বড় অবেলায় পেয়েছি তোমায়

বড় অবেলায় পেয়েছি তোমায়

হঠাৎ দেখা হতেই স্তব্ধ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল তারা। উভয়ের চোখ জোড়া টলমল টলমল করছে। যেন অদৃশ্য এক মন্ত্র যাদুতে উভয়েই বশীভূত হয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে তারা। বার বার কেঁপে উঠছে হৃদয়ের স্পন্দন। বলার মত কোন ভাষা নেই তাদের। তবুও হৃদয়ে বেজে ওঠা বোবা আর্তনাদে যেন ফেটে যাচ্ছে তাদের বুকের পাজর। অপলকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেই উভয়ের চোখ থেকে ঝর্ণার বেগে গড়িয়ে পরল কিছু তরল পদার্থ। আর যেন স্থির থাকতে পারছে না তারা। দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। হৃদয়ে জমা কথা গুলো যেন মুখ ফেটে একবারেই বেরিয়ে আসতে চাইছে সব। কিন্তু কেউ’ই যেন মুখ খুলতে পারছে না।

এভাবে একে অপরের দিকে এক ধ্যানে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠল মেয়েটি। ঝাপিয়ে পরল ছেলেটির দিকে। মেয়েটি অঝরে কাঁন্না শুরু করলো ঐ জনবহুল লোকালয়ে। কিন্তু ঐ মুহুর্তে কিছুই করার ছিলনা ছেলেটির। সে যেন পাথরের বোবা মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে শুধু। মেয়েটি শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু ছেলেটির হাত-পা যেন অবশ হয়ে আসছে। হঠাৎ মেয়েটি কাঁন্না মাখা কন্ঠে বলে উঠল,
–এতদিন কোথায় ছিলে শুভ?

না শুভ কিছুই বলতে পারছে না। কিন্তু যেন কলিজা ফেটে যাচ্ছে তার। তার তো আজ বলার মত কোন ভাষাই নেই। তাই জড়ো বস্তুর মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। হঠাৎ পিছন থেকে ইতির গর্জন শুনতে পেলো শুভ। তারাতারি ঐ মেয়েটির কবল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পিছনে ফিরে তাকায় সে। দেখল ইতি দাঁড়িয়ে আছে। ইতি তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু এমন দৃশ্য দেখে ইতিও আর স্থির থাকতে পারল না। রাগে ঘৃনায় ভেঙ্গে পরছিল সে। অমনি হাই হিল জুতার খটকা আওয়াজ তুলে হনহন করে বাসায় গমন করল ইতি।
–ইতি যেওনা প্লিজ! আমার কথাটা তো একবার শুনো? (পিছন থেকে ডেকে বলল শুভ। কিন্তু নাহ, ইতি আর কোন কথা না শুনে সোজা বাসায় চলে গেল)

অনেক রাত হয়েছে। প্রতিদিন শুভকে নিয়ে এক সাথে রাতের খাবার খেতো ইতি। কিন্তু আজ না খেয়ে একা একাই বিছানায় শুয়ে পরল সে। শুভও শোয়ার ঘরে এসে ইতির ঐ অভিমানী মুখ্খানি দেখে আবারও চলে গেল রুম থেকে। ঐদিকে রাতের আধারে ব্যালকুনিতে আরাম কেদারায় বসে পুরানো কিছু স্মৃতি মনে করতেই শুভর চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরতে লাগল। ইতিরও চোখে ঘুম নেই। প্রতিদিন শুভর বুকে মাথা রেখে ঘুমায় সে। কিন্তু আজ পাশে শুভ না থাকাতে নিজেকে খুব একা লাগছে। তাই সে আস্তে বিছানা থেকে উঠে শুভর কাছে এগিয়ে যেতে লাগল। ব্যালকুনিতে গিয়ে বাতিটা অন করতেই দেখল শুভর চোখে পানি। হঠাৎ বুকটা কেঁপে উঠল ইতির। ওমনি ছুটে গেল শুভর কাছে। বলে উঠল-

–ওগো আমি কি খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমায়? (শুভ তার চোখ জোড়া মুছে নিতে ইতি আবারও বলে উঠল)
–ওগো আমার জন্য তুমি কষ্ট পেয়েছো? প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও? আমি আর কখনোই এমন করব না। প্লিজ ক্ষমা করে দাও? (কথাগুলো এক নাগারে বলতে বলতে ইতিও কেঁদে উঠল। তখন শুভ আস্তে ইতির হাতখানি নিজের হাতে চেপে ধরে বলল)
–না গো তুমি কোন কষ্ট দাওনি!
–তাহলে কাঁদছ কেন?

–তোমাকে তো আগেই বলেছি আমার একটা অতীত আছে। কিন্তু সেগুলো তুমি শুনতে চাওনি। বলেছিলে ঐসব ভুলে যেতে। তোমার ভালবাসা পেয়ে আমি সত্যিই সব কিছুই ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু…
–কিন্তু কি? প্লিজ চুপ করে থেকো না! বলো আজ আমি সব শুনতে চাই…
–বেশ তাহলে শুনো…..

আজ থেকে ২বছর আগের কথা। অনু নামের একটি মেয়েকে খুব ভালবাসতো শুভ। এক সাথে গান গাওয়া ও পথ চলা সহ ইত্যাদি অনেক কিছুই ছিল তাদের নিত্য দিনের কাজ। একে অপরের সাথে শেয়ার করত জীবনের চাওয়া-পাওয়া সহ সব কিছু। যেন চোখ বুজলে এখনোও ভেসে উঠে পুরোনো সেই স্মৃতি মাখা দিন গুলো। মনে হয় এইতো সে দিনের কথা, পুকুর পাড়ে একে অপরের পাশা-পাশি বসে একই সুরে গান গাইছিল তারা-

চোখে রাখো চোখ
কিছু কথা হোক!
বলবে শুনবো আমি. . . (শুভ)
হাতে রাখো হাত
সারা দিন রাত!
স্বপ্নেরই পথে নামি. . . . (অনু)
সুখেরি এ লগনে
তুমি আমি দুজনে
প্রেমের পৃথিবী সাজাই. . . (শুভ)
ওওওওওওও প্রিয়ো. . . .
আমি তোমার হতে চাই. . (অনু)
ওওওওওওও প্রিয়ো. . . .
আমি তোমার হতে চাই. . (শুভ)

গান শেষে দুজনের মুখেই ফুটতো এক তৃপ্তির হাঁসি। আবার কখনো বা একে অপরকে নিয়ে হারিয়ে যেত দূর কোনো অজানায়। বলতো মনের কথা। ভাগা-ভাগি করে নিতো একে অপরের সুখ-দুঃখ আর ভালবাসা। এইতো সেই দিনের কথা- ১লা বৈশাখে অনুকে নিজ হাতে শাড়ী পড়িয়ে দিচ্ছে শুভ। শাড়ীর কুচি গুলো অনুর কোমরে গুজে দিচ্ছে। পারফিউম যুক্ত দেহের ঘ্রাণে বুক ভরিয়ে নিচ্ছে সে। গায়ের সমস্ত কাপড় নিজ হাতে পরিয়ে মনের মত করে সাঁজিয়ে নিচ্ছে তার সপ্নরাণী অনুকে। মাঝে মাঝে ঠোটের হালকা স্পর্শ্য এঁকে দিচ্ছে অনুর সারা দেহে। দুষ্টুমির ছলে নেয়া হচ্ছে অনুর ঠোটের টাচ্। হাঁজার চেষ্টার পরেও যেন লিপিস্টিক ছুচ্চা ছেলেটাকে ফিরাতে পারে না অনু। যেন পুরো ঘর জুড়ে থৈ থৈ করছে তৃপ্তির এক ঘন শ্বাঃস। অনুকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল শুভ। অনেক শক্ত করে বুকে চেপে ধরেছে অনুকে। এ যেন এক চরম অনূভুতির ছোয়া। সত্যিই এই অনূভুতি মিশ্রীত স্মৃতি গুলো কখনোই ভুলার নয়।

ঠিক সেই অবস্থাই আমাদের আজকের গল্প নায়ক শুভর। ছোট বেলাতেই অনুর মা মারা যায়। আর বাবা ব্যবসার কাজে প্রায়ই দেশের বাহিরে থাকতেন। ঠিক এমনই একাকীত্ত মূহুর্তে শুভ এসে হাজির হয় অনুর জীবনে। শুভরও অন্ধকার হৃদয়ে আলোর প্রদীপ হিসেবে আগমন হয় অনুর। একে একে অতিবাহিত হতে থাকে তাদের আনন্দ মাখা খুনসুটে আর দুষ্টমিষ্টি দিন। অনেক ভালবাসা মিশ্রীত সময় কাটিয়েছে তারা। কিন্তু সেটা যেন তাদের কপালে সইল না। হঠাৎ এক কালবৈশাখী ঝড়ের ন্যায় সব কিছু তছনছ হয়ে যায় তাদের মনের মাধুরীতে সাঁজানো স্বপ্নের রাজমহল। যেখানে তারা অনন্তকাল একসাথে থাকার আশায় তিলে তিলে স্বপ্ন বুনেছিল তা সব শেষ হয়ে যায়।

হঠাৎ একদিন অনুর বাবা দেশে ফিরে আসে এবং এসেই অনুকে নিয়ে আবারও দেশের বাহিরে চলে যায়। অনুর অজান্তেই সেখানে আমেরিকান একটা ছেলের সাথে অনুর বিয়ে ঠিক করে তার বাবা। কিন্তু এই অল্প সময়ে অনু যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। একটি বার শুভকেও এই সংবাদটা জানানোর সুযোগ পায়নি। অনু অনেক বার তার বাবাকে বলেছে, সে অন্য একজনকে ভালবাসে এবং তাকেই বিয়ে করতে চায়। কিন্তু অনুর বাবা সব কিছু উপেক্ষা করে এক প্রকার অনুর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। অনুর বাবা তার ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধির জন্যই মূলত এই কাজটা করেন।

যাইহোক, এদিকে অনুর বিয়ে হয়ে গেলো। আর শুভর সাথেও তার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। কাঁন্না আর যন্ত্রনায় অনুর দিন কাটে, মাস যায়। অনুর প্রতি তার স্বামীর কোন কেয়ার ছিলনা। রাতে ড্রিংক করে ঘরে ফেরা ও বাজে মেয়েদের নিয়ে যৌনাচারে মেতে থাকাটাই ছিল তার নিত্য দিনের কাজ। অনু মোটেও সুখি ছিল না ঐ আমেরিকান ছেলেকে বিয়ে করে। মনে হত তাকে বুঝি বিক্রি করে দিয়েছে কোন এক নরপিচাশের কাছে। দুঃখ আর যন্ত্রনার যেন শেষ ছিলনা অনুর। সে অনেক চেষ্টা করেছে দেশে আসার জন্য কিন্তু পারেনি। অভিশপ্ত ঐ যন্ত্রনা পিছু ছাড়েনি অনুর। দুঃখের বোঝা বইতে বইতে ওখানেই অনুর পেরিয়ে গেল পুরো একটি বছর।

আর ঐদিকে অনুকে হারিয়ে প্রায় পাগলের মত দিশেহারা অবস্থা শুভর। শহরের অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি সব জায়গাতেই দিন-রাত পাগলের মত খুঁজেছে অনুকে। দিন রাত রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মত ছুটেছে শুভ। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই বাঁচ্চাদের মত চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে সে। এভাবে অনুকে খুঁজতে খুঁজতে শুভরও কেটে যায় বছরটি। কিন্তু শুভর এমন পাগলামি দেখে তার বাবা-মা শুভকে বিয়ে করিয়ে দেয় (ইতি) নামের একটি মেয়ের সাথে। শুভও ধীরে ধীরে তার জীবন থেকে অনুকে পাওয়ার আশা চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করে। ঠিক যেন এমনই এক বিভীষিকাময় সময়ে ইতি এসে শুভকে আবার নতুন করে বাঁচতে শিখায়। ইতি তার সমস্ত ভালবাসা দিয়ে মনে প্রাণে ভালবেসে যায় শুভকে। ইতির ভালবাসা যেন শুভর সমস্ত দুঃখকে ভুলিয়ে তাকে আবার স্বাভাবিক করে তুলতে সাহায্য করে। আস্তে আস্তে শুভও যেন পূর্বের সব স্মৃতি ভুলে নতুন করে ভালবাসতে শুরু করে ইতিকে। এ ভালবাসাই যেন চির অমর। যেখানে নেই কোন হারানোর ভয়, নেই কোন না পাওয়ার বেদনা। অনেক সুখেই দিন কাটতে লাগল ইতি ও শুভর।

তাদের বিয়ের আজ ১বছর ঘুরতেই ইতির গর্ভে তৃতীয় একটি প্রাণের সন্ধান লক্ষ্য করা যায়। আনন্দে দিশেহারা হয়ে যায় ইতি আর শুভ। শুভ বাবা হতে চলেছে আর ইতি মা। ঠিক এই আনন্দটা উপভোগ করতে এবং তাদের বিয়ের ১ম বর্ষ পূর্তিটা সেলিব্রেট করতে তারা একটি পার্কে ঘুরতে যায়। যে পার্কে আজ থেকে ২বছর আগে শুভ প্রায়ই আসত তার প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে। আর আজকের এই দিনে ইতি ছাড়া তার কাছে প্রিয় মানুষ আর কেই বা হতে পারে? তাইতো আজ ইতিকে নিয়ে তার সেই প্রিয় জায়গাটিতে ঘুরতে আসে সে। আর ঠিক তখনই শুভর সামনে এসে দাঁড়ায় অনু। হ্যাঁ অনু পালিয়ে এসেছে তার ঐ যন্ত্রনাময় নরকখানা থেকে। আজ প্রায় তিন মাস ধরে অনু সকাল-বিকাল এই পার্কে এসে শুভকে খুঁজে যায়, তার জন্য অপেক্ষা করে। কারন অনুর আজও মনে আছে একদিন এই পার্কে বসেই শুভ তাকে বলেছিল, “আল্লাহ না করুক, আমরা যদি কখনও হারিয়ে যাই তাহলে এই পার্কে এসে আমাকে খুঁজে নিও। আমি তোমার অপেক্ষায় এখানেই বসে থাকবো”।

হ্যাঁ আজ সেই কথাটা সত্যি হলো। কিন্তু অপেক্ষার ব্যক্তিটি হল ভিন্ন। যাইহোক, তবুও তো আল্লাহর অশেষ কৃপায় ঠিকই শুভ এখানে চলে আসে এবং অনুর মুখোমুখি হয়। আর তারপরেই অবেগ সমলাতে না পেরে অনু জড়িয়ে ধরে শুভকে। দীর্ঘ দুটি বছর পর শুভকে পেয়ে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। যা ইতিরও চোখ এড়ায়নি। পার্কে যে মেয়েটি শুভকে জড়িয়ে ধরতে দেখে ইতি রাগ করে বাসায় চলে আসে সেই মেয়েটিই ছিল অনু। একদিন যাকে নিয়ে ছোট্ট একটা সুখের স্বর্গ রচনা করার প্রত্যাশায় তিলে তিলে স্বপ্ন বুনেছিল শুভ।

এতক্ষন শুভর কাছে ঘটানাটি শুনে ইতির চোখে যেন অশ্রু বাঁধা মানছে না। ইতি বাঁচ্চাদের মত চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল শুভর বুকে। শুভ শক্ত করে বুকে চেপে ধরে কাঁদতে লাগল ইতি। যেন মনে হচ্ছে, শুভর চেয়ে ইতিই অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছে ঘটনাটি শুনে। অঝরে চোখের জল ফেলে শুভর বুকটা ভাসিয়ে দিল সে। এই মূহুর্তে কোথায় একটু শুভকে শান্তনা দিবে তা না করে উল্টো ইতিকেই শান্তনা দিচ্ছে শুভ। ইতির চোখের জল মুছে দিয়ে তাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিল শুভ। এভাবেই হঠাৎ কখন যে ব্যালকুনিতে বসেই ভোর হয়ে গেল তা আর খেয়াল নেই তাদের।

সকাল বেলা হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে তাদের। ইতি চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলেই হঠাৎ চমকে উঠে। দেখল অনু দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। অনুও বুঝেছে শুভ এখন আর তার সেই শুভ নেই। সে এখন অন্যের বাহুডোরে বন্দি হয়ে গেছে। তার ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য এখন আর সে নয়। তবুও অনু আজ ছুটে এসেছে যেন নিজেকে নিয়ে তাদের মধ্যে কোন প্রকার ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়! তাই অনু হঠাৎ ইতির হাত জোড়া চেপে ধরে বলল,

–বোন আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আসলে আমি না জেনে তোমাদের মধ্যে চলে এসেছি। সত্যি ভুলটা আমারই। তুমি অন্তত শুভকে ভুল বুঝো না বোন…

কথা গুলো বলতেই অনুর চোখ থেকে গড়িয়ে পরল কিছু তরল পদার্থ। ঐদিকে ইতি শুধু মাত্র বোবা মূর্তির ন্যায় অনুর মুখনিসৃত কথা গুলো শুনেই গেল কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। কিই বা বলবে সে? রাতে পুরো ঘটনা শুভর কাছে শুনে নিজেই তো বেদনাক্রান্ত হয়ে আছে। আবারও কেন জানি কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠল ইতির। ইতি কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ ছাড়াই হঠাৎ অনুকে বুকে জড়িয়ে ধরল। হু হু করে কেঁদে উঠল অনুকে পেয়ে। অচেনা অজানা একটি মেয়ের জন্য ইতিরও বুকটা যেন কষ্টে নাড়া দিয়ে উঠল। আজ অনুর জায়গায় যদি ইতি থাকতো তাহলে সে হয়ত সহ্যই করতে পারত না এই যন্ত্রনা। ইতি অনেক বেশি ইমশোনাল, তাই জোড়ে জোড়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল অনুকে বুকে জড়িয়ে। আর অনুরও নিরব বোবা কাঁন্নায় বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। ঝর্ণার বেগে তারও গাল বেয়ে অশ্রু গড়াতে লাগল।

ঐদিকে কাঁন্নার শব্দ শুনে ব্যালকুনি থেকে শুভ বেরিয়ে এলো। তারও চোখ জোড়া লাল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। সারা রাত কেঁদেছে সে। হঠাৎ চোখের সামনে আবারও অনুকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় শুভ। তার হাত-পা যেন থরথর করে কাঁপছে। সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসতে লাগল তার। সে আর সামনে এগোতে পারল না। ঐখানেই খুটির মত দাঁড়িয়ে রইল শুভ। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে অনুর মুখের দিকে এক পলক তাকালো সে। অতঃপর অনু আস্তে ইতির কবল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে শুভর কাছে এগিয়ে আসতে লাগলো। শুভ যেন কাঁপতে লাগল। হার্টবিট ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। অনুও সামনে এসে শুভর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নাহ, কিচ্ছু বলল না অনু। শুধু আঙুলের হালকা স্পর্শে শুভর চোখ জোড়া শেষ বারের মত মুছে দিল। শুভ শিউড়ে উঠল। চোখ জোড়া বুজে নিলো অনুর ছোয়ায়। তারপর চোখ মেলে কিছুক্ষন চেয়ে থাকা। অতঃপর চিরকালের জন্য বিদায় নিয়ে শুভর সামনে থেকে চলে গেল অনু। একদম দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে যেতে লাগল সে।
.
শুভ তার গমন পথের দিকে এক পলকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ চিৎকার দিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পরে। জোড়ে কেঁদে উঠে। তবুও অনুকে ফিরাতে পারে না সে। অনু চলে যায় দুর সিমানায়। একদম চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। শুভ পিছন থেকে দুটি হাত বাড়িয়ে দেয়। দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডেকে যায় অনুকে। কিন্তু নাহ, শব্দহীন হৃদয়ের এই বোবা ডাক অনুর কানে পৌছায় না। সে শুনতে পায়না পিছনের মানুষটির বুক ফাটা আর্তনাদ। শুনতে পায়না এই বোবা কাঁন্না। সে চলে যায়। একদম বিলিন হয়ে যায় দৃষ্টির আড়ালে।

হঠাৎ ইতি দৌড়ে এসে বাঁচ্চাদের মত ঝাপিয়ে পরে শুভর বুকে। শূণ্য বুকে ইতিকে কাছে পেয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে। চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে, “আমি কিচ্ছু চাইনা ইতি, কিচ্ছু না। শুধু তোমাকে চাই, তোমাকে ভালবাসেই সুখি হতে চাই! তোমাকে নিয়েই অনন্তকাল এক সাথে বাঁচতে চাই বউ”। কথাটি বলেই হু হু করে কেঁদে উঠে শুভ। চোখের জলে ভাসিয়ে দেয় বউয়ের বুকখানি। দুজনেই যেন অসহায়ের মত একে অপরকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত