রূপূ

রূপূ

“ভাইয়া”
চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম৷ চোখ দু’টো সামনের খেলার মাঠে স্থির হয়ে আছে৷
“ভাইয়া” ডাকটা শুনে চমকালাম একটু৷ যদিও আমাকে ডাকেনি সেটা আমি নিশ্চিত৷
এই নিঃসঙ্গ শহরে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে এমন কেউ নেই৷ শুধু শহর না৷ দুনিয়াতেও নেই বোধ হয়!
দ্বিতীয়বারে মত আবার কানে আসলো ডাকটা৷ আশেপাশে দেখে নিলাম! না কেউ নেই৷
হিজাব বাঁধা হালকা পাতলা মেয়েটা একটু জোরে হাঁটছে! আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম!
আমাকে ভাইয়া ডাকছে! আগে দেখেছি বলে মনে হয় নাহ!

-ভাইয়া কেমন আছো?

এবার বড় রকমের ধাক্কা লাগলো৷ এই মেয়েকে আমি কোথাও দেখেছি বলে মনে পরছেনা৷ কিন্তু গলাটা কেমন জানি আপন মনে হচ্ছে!

এই ব্যাপারটা ঈদানিং বেশি করে হচ্ছে৷ কোথাও কিছু দেখলে আমার মনে হয় আমি এই ঘটনাটা আগে দেখেছি!
কিন্তু কোথায় দেখেছি তা মনে পরেনা৷

কিন্তু দেখেছি৷ আজকের ব্যাপারটা পুরোটাই আলাদা৷

-চিনতে পেরেছো আমাকে?
-য়ুহু! কে আপনি?
-রূপা! মনে আছে?
রুপা! এই নামের কাউকে চিনি আমি? মনে থাকবে কেন?
-না তো৷
-আরে তোমার রূপূ!
-রুপূ!
-হুম রুপু!

নামটা শুনেই ভেতরটা মুচড়ে উঠলো৷ বিষণ্ণ মেঘে ঢেকে যাওয়া মনটা হুট করে মেঘ কাটিয়ে উঠলো৷

-কেমন আছিস রে তুই? অনেক বড় হয়ে গেছিস দেখছি!
-ওমা! বড় হবো না তো? ছোট থেকে যাবো নাকি?
-হ্যা তাও কথা! কি করিস এখন?
-এইতো স্কুলে মাষ্টারি করা৷ তোমাকে বলেছিলাম না৷ আমি শিক্ষিকা হবো!
-হি হি হ্যা বলেছিলি৷ তা ম্যাম আমাকে মনে পরলো হঠাৎ?
-কত খুঁজেছি তোমাকে জানো? হুট করেই উধাও হয়ে গেলে! একবার ভাবলেনা, তোমার পিচ্চি বোনটা কষ্ট পাবে!

জানো ভাইয়া, আমি সব পেয়েছি৷ যা আমি আশা করিনি৷ তাও পেয়েছি৷ তারপরও কেন জানি পূর্ণতা পাচ্ছিলাম না৷ প্রতিনিয়ত মনে হয়, কিছু একটা নেই৷

কত রাত বারান্দার গ্রিল আকড়ে ধরে জোৎস্না আকাশে তাকিয়ে ভেবেছি!
শেষমেষ অপূর্ণতা কোথায় ছিল জানো?

-কোথায়?
-আমার বাবার পর যে দু’টো হাতে আমি ভরসা পেয়েছিলাম৷ সে দু’টো হাতকে মিস করেছি খুব৷

আমি হাসলাম৷ ভালো লাগছে আমার৷ সেদিনের পিচ্ছি মেয়েটা কি ঘুছিয়েই না কথা বলে! আগেও ঘুছিয়ে বলতো৷ এখন একটু বেশি ঘুছিয়েই বলছে৷

রুপুর গাল টানলাম আসতে করে৷ রুপু হাসে৷ খিলখিল করে হাসে৷
-হাসছিস কেন?
-গালটানার অভ্যাসটা গেল না এখনো?
-য়ুহু যায় নি৷ গালটানার মানুষ পাই না তো৷
-আজতো পেয়েছো৷ নাও টানো৷
-না আজ আর না৷ উঠি রে৷ টিউশন আছে ঐদিকটাই৷
রুপুর মন খারাপ হলো আমি জানি৷ মুখ কালো করে বলল,
-বারেহ! আমার চেয়ে টিউশন বড় হয়েছে বুঝি?
-টিউশন না করলে খাবো কি?
-মানে?
-মানেটা পরে বলব একদিন৷
-আচ্ছা ভালো থেকো৷ আর ঠিকানাটা দাও!

আমি হাঁটা দিলাম৷ রূপা বসে আছে আগের জায়গাটাতে৷ ভালো লাগছে আমার৷ আমার বিষণ্নতাগুলো শেষবিকেলের রোদের মত হুট করেই হারিয়ে গেল৷ আর কিছুদূর গেলেই গন্তব্যে পৌঁছে যাব৷

টিউশনটা জমবে বেশ৷

মেয়েটার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই৷ আত্মীয় স্বজনের মধ্যে পরে না আমার৷
মামার বাসায় থাকতাম ছোটবেলা থেকেই৷ মা ছিল না৷ বাবা থেকেও নেই৷ মাঝে মাঝে দেখা হতো বাবার সাথে৷ জড়িয়ে ধরতাম৷ মা মারা যাওয়ার পর মানুষটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল৷ একদম অন্যরকম৷ হাসি খুশি চন্ঞ্ছল মানুষটা একদম শান্ত হয়ে গিয়েছিল৷

বাবা হয়তো আমাকে তার কষ্টে জড়াতে চাই নি৷ তাই মামার কাছে রেখে গিয়েছিল৷

মামার বড়সড় একটা দোকান ছিল৷ সেটাতে বসতাম প্রায় সময়৷ বিনিময়ে লেখাপড়া আর খাওয়াটা ভালোই চলতো৷
তারপরও আমার মনটা ভালো থাকেনি কখনো৷ সবসময় মিস করেছি আপন কাউকে৷ আমার দীর্ঘঃশ্বাস আর মন খারাপের স্বাক্ষী ছিল মাথার নিচের বালিশ আর গায়ে মোড়ানো চাদরটাতে৷

রুপুর সাথে দেখা হল একদিন৷ তখন আমি কলেজে পড়ি৷ দোকানে কেউ ছিল না৷ আমি ছাড়া৷ হাতে কয়েকটা বাজারের থলে৷ খুব মিষ্টি করেই বলল,

-ভাইয়া থলে লাগবে?

আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম পিচ্ছি মেয়েটার দিকে৷ একটুখানি মেয়ে কি মায়া মায়া করেই কথা বলে৷ মাথায় ওড়না দিয়ে হিজাব বাঁধা৷ মিষ্টি একটা চেহারা! আর এভাবে “ভাইয়া” বলে কেউ ডাকেনি কখনো৷

সেদিন থেকেই প্রতি শুক্রবারে মেয়েটা আসতো৷ প্রত্যেক দোকানেই বাজারের থলে সাপ্লাই দিতো৷
শুক্রবারে স্কুল বন্ধ তাই শুক্রবারেই আসে৷ মনটা ভরে যেতো মেয়েটাকে দেখলেই৷ তারপর আস্তে আস্তে মেয়েটার মায়ায় পরে গেলাম৷ “ভাইয়া” ডাকটা শোনার অপেক্ষায় থাকতাম পুরো সপ্তাহ৷ রুপুও হয়তো বুঝতো ব্যাপারটা৷

একদিন হুট করে বললাম,
-ফুচকা খাবি পিচ্চি?
রুপুর চোখেমুখে তখন আনন্দ খেলা করছে৷ মিনিট কয়েক পর আস্তে করে বলল,
-ফুচকা ঝাল বেশি৷ বিরিয়ানী খাওয়াবা? বিরিয়ানী খুব পছন্দ আমার৷ কতদিন খায় না৷
সেদিন দু’জন মিলে তৃপ্তি করে বিরিয়ানী খেয়েছিলাম৷

দামটা অবশ্য একটু বেশি ছিল৷ টাকায় কুলোচ্ছিল না৷ মনটা খারাপ হল একটু৷ রুপু আমার হাত ধরে কানে কানে বলেছিল,

-আমরাতো ভাই-বোন তাই না! একটাতেই হবে৷ ভাগ করে খাবো!

মনটা ভরে গিয়েছিল সেদিন৷ রুপুর ছোট্ট ছোট্ট হাতের বিরিয়ানীর লোকমাগুলো মুখে নিয়ে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম সেদিন! বাকি জীবনে যত বিরিয়ানী খেয়েছি! কখনো পাইনি আমি৷

আমার মত রুপুরও মা ছিল না৷ বাবা অসুস্থ্য ছিল৷ তারপরও ছোট্ট মেয়েটা পিছু হটেনি৷ থলে বিক্রি করে করে লেখাপড়া করতো৷ আমার সাধ্য ছিল না৷ সাহস দিতাম সবসময়৷

কেক কেটে কখনো আমার জন্মদিন পালন হয়নি৷ আট দশটা দিনের মতই কাটতো৷
ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ পরলে মনে পরতো, এইতো আমার জন্মদিনের তারিখটা! কিন্তু ততদিনে অনেকটাই দেরী হয়ে গিয়েছে!

একদিন হুট করেই রুপূ চলে আসলো৷ শুক্রবার ছিল না সেদিন৷ হাতে থলে ছিল না৷ থলের বদলে ছিল আধ পুরনো একটা বাটি৷ আমার হাত ধরে একপাশে নিয়ে গেল৷ জিজ্ঞেস করলাম,

-কিরে আজ হঠাৎ?
বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
-এই নাও!
-কি এগুলা?
-বিরিয়ানী!
অবাক হলাম৷
-কি বলিস? কেন?
-আজ না তোমার জন্মদিন? এইটা গিফ্ট দিলাম৷ আমি রেঁধেছি!

আমার চোখগুলো ঝাপসা হয়ে এসেছিল৷ কান্নাগুলো বুক ফেটে বেরিয়ে আসছিলো৷ সুখের কান্না!
তারপরের তিনটা জন্মদিনেও রুপু ঠিক এই উপহারটাই দিয়েছিল আমাকে৷ মেয়েটার সবকিছুতেই আমি মুগ্ধ হতাম৷

তারপর একদিন হুট করেই চলে আসলাম সবকিছু ছেড়ে৷ রুপুকে শেষ বিদায়টাও জানানো হয় নি৷ ইচ্ছে করেঈ বলিনি৷ মেয়েটার কষ্ট সহ্য হবে না আমার৷ মায়ায় পরে যাবো৷

এই নিষ্ঠুর শহরের নিষ্ঠুরতাগুলো শক্ত করে তুলেছে আমাকে৷ রূপুকে মিস করতাম সবসময়৷ মাঝে মাঝে সব ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে হতো৷ কিন্তু পারিনি৷

আমিও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছি দিনদিন৷ আমার নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষী হয়ে আছে অলিগলি, আর দোকানের মোড়ের চায়ের দোকানগুলো৷ এই জায়গাগুলোতে বসেই আমি মনের সাথে নিষ্ঠুরতা করে কাটিয়ে দিয়েছি অনেকগুলো৷

আজ শান্তি লাগছে৷ অন্তত কিছু একটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে৷ নিশ্চিন্তে ঘুমাবো আজ৷ আমি জানি মেয়েটা আবারো চমকে দিবে আমাকে৷ দিন পনেরো পরেই আরেকটা জন্মদিন আমার৷ করিম চাচার দোকান থেকে লাল কালির কলম কিনেছি৷ ক্যালেন্ডারে পাতায় জন্মদিনের তারিখটা গোল বৃত্তে দাগিয়ে রাখবো৷

আমার রুপু আসবে ঐদিন আমি জানি৷ এসেই দড়জাই কড়া নাড়বে৷ লোকমা করে বিরিয়ানী খাওয়াবে৷ সেদিন থেকে একদম পাল্টে যাবো আমি৷ একদন পাল্টে যাবো৷

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত