সন্ধ্যা ছয়টা।
অফিস থেকে বের হয়ে রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।তখনি ফোনটা বেজে উঠলো।
সুপ্তির ফোন।এসময় মেয়েটা সচরাচর ফোন দেয় না।কিন্তু আজ আবার কি হলো।আমি ফোনটা ধরতেই সুপ্তি বললো,
-আইসক্রিমের কথা মনে আছে তো।
-থাকবে না কেন,আমার একটা মাত্র বউ,বউয়ের কথা কি ভুলতে পারি।
-এরকম বউয়ের কথা কজনই বা মনে রাখে।
সুপ্তির এমন কথায় আমার মনটা একটু খারাপই হলো।মেয়েটাকে কতবার বলেছি এরকম কথা কোন দিন বলা তো দূরে থাক মুখেও আনবা না।কিন্তু মেয়েটা ঠিকই কথাটা বলে আমার মনটা খারাপ করে দেয়।
আমি কিছু বলার আগেই সুপ্তি বললো,
-চুপ কেন?
-এমনিতেই, আসছি আমি।বাই।
সুপ্তিকে কিছু বলতে না দিয়েই আমি ফোনটা রেখে দিলাম।
ফোনটা পকেটে রাখতেই আবার বেজে উঠলো।সাথে সাথে আমার বিরক্তির মাত্রাটাও বেড়ে গেলো।এমনিতেই মনটা খারাপ তার উপর আবার কে।আমি ফোনটা বের করে দেখি জেনিফার ফোন।আমি ইচ্ছে করেই ফোনটা ধরলাম না।কেটে গেলো।কিন্তু নাছোড়বান্দা মেয়েটা আবারও ফোন দিল।আমি এবার ফোনটা ধরতেই জেনিফা বললো,
-তোমার অফিসের পাশের রেস্টুরেন্টে একটু আসবে?
-সরি, পারবো না।
-কিছু সময়ের জন্যে।
আমি আসছি বলেই ফোনটা রেখে দিলাম।এইতো সামনেই রেস্টুরেন্টটা,হেটে যেতে দু মিনিট লাগবে।আমি আর রিক্সা নিলাম না।হেটেই রওনা দিলাম।
-তুমি আসবে ভাবিনি।
-ভাবনার সবকিছুই সঠিক হয়না।
-কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল।তুমি?
-হুম ভাল।
-তোমার সাথে অনেক দিন ডিনার করা হয় না,ভাবছি আজ তোমার সাথে ডিনার করবো।
-সরি,আমি পারবো না।
-প্লিজ, শুধু আজকে।
-সরি,সুপ্তি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে,আমি গেলেই ও আমার সাথে ডিনার করবে,নয়তো না।
কথাটি বলেই আমি উঠে দাড়ালাম।এখানে আর একমুহুর্ত না।রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আমি আর পেছনে তাকালাম না।হয়তো মেয়েটা কাঁদছে, নয়তো না।
সুপ্তির পছন্দের আইসক্রিম নিয়ে রিক্সায় চেপে বসলাম।মেয়েটার জন্যে প্রতিদিন আইসক্রিম নিতেই হবে।অবশ্য না নিলে রাগ করে না,কিন্তু একটু অভিমান লক্ষ করা যায়।
সুপ্তির সাথে আমার বিয়ের হয়েছে তিন বছর হবে।বিয়ের আগে নাকি অনেকেরই প্রেম হতো ঠিক আমার ও
হয়েছিল।জেনিফার সাথে।সবকিছু ঠিক থাকলে সেদিন আমরা পালাতাম।কিন্তু জেনিফা আসেনি।আমার মত বেকার ছেলের সাথে আর যাই হোক ওর নাকি পালানো সম্ভব না।
এর কিছুদিন পরেই ওর ইচ্ছেতেই এক বড়লোক বাবার বড়লোক ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়।টাকার নেশাটা জেনিফা কোনমতেই ছাড়তে পারেনি।
জেনিফার বিয়ের এক বছর পর ওদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল।ততদিনে এই বেকারের হাত অন্য একজন ধরেছিল।খুব শক্ত করেই।
তখন অল্প বেতনে আমার আর সুপ্তির বেশ কষ্টই হচ্ছিলো।কিন্তু মেয়েটা সবকিছু একহাতে সামলে নিয়েছিল।এমনকি মাঝে মাঝে ওর বাবার কাছে থেকে বেশ কিছু টাকাও আনতো।তবে সেটা ও আমাকে কোনদিনও বলেনি।
আজ আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না।বেশ মোটা অংকের বেতনের সাথে বেশ ভাল চাকরি।আসলে সবকিছু হয়েছে সুপ্তির ভালবাসা আর সাপোর্টে। ও আমার পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছে। আজ আমার সব আছে, আছে সুপ্তির ভালবাসাও।কিন্তু টাকার লোভে যে মেয়েটা আমার হাত ছেড়ে দিয়েছিল সে আজ ভাল নেই।একটুও না।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন চলে এসেছি সে খেয়ালই নেই।আজ কেমন যেন লিফটে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না তাই সিড়ি দিয়েই উপরে উঠলাম।
ফ্লাটের সামনে এসে বেশ কয়েকবার কলিংবেল বাজালাম কিন্তু দড়জা খোলার কোন নাম নেই।তাই আমি আর কলিংবেল বাজালাম না।পকেট থেকে চাবিটা বের করে নিজেই খুললাম।আসলে রুমের চাবি আমার কাছে সবসময় একটা থাকে।মাঝে মাঝে কলিংবেল না বাজিয়ে নিজেই খুলে ভেতরে ঢুকি।আজকেও ঠিক সেটাই করতে হলো।
আমি দড়জাটা আটকিয়ে শোবার ঘরে ঢুকতেই দেখি সুপ্তি ফ্লোরে পড়ে আছে।আমি ওর মুখের দিকে তাকাতেই দেখি মেয়েটার চোখে পানি টলমল করছে।যে কোন সময় কেঁদে দিতে পারে।সুপ্তির এ অবস্থা দেখে আমার ভেতরটা কেমন যেন কেঁদে উঠলো।আমি সুপ্তিকে তুলে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে বললাম,
-কিভাবে পড়ে গেলে,ব্যাথা পাওনি তো।আমাকে তো একবার ফোন করলেও পারতে।কিছু হয়নি তো।
-তুমি শান্ত হও,কিছুই হয়নি,আমি ঠিক আছি।
-পড়ে গেলে কিভাবে?
-অনেক দিন হলো তোমার জন্যে রান্না করিনা।তাই ভাবছিলাম একটু কিছু রান্না করতে।বিছানা থেকে নেমে হুইল চেয়ারে বসতেই আর সামলাতে পারিনি।পড়ে গিয়েছি।
-তোমাকে কি আমি বলেছি আমার জন্যে রান্না করতে।যদি কিছু হয়ে যেত।
-কিছু হয়নি তো।তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে নাও।
-হুম, উঠবা না কিন্তু।শুয়েই থাকো।
আমি সুপ্তিকে শুয়িয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে গেলাম।
আজ থেকে ছয়মাস আগে বাথরুমে পড়ে গিয়ে সুপ্তির ডান পা টা ভেঙে যায়।সাথে একটা রগও ছিড়ে যায়।ডাক্তার বলেছে ঠিক হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে।
তাই বাসায় আমি না থাকলে হুইল চেয়ারই ওর একমাত্র সঙ্গী।এ কারনেই সুপ্তি তখন বলেছিল, এ রকম বউয়ের কথা কজনই বা মনে রাখে।
আমি ফ্রেশ হয়ে এসে সুপ্তিকে কোলে নিয়ে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিলাম।প্রতিদিন বুয়া এসেই সবকিছু করে দিয়ে যায়।আমি সুপ্তির পাশের চেয়ারে বসে ওকে খায়িয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলাম।মেয়েটার বেশ ক্ষিদে পেয়েছে।বাসায় একা রেখে যেতে বেশ খারাপই লাগে।
তাই অফিস থেকে বেশ কিছুদিনের ছুটি নিয়েছি।এসময় ওর পাশে থাকা খুবই জরুরী।যে মেয়েটা আমার খারাপ সময়গুলোতে পাশে থেকে সাপোর্ট দিয়েছে তাকে আর যাই হোক কোন ভাবেই কষ্ট দিতে পারবো না।কোন ভাবেই না।
আমার আইসক্রিম কোই?
সুপ্তিকে এনে বিছানায় বসিয়ে দিতেই সুপ্তি কথাটি বললো।আমি ওর চুলগুলা ঠিক করে দিয়ে বললাম,
-এনেছি তো,খাবে?
-হুম,এখনি।
আমি ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম এনে সুপ্তিকে একটু একটু করে খায়িয়ে দিলাম।এত বড় মেয়েটা ঠিক বাচ্চা মেয়েদের মত আইসক্রিম খাচ্ছে।একদম নিষ্পাপ লাগছে মেয়েটাকে।
সুপ্তি আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে।থাইয়ের কাচ ভেদ করে চাদের আলো সুপ্তির মুখে এসে পড়েছে।চাদের আলোতে মেয়েটাকে একদম চাদপরীর মত লাগছে।
আমি সুপ্তির কপালে লেগে থাকা চুলগুলা সরিয়ে দিয়ে মেয়েটার কপালে চুমু একে দিলাম আর ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বললাম,
চাদপরী,আমার চাদপরী।