— অ্যাই ছেলে।
— কী?
— বুঝো না?
— কী বুঝবো?
— ধুর তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
— বাবা ও বলে।
উদয়ের কথা শুনে অনা হতাশ! দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো— একটা মেয়ে একটা ছেলের কাছে কী চায়?
— টাকা চায়।
— ছিঃ তোমার মা কী তোমার বাবার কাছে শুধু টাকাই চায়? আর কিছু চায় না?
— চায় তো, ঔষধ।
— অসুস্থ হলে তো ঔষধ লাগবেই। তাছাড়া আর কিছু চায় না?
— চায়, বলে বাজার শেষ। আসার সময় বাজার নিয়ে আসবেন।
— আরে আল্লাহ্! বাজার না আনলে খাবে কী তোমরা? আরো তো কিছু চায়, চায় না?
— চায় তো, কবিতা।
— তাও কিছু একটা তোমার চোখে পড়লো! কী রোমান্টিক তোমার মা দেখছো? আচ্ছা তোমার বাবা কবিতা লিখে?
— না, চুরি করে মাকে শুনায়।
— তবুও তো তোমার মায়ের জন্যই। তুমি আমার জন্য কবিতা লিখবা?
— আমি ওসব পারি না।
— ধুর তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
— বাবা ও বলে।
— আমার জন্য কবিতা চুরি করবা তুমি?
— মা তো বাবার বৌ।
— তো কী? আমি ও তোমার বৌ হবো।
— ফাজিল মেয়ে!
বলে উদয় হাঁটতে শুরু করলো। অনা মাথায় হাত দিয়ে মনে মনে বললো— অনা, তোর কপালটাই এমন রে।
সুদীর্ঘ চার বছর পেরিয়ে যাচ্ছে অনার। তবুও অনা কী চায় উদয় বুঝে উঠতে পারছে না। রাস্তাঘাট, ফেসবুক সহ ইমু সবখানেই অনা উদয়ের পিছনে লেগে আছে। একই এলাকায় পাশাপাশি থাকার কারণে দুজনের প্রতিদিনই দেখা হয়।
আজকে প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। তাপমাত্রা খুবই প্রখর। উদয় যাবে বই উৎসবে। তাঁর কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। হঠাৎ কেউ তাঁর মাথার উপর ছাতা ধরলো! পাশে তাকিয়ে দেখার সাথে সাথেই অনা বললো— এরকম রোদের মধ্যে বাইরে বেরোলে মানুষ হাতে ছাতা নিয়ে বেরোয়।
— বাবা ও বলেছিলো। আমি নেইনি।
— সব শুধু বাবাই বলে! আচ্ছা যাচ্ছো কোথায়?
— বই উৎসবে।
— আমি তোমাকে ভালোবাসি।
উদয় থমকে যায় অনার কথা শুনে। অনার দিকে তাকিয়ে বললো— কী বললেন?
— কানে শুনো না? আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সাথে প্রেম করবো। রাজি হয়ে যাও নাহয় এই রাস্তার মাঝে
জড়িয়ে ধরবো। তারপর আরো কিছু করবো। তখন কিন্তু বিয়ে করতে হবে।
উদয়ের গলায় পানি শুকিয়ে গেছে। কিছু বলতে পারছে না। অনা গলা বাড়ালো— কী জড়িয়ে ধরবো?
উদয় কোনোরকম বললো— না না, ঠিকাছে আমি রাজি।
অনা সঙ্গে সঙ্গেই ছাতা ফেলে দিয়ে উদয়ের হাত টা নিজের বাহুর ভেতরে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। উদয় কাঁপছে! এই প্রথম কোনো যুবতী তাঁর হাত ধরেছে। নারীর স্পর্শে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে যেন উদয়ের শরীরে।
অনা মুচকি মুচকি হেসে বললো— তোমার বয়স কতো যেন?
— সাতাশ।
— কয়টা প্রেম করছো?
— একটাও না৷
— থাপ্পড় দিয়ে সাতাশ টা দাঁত ফেলে দিবো। তাহলে আমি কে? আকাশ থেকে পড়ছি না কী?
উদয় আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ অনার কথা খেয়াল করেছে কী না! শত হোক মানসম্মানের ব্যাপার। একটা মেয়ে তাঁকে ধমকাচ্ছে। ভীতুস্বরে বললো— একটা, একটা।
— ধুর তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমি তোমাকে ঝারি দিলাম তুমি পুরুষ মানুষ হয়ে সয়ে গেলা? আমাকে বকা দাও তো অনেকগুলা।
— বাবা বলছে কাউকে বকা না দিতে। বকা দেওয়া ভালো না।
— তোমার পেটের ভিতরে ইঁদুর ঢুকিয়ে দেওয়ার দরকার ছিলো কচু।
— ঢুকানো যাবে না তো। খেতে হবে।
— হাঁট।
বই উৎসবে ঢুকে অনা একটা বইয়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বললো— কী বই কিনবা তুমি?
— আমার জন্য না। বাবা বলছে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটা বই নিতে।
— তোমার জন্য কিনবা না? আচ্ছা আমাকে তাহলে কয়েকটা বই কিনে উপহার দাও।
উদয় কয়েকটা মুক্তিযুদ্ধের বই নিলো। তারপর ভূতের গল্প একটা বই কিনে অনাকে দিলো। অনা রেগেমেগে আগুন হয়ে বললো— আমি ভূতের গল্প পড়ে কী করবো? অল্প বয়সে মরবো না কী?
কথা টা বলে ও অনা বই টা নিলো। তারপর অনা একটা বই কিনলো। কীভাবে মেয়ে পটাতে হয়। সাত দিনে মেয়ে পটানোর পদ্ধতি। উদয়ের হাতে বই টা দিতেই উদয় বললো— এই বই দিয়ে আমি কী করবো?
— বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পানিতে ধুয়ে খাবে।
উদয় গালগোল ফুলিয়ে রেখেছে৷
বাড়িতে ফিরছে দুজন। অনা এমনভাবে উদয়ের হাত টা ধরে রেখেছে উদয় যেন শ্বাসই নিতে পারছে না। অনার বাড়ির সামনে যেতেই ধুম বৃষ্টি। অটো চালককে ভাড়া দিয়ে দুজন কোনোরকম অনার বাড়িতে উঠলো। যদি ও উদয় ঢুকতে চাচ্ছিলো না। তবু ও বৃষ্টি হচ্ছে, কিছু করার নেই।
উদয় অনার বাড়িতে ঢুকে অবাক হলো। সারা বাড়িতে একটা পোকা পর্যন্ত নেই! উদয়কে বসিয়ে রেখে অনা বাথরুমে ঢুকেছে। কিছুক্ষণ পর বেরোলে অনাকে বললো— বাড়িতে কোনো মানুষ থাকে না?
— থাকে, কিন্তু আজকে সবাই খালার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। কেনো ভয় পাচ্ছো?
উদয় কিছু বললো না। বৃষ্টি নামার গতি আরো বেড়ে যাচ্ছে। উদয়ের ফোনে তাঁর বাবা এরই মধ্যে ফোন করে ফেলেছে কয়েকবার। উদয় অবশ্য ফোন ধরে বলে দিয়েছে চিন্তার কিছু নেই আমি অনাদের বাড়িতে আছি।
বৃষ্টি থামলেই চলে আসবো।
উদয়ের হাতে একটা লুঙ্গি ধরিয়ে দিয়ে অনা বললো— বৃষ্টি মনে হচ্ছে না রাত দশটার আগে থামবে। এতক্ষণ ভেজা শরীর নিয়ে থাকার কোনো দরকার নেই। গোসল করে নাও।
উদয়ের ও তা মনে হলো। লুঙ্গি নিয়ে বাথরুমে ঢুকে উদয় আরো অবাক হলো৷ বাথরুমের পুরো দেয়ালে উদয়ের ছবি টানানো! অনেক ছবি! কোনোরকম গোসল করে বের হয়ে বললো— বাথরুমে আমার এতো ছবি টানানো কেনো?
অনা ঝারি দিয়ে বললো— তোমার না, আমার হিরোর। তাছাড়া এটা আমার ব্যক্তিগত বাথরুম। কাউকে ঢুকতে দেই না। আজকে তোমাকে দিলাম।
উদয় ভালো করে দেখে আসলো। তাঁরই ছবি! যাকগে এ ব্যাপারে কথা বললে অনা আরো রেগে যাবে। সারা বাড়িতে এরা দুজন। উদয় বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখছে। ভালো লাগছে কিন্তু মনে মনে চাচ্ছে বৃষ্টি থেমে যাক।
পেছন থেকে অনা উদয়ের শার্টের কলার ধরে টান দিলো। উদয় ভয় পেয়ে নিজের বুকে থুতু দিয়ে বললো— কলার ধরে টান দিলা কেনো?
— তোমার কী কোনো অনুভূতি নেই? একা একটা বাড়িতে তোমার সামনে জলজ্যান্ত একটা মেয়ে মানুষ। তার উপর বৃষ্টি হচ্ছে।
— এখানে অনুভূতির কী আছে?
— ধুর তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
— বাবা ও বলে।
উদয়ের চোখে চোখ রেখে অনা বললো— শালারফুত, এখন যদি জড়ায় না ধরছিস তাহলে কিন্তু চিৎকার করবো। বদনাম হয়ে যাবে, তারপরে কিন্তু বিয়ে করতে হবে।
উদয় ভয় পেয়ে আস্তে করে অনাকে জড়িয়ে ধরলো। অনা সমানে হেসে চললো। ভাবছে ছেলে টা কতো বোকাসোকা। এজন্যই অনার এতো বেশি ভালো লাগে উদয়কে। পরমুহূর্তে অনা উদয়কে ধাক্কা দিয়ে বললো— আপনার আর গরীবের বাড়িতে থাকতে হবে না সাহেব। ছাতা দিচ্ছি চলে যান।
উদয়ের দেহতে যেন ফের প্রাণ এলো। বেরোবার সময় অনা বললো— আচ্ছা তোমার কী কোনো সমস্যা আছে? বিয়ে করতে এতো ভয় পাও কেনো? কদিন পর তো পাত্রীই পাবে না!
— সমস্যা নেই তো৷ কীসের সমস্যা থাকবে?
উদয়ের চোখেমুখে আকুবাকু কোনো রহস্যের ছাপ ভেসে উঠছিলো কথাগুলো বলার সময়। উদয় গুটিগুটি পায়ে বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটতে শুরু করলো ছাতা নিয়ে।
এক বছর পর।
অনার বিয়ে হয়ে গেছে। উদয়ের খুশি হওয়ার কথা কিন্তু সে পারছে না। হাসতে ভুলে গেছে। আকাশ দেখতে ভুলে গেছে। কেউ আর পথ আটকায় না। কেউ বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করে না। কবে যে উদয় নিজের অজান্তে অনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো তা বুঝে উঠতে পারেনি।
আজকে অনার কথা উদয়ের খুব বেশি মনে পড়ছে। কারণ কিছু ঘণ্টা আগে উদয়ের বিয়ে দিয়েছে তাঁর বাবা। বাসর ঘরে ঢুকবে টের। অনার হাসি টা উদয়ের চোখে বারবার ভেসে উঠছে। হাসি টা বাসর ঘরে ঢুকতে বাঁধা দিচ্ছে। নিজের সাথে যুদ্ধ করে বাসর ঘরে ঢুকলো উদয়।
শুনেছে পাত্রী না কী দেখতে অনেক ভালো। তাই ঘোমটা সরানোর প্রয়োজনবোধ করলো না উদয়। সুন্দর দেখলে ও সুন্দর না দেখলে ও সুন্দর। তবুও তো ঘোমটা সরানো দরকার। নাহলে নববধূ ঘুমাতে অস্বস্তিবোধ করবে।
মলিন ইচ্ছে নিয়ে ঘোমটা সরালো উদয়। ঘোমটা সরানোর সাথে সাথে যেন উদয় অজ্ঞান হয়ে যাবে! নিজের চোখ বারবার ক্যাঁচলিয়ে দেখছে। উদয়ের নববধূ আহামরি সুন্দরী যে তার জন্য উদয় এমন করছে না।
কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে বললো— অনা তুমি! তোমার না এক বছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে?
অনার চোখে পানি। উদয় তাড়া দিচ্ছে— কিছু বলছো না কেনো?
— আগে বলো আমাকে দেখে খুশি হয়েছো?
— হ্যাঁ খুব। কিন্তু তুমি এখানে কীভাবে?
— সুন্দর লাগছে না আমাকে?
— আরেহ বাবা অনেক। কিন্তু তুমি এখানে কী করছো আগে বলো?
অনা বলতে শুরু করলো— যার বিয়ে হয়েছে সে অনামিকা জান্নাত আর আমি অনা জান্নাত। ও আমার যমজ বোন। রাজশাহী নানুর বাড়িতে থেকে ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়া করেছে তাই কেউ ওকে তেমন চেনে না বললেই চলে।
— তাহলে তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে?
— মিস করছো খুব? আগে বলো।
— প্রতিটা মুহূর্তে মিস করেছি তোমায় জানো না অনা। প্রতিবার বৃষ্টি আসলে তোমার কথা হতো। রোদে বাইরে
বেরোলে আরো বেশি মনে পড়তো।
অনা মুচকি হেসে বললো— ট্রেনিং এ গিয়েছিলাম। তোমার বৌ এখন পুলিশ!
উদয় কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলো। বিশ্বাস করতে পারছে না এসব। তবে অনাকে পেয়ে সে ভীষণ খুশি। অনা আবারো বললো— কথা বলছো না কেনো? জানো তোমাকে না খুব মিস করেছি। কোনো ছেলেকে দেখলেই তোমার কথা মনে হতো। আমাদের একটা স্যার ছিলো, তোমার মতো বোকা। কিন্তু উনি খুব বজ্জাত ছিলো।
উদয় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো— কপালে বুঝি আমার একটা মহিলা পুলিশ ছিলো?
— মহিলা? আমার সাথে কিন্তু বন্দুক আছে বলে দিলাম। সাবধানে কথা বলো।
উদয় ভয় পেয়ে বললো— আবার বন্দুকের কী দরকার ছিলো?
— উদয়।
— কী?
— বুঝো না?
— না।
— বাসর রাতে মানুষ শুধু গল্পই করে?
— না, ঘুমায় ও।
অনা নাকমুখ এক করে বললো— মুড়ি ও খায়।
উদয় সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে বাবার কাছে গিয়ে বললো— আব্বা, মুড়ি লাগবে।
উদয়ের বাবা অবাক হয়ে বললো— কেনো?
— আমি এখন বড় হইছি। এতো প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না।
উদয়ের বাবা কপালে হাত দিয়ে বললো— দেখতেই পাচ্ছি অনেক বড় হয়ে গেছো, দাঁড়াও দিচ্ছি।
উদয় মুড়ি নিয়ে আবার বাসর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে অনার সামনে গিয়ে বললো— মুড়ি আনছি, খাও।
অনা কাঁদবে না হাসবে বুঝছে না। নরমস্বরে বললো— উদয়।
— বলো।
— ধুর, তুমি বুঝো না?
— বুঝি না। তুমি বলো।
— মুখে বলতে শরম করে।
— বলো।
— তোমার প্যান্ট ছেঁড়া!
উদয় লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে তাড়াহুড়ো করে বাইরে গিয়ে দেখলো তাঁর প্যান্ট ছেঁড়া কী না! সে কী, উদয় দেখলো সে লুঙ্গি পড়ে আছে! উদয় এবার অনাকে গিয়ে বললো— মিথ্যা বললে কেনো? আমার পড়নে তো লুঙ্গি।
— তুমি যে বুঝো না।
— কী বুঝবো? তুমি মিথ্যুক।
— উদয়।
— কী?
— বুঝো না?
— বুঝেছি, তোমার ঘুম পাচ্ছে।
— ধুর তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
— বাবা ও বলে।
অনা আর বৃথা চেষ্টা না করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। এই উদয় আর বাবার ছেলে থেকে একজন প্রেমিক হতে পারবে না। মাঝরাতে অনার ঘুম ভাঙিয়ে উদয় বললো— আমি না কারো সাথে ঘুমাতে পারি না। নীচে চলে যাই?
অনা নিরুপায় প্রায়! কান্না শুরু করে দিয়েছে। দুহাত দিয়ে উদয়ের গলায় শক্ত করে ধরে বললো— চুপ কর শালা।
— বাবা ও বলে!
— আল্লাহ্!