প্রতারণার আড়ালে

প্রতারণার আড়ালে

কলেজ মাঠের এক ধারে, বাঁধানো একটা গাছের নিচে বসে আছে অরু। পুরো নাম অরুণিমা, সংক্ষেপে অরু বলেই ডাকে সবাই। সে অপেক্ষা করছে একজনের জন্য। কিন্তু যার জন্য অপেক্ষা করছে তার কোনো খবর নেই। এদিকে কলেজের ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। অরু উঠতে যাবে। হঠাৎ এমন সময় কলেজের গেট দিয়ে কলেজে প্রবেশ করলো ফয়সাল। অরু খুশি হয়ে উঠেও তা বিলীন হয়ে গেল। কারণ ফয়সাল একা না তার হাত ধরে আরেকটা মেয়েও ঢুকলো কলেজে। অরুর তখন মাত্র অবাক হয়ে চিৎকার দেয়া বাকি ছিল। তবে তা বন্ধ করে এগিয়ে গেল ফয়সালের দিকে। আগে সে কখনো এই মেয়েকে এই কলেজে দেখেনি। জানতে হবে মেয়েটি কে এবং মেয়েটির সাথে ফয়সালের সম্পর্ক কী? আর এভাবে হাত ধরাধরি করে হাটতে হবেই বা কেন?

ফয়সাল আর অরুণিমা দুজনেই ইন্টার ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। এইতো কিছু দিন পরেই এইচএসসি পরিক্ষা দিবে। তাদের প্রেমের সম্পর্ক ৩ বছর। ক্লাস ১০ থেকে সম্পর্ক। একই স্কুলে না পড়লেও একই কোচিং সেন্টারে পড়তো ৮ থেকে। এদিকে ফয়সাল ভালো ছাত্র আর অরুও ভালো ছাত্রি। এ সূত্র ধরে তাদের বন্ধুত্ব। এবং অবশেষে তা থেকে প্রেমের পরিণতি।

অরু দ্রুত এগিয়ে গেল ফয়সালের কাছে। ফয়সাল সেটা দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে এল। এবার অরু ভালোই অবাক হয়ে গেল। তাহলে কী ফয়সাল তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে? কারণ কী? তাকে এর কারণ জানতেই হবে যেভাবে হোক। এদিকে ফয়সাল তো রীতিমত মেয়েটির সঙ্গে আড্ডা জমিয়ে দিয়েছে। হাত ধরা ধরি, একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়া। আর এদিকে এসব দেখে অরু রাগে ফুঁসছে। রাগ সামলাতে না পেরে অরু এবার সরাসরি ফয়সালের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সরাসরি তাকে প্রশ্ন করে,

— এসব কী ফয়সাল? এই মেয়েটি…

অরুকে কথা শেষ না করতে দিয়েই ফয়সাল বলে উঠলো,

— এসব নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। আপাতত লাইব্রেরি রুমে যাও।

এমন সময় ফয়সালের পাশে বসা মেয়েটি বলল,
— এই মেয়েটি কে?

ফয়সাল উত্তর দেয়,

— আসলে আমার সহপাঠী। পড়া বুঝতে চাইছিলো। সেজন্যেই এখন এসেছে বোধ হয়।

এসব কী শুনছে অরু। যা শুনছে সব ঠিক শুনছে তো? নাকি ভুল শুনছে। সে তো এখন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যদিও তার মনে প্রশ্নে ভরপুর, তবুও সে আর এক মুহুর্ত কথা না বাড়িয়ে লাইব্রেরিতে গেল। খানিক বাদেই ফয়সাল এসে পৌছালো সেখানে। ফয়সাল ঢুকতে না ঢুকতেই অরু তাকে প্রশ্ন করলো,

— মেয়েটি কে?

ফয়সাল উত্তর দিল,

— তা জেনে কী করবে?

অরু উত্তর দিল,

— তোমার নতুন প্রেমিকা তাই না?

ফয়সাল নির্বিঘ্নে উত্তর দিল,

— হু..

অরু বলল,

— দেখ মজা করো না।
— আমি মজা করছি না। তাছাড়া এখানে মজা করার কারণ নেই। (ফয়সাল)
— মানে? (অরু)
— যা শুনেছো সব সত্য।

অরু হতভম্ব হয়ে উত্তর দিল,

— মানে কী এসবের? এসব করার কী খুব দরকার ছিল? আমাদের ৩ বছরের রিলেশন কী এতটাই ঠুনকো ছিল? কী দোষ ছিল আমার? যে অন্য আরেকটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক করতে হলো?

ফয়সাল উত্তর দিল,

— তোমার দোষ ছিল না। তোমার চেয়ে ও যথেষ্ট স্মার্ট আর সুন্দরী। আর কোনো কথা নয়, ও তোমার তোমার সাথে এত ক্ষণ থাকলে সন্দেহ করতে পারে। আজ থেকে তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়। বায় ভালো থেকো।

এই বলে ফয়সাল লাইব্রেরি হতে বের হিয়ে গেল। লাইব্রেরিতে শুধু পরে রইলো কান্নারত অরু। সেদিন এর পর থেকে তারা সত্যিই আলাদা হয়ে গেল। এর পর থেকে ফয়সালও কলেজে আসে না। অরু জানতে পারে নি অই মেয়েটির নাম। তবে এটা নিশ্চিত মেয়েটা এই কলেজের কেউ নয়। আর এজন্যেই হয়তো ফয়সাল কলেজে আসে না। অরু আর ঘাটায় না। যাকে এত বেশি ভালোবেসেছিল, আর সেই কী না এত বড় ধোকা দিল। তাকে ছেড়ে চলে গেল। এভাবেই চলতে থাকে। একসময় এইচএসসি এর পরিক্ষাও শুরু হয়ে গেল।

পরিক্ষার কেন্দ্রে পাশাপাশি রুমেই তাদের সীট পড়েছে। প্রথম দিন প্রথম পরিক্ষা অরুর ভালো ভাবেই শেষ হলো। তারপর বাহির হতে গিয়েই দেখলো , ফয়সাল মাঠ দিয়ে হেটে হেটে গেট দিয়ে বাহির হয়ে যাচ্ছে। অরু ডাক দিতে গিয়েও ডাক দিল না। কারণ সে তো অন্যের হয়ে গেছে, তার কী আর অধিকার আছে? তবে সে একটা জিনিশ খেয়াল করলো, ফয়সাল আগের তুলনায় অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। এভাবেই প্রতি পরিক্ষার পর ফয়সালের সাথে দেখা হয়। কিন্তু কোন কথা হয় না। বরং বলা যায় অরু কথা বলারই চেষ্টা করে না। এভাবেই পরিক্ষা শেষ হলে, এবার যেন তাদের মুখ দেখেদেখিই বন্ধ হয়ে গেল।

এভাবে কয়েকমাস পর রেজাল্টের দিন ঘোষণা করা হলো। সেদিন উপস্থিত হলো সবাই কলেজ ক্যাম্পাসে। অরুও এসেছে। আসার পর থেকেই সে আশেপাশে কাকে যেন খুঁজছে। হয়তো ফয়সালকে। কিন্তু তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। এদিকে প্রিন্সিপাল কলেজ টপার দের নাম বলে চলেছে। কলেজের টপ ১০ এর মধ্যে অরু ৪র্থ হলো। আর প্রথম হলো ফয়সাল। অরু আশা করেছিল এবার হয়তো তাকে দেখা যাবে। কিন্তু ফয়সাল উঠলো না। ফলে প্রিন্সিপালও অন্য দিকে মনযোগ দিল। তবে অরু ভাবছে আজ আসলো না কেন? তবে সে ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। সে ব্যস্ত হয়ে গেল তার বন্ধুদের নিয়ে। এভাবেই বয়ে চলেছিল সময়।

৫ বছর পর..
অরু এতদিনে বিয়ের কাজ সম্পুর্ণ করে ফেলেছে। আজ তাদের বিয়ের ১ বছর পূর্ণ হলো। সেজন্যেই কেনাকাটা করতে এসেছে মার্কেটে। অরু পারিবারিক ভাবে ঠিক হওয়া ছেলেকেই বিয়ে করেছে। ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মোটামুটি ভালোভাবেই চলছে তাদের সংসার। এদিকে অরু এই দোকান সেই দোকান ঘুরে কেনাকাটা করতে ব্যস্ত। এমন সময় সে একটা মেয়েকে লক্ষ করলো। সেই মেয়ে যার জন্য ফয়সাল তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি একা নয়। সাথে ২-৩ বছরের একটি ছেলেও আছে। অরু মনে মনে ভাবলো, হয়তো ফয়সালের ছেলে। অবশ্য এমনটা না মনে হবার কারণও নেই।

অরু মেয়েটির কাছে যাবে কী যাবে না ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে। গিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে,

— বাহ সুখী ফ্যামিলি মনে হচ্ছে? বিয়েও ককরে নিয়েছো। বাচ্চাও আছে দেখছি। তা তোমার স্বামী আই মিন ফয়সাল কোথায়?

মেয়েটি উত্তর দিল,

— যথেষ্ট সুখী ফ্যামিলি। হ্যা বিয়ে করলেই বা তোমার আপত্তি কিসের? তুমি নিজেও বিয়ে করেছো। তবে একটা কথা জানানো দরকার, ফয়সাল আমার স্বামী নয়। ওই যে ছেলেটাকে দেখছো উনিই আমার স্বামী। নাম তানভীর।

অরু এবারর বলল,

— তাহলে ফয়সাল? তাকে ছ্যাকা দিয়ে ব্যাকা করে দিয়েছো মনে হয়। অবশ্য এটাই ওর প্রাপ্য ছিল। যার যেমন কর্ম তেমন ফল।

এবার যেন মেয়েটির কথায় রাগের আভাস পাওয়া গেল। চেপে চেপে উত্তর দিল সে,

— ওর সাথে আমার কখনো রিলেশন ছিল না। তাছাড়া যা ইচ্ছা বলো। তবে ওকে নিয়ে বলার কোনো দরকার নেই। কারণ আজ অব্দি এক ফোটা সত্যও তুমি জানো না।

অরু বলল,

— প্রতারক কে প্রতারক বললে তো আর পাপ না।

মেয়েটি উত্তর দিল,

— যদি ফয়সাল প্রতারকই হয়ে থাকে তাহলে তুমি যে সব চেয়ে বড় প্রতারক।

অরু উত্তর দিলো,

— কীভাবে?

মেয়েটি বলল,

— আসো আমার সাথে। আজ সব সত্য জানাবো তোমাকে। আজ আর বাধা নেই সত্য জানাতে।

অরু ভাবছিলো কী সত্য, যা তার জানা দরকার। তবে মেয়েটির সাথেই চলল। মেয়েটি তার ছেলেকে তার স্বামীর কাছে দিয়ে এল। তারপর মেয়েটি ফয়সালদের বাড়িতে নিয়ে এল। অবশ্য অরু আগে কখনো ফয়সালের বাড়ি দেখে নি। তবে ঠিকানা টা তার জানা ছিল। মেয়েটি অরুকে বাড়ির পাশে বাগানে নিয়ে গেল। সেখানে ২ টো দোলনা আছে। অরু ভাবলো সেখানে বসে সব কথা বলল। কিন্তু মেয়েটি ওগুলোর ধার ধরলো না। সে সোজা একটা কোনে একটা কবরের দিকে নিয়া গেল। অরু যখনই জিজ্ঞাসা করতে যাবে যে তাকে কবরের কাছে নিয়ে এল কেন? কিন্তু যেই জিজ্ঞাসা করতে যাবে হঠাৎ নাম ফলকের দিকে নজর পড়লো। আরে ফয়সালের নাম লেখা না। হ্যা তাইতো, লেখা আছে ‘ফয়সাল আহমেদ’ জন্ম- ২৮/১০/১৯৯৬, মৃত্যু- ২০/৭/২০১৪। এটা তো ফয়সালেরই পূর্ণ নাম আর জন্ম তারিখ। কিন্তু কীভাবে কী? কিছুই অরুর মাথায় আসছে না।

মেয়েটি হয়তো বুঝতে পেরেছি অরুর ভাবনা গুলো। তাই বলল,

— হ্যা তুমি যা ভাবছো তাই। ফয়সাল মারা গেছে। আজ থেকে ৫ বছর আগে। ব্রেইন ক্যান্সার হয়েছিল ওর। কবে ধরা পড়েছিল জানো। তোমার সাথে যেদিন ব্রেক আপ করেছিল ও, ঠিক তার আগের দিন। একেবারে লাস্ট স্টেজ। ডাক্তার ২-৩ টা মাস সময় ঘোষণা করেছিল। উন্নত চিকিৎসাতেও লাভ হত না। এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।

অরু ততক্ষণে নির্বাক হয়ে মাটিতে বসে পড়েছে। তবে মেয়েটি নিজের মতই বলে চলেছে,

— সেদিন পুরো এক রাত সে জেগেছিল। সাথে জেগেছিলাম আমিও। সে বার বার তোমার কথা বলছিলো। চাইছিলো না তুমি কষ্ট পাও। তার পরেই সে এমন সিদ্ধান্ত নেয় যেন তুমি তাকে ঘৃণা করো। আর এতে আমি বারণ করি। তবে তার জেদ আর তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি রাজি হই। আর এতে হেল্প করি আমি। আরেকটা কথা, সে ভাবছিল কী জানো, ওর নাটক তুমি বিশ্বাস করবে না। ও চাইছিলো ভুল বুঝো। কিন্তু আশা নিয়েছিল বিশ্বাস করবে না নাটকটা। কিন্তু বিশ্বাস করলে। সে কলেজ যায় নি শুধু তোমার সামনে পড়ার ভয়ে। সে পরিক্ষাও দিতে চাইছিলো না। আমিই জোর করে তাকে পাঠিয়ে ছিলাম। রোজ সে তোমাকে দেখতো। কথা বলতে চাইতো। কিন্তু বলতো না। ও আশায় থাকতো তুমি হয়তো ওর সাথে কথা বলবে কিন্তু বলো নি একদিনও। সে প্রতিদিন আমার কাছে সব খুলে বলত। সব সময় কাছে পেতে চাইতো তোমায়। কিন্তু পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নিত। কারণ সে এটাই চেয়েছিল। তুমি যেন ওর থেকে দূরে থাকো। এভাবেই সময় চলে গেল। তার সময় আরও ফুড়িয়ে যেতে থাকলো। এক পর্যায়ে হাস্পাতালে ভর্তি হতে হলো। রেজলাটের দিন, বাহির থেকে মোবাইলে যখন ওর রেজাল্ট এর খবর জেনে তাকে জানাতে গেলাম ভেতরে। তবে ততক্ষণে সে চলে গিয়েছে আমাদের সবাইকে ছেড়ে। হতভাগা ছেলেটি শেষ পর্যন্ত তার রেজাল্ট জেনে যেতে পারে নি। আর আমি কে জানো, ফারিয়া। ফয়সালের চাচাতো বোন। আমার কথা অনেক শুনেছো ওর কাছে। ফোনে কথাও বলেছিলে আমার সাথে। আমিই ফয়সালের কাছের বন্ধু ও চাচাতো বোন। এখন নিশ্চয় চিনতে পেরেছো। এখন তাহলে তুমি নিজেই ভাব প্রতারক কে?

অরু ততক্ষণে কান্না করছিল। জোরে নয় নিরবে। ফারিয়া আর তাকে ঘাটালো না। আজ তার ঘাড়ে চাপানো বোঝা নেমে গেছে। অনেকদিনের পড়ে থাকা কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। সে তার ফোন দিয়ে তানভীরকে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ দিয়ে কাকার বাড়িতে আসতে বলল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিল। তবে কী উদ্দেশ্যে কাকে উদ্দেশ্য করে দিল তা না হয় ফয়সালের আড়ালে যাবার মতই আড়াল থাকুক…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত