দ্বিতীয় জীবণ

দ্বিতীয় জীবণ

আমার বিয়ে হয়েছে, একটা বিবাহিত ব্যাচেলরের সাথে। অবশ্য বউ মারা গেলে তাকে widower বা বিপত্নীক বলে। কিন্তু বিপত্নীক শব্দটা বলতে আমার ভালো লাগে না। তার চেয়ে বিবাহিত ব্যাচেলর কথাটা বেশ ভালো শোনায়। হয়ত সবাই ভাবছেন যে এই বিবাহিত ব্যাচলর কে আমি কেনো বিয়ে করলাম! আসলে আমার সমবয়সী বা দু’ চার বছরের সিনিয়র কোনো ছেলেই আর অবিবাহিত ছিল না, এটা অবশ্য আমার ধারণা।আমি একজনকে ভালবাসতাম আর তার প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য আমি নয় বছর অপেক্ষাও করে ছিলাম। প্রতিষ্ঠিত হবার পর সে একদিন দেখা করে একটা বিয়ের কার্ড আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো-” ফ্যামিলীর চাপা চাপিতে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি বীথি, তোমাকে বিয়ে

করাতে কেউ রাজী নয়, ফ্যামিলীকে ম্যানেজ করতে পারলাম না। আই এম সো স্যরি বিথী!”আমি চুপচাপ শুনছিলাম। কি বলবো আমি? কি বলা উচিত আমার? সে তো সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে যে সে আমাকে বিয়ে করবে না। তারপরেও ওকে কিছু বলে নিজেকে ছোট করা কি ঠিক হবে আমার? যদি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদি তবে কি সে ফিরবে আমার জীবণে? না ফিরবে না, কারণ সে অলরেডী আমার পথ থেকে আলাদা হয়েই গেছে। সত্যিই কি একটা ছেলে তার ভালবাসার মানুষের জন্য নিজের ফ্যামিলীকে ম্যানেজ করতে পারে না? আমি মনে করি ছেলেরা সব পারে। এমন কি মেয়েদের সব কাজ ছেলেরা মেয়েদের চেয়েও অনেক ভালো পারে। এ কারণেই নামী দামী রেস্টুরেন্টের রাঁধুনী গুলো ছেলেই হয়ে থাকে। ছেলেরা একটা বউ থাকতেও আরেকটা বিয়ে করতে পারে যেটা একটা মেয়ের পক্ষে ইম্পসিবল, মেয়রা ডিভোর্স না করে রিম্যারেজ করতে পারে না। তাই আমার মনে হয় পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য ফ্যামিলী কোনো বড় বিষয় হতে পারে না। আসলে বিদেশ থেকে ডীগ্রি নিয়ে এসে শঙ্খনীল আমার লেভেল থেকে অনেক উপরে উঠে গেছিল তাই আমাকে তার পাশে আর মানায় না। কিন্তু আমি তো

দেখতে অসুন্দর নই, আমি উচ্চ বংশের মেয়ে, আমি এবং আমার ফ্যামিলী এডুকেটেড তাহলে আমাকে ওর পাশে কেনো মানাবে না?ওর হাতের ইশারায় আমার নিরবতা ভাঙলো। সে বললো-“প্লীজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড বীথি! তুমি যেনো আবার কমবয়সী মেয়েদের মত পাগলামী করে বসো না প্লীজ!”ওর কথা শুনে আমার মনে মনে খুব হাসি পেলো, আমি কি পাগলামী করবো? আর কার জন্যই বা করবো? সে না বললেও আমি জানি যে আমি কমবয়সী মেয়ে নই। ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমার বয়স সত্যিই অনেক বেশী হয়ে গেছে। ত্রিশ ছাড়িয়ে গেছে আমার বয়স। কত ভালো ভালো ছেলের সাথে আমার বিয়ে এসেছে, কত ভালো ভালো ছেলেরা প্রোপজ করেছে আমাকে অথচ আমি শঙ্খনীলকে ভালবেসে সব রিফিউজ করেছি। আর আজ সে আমাকে রিজেক্ট করলো।চলে যাওয়া বয়সটার ক্ষতি পূরণটা কে দেবে আমাকে? নয় বছর ধরে তাকে ভালবেসে প্রতিক্ষা করার প্রতিদান বোধ হয় একটু বড় সড়োই পেলাম। আমি কিছু না বলে ওর হাত থেকে বিয়ের কার্ডটা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার অপেক্ষিত নয়টা বছরের জন্য। এই আমি একটা সময় চোখ ধাঁধানো সুন্দরী ছিলাম। বয়সের কারণে আমার সৌন্দর্য্য অর্ধেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। চোখের গভীরতায় সেই উনিশ বছরের তারুণ্যতা আর নেই। ত্বকের

সজীবতাও আর আগের মত নেই। কার জন্য সবটা হারিয়েছি? যে কখনোই আমাকে ভালবাসতেই পারেনী! নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে এই ভেবে যে আমি একটা ভুল যায়গায় মন হারিয়ে ছিলাম ছিঃ!ছোট বেলা থেকেই আমি সোজাসুজি কথা বলতে পছন্দ করি তাইরাতে খাবার টেবিলে সবার উদ্দেশ্যে বললাম—“বাবা আমার এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করা উচিত, এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে আমার, আর এক সপ্তাহের বেশী সময় আমি নষ্ট করতে পারবো না।”সবাই বিস্ময়ের চোখে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সবাই চুপচাপ ওরা হয়ত বুঝতে পারছে না যে এখন কি বলা উচিত। বাবা বললেন—“অনেক দিন হলো তোমার বিয়ে তেমন ভালো ঘর থেকে আসে না। যখন আসত, যখন আসার সময় ছিল তখন তো তোমার সময় ছিল না। বিয়ে সাধারণ কিছু নয় যে তোমাকে যার তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দিতে পারবো। আমি ঘটক কে ফোন করে দেখবো যে তোমার চেয়ে বয়সে একটু বড় কোনো ছেলে পাওয়া যায় কি না।”পাঁচ দিন কেটে গেলো তবুও ঐ রকম কোনো পাত্র পাওয়া গেলো না।এক সপ্তাহ পর একটা পাত্রের সন্ধান মিললো, ছেলেটা বিপত্নী এবং তার একটা আড়াই বছরের মেয়ে আছে। এই প্রোপজটাতে বাসার কেউ রাজী ছিল না। বাচ্চাটা যদি না থাকতো তবে হয়ত বাবা মায়ের আপত্তি থাকতো না। আমি ছেলেটার ছবি দেখলাম, শ্যামলা গায়ের রঙ, বেশ লম্বা ছয় ফিট+ হবে, মিডিয়াম স্বাস্থ্য, আমার চেয়ে দুই কি তিন বছরের বড় হবে হয়ত।

বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে ছবিটা উঠেছে। বাচ্চাটার চেহারা বেশ মিষ্টি। গায়ের রঙ ফর্সা, বাবার মত দেখতে হয়নী। বাচ্চাটাকে দেখে মনে হলো ঠিক বয়সে আমার বিয়ে হলে এ রকম একটা মেয়ে আমারো হয়ত থাকতো।আমি বাবা মাকে বলে দিলাম যে এই ছেলেটাকেই আমি বিয়ে করবো। কারো কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাই না। মনে মনে ভাবলাম ঐ বাচ্চাটার মা আমাকে হতেই হবে।শঙ্খনীলের বিয়ের আগের দিন আমার বিয়ের ডেট ঠিক করালাম। আমি চেয়ে ছিলাম যে শঙ্খনীলের বিয়ের আগেই যেনো আমার বিয়ে হয়। যে সব কাপুরুষেরা পছন্দের মানুষটিকে বিয়ে না করার কারণ হিসেবে পরিবার আর পরিস্থিতির অযুহাত দেখায় তাদেরকে মনে রাখা মানেই মনটাকে অপমান করা, অসম্মান করা। পৃথিবীতে সবার কাছে আমি তুচ্ছ হতে পারি কিন্তু আমার কাছে আমি তুচ্ছ নই। বসে বসে শঙ্খনীলের বিয়ে দেখার মত সরল মন আমার আর নেই।আমার একটা ইনভিটেশন কার্ড ছাপানো জরুরী ছিল কারণ আমি ধার রাখতে পছন্দ করি না। পাত্রপক্ষ চায়নী যে বিয়েটা জাকজমক ভাবে হোক। তাই ইনভিটেশন কার্ড এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমার একটা মাত্র কার্ড ছাপানো জরুরী ছিল। তাই নিজেই চলে গেলাম কার্ড ছাপাতে। কেউ রাজী হচ্ছিল না মাত্র একটা কার্ড ছাপাতে। এক’শ টা কার্ডের দাম দিয়ে একটাই কার্ড ছাপানো হলো তবে শর্ত একটাই ছিল যে, সুধী বা জনাব/জনাবা এর স্থানে শঙ্খনীল লেখা থাকবে। আমন্ত্রণে বাবার নামের জায়গায়

থাকবে বীথিকা। এবং খামের উপরের শঙ্খনীলের নামটাও টাইপ করা হবে।কার্ডটা তৈরী করে শঙ্খনীলের ঠিকানায় কুরিয়ার করে পাঠালাম কারণ কোনো কাপুরুষের সামনে যেতে আমার ইগোতে আঘাত লাগছিল।যথারীতি আমার বিয়েটা সু সম্পন্ন হলো। আমি স্বামীর বাড়িতে গেলাম। একটা রুমে আমাকে বসানো হলো, ফুল দিয়ে তেমন করে সাজানো নয় ঘরটা। তবে ফুলদানীতে এক গোছা রজনী গন্ধা চোখে পড়লো। আমি রজনী গন্ধা একদম পছন্দ করি না কারণ এর গন্ধটা আমার খুব একটা ভাল লাগে না। অবশ্য আমি যে ফুলটা পছন্দ করি সেটা ফুলদানীতে শোভা পায় না।ঘন্টাখানেক পর দুই তিনটা মেয়ে আমার বর কে এক রকম জোর করেই এ ঘরে ঢুকিয়ে দিল। ওর নাম তৌসিফুর রহমান। দ্বিতীয় বিয়েতেও কি মানুষ এতটা লজ্জা পায়? কি জানি বাবা আমার অভিজ্ঞতা নেই। সে ঘরে ঢুকে ঠাই দাড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর সে বললো—“তোমাকে আমার কিছু বলার আছে”আমি বুঝলাম সে বাংলা সিনেমার মত কিছু কমন ডায়লোগ ঝাড়বে এখন। কি আর করা, শুনি তাহলে। বললাম—“বলুন আমি শুনছি”সে-“ফ্যামিলীর চাপা চাপিতে বিয়েটা করতে বাধ্য হলাম,তাই তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারলেও অধিকারটা দিতে পারবো না স্যরি”ওর কথা শুনে আমার কি বলা উচিত? একজন ফ্যামিলীর চাপাচাপিতে আমাকে বিয়ে করতেই পারলো না আর আরেক জন ফ্যামিলীর চাপাচাপিতে বিয়ে করে অধিকার দিতে পারছে না। তৌসিফের এমন ধরনের

কথা শুনে হয়ত সবাই ভাববে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে বা পায়ের তলের মেঝে সরে গেছে এরকম কিছু।আমি চুপচাপ দাড়িয়ে আছি। সে বললো—“ঠিক আছে গুড নাইট, পাশের রুমে আমার মেয়ে ঘুমিয়ে আছে তাই আমি ঐ রুমেই ঘুমাবো”সে চলে যাচ্ছিল তখন আমি বললাম—“দাড়ান, আমারও কিছু বলার আছে”সে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাড়ালো।আমি বললাম—“আপনি কি নাবালক?”সে অবাক হয়ে বললো—“মানে?”–“দেখুন আমি স্ট্রেইটফরওয়ার্ড কথা বলতে পছন্দ করি তাই বলছি নাবালকদের জোর করে বিয়ে করানো যায় কিন্তু আপনার মত বয়সী মানুষকে ফ্যামিলী জোর করে বিয়ে দেবে তাও আবার দ্বিতীয় বিয়ে, এটা কি ধুপে টেকার মত এক্সকিউজ হলো? তবুও ধরেই নিলাম আপনাকে জোর করে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছে তাতে আমার দোষ কোথায়? আপনাদের পারিবারিক কলহে আমি কেনো ভুক্তভুগী হবো?”সে চুপচাপ দাড়িয়ে, নিরবতা হয়ত ওকে ভর করেছে। আমি কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে শুরু করলাম—” দেখুন আমি বাংলা সিনেমার নায়িকা নই যে আপনি অধিকার দেবেন না বললেন আর আমি অধিকার নিলাম না। আপনি বিছানায় ঘুমালেন আর আমি ফ্লোরে। জীবণটা কোনো সিনেমা নয় মিস্টার, যে তিন ঘন্টাতেই শেষ হয়ে যাবে”–“আমি অনিমার যায়গাটা কখনো অন্য কাউকে দিতে পারবো না।”–

“কে চাইছে আপনার অনিমার জায়গা? মানুষের মনটা এতটাই ছোট নয় যে সেখানে একটা মানুষেই পুরো স্থান ভরে যাবে। আমি অন্য কারো স্থান দখল করতে চাই না। আমি অনিমার পাশে নিজের স্থান গড়ে নেবো।”–“আমার পক্ষে সম্ভব নয় অন্য কাউকে স্ত্রী ভাবা”–“সেটা আপনার প্রবলেম আমার নয়”এবার সে একদম চুপ হয়ে গেলো। আমি তাকে বললাম-“আই এম স্যরি টু সে, স্ত্রী হিসেবে আমার যা কিছু প্রাপ্য তার থেকে এক ফোটাও ছাড় আমি দিতে পারবো না। তবে একটা ছাড় আমি আপনাকে দিতে পারি, সেটা হলো- যেহেতু আপনার একটা সন্তান আছে তাই ইনফিউচার আমি দুটো সন্তানের জায়গায় একটা সন্তান নিতে পারি। আপনার এটা দ্বিতীয় বিয়ে হলেও এটা আমার প্রথম বিয়ে তাই আমি দশটা সাধারণ মেয়ের মত একটা সাধারণ জীবণ চাই। কোনো কিছু স্যাকরিফাইস করে মহিয়সী হতে চাই না। প্লীজ আপনি পাশের রুম থেকে আপনার বাচ্চাকে এই রুমে নিয়ে আসেন এবং ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে যান”সে চুপচাপ আমার কথা মত তার মেয়েকে এই ঘরে নিয়ে আসলো।কি নিষ্পাপ মুখ মেয়েটার! মনে হচ্ছিল একটা ঘুমন্ত পরী। আজ থেকে এই পরীটার মা বিথিকা, এটা ভাবতেই খুশিতে মন ভরে উঠছে।

বিয়ের দু’ দিন পর সব ক’ টা ঘর ঘুরে ঘুরে দেখলাম। পুরো বাড়িটাই বেশ সাজানো গোছানো। তৌসিফও খুব টিপটাপ মানুষ। আমি অবশ্য টিপটাপ পুরুষই পছন্দ করি।দেখলাম একটা ঘর একটু বেশী সুন্দর করেই সাজানো গোছানো। দেয়ালে একটা মেয়ের বেশ কয়েকটা ছবি টাঙানো আছে। এর মধ্যে দুটো ছবিতে মেয়েটার পাশে তৌসিফও আছে। তবে বেশীর ভাগ ছবিতে মেয়েটা একাই আছে। বুঝলাম এটা তৌসিফের প্রথম স্ত্রী অনিমা। মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দরী, এক হারা ফিটনেস, বেশ ফর্সা গায়ের রঙ। তৌসিফের মেয়েটার ফেসটা ঠিক ওর মায়ের মত। শুধু ওর কোঁকড়ানো চুল গুলো তার বাবার মত হয়েছে। বাচ্চাটার নাম টুসি। নামটাও রেখেছে দারুণ। জানিনা বাচ্চাটির নাম কে রেখেছে। হঠাৎ বাচ্চাটি আমার সামনে এসে বললো—“আন্টি তুমি আমার কে হও?”আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম, বললাম—“আমি তোমার মামনি হই”টুসী হেসে উঠে দেয়ালের ছবিটাকে হাত দিয়ে ঈশারা করে বললো—“তুমি কিচ্ছু জানো না, মামনি তো ঐ টা”আমি এরপর কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি ওর ছোট মা অর্থাৎ স্টেপ মাদার, এটা ভাবতেই নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিল। আমি ওর ছোটমা হয়ে থাকতে চাইনা। আমি ওর শুধু মা

হতে চাই। তাই ওকে বললাম —” ওটা তোমার মামনি কিন্তু আমি তোমার মা”মেয়েটার চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, সে আমাকে জড়িয়ে ধরে ‘মা’ বলে ডেকে উঠলো। এই টুকু বাচ্চাকে কি করে যে বুঝাই, যে ওর মা হতেই আমি এখানে এসেছি! আমার যে বহু বছর আগেই মা হবার বয়স হয়েছে!পেছন দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখলাম পর্দার আড়ালে তৌসিফ দাড়িয়ে। সে হয়ত আমাদের কথা গুলোই শুনছিল। আমি তার মেয়েকে কতটা মেনে নিতে পেরেছি তা পর্যবেক্ষণ সে করতেই পারে। আমি তার সামনে গিয়ে বললাম—” আচ্ছা অনিমার এত্তো গুলো ছবির মধ্যে মাত্র দুইটা ছবিতে ওর পাশে আপনাকে দেখছি, কেনো?”–“আনিমার পাশে আমাকে মানায় না তাই আমি নিজেই ওর সাথে ছবি উঠতাম না, আর সে একা ছবি উঠতেই পছন্দ করতো।”–“ভালবাসার মানুষ বুঝি কখনো কুৎসিত হয়?”আমার কথা শুনে সে চুপ হয়ে গেলো। আমি প্রসঙ্গো চেইঞ্জ করে বললাম- –“দু’দিন হয়ে গেলো অথচ আপনি একবারও আমাকে ‘তুমি’ করে বলতে বললেন না, আপনার কি ‘আপনি’ ডাক শুনতে খুব ভালো লাগে?”–“তোমার ইচ্ছে হলে ‘তুমি’ বলতে পারো”–“সে তো আমি বলবোই, আপনি চান বা না চান”সে আর কিছু না বলে চলে গেলো।তৌসিফ অফিস থেকে ফিরেই সরাসরি অনিমার ঘরে যায়। কর্তব্যের খাতিরে রাতে ঘুমানোর সময় ছাড়া আমার রুমে সে খুব একটা আসে না। আমাদের মধ্যে কর্তব্যের খাতিরে দাম্পত্য সম্পর্ক হয়েছে ঠিক কিন্তু মনের সম্পর্কটা যেনো কিছুতেই গড়ে উঠছে না।এক মাস কেটে গেলো তবুও যেনো আমি ঐ মানুষটার মনের নাগাল

পাচ্ছিলাম না। কি এক রস কষবিহীন মানুষ একটা! প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও সে আমার সাথে বলে না। কথা না বলে থাকে কি করে তা আল্লাহই জানেন। কাজের মেয়ে ছিল দুইটা। এক জন রান্নাসহ সব কাজ করে আর এক জন টুসির দেখা শুনা করে। এই চার বেডরুমের বাড়িতে আমি ছিলাম বেকার। তৌসিফের কাপড় ধোয়া, ঘন্টায় ঘন্টায় চা করে দেয়া সব কিছুই কাজের মেয়েকে বলে। উপযাচক ভাবে আমি অবশ্য মাঝে মাঝে চা করে দিই। আমাকে সে ভালবাসুক বা না বাসুক আমি তৌসিফকে ভালবেসে ফেলে ছিলাম। তাই চাইনী যে তার কাজ গুলো কোনো কাজের লোক করে দিক। দুটো কাজের মেয়েকেই বাদ দিয়ে দিলাম। তাই তৌসিফ বাধ্য হয়ে ছিল তার দরকারী কাজের জন্য আমার সাথে কথা বলতে।ছয় মাসের মধ্যে বাড়ির পরিবেশটা একটু বদলে গেছিল; টুসি, যে মেয়েটা বাবার গলা জড়িয়ে ঘুমাত সে এখন আমার গলা জড়িয়ে ঘুমায়। অবসর সময়টাতে আমি টুসিকে বিনোদন দেয়ার চেষ্টা করি। ওকে কার্টুন আঁকিয়ে দিই, মিউজিক ছেড়ে মা মেয়ে ড্যান্স করি। ওর সাথে ছাদে গিয়ে পুতুল খেলি। সব মিলে টুসির চোখে আমি একটা প্রিয় মানুষ হয়ে গেলাম। কিন্তু তৌসিফের কাছে কি হতে পেরে ছিলাম? ওর কাছে প্রিয় মানুষ হওয়া সহজ কোনো বিষয় ছিল না। ওর কাঠের তৈরী মনের ঘরে ঢোকার জন্য আমাকে কাঠমিস্ত্রী বা কাঠ ঠোকরা হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মানুষ কি কখনো কাঠ ঠোকরা হতে পারে? কি অদ্ভুত তাই না? ছয় মাস ধরে পাশা পাশি আছি কলিগ বা রুমমেটের মত। দাম্পত্য সম্পর্কও হয় অথচ প্রয়োজনের বাহিরে একটাও মনের কথা নেই।আমি

দেশী বিদেশী সব রকমের রান্না খুব ভালো করতে পারি।চটপটি, সিঙারা, ছমোচা, পিয়াজু সব কিছুই তৈরী করতে পারি।শঙ্খনীলের জন্য সব রান্না শিখে ছিলাম। কিন্তু সেখানে তো কাজে লাগাতে পারিনী। আমার কাঠ ঠোকরা অভিযান চলছিল আর এখানেই আমার শিখে রাখা রান্না গুলো কাজে লাগালাম। আমি তৌসিফের পছন্দের খাবার প্রতিদিন রান্না করতাম। আর নিজের পছন্দ গুলো বদলে তৌসিফের পছন্দ গুলোকে নিজের পছন্দ করে নিলাম। তৌসিফের বাহিরের খাবার খাওয়ার সব অভ্যেস বাদ হয়ে গেলো। আমি বুঝতাম যে সে আমার রান্না খেতে খুব ভালোবাসে। আমি সব সময় ওর খুব খেয়াল রাখিটুসি ছিল তৌসিফের প্রাণ ভোমরা। সে টুসির জন্য সব কিছু করতে পারে। সবার মনে রাখা প্রয়োজন এটা-“ভালোবাসার মানুষের ভাললাগা এবং ভালোবাসা গুলোকেও ভালোবাসতে হয়।”যাকে ভালবাসবো তার দোষ গুন সব কিছুকেই ভালোবাসতে হবে। না হলে সেটাকে ভালোবাসা বলা যাবে না।আমি টুসিকে আমার সন্তানের মতই ভালোবাসি। ছয় মাসে মেয়েটাকে সত্যিই খুব ভালোবেসে ফেললাম। টুসিটা যেনো আমার এক পৃথিবী হয়ে গেলো। আর তৌসিফ? তৌসিফ বোধ হয় সেই পৃথিবীর প্রজা ট্রোজা হবে হয়ত! এক দিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম— আচ্ছা আমাকে কি তোমার কিচ্ছু বলতে ইচ্ছে করে না? এত চুপ থাকো কি করে?”–

“আসলে কি বলবো সেটা বুঝি না”রাগে আমিও চুপ হয়ে গেলাম। মনে মনে আমার লেখা কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়লো-“প্রেমের রাজ্যে এক’লা রানীদিবা নিশি পায় সাজাসেই রাজ্যে প্রেমে উদাসতুমি এক দুখী প্রজা।”তৌসিফের জামা কাপড় অনিমার আলমারীতেই রাখতো। আমিই তার জামা কাপড় ধুয়ে ইস্ত্রী করে গুছিয়ে অনিমার আলমারীতে রাখতাম। কিন্তু আমার কাঠ ঠোকরা অভিযানের কারণে ওর জামা কাপড় আমার আলমারীতেই রাখা শুরু করলাম। এতে তৌসিফের একটু অসুবিধা হলো, সারাক্ষণ আমার ঘরে যাওয়া-আসা সহ আমার কাপড়ের ভীড়ে সে নিজের কাপড় খুঁজেই পেতো না। তাই বাধ্য হয়ে তাকে বলতে হতো—“বীথি আমার গ্রীন শার্ট টা খুঁজে পাচ্ছি না, বীথি আমার রুমাল কোথায় রেখেছো? বিথী ওয়ালেট পাচ্ছি না। বীথি পেন আর ঘড়িটাও কি আলমারীতেই লুকিয়ে রেখেছো নাকি? বীথি……বীথি….এই বীথি…”আহা! শুনতে কি ভালো লাগে……আমার কাঠ ঠোকরা অভিযানের একটু একটু ফলাফল পেতে শুরু করে ছিলাম।

আমার কাঠ ঠোকরা অভিযানে আমি বেশ সচল ছিলাম। তৌসিফ কিন্তু বোকা সোকা মানুষ ছিল না, সে খুব Intelligant man. আমার কাঠ ঠোকরা অভিযান সে যে বুঝতে পারতো না, তা কিন্তু নয়। সে বুঝুকগে, আমার জীবনকে সুখী করার দায়িত্ব শুধুই আমার। তাই নিজেকে সুখী জীবন দানে যা কিছু করা প্রয়োজন তার সবটাই করা আমার কর্ত্বব্য বলে আমি মনে করি।আমাদের দাম্পত্য জীবনটা এক বছরের কাছা আছি চলে এসেছে কিন্তু আমি ঐ মানুষটার প্রেমের গন্ধেই মগ্ন সারাক্ষণ। আর সে দায়িত্ব আর কর্ত্বব্যের বাহিরে কোথাও নেই। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহতেই মোটা অঙ্কের টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বলে–“হাত খরচা দিলাম” যদিও আমার সেই টাকা গুলো কখনো নিজের কাজে লাগে না।আজব মানুষ একটা! কি করবো আমি, ওর মত সৎ, দয়ালু, ভালো মনের

মানুষের প্রেমে না পড়ে কোথায় যাবো আমি? কিন্তু আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না? সত্যিই কি ওর মনের সব জায়গা টুকু অনিমার দখলে? একটা মৃত মানুষের কাছে আমি বার বার হেরে যাবো?প্রায় এক বছরেও ওর অনিমা বিলাস শেষ হলো না। আমি অবশ্য চাইনী যে অনিমা নিঃচিহ্ন হয়ে যাক। তৌসিফের ভালোবাসা বেঁচে থাক ওর মনে। আমি রোজ অনিমার ঘরে গিয়ে ওর ঘর টা পরিষ্কার করি। কিন্তু নিজেকে অসহায় মনে হয়। তৌসিফের মনে আমার কোনো অস্তিত্বের চিহ্ন টুকুও খুঁজে পাইনী।টুসির খালামণি কয়েক দিনের জন্য টুসিকে ওদের বাসায় নিয়ে গেলো। সারাটা বাড়ি ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। আমার ইচ্ছে ছিল না যে,টুসি যাক কিন্তু তৌসিফের কথা ওর নানুর বাসার সবার অধিকার আছে কয়েক দিন টুসিকে ওদের কাছে রাখার। আমার শরীরটাও ঠিক যাচ্ছিল না। তৌসিফ বললো ওর এক বন্ধু ডাক্তার। তাই তাকে ফোন করে দিলো। আমি একাই সেখানে গেলাম। তৌসিফ আমার সাথে গেলো না। সে কি পারতো না আমার সাথে যেতে? অফিস শেষ করে বা ছুটির দিনে তো নিয়ে যেতে পারতো! মানুষের যতো ছোট

খাটোই অসুখ হোক না কেনো, মানুষ যখন নিজেকে অসুস্থ বোধ করে তখন মনে মনে একটা ভাবনা আসে যে, মনে হয় আমি আর বাঁচবো না। সেই মুহূর্তটাতে মানুষ কাছের মানুষের সহানুভূতি এক্সপেক্ট করে। আমি তো মানুষের বাইরের কেউ নই! যাই হোক, ডাক্তার আমাকে কোনোই ঔষধ লিখে না দিয়ে শুধু কয়েকটা টেস্ট করতে দিলেন এবং বললেন-“ভাবী আপনি বাসায় যান আমি রিপোর্ট আসলে বাসায় পাঠিয়ে দেবো”আমি বাসায় চলে এলাম, শরীর আর মন দুটোই অসুস্থ আর টুসিও নেই তাই ভাবলাম কয়েক দিন মায়ের কাছে থেকে আসি। তৌসিফের খেয়াল রাখার জন্য তো বাবার বাসায় খুব একটা যেতাম না। তৌসিফ কে রাতে বললাম যে, আগামী কাল সকালেই আমি বাবার বাসায় যেতে চাই। তৌসিফ ল্যাপটপে কাজ করছিল, আমার কথা শুনে ল্যাপটপে মুখ গুজে থেকেই বললো-“যেতে ইচ্ছে করতেছে তো যাবা! আমি কি বলবো?”পর দিন শুক্রবার ছিল, তৌসিফ পারতো আমাকে রেখে আসতে তবুও সে গেলো না। আমার এতটা শরীর খারাপ তবুও সে আমাকে একা ছাড়তে পারলো! সত্যিই নিজেকে খুব তুচ্ছ আর নগন্য মনে হলো। পৃথিবীতে কারো কাছেই বোধ হয় আমার কিনচিত মূল্যও নেই। যাকে নয় বছর ধরে ভালবেসে ছিলাম তার কাছেও আমি নগন্যই ছিলাম। আর যাকে বিয়ে করে ভালবেসে চলেছি তার কাছেও আমি তুচ্ছ। আমার ভালবাসা হয়ত মিনিংলেস তার কাছে। আজ সত্যিই নিজের কাছে নিজের এই হেরে যাওয়া মুখটা আর দেখতেই ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে আয়নার সামনে গিয়ে যদি দাড়াই তবে আয়না আমাকে দেখে হাসবে আর বলবে-

“বিথীকা তোর লজ্জা করে না?”বাবার বাসায় আসার চার দিন হয়ে গেছে তবুও তৌসিফ একবারও আমাকে ফোন করেনী। বার বার ফোন দেখি, মেসেজ চেক করে দেখি কিন্তু কিছুই পাই না। এবার ওকে দয়ালু নয় নিষ্ঠুর নির্মম আর হৃদয়হীন মনে হচ্ছে। আরো একটা রাত এলো কিন্তু তৌসিফের ফোন এলো না। সন্ধ্যে থেকেই আকাশটা গুম ধরে আছে। বৈশাখ মাস ঝড় হবে মনে হয়। রাত দশটা থেকে প্রচন্ড ঝড় বজ্রপাত তারপর প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলো। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আজ শহরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বেশ শীত শীত লাগছিল তাই একটা চাদর গায়ে দিয়ে পেছনের বেলকোনিতে গিয়ে দাড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। বৃষ্টির ঐ ভেসে যাওয়া জল গুলোর মত নিজেকে খুব নগন্য মনে হচ্ছিল। আরো অনেক কিছুই ভাবছিলাম। হঠাৎ মা দরজা নক করে বীথি বীথি বলে চিৎকার করছে। আমি দরজা খুলতেই দেখি তৌসিফ দাড়িয়ে। কাকের মত ভিজে গেছে বেচারা। আমি বিস্মিত হয়ে হতভম্বের মত ওর দিকে তাকিয়ে আছি। তারপর চেতনা ফিরতেই ওকে বললাম—“ভেতরে এসো, আর এই ঝড় বৃষ্টির রাতে এভাবে ভিজতে ভিজতে কেনো এসেছো?”তারপর টাওয়েলটা এগিয়ে দিলাম। সে মাথা মুছতে মুছতে বললো—” না এসে কি উপায় বলো? চার দিন ধরে এই একটা শার্ট আর প্যান্ট পরে আছি, তুমি কি ভুল করে তোমার ব্যাগে আমার সব শার্ট প্যান্ট

গুলো নিয়ে এসেছো নাকি?”–“তোমার জামা কাপড় আমি এখানে কেনো আনবো?”–“পুরো আলমারী তল্লাসী করেও এটাও শার্ট প্যান্ট পাইনী। রোজ একটা শার্ট পরে অফিস করতে কত লজ্জা লেগেছে জানো?”–“আমি তো তোমার সব কাপড় অনিমার আলমারীতেই রেখে এসেছি”–“কেনো?”–“তুমি চাও তাই”–“এই চার দিনে আমি একবারও অনিমার ঘরে যাইনী।”তৌসিফের কথা শুনে আমি সত্যিই খুব অবাক হলাম। আমি এটা নিয়ে তাকে আর কোনো প্রশ্ন করিনী। ওর মনের গুপ্ত কথার সিন্ধুক আমি খুলতে চাই না।আমি বললাম—“ও… জামা কাপড় খুঁজে পাচ্ছো না তাই এই আগমন? তো একটা ফোন করলেই তো পারতে!”–“আরে সে কারণে আসিনী”–“তাহলে?”–“রেস্টুরেন্টের রাঁধুনীরা যে আজ কাল কি বাজে রান্না করে তা তুমি ভাবতেও পারবে না”আমি দেখলাম তৌসিফের হাত ব্যান্ডেজ করা। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?–“আরে ডিম পোচ করতে গিয়ে তেল ছিটে পড়ে ফোঁসকা পড়ে গেছে তাই ব্যান্ডেজ করেছি”–“তাহলে খাবার অসুবিধার জন্য এসেছো তাই না?”–“আরে সে জন্যও নয়”–“তাহলে কেনো?”–“জানো সারা বাড়ি চিরুণী তল্লাসী করেও তোমার একটাও ছবি পেলাম না। কি বেরসিক মেয়ে তুমি হ্যা? ছবি উঠো না!”–“তো ছবি নিতে এসেছো?”–“আরে সে জন্য নয়”–“তো কি জন্য?”–“ছাদের সব ফুল গাছ গুলো মরতে বসেছে, বৈশাখ মাস বৃষ্টি নেই আর পানি দেয়ার বীথিকাও নেই”–“আজ তো বৃষ্টি হচ্ছে দেখলেই তো তারপরেও পানি দেয়ার আর কি দরকার আছে?”–“আমি তো সে জন্য আসিনী”আমি-“তাহলে কেনো এসেছো প্লীজ বলো!”–

“তোমাকে নিতে এসেছি বীথি”–“এই ঝড় বৃষ্টির রাতে ভিজতে ভিজতে তুমি আমাকে নিতে এসেছো?”–“একটা খবর দিতেও এসেছি”–“কি খবর?”–“বীথি আমি বাবা হতে চলেছি”ওর কথা শুনে আমার এক মিনিটের জন্য এটা মনে হয়ে ছিল যে ছেলেরাও কি conceive করে নাকি? আর এটা ভেবেই হাসি পেলো।তৌসিফ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে দেখালো, দেখলাম আমার সেই টেস্টের রিপোর্ট এটা। রিপোর্টে লেখা আছে-“Pregnancy positive”সেদিন ঐ ঝড় বৃষ্টির রাতেই সে আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেছিল। রাতে আমার রুমে ঢুকে আলো জ্বেলে দেখি দেয়ালে বেশ বড় করে বাঁধানো আমার আর তৌসিফের ছবি। সব গুলো ছবিই আমাদের বিয়ের দিন উঠানো। এর পরে ঐ বেরসিক মানুষটার সাথে ছবি উঠানোর সুযোগ কোথায় ছিল? তৌসিফের দিকে তাকাতেই সে বললো—“ভাগ্যিস সজীবের ক্যামেরাতে ছবি গুলো ছিল! তাই তো পাটরানীকে দেয়ালে টাঙাতে পারলাম”পরদিন সকালে তৌসিফ সেই পুরোনো দুই কাজের মেয়েকে জয়েন করালো তারপর টুসীকে বাসায় ফিরিয়ে আনলো। আর আমার উপর এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা জারি হলো, বিছানা থেকে নামা যাবে না। তৌসিফ ওর ডাক্তার বন্ধুর কাছে থেকে কি সব শুনে এসে এই সব শুরু করেছে। ডাক্তার নাকি বলেছে যে ত্রিশ এর পর প্রেগনন্সীতে নাকি ঝুঁকি আছে।আমি সারা দিন টুসির সাথে বিছানাতেই বসে খেলি। আজ কাল তৌসিফ খুব ফাঁকিবাজ হয়ে গেছে, সে দেরীতে অফিসে যায় আর তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে। আর ফিরে এসেই সে এটা খাও ওটা খাও বলে আমাকে অত্যচার করে। আর অফিসের স্টাপদের বলে–

-“আমার মিসেস খুব অসুস্থ তাই তাড়া তাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।”মানবাধিকার অধিদপ্তরের বড় কর্মকর্তা যদি এসব কথা বলে তাহলে দেশের মানুষের অধিকারের হাল তো বেহাল হয়ে যাবে। সেদিন মানুষটা আমার জন্য আপেল কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেললো। টপ টপ করে রক্ত পড়ছিল, আমি যখন ওর হাতটা ব্যান্ডেজ করতে গেলাম তখন সে আমাকে কি বললো জানেন পাঠক?–“বীথি এই রক্তের মাঝে কি তুমি কিছু দেখতে পাচ্ছো?”–“দেখতে পাচ্ছি তো”সে খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো—“কি দেখতে পাচ্ছো?”–“লাল রঙ দেখতে পাচ্ছি”–“আর কিছু দেখতে পাচ্ছো না?”–“আর তো কিছু নেই, তবে হিমোগ্লোবিন আছে, আর ঐ হিমোগ্লোবিনটা লাল রঙের হয়”–“এই রক্তের মাঝে বীথির জন্য যে ভালোবাসা ঝরে ঝরে পড়ছে সেটা কি তুমি দেখতে পাচ্ছো না?”ওর কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম তাই আর কোনো উত্তর দিইনী। ভালোবেসে অর্জিত ভালোবাসার ঘোরে ছিলাম আমি তাই ওর প্রশ্নের কোনো জবাব নেই আমার কাছে।পাঠকগণ, আমি কিন্তু বুঝলাম না যে তৌসিফের কাঠের তৈরি মনের ঘরের দেয়ালটা ভাঙলো কি করে? সে নিজেই কি কাঠ মিস্ত্রী হয়ে ভেঙেছে নাকি আমার কাঠ ঠোকরা অভিযানের চুড়ান্ত ফলাফল এটা?

********************************************সমাপ্ত*****************************************

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত