-আসবে কখন?
-একটু দেড়ি হবে।
-প্রতিদিনই তো দেড়ি হয়।
-কাজের চাপ একটু বেশীই।
-তাহলে আমাকে বিয়ে করেছো কেন,তোমার কাজকেই বিয়ে করলে পারলে।
কথাটি বলেই সুপ্তি ফোনটা রেখে দিল।আমি ফোনটা কান থেকে নামিয়ে একদৃষ্টিতেই তাকিয়ে রইলাম স্ক্রিনের দিকে।বেশ লাগছে মেয়েটাকে।স্ক্রিনে রাখা সুপ্তির হাসিমাখা মুখটা দেখে কেমন যেন ভাল লাগা কাজ করলো।ওকে দেখলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।হাসলে মেয়েটাকে বেশ লাগে।
আমাদের বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক হবে।শুরুতে সুপ্তিকে নিয়ে ঘোরাঘুরি, খাওয়া দাওয়া,আরও অনেক কিছুই হতো কিন্তু আস্তে আস্তে কাজের চাপটা বেড়ে যাওয়ায় আর ওকে খুব একটা সময় দিতে পারিনা।তবে ভালবাসাটা আমার ওর প্রতি ঠিক আগের মতই আছে।
আমি আবার কাজে মনোযোগ দিলাম।সব চাপ যেন আমার উপরে এসে পড়েছে।খাওয়ার সময়টাও পাচ্ছি না।
অফিস থেকে বের হলাম প্রায় সন্ধার পর।মেয়েটা হয়তো আজকেও রেগে আছে।আমি সুপ্তির জন্যে ওর পছন্দের আইসক্রিম নিয়ে রিক্সায় চেপে বসলাম।আজ রিক্সাটা কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগছে।পাশে সুপ্তি থাকলে বেশ হতো।
সুপ্তিকে নিয়ে কবে রিক্সায় ঘুরেছি সেটা আমার মনে নেই।তবে সেদিন আকাশ মেঘলা ছিল।আমি অফিস থেকে আসতেই সুপ্তি বললো,
-এই চলো না একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
-মাত্রই আসলাম অফিস থেকে,আজ না অন্য দিন।
-না আজকেই,দেখোনা আকাশটা কত মেঘলা,আমার খুব ইচ্ছে তোমার সাথে রিক্সায় চড়ে বৃষ্টিতে ভিজবো।
বলে কি মেয়েটা, বৃষ্টিতে ভিজবে।বৃষ্টি নামলেই আমার জ্বর এসে যায় আর ভিজলে তো মারাই যাব।আমি সুপ্তিকে কিছু বলার আগেই সুপ্তি বললো,
-তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও,আমি রেডি হয়ে আসছি।
সুপ্তির কথায় আমি মাথা নাড়ালাম।আসলে বিয়ের আগে ও কোথাও বের হয়নি।ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর বরের সাথে বের হবে।আর ওর ইচ্ছে পুরনের দায়িত্ব এখন আমারই।
বেশ জোরেই বাতাস বইছে।সুপ্তির চুলগুলা বারবার আমার মুখে এসে পড়ছে।তবে আমি কোনভাবেই সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি না।বেশ লাগছে ওর চুলের গন্ধ পেতে।
সুপ্তি আমার হাত বেশ শক্ত করেই জড়িয়ে ধরে আছে।মনে হচ্ছে এই বাতাসে আমি উড়ে যাব।
তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই বাতাসটা কমে চারিদিকে প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো।
আমি সুপ্তিকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেশ জলদি খেয়ে বের হলাম।তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে।আমি সুপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা বেশ মজায় আছে।বৃষ্টিতে ভিজবে।
আমি আর দেড়ি না করে সুপ্তিকে নিয়ে রিক্সায় চেপে বসলাম।যত দ্রুত সম্ভব বাসায় যেতে হবে।কোন মতেই এই বৃষ্টিতে ভেজা চলবে না।
বাসার কাছাকাছি আসতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।এতক্ষন সুপ্তিকে আটকে রাখতে পারলেও এখন আর পারলাম না।মেয়েটা নিজে তো রিক্সা থেকে নামলোই সাথে আমাকেও নামালো।আমি কিছুনা বলে সুপ্তির দিকে তাকালাম।মেয়েটা আজ অনেক খুশি।আমার জন্যে ওর এই হাসি মাখা মুখটা মলিন হয়ে যাক এইটা আমি চাই না।
সুপ্তির সাথে ভিজতে বেশ মজা লাগলেও রাতের বেলা জ্বর বাবাজি কিছু না বলেই চলে এলো।সারারাত মেয়েটা ঘুমায় নি।ওষুধ খায়িয়ে দিয়ে সারারাত আমার পাশে বসে কেদেছে আর কপালে জ্বলপট্টি দিয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে বাসার সামনে এসে গেছি সে খেয়ালই নেই।আসলে সুখের সৃতি গুলা বেশ তাড়াতাড়িই যায়।
কলিংবেল বাজাতেই সুপ্তি দড়জা খুলে দিল।আগে দড়জা খুলেই আমার হাতের ব্যাগটা নিতো,আমাকে বসিয়ে দিয়ে সরবত বানিয়ে খাওয়াতো,ওর আচল দিয়ে ঘেমে থাকা মুখটা পরম যত্নে মুছে দিত।কিন্তু এগুলা এখন শুধুই কল্পনা।
আমি ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসতেই সুপ্তি বললো,
-তুমি আজকের দিনটার কথাও ভুলে গেছো।
-কেন আজকে আবার কি?
-আজ আমার জন্মদিন ছিল।
এই রে কাজের চাপে সবকিছু ভুলে গেছি।আমি কিছু বলার আগেই সুপ্তি বললো,
-কাজ কাজ আর কাজ।আমাকে নিয়ে কবে ঘুরতে গেছো তোমার মনে আছে,কবে দুজন রেস্টুরেন্টে খেয়েছি
সেটাও মনে করতে পারছি না,তোমার সাথে কবে কিছুটা ভাল সময় কাটিয়েছি সেটাও ভুলে গেছি,আসলে তোমার সবকিছুতেই কাজ।আমাকে ভুলে তুমি কাজের দিকেই বেশী নজর দিচ্ছ।আবার কোন সুন্দরী কলিগের প্রেমে পড়ে যাওনিতো।তোমার সাথে আর না।কাল সকালেই আমি চলে যাব।
সুপ্তি কান্না জড়িত কণ্ঠে এক নাগাড়ে কথাগুলা বলে কান্না করতে করতে রুমে চলে গেলো।আমি কি করবো ভেবে পেলাম না।আমারই বা কি করার আছে।সত্তিই তো কেমন যেন এক ঘেয়েমি হয়ে গেছি।ওর ও তো ইচ্ছে হয় একটু আমার সাথে ঘুরতে,সুন্দর কিছু সময় কাটাতে।কিন্তু আমি ছুটেছি অন্য কিছুতে।
সুপ্তির চোখের পানি দেখে আমার চোখটাও ভিজে উঠলো।এই এক বছর আগের কথা।ওর জন্মদিনে কত মজা করেছিলাম আমরা।আর আজ ওর জন্মদিনের কথা ভুলেই গেছি।
চেয়ারেই কখন ঘুমিয়ে গেছি সে খেয়ালই নেই।আমি উঠে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখি প্রায় নয়টা বেজে গেছে।অফিসের সময় তো হয়ে গেছে।কিন্তু আজ সুপ্তি ডেকে দিল না যে।আমি রুমে ঢুকে সুপ্তিকে খুজলে লাগলাম।
মেয়েটা কোই গেলো।দেখি ফোন দিয়ে দেখি।আমি ফোনটা ধরতে দেখি সাথে একটা কাগজ আটকানো।এক লাইনের লেখা,আমি বাবার বাসায় যাচ্ছি।
সুপ্তিকে ছাড়া যে পুরোপুরিই অচল সেটা এই কয়েকদিনে আমি বেশ ভালভাবেই বুঝে গেছি।কাজের চাপে মেয়েটাকে সময় দিতে না পেরে ও যে আমার থেকে একটু একটু করে দূরে সরে গেছে সেটা আমি বুঝতেই পারিনি।
ওকে ছাড়া আর একমুহুর্ত না।অফিস থেকে সোজা সুপ্তিদের বাসায় চলে যাব।প্রয়োজনে এ চাকরি টা ছেড়ে দিয়ে নতুন কোথাও জয়েন করবো।তবুও আর সুপ্তিকে কষ্ট দেওয়া চলবে না।
আজ মনটা বেশ ভাল।আমার এই খুশিতে সুপ্তিও অনেক খুশি হবে।ওকে আর কষ্ট পেতে হবে না।আমি অফিস থেকে বের হয়ে সোজা সুপ্তিদের বাসায় আসলাম।শ্বশুরবাড়
ি গেলে নাকি ফলমূল, মিষ্টি নিয়ে যেতে হয়।আমিও নিলাম।আজ একটু বেশী করেই নিলাম।
কলিংবেল বাজাতেই সুপ্তির মা এসে দড়জা খুলে দিল।আমাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি বেশ খুশিই হয়েছে।আমি ওনাকে সালাম দিয়ে ভেতরে গিয়ে বললাম,
-সুপ্তিকে দেখছি না যে,ও কোই?
-আসলে বাবা সংসারে একটু ঝগড়া হয়ই,তাই বলে এতদিন রাগ করে থাকবে।সুপ্তি ওর রুমে আছে,তুমি যাও।
সুপ্তির মায়ের কথায় আমি আর কিছু বললাম না।সুপ্তির রুমের দিকে গেলাম।
আমি রুমে ঢুকতেই সুপ্তির কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম।আমি একটু এগিয়ে যেতেই দেখি বিছানায় ল্যাপটপের স্ক্রিনে আমার ছবি আর পাশেই সুপ্তি শুয়ে শুয়ে কান্না করছে।সুপ্তির এ অবস্থা দেখে আমার চোখটা কেমন যেন ভিজে উঠলো।আমি এগিয়ে গিয়ে সুপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ওকে ডাক দিলাম,
-সুপ্তি,এই সুপ্তি।
আমার কথায় মেয়েটা মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো।চোখটা একদম লাল হয়ে গেছে।মুখটাও ফুলে গেছে।আমি সুপ্তিকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম,
-এভাবে কেও চলে আসে।
-তুমিও তো খোজ নাওনি।
-তোমাকে ছাড়া এ কদিন আমি ভাল ছিলাম না।
সুপ্তি আর কিছু বললো না।আমার বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো।আমি সুপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
-এখন থেকে সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে।তোমাকে আর কষ্ট দেবো না।
-তুমি দেড়ি করে আসলেও সমস্যা নেই,আমি শুধু তোমার কাছেই থাকতে চাই।
-আর দেড়ি হবে বা রে পাগলী। এখন থেকে ঘরের বস তুমি আর অফিসের বস আমি।
-মানে?
-আমার প্রমোশন হয়েছে।
আমার কথায় সুপ্তির মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।আমার থেকে সুপ্তিই বেশী খুশি হয়েছে।এই হাসি মাখা মুখটা কতদিন হলো দেখিনা।আমি এবার পকেট থেকে দুটো টিকিট বের করে সুপ্তির হাতে দিয়ে বললাম,
-অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি,এখন তোমাকে নিয়ে সোজা কক্সবাজার।
আমার কথায় সুপ্তি আমার কপালে একটা চুমু একে দিয়ে বললো,
-আমার কিছুই লাগবে না,শুধু তুমি থাকলেই চলবে।
সুপ্তির কথায় আমি ওকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম আর মনে মনে বললাম,
এ বাঁধন ছিড়ে যাবার নয়।