুব ক্ষুদা লেগে গিয়েছে। তাই এখানে বসে পড়লাম। দেখি যদি খাওয়ার জন্য কিছু পাই।”

ফাহিমের কথা শুনে আদিবা খুব একটা অবাক হয়নি। সেই ছোটবেলা থেকে ফাহিমকে চেনে আদিবা। ফাহিম ছোটবেলা থেকেই আদিবার কাছে একটা রহস্যের নাম। ফাহিম এতটাই রহস্যময় ছেলে যে স্কুল, কলেজে আদিবা ছাড়া ফাহিমের আর কোন বন্ধু ছিল না।
” ফাহিম তুই রহস্য করা বন্ধ কর। সত্যি করে বল এখানে কেন বসে আছিস? ”

” সত্যিই তো বললাম। আজকে ইচ্ছে করছিলো হেঁটে হেঁটে দূরে কোথায় যাই। সেই ইচ্ছে অনুযায়ি এখন আমি এখানে।”

” তুই সিরিয়াসলি খাবারের আশায় এখানে বসে আছিস?”
” হুম সিরিয়াস।”

আদিবা গাড়ির ভেতর থেকে একটা ব্যাগ বের করলো। ব্যাগের ভেতরে একটা কালো রঙের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিটা ফাহিমের দিকে বাড়িয়ে দিল আদিবা।

” নে এইটা পরে নে। তারপর চল আমার সাথে ভেতরে। আজ আমার কাজিনের বিয়ে হচ্ছে।”

” কিন্তু আমি তো একা যেতে পারবো না। আমার এই দুই বন্ধু তো আছে আমার সাথে।”
এবার আদিবার দৃষ্টি গেল ছেলেগুলোর দিকে। এখন আদিবা বুঝতে পারলো ফাহিমের এখানে বসে থাকার রহস্য। আদিবা মৃদু্ হাসলো। আর এই হাসিতেই ফাহিম নামের আশিক ঘায়েল হলো।

” আদিবা এভাবে হাসিস না, বুকে ব্যাথা করে।”

” ও তাই বুঝি? ঠিক আছে হাসবো না। চল তাহলে তোর দুই বন্ধুও আমাদের সাথে যাবে।”
ফাহিম হাঁটছে, তার সাথে সাথে হাঁটছে ছেলেদুটো। তাদের চোখে অবাক বিস্ময়। যা তারা কল্পনাও করেনি, তাই ঘটতে চলেছে তাদের সাথে।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক ফাহিম এবং ছেলেদুটোকে থামিয়ে দিল। এমন পোশাক নিয়ে বিয়ে বাড়িতে ঢোকার অনুমতি কি আছে কারো?

” রাজীব ভাই, ওরা আমার সাথে এসেছে।”

ওহ তাহলে লোকটার নাম রাজীব। লোকটার নাম যেনে ফাহিমের অনেক সুবিধা হলো। ফাহিম একেবারে রাজীবের কানে কানে গিয়ে বললো,

” ভাই গেটের বাইরে কয়েকটা কুকুর বসে আছে। সকাল থেকে না খেয়ে বসে আছে বেচারারা। ওদেরকে কিছু খাবার দিয়ে আসেন।”

ফাহিমের কথা শুনে রাজীব প্রচুর অবাক হয়েছে। তার চোখ দিয়ে অবাকের জোয়ার বইছে। সে ফাহিমের উপর থেকে চোখ সরিয় তাকালো বাইরের দিকে। সত্যিই ওখানে কয়েকটা কুকুর বসে আছে। কুকুরদের চোখে করুণার দৃষ্টি।

আদিবা, ফাহিম, আর ছেলেদুটো খেতে বসেছে। তাদের সামনে গরুর মাংস, মুরগীর রোষ্ট, বোরহানী আর জর্দা রাখা। ছেলেদুটো তাকিয়ে আছে খাবারের দিকে। এতো খাবার তারা একসাথে কখনো দেখেনি। এত খাবার দেখে তারা খাওয়ার কথা ভুলে তাকিয়ে আছে ফাহিম আর আদিবার দিকে। একটু পরেই তারা দুজন একইসাথে কেঁদে উঠলো। তাদের কান্না দেখে আদিবা একটু অবাক হলেও ফাহিম অবাক হয়নি। মাঝে মাঝে অসম্ভব কোন স্বপ্ন যদি সত্যি হয়ে যায় তাহলে মানুষ কাঁদে। তখন এই কান্নাকে আনন্দের কান্না বলে। এই হতদরিদ্র ছেলেদুটোর কান্না হচ্ছে আনন্দের কান্না, ক্ষুদা নিবারন হওয়ার কান্না।

” আচ্ছা আদিবা তুই তখন গাড়ি থেকে পাঞ্জাবি বের করে দিলি। এই পাঞ্জাবী কার জন্য এনেছিলি? ”

খাওয়া শেষে রাব্বি আর নিশানকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো আদিবা আর ফাহিম। ওহ বলতে ভুলে গেছি ছেলেগুলোর নাম রাব্বি আর নিশান। ছোটবেলায় মা তাদেরকে রেখে চলে

গিয়েছিল অন্য পুরুষের হাত ধরে। তারপর তাদের বাবাও একদিন অন্য এক মেয়ের হাত ধরে তাদের ফেলে চলে গিয়েছিল। তারপর থেকেই তাদের এই জীবন।

রাব্বি আর নিশানের গায়ে নতুন পোশাক। আদিবাই কিনে দিয়েছে এসব। বড়লোকের সন্তান হওয়ার এই একটা সুবিধা, চাইলেই মানুষদের সাহায্য করা যায়। যেমনটা আদিবা কলেজে থাকতে করতো। এখনো সে এসব করে যাচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে ফাহিম আদিবাকে পাঞ্জাবীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো। আদিবা তখন কিছুক্ষন মাথা নিচু করে রাখলো তারপর বললো,

” আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তোর সাথে আজ আমার দেখা হয়ে যাবে। তাই এই পাঞ্জাবীটা কিনে সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম।”

আদিবার উত্তরে ফাহিম চুপ করে রইলো। ফাহিম আদিবাকে যদি তার মনের কথা বলে দিতে পারতো তাহলে হয়তো আদিবা ফাহিমেরই থাকতো। হয়তো আদিবা বিয়ে করতো

ফাহিমকেই। আর যদি ফাহিমকে বিয়ে করতো তাহলে হয়তো এমন করে বিধবা হয়ে ঘুরতে হতো না আদিবাকে।

রাব্বি আর নিশান চলে গেছে তাদের বাসায়। বাসা বলতে তারা থাকে চাষাড়া শহীদ মিনারের আশেপাশেই। এসব পথশিশুদের জন্য তো সরকার কখনো কিছু করেনি। এমন সড়কের পাশে, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশনই তাদের একমাত্র আশ্রয়।

শীতলক্ষ্যার পাড়ে বসে আছে ফাহিম এবং আদিবা। চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আদিবা আলতো করে ফাহিমের কাঁধে হাত রাখলো। ফাহিম শিউরে উঠলো কিছুটা।

” ফাহিম তোর হাতটা একটু ধরি? তোর হাতটা ধরতে ইচ্ছে করছে খুব।”
” আমার হাত ধরবি? আমি তো তোর বয়ফ্রেন্ড নই।”
” কেন বয়ফ্রেন্ড ছাড়া আর কারো হাত ধরা যায় না বুঝি? ”
” জানি না তো। ঠিক আছে ধরতে চাইলে ধর আমার হাত।”

আদিবা শক্ত করে ফাহিমের হাত ধরে রেখেছে। অন্ধকারে আদিবার মুখ দেখতে পাচ্ছে না ফাহিম। তবে বুঝতে পারছে আদিবা কাঁদছে। চারদিকে ঘোর অন্ধকার, এই অন্ধকারে ফাহিম বসে আছে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত