রেজাল্ট কি?
আমার কথায় সুপ্তি চুপ করে রইলো।ফোনের ওপাশে যে কেও কাদছে এইটা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম।সাথে একটা মেয়েলি কণ্ঠ বেশ কিছুক্ষন হলো বকছে,এটাও স্পষ্টই শোনা গেলো।আমি সুপ্তিকে আবারও বললাম,
-রেজাল্ট কি?
মেয়েটা সেই আগের মতই চুপ করে রইলো।কান্নার শব্দটা আরও একটু বেড়ে যেতেই ফোনটা কেটে গেলো।আমি এসিটা চালিয়ে দিয়ে চেয়ারে একটু আরাম করে বসে আবার ফোন দেবো কি না ভাবতে লাগলাম।
আজ সুপ্তির রেজাল্ট দেওয়ার কথা।দিয়েও দিয়েছে এতক্ষনে।সকালে অফিসে আসার সময় প্রতিদিনের মত আজকেও সুপ্তি ফোন করে জাগিয়ে দিয়েছিল।বলেছিল রেজাল্ট পেলে সাথে সাথেই জানাবে।কিন্তু ও এমন করছে কেন।
সুপ্তির সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে এই মাস খানেক হবে।সবকিছু ঠিক থাকলে ওর রেজাল্টের পরই আমাদের বিয়ের কথা ছিল।ছিল বলতে,বিয়ে হবে।
সেদিন সুপ্তিকে কালো শাড়িতে বেশ লাগছিল।আসলে ওর থেকে ওর শাড়িটা দেখেই আমার বেশী পছন্দ হয়েছিল।মেয়েটা ঘোমটা দিয়ে ঠিক আমার সামনের দিকের সোফায় বসেছিল।অপেক্ষায় ছিলাম কখন ঘোমটা তুলবে আর কখন মেয়েটাকে দেখবো।তবে আমার কথা মনে হয় মামী বুঝে গেলেন।আমার পাশে থেকে উঠে সুপ্তির পাশে বসতে বসতে ঘোমটাটা তুলে দিলেন।
এওক্ষন চাইছিলাম ঘোমটা তোলে না কেন,আর এখন লজ্জায় তাকাতেই পারতেছি না।ভাবিনি এরকম পরিস্থিতিতে কখনও পড়বো।আমি মেয়েটার দিকে চোখ তুলে তাকালাম।
ঠিক আমার মনের মত।কতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম জানিনা,আমার ধাক্কায় আমার ধ্যান ভাঙলো।আম্মা আমাকে ইশারা করে বুঝালো,কি মেয়ে পছন্দ হয়েছে।আম্মার কথায় আমি শুধু মুচকি হেসেছিলাম।
পড়তে চাই।
মামির কথায় আমাদের আলাদা কথা বলার ব্যাবস্থা হলো।কিন্তু কি বলবো সেটাই বুঝতে পারলাম না।আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আচ্ছা আপনার ইচ্ছে কি?
-পড়তে চাই।
-বিয়ের পর?
-হ্যা।
-আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?
আমার কথায় সুপ্তি কিছু বললো না।শুধু মাথা নাড়ালো।
সেদিন এটুকুই কথা হয়েছিল ওর সাথে।আম্মা একদম আংটি পড়িয়ে এসেছিল।
সকালে ঘুমটা ভাঙলো অচেনা কারও ফোন কলে।আমি ফোনটা ধরতেই বিরক্তি ভাব নিয়ে বললাম,
-কে?
-আমি,সুপ্তি।
সুপ্তি।নামটা শুনের আমার ঘুমটা চলে গেলো।কিন্তু ও আমার নাম্বার পেলো কোথায়।কাল তো আসার সময় নাম্বার দেইনি।আমি বললাম,
-নাম্বার কোই পেলেন?
-মামির কাছে থেকে নিয়েছি।
-তো এত সকালে ফোন।
-এখন থেকে আমার ফোনেই ঘুম ভাঙবে।ওঠো,উঠে ফ্রেশ হয়ে অফিস যাও।আর যাওয়ার আগে অবশ্যই আমাকে ফোন দিবা।
বাহ বিয়ের আগেই দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে।মেয়েটা আর যাই হোক বেশ ভাল।আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে সুপ্তিকে ফোন দিয়ে তারপর বের হলাম।বিয়ের আগেই এরকম মিষ্টি শাষন বেশ ভালই লাগে।মিষ্টি শাষন।
এভাবে বেশ ভালই চলছিল।প্রতিদিন মেয়েটা সকালে জাগিয়ে দিত আর আমারও মিষ্টি কন্ঠে ঘুম ভাঙতো।অল্প কয়েকদিনেই মেয়েটা আমাকে একদম আপন করে নিয়েছে।
এসব ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠলো।হুম সুপ্তির ফোন।আমি ফোনটা ধরতেই মেয়েটা বললো,
-একটু নিচে নামবা,আমি তোমার অফিসের নিচে।
সুপ্তির কথায় আমি একটু অবাকই হলাম।আমার অফিস ও চেনে মেয়েটা।কিন্তু উপরে না এসে নিচে নামতে বললো কেন।আমি আর কিছু না ভেবে অফিস থেকে বের হলাম।নিচে আসতেই সুপ্তি আমাকে দেখে আমার দিকে এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বললো,
-চলো।
-কোথায়?
-বিয়ের শপিং করতে।
শপিং।নাম শুনেই কেমন যেন অস্বস্থি লাগলো।তার উপর মেয়েদের সাথে।না ও করতে পারতেছি না।আসলে সুপ্তি আমার পাশে থাকলে বেশ ভাল লাগে।কেমন যেন শক্তি পাই।
আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-গাড়ি এনেছো?
-না,আজ তোমার সাথে রিক্সায় ঘুরবো।
-আচ্ছা চলো।রিক্সাতেই ঘুরবো।
দেখোতো এইটা কেমন?
দোকানি বেশ কয়েকটা শাড়ি বের করে দিয়েছে।শাড়িগুলাই দেখছিলাম।তখনি সুপ্তি কথাটি বললো।আমি ওর দিকে তাকাতেই দেখি মেয়েটা হাতে একটা কালো রঙের পাঞ্জাবী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি শাড়িটা রেখে দাড়াতেই সুপ্তি আমার গায়ে পাঞ্জাবিটা ধরে বললো,
-বেশ মানাবে তোমায়।
আরে আসলাম শাড়ি কিনতে আর উনি পাঞ্জাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমি সুপ্তিকে বললাম,
-আমরা তো শাড়ি কিনতে এসেছি।বরং শাড়িই কিনি।
-হুম কিন্তু পাঞ্জাবীটা আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।তোমাকে বেশ মানাবে।শাড়ির সাথে পাঞ্জাবিটাও কিনবো।
-থাক না আজকে।
আমার কথায় সুপ্তি রাগ ভাব নিয়ে বললো,
-বলছি যখন নেবো,সো নেবোই।
কথাটি বলেই মেয়েটা হনহন করে কাউন্টারের দিকে গেলো।সুপ্তিকে আমি আর কিছু বললাম না।মেয়েটা যেটা বলবে সেটাই করবে।
আমি আর ওর দিকে তাল না দিয়ে শাড়ির দিকে মনোযোগ দিলাম।
শার্টটা সুন্দর না।
সুপ্তির শাড়িটা কিনে যখনি বের হতে যাব তখনি মেয়েটা একটা শার্ট হাতে নিয়ে কথাটি বললো।
হুম দেখতে বেশ সুন্দর।তবে মেয়েটা নিজের জন্যে কিনতে এসে সবকিছু আমার জন্যেই কিনে ফেলছে।এটা কেমন দেখায় না।আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-নাহ,দেখতে একদমই ভাল না।কেমন যেন।
-কি বলো,আমার কাছে তো ভালই লাগছে,তোমার গায়ে এটা বেশ ভালই লাগবে।
সুপ্তির কথায় আমি আর কিছু বললাম না।জানি, ওকে বলে আর কিছু হবে না।আমি সুপ্তির হাত থেকে শার্টটা রেখে ওর হাত শক্ত করে ধরে শপিংমল থেকে বের হলাম।
মেয়েটা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও ছাড়াতে পারলো না।একে বারে রিক্সায় উঠে ওর হাতটা ছাড়তেই সুপ্তি বললো,
-এইটা কি হলো?
-কেন,কি হবে?
-তুমি শার্টটা নিতে দিলে না কেন?
-ভাল না তো।
-আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।
-আচ্ছা অন্য কোন দিন নেবো।
আমার কথায় সুপ্তি কিছু বললো না।বেশ রেগে গেছে।সারা রাস্তায় একদম কথা বলেনি।আমি সুপ্তির বাসার সামনে ওকে নামিয়ে দিতেই মেয়েটা কিছু না বলেই নেমে গেলো।আমি ওকে পেছন থেকে ডাক দিলাম।
-সুপ্তি, এই সুপ্তি।
মেয়েটা ঘুরে আমার কাছে এসে বললো,
-বলো।
-শাড়িটা তো নিয়ে যাও।
-যেদিন ওই শার্টটা কিনবা সেদিনই শাড়িটা নেবো।তার আগে না।
কথাটি বলেই মেয়েটা ভেতরে চলে গেলো।কি রাগি মেয়েরে বাবা।আমি রিক্সাওয়ালাকে ঘুরাতে বললাম।আগে শার্টটা অন্তত কিনে বাসায় যাই।নইলে কপালে বেশ ঝামেলা আছে।
আমি আর দেড়ি করলাম না।অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়লাম।কেমন যেন বারবার সুপ্তির কান্না আমার কানে ভাসছে।তার উপর সবাই যে ওকে বকছে এইটা বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছি।
বউমার রেজাল্ট দিয়েছে আজ?
বাসায় আসতেই আম্মা কথাটি বললো।আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-হ্যা দিয়েছে।
-শুনেছিস রেজাল্ট?
-না শোনা হয়নি।দেখি ওদের বাসায় গিয়ে শুনবো।
-সেটাই ভাল হবে।অনেকদিন হলো যাস না।
-হ্যা,ফ্রেশ হয়ে বের হবো।
-মিষ্টি নিয়ে যাস।আমি নিশ্চিত আমার বউমা এ+ পেয়েছে।তাছাড়া আমার ছেলের বউ,এ+ ছাড়া কি হয়।
আম্মার কথায় আমি আর কিছু বললাম না।বুঝিনা এই এ+ এ কি আছে।সবার মুখেই শুধু এ+,এ+।
শ্বশুরবাড়িতে গেলে নাকি ফলমুল, মিষ্টি নিয়ে যেতে হয়।আমিও তার ব্যতিক্রম নই।তবে এসব হাতে নিয়ে যেতে কেমন যেন লজ্জা লাগে।
তবুও নিয়ম বলে কথা।মানতেই হবে।আমি হাতে রাখা মিষ্টি, ফলমুলের দিকে তাকিয়ে কলিংবেলে চাপ দিলাম।কিন্তু আগের দিনের মত আজ দড়জাটা একটু তাড়াতাড়ি না খুলে একটু দেড়িতেই খোলা হলো।দড়জা খুলতেই আমি শ্বাশুড়ি আম্মাকে সালাম দিলাম।
ওনার দিকে একটু ভালভাবে লক্ষ করে দেখলাম মনটা বেশ খারাপ।আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
-আসো বাবা ভেতরে আসো।
আমি ভেতরে গিয়ে সোফায় বসতে বসতে বললাম,
-আজ তো সুপ্তির রেজাল্ট হয়েছে,জানালেন না যে।
আমার কথায় সুপ্তির মায়ের মুখটা কেমন যেন মলিন হয়ে গেলো।কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
-তোমাদের বিয়েটা মনে হচ্ছে হচ্ছেনা।
-কেন?
-সেদিন তোমার আম্মার সাথে কথা বলার সময় উনি বলেছেন তার একজন এ+ ওয়ালা ছেলের বউ লাগবে।আর সেইটা সুপ্তি শুনে ফেলেছিল।
-হুম এতে সমস্যা কি?
-আসলে বাবা মেয়েটা এ+ পায়নি।সেই দুপুর থেকে দড়জা আটকিয়ে শুধু কান্না করতেছে।কেন যেন মেয়েটাকে আজ আমিও অনেক বকেছি।
সুপ্তির মায়ের কথায় আমি আর কিছু বললাম না।তার মানে সুপ্তি এর জন্যেই তখন কান্না করছিল।আর কিছু না বলেই ফোনটা রেখে দিয়েছিল।আম্মাকেও বলি,এরকম ফালতু শর্ত দেওয়ার মানেটা কি।
আমি উঠে সুপ্তির দড়জার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে বেশ কয়েকবার ডাক দিতেই মেয়েটা দড়জা খুলে দিল।
আমাকে দেখে কিছু না বলে বেলকুনিতে গিয়ে দাড়ালো।
সুপ্তির চোখ মুখ দেখে নিজেরই কেমন যেন খারাপ লাগলো।কান্না করতে করতে একদম চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।আমি বেলকুনির দিকে এগিয়ে গিয়ে সুপ্তিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
-আমার এ+ লাগবে না,এই পিচ্চি মেয়েটা থাকলেই চলবে।
সুপ্তি আমার কথায় আমার দিকে ঘুরে তাকালো।চোখে এখনও পানি টলমল করছে।সুপ্তি কাপা গলায় বললো,
-কিন্ত তোমার মা।
-আম্মাকে আমি দেখে নেবো।
আমি এবার সুপ্তির গায়ে সেদিনের কেনা শাড়িটা জড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-শাড়িটা পড়ে নাও,তোমাকে নিয়ে আজ ঘুরতে যাব।
আমার কথায় সুপ্তির টলমল করা চোখের পানি এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-ওই শার্টটা ছাড়া আমি এই শাড়িটা পড়বো না।
সুপ্তির কথায় আমি ওকে হাত দিয়ে ইশারা করে বিছানার উপরে রাখা প্যাকটটা দেখিয়ে বললাম,
-ওই দেখো শার্টটা।আমি জানতাম তুমি এমন কিছু একটাই বলবে।তাই নিয়েই এসেছি।
আমার কথায় সুপ্তি আর কিছু বললো না।আমাকে শক্ত করেই জড়িয়ে ধরে রাখলো।কান্নাটা এখন কিছুটা কমেছে।
এদিকে আমি ভাবছি অন্য কথা।আজ বেশ মজা করে বিরিয়ানি খাবো।বউকে সাথে নিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ার মজাই আলাদা।বেশ ভালই হবে।সুপ্তির মনটাও ভাল হবে সাথে বিরিয়ানি খেয়ে আমার মনটাও।