তুষার কথনঃ
ফ্যান্টাসিতে বিশ্বাসি এই আমি যখন আবিষ্কার করলাম যে সচ্ছ কাচ বীহিন কানা ওই ভাবের বস্তার উপর আমি নাকমুখ থুবড়ে প্রেমে পড়েছি , পাঠক বিশ্বাস করবেন না- সেই মহুর্তে আমার নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ হয়েছিলো।
প্রেম জিনিসটা কি ? বোঝার পর থেকেই ভাবতাম আমার সপ্নবালীকার সাথে আমার দেখা হবে একদম সপ্নের মতো। হয়তো তাকে আবিষ্কার করতাম দুরযাত্রার ভ্রমন সঙ্গী হিসেবে । হয়তো কোন জৎস্না রাতে পথ হারা কোন জোৎস্নাবতীর বেশে । হয়তো কোন মুখোমুখি কোন সংঘর্সে মিষ্টি হাসিভরা কোন মায়াবতীর বেশে । কিন্তু পাঠক যেদিন আমাদের দেখা হলো- সেই অলুক্ষুনে দিনের কথা মনে পড়লে আজও আমার ডান হাত গালে বিদ্যৎ গতিতে প্রতিস্থাপিত হয় ।
প্রচন্ড গরমে সিদ্ধ হয়ে বিকেল সাড়ে তিনটের দিকে বিরক্তি মাখা প্রাক্টিক্যাল ক্লাসটা সেরে বের হতেই মনে হলো পেটের ইদুরগুলোর ছুটোছুটি বেড়েছে । ওগুলোকে শান্ত করতে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে হাটতে হাটতে যখন কম্পিউটার ডিপার্টমেন্ট এর মাঝামাঝি চলে এসেছি পাঠক বিশ্বাস করবেন না, আমার কপালে শনি,রাহু,কেতু সব গুলোই মনে হয় একি সাথে প্রদক্ষিন করেছিলো । ঠাস! শব্দ হতেই যখন নিজের ডান হাত গালে আবিষ্কার করলাম তখনি বিশ্বাস হয়ে গেলো যে বিজ্ঞানের কোন কিছু মিথ্যে নয় । পৃথিবী প্রতিনিয়ত ঘুরছে । পৃথিবী ঘুরছে সে নাহয় ঠিক আছে কিন্তু এতো জোরে ? মাথা ঘুরা বন্ধ হতেই আমি লক্ষ করলাম আমার সামনে দাড়ানো মোটা ফ্রেমের চশমা পরা ঠিংঠিঙে মেয়েটিকে। সাদা সাদা স্কার্ফে মুখ বাধা । একহাতে ল্যাপটপ পিঠে বইয়ের ভারে ঝুলে পড়া কালো ট্রাভেল ব্যাগ। এই আগুন ঝরানো সুন্দরী মেয়েটি যখন আমার সামনে কোন বিষয় নিয়ে তীব্র রাগে হাতমুখ নাড়িয়ে কোন বিষয় নিয়ে বকবক করতে ব্যস্ত ততক্ষনে আমি ভাবছি এই ঠিংঠিঙে মেয়েটির হাতে কিকরে এতো জোর? যে কিনা প্রমান করেই ফেল্ল পৃথিবী ঘুর্ণায়মান । পাঠক জেনে অবাক হবেন যে আমি একটা বিষয় নিয়ে খুবই খুশি হলাম যে ভাগ্যিস দাতগুলো দুধদাত ছিলো না। নয়তো আমার মতো সুদর্শন দেখতে কাউকে যদি কেউ ফোকলা বলে ডাকতো তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাড়াতো ভাবতেই আমার জ্বর আসে ।
আর যদি কোনদিন আমার বান্ধবী তো দুরের কথা অন্য কোন মেয়েকে টিজ করতে দেখি তবে আপনার ফোকলা ডাক শোনা কেউ আটকাতে পারবে না।’’ কথা টি শোনামাত্রাই রিতিমত আকাশ থেকে পড়লাম । কোন মেয়েকে টিজ! তাও আমি ? যখন আমি এসব ভাবছি ততক্ষনে মেয়েটি কম্পিউটার ডিপার্টমেন্ট এর দিকে ঢুকে গেছে । পাঠক বিশ্বাস করবেন না সেই মহুর্তে আমি বাসায় থাকলে হয়তো চোখের পানিতে বাসায় বন্যা বয়ে যেত।
এর পরের ঘটনাগুলো তো আরো দ্রুতই ঘটে গেলো । খুব অল্প সময়ের ভিতরেই আবিষ্কার করলাম আমাকে নিজের সিভিল ডিপার্টমেন্টে এ যেন তেন কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের আশেপাশেই বেশি পাওয়া যেত । পাঠক জানেন আমি কত চিঠি ইতি নামের এই দুইবছরের জুনিওর অধিক পড়ুয়া ভাবধরা মেয়েটিকে কল্পনা করে ওর ডিপার্টমেন্টের আশেপাশে ফেলেছি । রোজ কত তীব্র ভালবাসা মাখা চিরকুট তার রাস্তায় ফেলেছি । কিন্তু কোনদিন আর সেই চিরকুট কিংবা তার উত্তর কোনটাই পাই নি। পরদিন আশায় বুক বেধে আবার লিখেছি কিন্তু তার ভাবের কোন পরিবর্তন হয় নি ।
পাঠক হয়তো ভাবছেন আমি এসব না করে সরাসরি বলছি না কেন ? তাহলে লজ্জার মাথা খেয়ে বলছি শুনুন… আমি জানিনা কেন এই মেয়েটির আশেপাশে গেলেই আমার হাতপায়ের কাপুনি শুরু হয়ে যেত। ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে বাচাল ছেলেটা কিভাবে তৎলা হয়ে যেত সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । তবুও শেষ বর্ষে অনেক জল্পনা, কল্পনা,রিহার্সেল এবং এক বুক সাহস নিয়ে সেদিন দাড়িয়েছিলাম তার সামনে । বলেছিলাম- ‘’ ইতি একটু দাড়াবে?’’ মুখে বিরক্তি ভাব নিয়েই যখন বললো “ জ্বি কি বলবেন ? জলদি বলুন ! আমার অতো ফালতু সময় নেই।” ততক্ষনে আমার শীতের মেঘশুন্য আকাশে বৃষ্টির আভাস পেয়েছি । কিন্তু তাই বলে তো আর কষ্ট রোজ বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয় । পাঠক তার আমার প্রতি ঔদাসিন্য ভাব দেখে যে রোজ কতবার মরি সেকি তা জানে ? পাঠক বলতে পারেন আমার সকল অনুভুতি নিংড়ানো চিরকুট গুলোর প্রতিদান কি পৃথিবীর কোন সম্পদ দিতে পারবে ? আমি একবুক শীতল নিঃশাস নিয়ে আবার কিছু সাহস সঞ্চয় করে তার চোখে তাকাই । ” তোমার বর্ষাগুলো আমাকে দেবে ?জানালার ভেজা বাতাস গুলো বার্তা দেবে আমাদের । খুব করে বৃষ্টি হবে একদিন । ছাদের কার্ণিশে দাড়িয়ে একদিন ভিজবে আমার সাথে? তোমার কানের পাসের চুল থেকে চুয়ে পড়া পানিগুলো দেখে খুব হিংসে হবে সেদিন । দেবে ?সেই চুল গুলো কানের পাশে গুজে দেয়ার অধিকার ? কথা গুলো বলতে বলতেই যখন তার চোখে তাকাই ,পাঠক আমি খুব অবাক হয়েছিলাম কারন আমার চোখে তাকে পাওয়ার তীব্র হাহাকার তার বোধগম্য হয় নি । তার সুরে ভেসে এসেছিলো তাচ্ছিল্যতা । – “ এসব আজাইরা চিন্তা ভাবনা কোৎথেকে আসে মাথায়? আর হ্যা! আপনি এরকম ছোটলোকের মতো আচরন করেন কেন বলেন তো ? আর আপনার দৃষ্টি এতো খারাপ কেন ? কেন এত ভয়ংকর ভাবে তাকান আপনি ? জানেন আপনার জন্য আমার কতটা অসস্তি হয় । ফার্দার যদি আপনাকে আমার আশেপাসে না দেখি । তবে আমি ভুলে যাব আমি আপনার সিনিওর ।’’
এরপর আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না । আমার এই তীব্র যন্ত্রনায় ভরা করুন মুখটি দেখে কিছু না এই বোঝা এই মেয়েটিক আর কি বলার থাকতে পারে বলতে পারেন ? আমি বাকরুদ্ধ হয়ে ঠায় দাড়িয়ে থাকি । ইতি ধীর পায়ে হেটে ক্যাম্পাস গেটের দিকে মিলিয়ে যায় । বিকেল গড়িয়ে সন্ধা হয় আমি ধীর পায়ে আমার অবস্থান প্রতিস্থাপন করি নিজের গ্রামে । আমার উঠোনে ধীরে ধীরে রাত বাড়ে । আমার আর সকাল হয় না । আমার নির্ঘুমে কাটতে থাকে কত রাত। আমার জানালা দিয়ে আর রোদ গুলো হুড়মুড়িয়ে ঢোকে না । এক ঘর অন্ধকার আর কষ্ট নিয়ে তৈরী হয় আমার পৃথিবী । কতসহস্র রাত আমার ঘরে জৎস্না ঢোকে না ওই মেয়েটি কি তা জানে ?
ইতি কথনঃ
ভুল করে থাপ্পড় মারা সেই গভীর মায়ায় ভোরা চোখওয়ালা ছেলেটার প্রেমে আমি কিভাবে পড়েছিলাম তা আমার জানা নেই । পাঠক সে কি জানে ? তার সেই ভয়ংকর দৃষ্টি নিয়ে তাকানো আমি কত্ত সহজে পড়ে ফেলতে পারি। তার কি জানা আছে আমি তার অনুভুতি নিংড়ানো সেই প্রত্যেকটা চিরকুট পরম ভালোবাসায় কিভাবে প্রতিটা মহুর্ত আগলে রেখেছি । সে কি জানে তাকে লুকিয়ে দেখতে গিয়ে কিংবা তার চিরকুট সংগ্রহ করতে গিয়ে কতশত প্রোগ্রামিং ক্লাস মিস দিয়েছি , কতশত দিন কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের আশেপাশে থেকেও অনুপস্থিতির খাতায় নাম লিখিয়েছি। তারপরও গাধাটার সাহস হয়নি । কত দিন অপেক্ষায় থেকেছি তার পিছু ডাকের। একসময় তার ওপর বিরক্তির অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি কিন্তু সত্যি বলছি পাঠক ভালবাসা কমেনি একটুও বরং বেড়েছে । আমি আবার অপেক্ষা করি। একসময় অভিমান জমে । ভেবে রাখি প্রথম যেদিন কথা বলবে খুব করে বকে দেব। জানি কষ্ট হবে। কিন্ত আমারি তো পরে ঠিকি সবকিছু ঠিক করে নেব। এর পর অনেক গুলো দিন কেটে যায় । আমার অভিমান বাড়ে । তারপরিই আসে সেই কাঙ্খিত দিন। পাঠক একটা সত্যি কথা বলি কাউকে বলবেন না, ও যখন প্রথম আমাকে ডেকেছিলো – আমার কি হয়েছিলো জানেন ? ইচ্ছে হয়েছিলো দৌড়ে গিয়ে সয়তান ছেলে টাকে জড়িয়ে ধরি । তার পরম ভালবাসার অলিঙ্গনে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নিই। শতশত কিল ঘুশি শেষে তার বুক মুখ লুকিয়ে শান্তিতে কিছুক্ষন কাঁদি । কিন্তু ’’কষ্ট থাকলে কপালে, ঠ্যাকায় কোন গোপালে? ’’ আমার অভিমান গুলো হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।
এরপর আর কোন দিন আমার রোদে তার ছায়া পড়েনি । পাঠক কিরকম ভালবাসতো সে আমাকে ? সে কিভাবে পারলো আমার কাঠিন্যতার আড়ালে ঢাকা আমিকে উপলদ্ধি না করতে? কেন সে দেখলো না একবুক কষ্ট নিয়ে তার সামনে থেকে চলে আসাটা? কিভাবে পারলো আমার হাতের উল্টোপিঠে থাকা অশ্রুগুলোকে উপেক্ষা করতে? সে কি জানে পরদিন কিভাবে আমি পাগলের মতো সিভিল ডিপার্টমেন্টের অলিগিলিতে খুজেছি ? সে কি জানে ? কতদিন তার কথা ভাবতে ভাবতে উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায় হেটেছি ? সেকি জানে তাকে উপলদ্ধি করে বৃষ্টিতে ভিজে কতরাত কেটেছে বিছানায় ? তার কানে কি পৌছেছে আমার সেই নির্ঘুম রাতের প্রলাপগুলো ?
পরবিষ্টঃ
এরপর কেটেগেছে অনেক গুলো রাত । আবার নতুন করে বর্ষা আসে । ইদানিং রোজ রোজ আকাশে মেঘের ঘনঘটা শুরু হয়। আমার মনের আকশেও মেঘ জমে । মেঘে মেঘে ধাক্কা খেয়ে বিদ্যুৎ চমকায় ।
আচ্ছা পাঠক বলতে পারেন? সৃষ্টিকর্তা বুকের বা পাশের ওই বিচ্ছিরি রকমের অসহ্য কষ্টের নাম ভালবাসা দিতে গেলো কেন? মানুষ কিভাবে এই বিচ্ছিরি রকমের যন্ত্রনা সহ্য করেও রোজ রোজ নতুন ভাবে ভালবেসে যায় বলতে পারবেন ? পারবেন না না?
সকালে বিছানায় থাকাতেই টুং করে মেসেজটা আসে। অচেনা নাম্বারের এই মেসেজ টা আমার ঘরে নিয়ে আসে যেন ছোট্টবেলার সেই ঈদের আনন্দ। আমি আলতো করে বিছানা থেকে নেমে জানালার সামনে দাড়াই। ঝট করে জানলা খুলে একটানে পর্দা সরিয়ে ফেলি । আমাকে পাশ কাটিয়ে আমার ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে সকালের সোনা রোদ । আমি মোবাইলটা আবার হাতে নিই । ধপ করে বসে পড়ি চেয়ারে ।বার বার পড়তে থাকি ,-’’ তুষার চোখ বন্ধ কর তো । তোমার জন্য বর্ষা এনেছি। অনুভব করতে পারছো? জানালার ভেজা বাতাস গুলো কি বলছে জানো? ওরা আমাদের নামে বার্তা নিয়ে এসেছে জানো ? জানো আজই সেই বৃষ্টির দিন? তুষার তুমি শুনতে পাচ্ছো আমার কানের পাশের চুলগুলো থেকে পড়া বৃষ্টির পানির টুপটাপ শব্দ ?
আসবে কি- একটু কি সাথে ভিজবে ?
খুব হিংসেতে ওই চুলগুলো কি একটু কানে গুজবে ?’’
আমি আনমনে হেসে উঠি । ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াই…