স্বামীর সংসার

স্বামীর সংসার

অষ্টম শ্রেণীতে ভাল ফলাফল করাতে সবাই খুব খুশি,প্রিয়জন,পরিজন সবার মুখে হাসির ফোঁটা কিন্তু অন্তরালে ভয় ঢেউ খেয়ে যাচ্ছে ঘাম ঝড়িয়ে,দু’চোখে ঘুম নেই। অতৃপ্তি খুব নিকটে,মন বেমানান,না হোক এটা! কিন্তু এটা নাকি সমাজের নিয়ম। নিয়ম মানতে হবে আমাকে,নিয়ম কে মানাতে হবে মনে,আচ্ছা মনের উপর জোর চলে? উত্তরে একটায় সুর “হ্যাঁ জোর চলে কারন আমি মেয়ে মানুষ,আমি নারী” নারী তুমি পারবে না কিছু বলতে,তোমাকে অভ্যাস করতে হব সব কিছু সইতে,নেই তোমার স্বাধীনতা,আছে শুধু সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা,তুমি নারী তুমি দিবে ধর্য্যের পরিক্ষা,তুমি হবে মহত মনের অধীকারি।

প্রায় এক বছর ধরে শুনে আসছি অষ্টম শ্রেনীতে ভাল ফলাফলের পর আমার বিয়ে হবে, বাবার ঘনিষ্ট বন্ধুর বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে বছর খানিক হলো এমন কথা দিয়ে রেখেছেন বাবা,পরিবারের বাকি সদস্যদের অমত নেই। দেখতে শুনতে ছেলেটা বেশ ভাল,সরকারী চাকরী করেন উনি,তার ছোট তিন ভাই এবং দু’বোন আছেন,বাবা-মা এবং পাঁচ

ভাই বোন কে নিয়ে তার পরিবার। পরিবারে সবার মতের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিলো না,তাই তাদের
ইচ্ছায় আমার ইচ্ছা,তারা ভালো মনে করেছেন তাই আমিও ভাবছি সব কিছুই হয়তো ভাল হবে,তবে এমনটা না হলেও পারতো খুব বড় হয়ে গিয়েছি!খুব বেশি বয়স হয়ে গিয়েছে!
তবুও পরিবারের সবাই চায় বিয়েটা হোক তাই আমার অমত নেই।

দেখতে দেখতে কেমন যেনো দিন ঘনিয়ে এলো। পুরো বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে,চার পাশে সব পরিচিত মুখ,আত্বিয়সজনে বাড়ি জমজমাট। বেশ ভালো মুহুর্ত,বাচ্ছাদের ছুটোছুটি,বড়দের তড়িগড়ি বাহ্ কি চমৎকার মুহুর্ত,মনের মধ্যে

ক্ষীণ ভয়,আচ্ছা যা হচ্ছে তা কি ঠিক হচ্ছে! সময় গড়াতে শুরু করলো,সকাল হলো। সবার তড়িগড়ি কেমন যেনো বেড়ে গেলো। জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছি,সবাই

মেহেদী পাতা তুলছে,কেউ কেউ আবার কাঁচা হলুদ বাটছে,ছোট্ট বাচ্ছারা রং নিয়ে খেলা করছে। তাদের দিকে নজর পড়লেই অজান্তে ঠোঁটের কোণে হাসি জমছে। আমার কাজিনরা এসে আমায় সাজিয়ে দিলো। হলুদ শাড়ি,গেঁন্ধা ফুলের গহনা,গাঢ় কাজল আয়নায় তাকাতে একটু লজ্জা লাগছে। কবে আমি এত সুন্দর দেখতে হলাম!! মা,বাবা,খালা,চাচি এক এক করে সবাই

গায়ে হলুদ লাগিয়ে দিলেন,আনন্দের মাঝে সবাই আমায় গোসল করিয়ে দিলেন। শুনেছি এটা নাকি বিয়ের গোসল।
অনুভূতি খেলে যাচ্ছে আবেগে। অনুভব করার মত একটা মুহুর্ত আমার জীবনের। সবাই যখন হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছিলো তখন

মনের কোণে বেশখানিক হাসির রশ্মি জ্বলেছিলো অসাধারন একটা মুহুর্ত। একটা নারী এই অনুভূতি বুঝবে। কতটা মূল্যবান মুহুর্ত। হৈহৈরৈরৈ করে বর যাত্রীদের সবাই স্বাগতম করলেন।
অল্প সময়ের মধ্যে আমার দুই ননদ আমায় সাজিয়ে দিলেন।

খুব খারাপ লাগছে আজ। সকালে বেশ মিষ্টি লাগছিলো কিন্তু এখন ভূতের মত লাগছে। বূধু সাজে আমাকে একদম মানায়নি।

মানাক বা না মানাক বিয়েটা হবে আজ। একজন হুজুর এসে আমার সামনে বসে বললেন ” আলহামদুলিল্লাহ্” বলতে।

হঠাৎ করে বলে উঠলাম “আলহামদু্লিল্লাহ” হুজুর বলে উঠলেন “আমিন” বিয়ের কাজ সম্পর্ণ হয়েছে বলে উঠে চলে গেলেন।

বিকাল গড়াতে বর পক্ষ আমায় নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন।
বাবা-মা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। কেন যেনো ভিতর থেকে কান্না বের হয়ে যাচ্ছিলো।
কান্নার এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন অনুভব করলাম অচেনা একটা রুমে শুয়ে আছি,পাশে অনেক

মানুষের হইহুলড়। এটায় তবে ছিলো আমার স্বামীর বাড়ি।

ফুলে মৌমৌ করা একটা সাজানো বিছানায় বসতে বলা হলো আমাকে। সবাই হাসিঠাট্টা করে চলে গেলেন। একটা রুম,অচেনা একজন পুরুষ,ভিতরটা ভয়ে কাপছে কিন্তু মুখে চিলেফোঁটা হাসি বজায় রাখলাম,অচেনা ছেলেটি নাকি আমার স্বামী এবং সারা জীবন তার কথা মত আমায় চলতে হবে,চুপচাপ বসে রইলাম। আমার স্বামী আমার কপালে,ঘাড়ে,পেটে দুটো কিস্ খেয়ে নিজের পুরুষত্ব জাগিয়ে নিজেকে পুরুষ প্রমান করে পাশে শুয়ে পড়লেন। ওয়াশ রুমে গিয়ে কোন রকম চোখে মুখে

পানি দিয়ে এসে কিছুক্ষণ কাঁদলাম তবে কি এটায় স্বামীর সংসার!! সকালে ঘুম থেকে উঠে নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম।
শ্বাশড়ী মা আমার দিকে বড় চোখ করে তাকিয়ে আছেন,নিজেকে আসামি মনে হচ্ছিলো কিন্তু কি করেছি!
শ্বাশড়ী মা বলে উঠলেন-

– স্বামীর বাড়ি পাঠানোর আগে মা কিছু শিখায়নি?
এতক্ষন কেউ শুয়ে থাকে? সবার উঠার আগে বিছানার চাদর পরিবর্তন করনি কেন? নাকি এটাও মা শিখিয়ে দেয়নি? গোসলও তো করনি দেখছি,সারা রাত কি করেছো? গোসল করার কথাও কি আমায় বলে দিতে হবে?

মাথা নিচু করে উনার সব কথা শুনে নিলাম। উনার যাওয়ার পরে বিছানায় নজর পড়লো। একি অবস্থা!! এত রক্ত!!
হঠাৎ মনে হল আমার অঙ্গ বেঁদনায় শিউরে উঠছে। কি হয়েছে!

এত কষ্ট হচ্ছে কেন? আমার চটপট করা দেখে ননদীনিরা প্রাণ খুলে হাসছে। কার কাছে সাহায্য চাইবো?
ভেবে রেখেছিলাম স্বামী যখন রুমে আসবে তখন জিজ্ঞাস করবো কিন্তু সারা দিনে তার কোন পাত্তা নেই।
আমার বাপের বাড়ির লোকজন আসলেন আমায় দেখতে,আমার হাসি দেখে তা নিশ্চন্ত হ্যাঁ তাদের বাড়ির মেয়ে সুখে আছে। দিন ফেরিয়ে রাত এলো।

অচেনা স্বামীর সাথে একা একই বিছানায় আমি। আগের দিনের মত তার পুরুষত্ব জেগে উঠলো,আমায় ঝাপটে ধরে পাগলের মত করছে সে,তাকে বললাম-

– শুনন আমার খুব ব্যথা করছে।
– কিসের ব্যথা?
– আমার অঙ্গে খুব কষ্ট হচ্ছে।
– প্রথম প্রথম তাই,ঠিক হয়ে যাবে।
– আমার ভাল লাগে না।
– কি?
– আপনি যা করতে চাচ্ছেন।
– তবে বিয়ে করলে কেন?
– বিয়ে কেন করে মানুষ?
– আমি যা করছি তার জন্য,চুপ করে
থাকো তুমি,সব ঠিক হয়ে যাবে।

মরার উপর খাড়া ঘার মত হলো। কষ্টের মাঝে আরো বেশি কষ্ট।
তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। সত্যি পুরুষ মানুষদের অনেক শক্তি থাকে। নতুন নতুন মানিয়ে গুছিয়ে নিতে একটু সমস্যা হলেও সময়ের সাথে সাথে মানিয়ে নিয়েছি।

কতটুকু পেরেছি তা বুঝার বাকি ছিলো। শ্বাশড়ি মা সব সময় বলেন- বউমা তোমার এই কাজ হয় না,ওই কাজ হয় না,ঠিক মত কর, সংসারে মন দাও,আমার ছেলেমেয়েদের যত্ন কর, তুমি বড় বউ,এসব কিছুর দায়িত্ব তোমার। দেবর,ননদ,শ্বাশড়ি,শ্বশুড় এবং স্বামীর মন জয় করতে পারছি না,কেন এমন? কোন কাজে কি তবে ত্রুতি হয়?? প্রতি রাতে স্বামী তাকে পুরুষ প্রমান করে ঘুমিয়ে পড়েন,কখন মন খুলে একটু সময় নিয়ে কথা বলে না,সারা দিন সবার কথা শুনতে শুনতেই যায়। দিনে সবার কথা শুনা এবং রাতে স্বামীর কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নাম কি সংসার?? প্রায় ৩ মাস কেটে যায় স্বামীর বাড়িতে।

হঠাৎ এক রাতে স্বামী বলে উঠলেন-

– শুনছো বউ…
– হুমম বলেন,কিছু লাগবে?
– না কিছু লাগবে না।
– কিছু বলবেন?
– হ্যাঁ,শুন বউ তুমি কাল তোমার বাবার কাছ
থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা এনে দিও।
– কি বলছেন!! এত টাকা! কেন আনবো?
– আনতে বলেছি এনো তুমি।
– আমি পারবো না এত টাকা বাবার কাছে চাইতে।
কিছু বুঝে উঠার আগেই কারোর হাতের
জোরালো স্পর্শ পড়লো মুখে।
চট করে দুটো থাপ্পড় মেরে রুম থেকে বের
হয়ে গেলেন উনি।
সকালে শ্বাশড়ী মা একই কথা বললেন।
জবাবে না বলে দিলাম।
শ্বাশড়ী মা এসে দু’ঘা মারলেন।

কাঁদতে কাঁদতে রুমে গিয়ে নিজে কে স্থীর করলাম। প্রায় রাতে অর্থের জন্য মার খাওয়া বা স্বামীর পুরুষত্বের কাছে শিকার হওয়া আমার অভ্যাসে দাড়িয়ে ছিলো। বছর ঘুরতেই আমার দেহে অন্য এক দেহ বড় হতে লাগলো,স্বামীর বাড়ির লোকজন খুশি হলেন না এমন কিছুতে,রাতে স্বামী বললেন-

– তুই কি ঔষধ খাচ্ছিলি না?
– হ্যাঁ খাচ্ছিলাম।
– তবে তোর পেটে বাচ্ছা এলো কি করে?
– আমি কি করে বলবো।
– তুই জানিস না!
– না।

রাগান্বিত হয়ে দু’ঘা মেরে রুম থেকে বের হয়ে যান তিনি।
তাকে সেদিন প্রথম মিথ্যা বলেছিলাম,আমি ঠিক মত ঔষধ খাচ্ছিলাম না,আর দশ জনের মত আমারও স্বাদ হয়েছিলো মা হওয়ার জন্য। কিন্তু স্বামীর বাড়ির কেউ এতে খুশি না।
রাতে স্বামী ঘরে ফিরে বললেন-

– এই ঔষধটা খেয়ে নাও।
– কিসের ঔষধ!
– এটা খেলে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে।
– আমি কখন এমন কাজ করবো না।
– তুই খাবি না,তোর বাপ খাবে।
– একটা সন্তান হলে কি ভাল হয় না?
– সন্তান কে লালনপালন কি তোর বাপ করবে?
– তুমি সরকারী চাকরী কর।
– মিথ্যে,মিথ্যে ছিলো তা।

স্বামীর মুখে এমন কথায় নির্বাক হয়ে বসে পড়লাম। কখনো কেন বুঝতে পারলাম না সে বেকার। মিথ্যা দিয়ে বুনা জাল কেন ধরতে পারলাম না। এখন বুঝতে পারছি কেন বার বার বলেছিলো বাবার কাছ থেকে অর্থ এনে দিতে।
তবে যাইহোক আমার সন্তান কে আমি পৃথীবিতে আনবো।

বছর ঘনাতেই ঝলমলে আলো ফুঁটিয়ে আমার কণ্যা সন্তান আসেছিলো দুনিয়াতে। সবাই আনন্দে আত্মহারা।
ডাক্তারবাবু যখন বলেছিলেন আমার মেয়ে সন্তান হয়েছে তখন আমার স্বামী চোরের মত হসপিটাল থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো। সে খুশি ছিলো না মেয়ে সন্তান হওয়াতে,তার

আশা ছিলো ছেলে সন্তানের স্বামীর বাড়িতে আর ঠায় হলো না আমার। বাপের বাড়িতে চলে আসলাম। স্বামী তালাকনামা পাঠিয়েছেন। তাকে মুক্ত করে দিয়েছি। যে পাখি পোষ মানে না তাকে খাঁচায় বন্দি করে কি করবো! উনার কাছে কি তবে স্বামীর সংসার বলতে তার পুরুষত্ব দেখানো ছিলো??

ভালবাসার কোন চিলেফোঁটা কি ছিলো না তার মাঝে!

একাকিত্ব একা আমি আমার মেয়ে সন্তান কে নিয়ে বেশ সুখে আছি। আমি একজন মা। আমি হবো আমার সন্তানের বাবা।

আমার সন্তান আমার পরিচয়ে বড় হবে। চিৎকার..
একটা শিশু যখন আর একটা শিশুর জম্ম দেয় তখন তান চিৎকার কয়জন শুনতে পায়। আমি একা বড় করবো আমার মেয়ে কে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত