“দিলবার দিলবার ও দিলবার দিলবার” গানের শব্দে সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গল। মোবাইলে নতুন রিংটোন লাগিয়েছি। কেউ কল দিলে নিজে নিজে অনেকক্ষণ শুনি তারপর রিসিভ করি। আধবোজা চোখে মোবাইলটা হাতে নিলাম। দেখি ফাহিম কল দিচ্ছে।
রিসিভ করার আগে কয়েকবার ভাবলাম। নিশ্চয় সকাল সকাল গার্লফ্রেন্ডের সাথে কোনো ঝামেলা করেছে। মিটমাট করানোর জন্য হয়তো কল দিচ্ছে। আরো দুই-তিনবার গানটা শুনে তারপর রিসিভ করলাম।
ওপাশ থেকে ফাহিম ব্যস্তভাবে বলল,” কই তুই?”
আমি বললাম,” বাসাতেই আছি। কেন কি হয়েছে?”
ফাহিম করুণ কণ্ঠে জানালো,” আজ সকাল থেকেই লাবণ্যকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ”
লাবণ্য ফাহিমের গার্লফ্রেন্ড। আমাদেরও ব্যাচমেট হয়। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে কি? আমরা দুষ্টামি করে লাবণ্যকে গরু ডাকি, ভাবি ডাকি।
প্রথমে ভাবলাম ফাহিম ফাজলামি করছে। ফাহিমকে জিজ্ঞেস করলাম,” কীভাবে গরুটা হারালো?”
এবার ফাহিম উত্তেজিত হয়ে বলল,” প্লিজ তুই একটু সিরিয়াস হ। আমি কিছুই জানি না। ওর আইডি দুটাই ডিএক্টিভেট করা। সকাল থেকে মোবাইলও অফ। তুই কিছু একটা কর প্লিজ।”
দুইবার প্লিজ বলেছে তার মানে ঘটনা সিরিয়াস কিছু।
আমি তো গতকালও সন্ধ্যার দিকে লাবণ্যের ছবিতে ‘নাইস ভাবী ওরফে মিসেস ফাহিম’ লিখে কমেন্ট করেছিলাম।
এর ভিতর কি এমন হয়ে গেল!
তাছাড়া লাবণ্য দুইটা ফেসবুক আইডি ইউজ করে। একটাতে ফ্যামিলির মানুষজন সবাই এড আছে। আরেকটাতে বন্ধু-বান্ধবীরা এড আছে। যে আইডিতে ফ্যামিলির সবাই এড আছে সেখানে লাবণ্য একদম চুপচাপ।
অন্য আইডিতে সে ফাহিমকে নিয়ে ছবি আপলোড দেয়। “আমার বাবুটা” লিখে ক্যাপশনও দেয়।
আমরাও সেখানে ‘নাইস ভাবী’, ‘জোস কাপল’ ‘গরুর সাথে রাখাল” লিখে কমেন্ট করি।
উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। মাকে তাড়াতাড়ি নাস্তা দিতে বললাম। আমার তাড়াহুড়ো দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,” কি হয়েছে?”
মাকে বললাম,” কিছু না। একটু ফাহিমের বাসায় যাচ্ছি।”
মা আবার জিজ্ঞেস করলেন,” কি যেন হারালো বললি?”
মা তাহলে শুনে ফেলেছেন।
“তেমন কিছু না।” বলেই দরজার দিকে পা বাড়ালাম। পিছন থেকে মা ডাক দিলেন,” আমি তো শুনেছি। গরু হারানোর কথা বলছিলি মোবাইলে। তোরা কি গরুর ব্যবসা শুরু করেছিস নাকি?”
আমার মাকে নিয়ে হয়েছে এক জ্বালা। কোনোকিছুতেই বিশ্বাস করতে চান না তিনি আমাকে। আমি কিছু না বলে দরজা খুলে বাইরে বের হতে গেলাম। বাইরে চোখ পড়তেই দরজার সামনে লাবণ্যকে দেখে ভূত দেখার মতে কেঁপে উঠলাম। দুই পা পিছিয়ে আবার ঘরে ঢুকে গেলাম। মা জিজ্ঞেস করলেন,” কি হলো আবার তোর?”
মাকে বলতে চাইলাম,” যে গরুটা খুঁজতে যাচ্ছি সেটা আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”
কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো স্বর বের হচ্ছিল না।
লাবণ্য বাসায় ঢুকে সোফায় বসল। চোখমুখ ভেজা। মা লাবণ্যকে আগে থেকে চিনতেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এটা লাবণ্য না? কি হয়েছে ওর?”
লাবণ্য মুখ খুলল।
সে বলল,” আমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি।”
মানুষ বাসা থেকে পালিয়ে প্রেমিকের কাছে যায় অথবা কাছের কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় যায়। এই মেয়েটা আমার বাসায় কেন আসলো?
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবলাম ফাহিমকে একটা কল করা যাক। মোবাইল হাতে নিয়েছি এমনসময় লাবণ্য আমাকে ডাক দিল, “অভি, বাসায় সব জানাজানি হয়ে গিয়েছে। গতকাল আমার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিয়েছে। বাসায় দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। কোনোমতে পালিয়ে এসেছি আমি।”
মা আমার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছেন। আমি মায়ের ভুল ভাঙ্গানোর জন্য তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “তোমার আর ফাহিমের ব্যাপারটা বাসায় কীভাবে জানলো?”
লাবণ্য উত্তেজিত হয়ে বলল, “গতকাল তোমার কমেন্টের জন্য। ”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,” আমার জন্য মানে?”
লাবণ্য বলল,” গতকাল তুমি আমার পারিবারিক একাউন্টে কমেন্ট করেছিলে। সেটা আমার চাচা দেখে ফেলেছে। ঝামেলা শুরু হয়ে গিয়েছে এখন। সকালে বাসা থেকে আসার সময় রাস্তার একটা দোকান থেকে কল দিয়ে ফাহিমকে সব জানিয়েছি। ও এখানে আসছে।”
তার মানে গতকাল সন্ধ্যায় আমি কমেন্টটা ভুল জায়গাতে করেছিলাম। লাবণ্যের মুখে শুনে পুরো ঘটনা মা বুঝে নিয়েছেন। আমার দিকে আবারো রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি।
কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এই মুহূর্তে বাসায় থাকলে মায়ের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত কিল-ঘুষি, রান্নাঘরের বিভিন্ন তৈজসপত্রের গুঁতা খেতে হবে। বাইরে গেলে ফাহিম যেখানে পাবে সেখানেই পিটাবে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে বাইরে দৌড় দিলাম।
কারণ ফাহিমের সাথে দেখা নাও হতে পারে কিন্তু মা ছাড়বেন না আমাকে। বাসা থেকে নিচে নেমে দেখি ফাহিম রাস্তা পার হয়ে আমাদের এদিকেই আসছে।
আমি রাস্তার অন্যদিক ধরে দৌড় দিলাম। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর দেখি ফাহিম এবং লাবণ্য একত্রে দৌড়াচ্ছে। আমিও প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি। এমনসময় আবার মোবাইল বেজে উঠল। এবার গান শোনার সময় নেই। দেখি ফাহিমের কল। বর্তমান যুগে তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রেও শত্রু শত্রুর খবরাখবর নেয়। বেশ ভালো কথা। তাড়াতাড়ি রিসিভ করলাম।
রিসিভ করা মাত্র ফাহিম চিৎকার দিয়ে উঠল,” **বাচ্চা, গতকাল রাতে আমার আর লাবণ্যের ছবি দিয়ে আমার পারিবারিক আইডিতে কে কমেন্ট করতে বলেছিল তোকে?”
তার মানে ঘুমের ঘোরে গতকাল আরো একটা পারিবারিক একাউন্টে হামলা চালিয়েছিলাম আমি। পিছনে তাকালাম। লাবণ্যকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ফাহিম দৌড়াচ্ছে। আমিও প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি।
কারণ এইমুহূর্তে বাঁচতে হলে দৌড়াতে হবে আমাকে। প্রচুর দৌড়াতে হবে।