ছাতাটা নিয়ে যান

ছাতাটা নিয়ে যান

অফিস থেকে বের হতেই রফিক সাহেবের ডাকে ওনার দিকে ঘুরে তাকালাম।লোকটা বেশ মিশুক।তবে ওনার ভুড়িটার জন্যে ওনাকে আমার বেশ লাগে।বেশ গম্ভীর একটা ভাব আছে।

এই অফিসে জয়েনের পর থেকে ওনার সাথে আমার বেশ খাতির জমে গেছে।মাঝে মাঝে বাসা থেকে উনি আমার জন্যে দুপুরের খাবারও নিয়ে আসেন।এমনকি অফিস শেষে আমাকে ওনার নিজস্ব গাড়িতে বাসায় ও নামিয়ে দিয়ে আসেন।তবে এর একটা যথেষ্ট কারনও আছে।

ওনার একমাত্র শালির জন্যে আমাকে ওনার বেশ পছন্দ হয়েছে।ওনার ইচ্ছে আমি ওনার ভাইরা ভাই হই।যেমনটা ক্রিকেটার মুশফিক,মাহমুদুল্লাহর মত।কিন্তু আমার ইচ্ছেটা একটু ভিন্ন।কারও শালিকে বিয়ে করবো না।আমারই একটা নিজস্ব শালি থাকবে।কিন্তু রফিক সাহেব বেশ চতুর মানুষ। ওনাকে সামলানো বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

আমি রফিক সাহেবের দিকে তাকাতেই উনি আবারও বললেন,
-যাবেন আমার বাসায়?
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
-আজ না ভাই,অন্য দিন।
-আসলে মিমি এসেছে তো,তাই বললাম।চলুননা ভালই লাগবে।

রফিক সাহেবের মুখে মিমির নাম শুনে আমার হাসিটা একটু বেড়ে গেলো।তবে সেটা বেশ শক্ত ভাবেই আটকে রেখে আমি বললাম,

-একটু বাজার করতে হবে আজ।বাসায় কিছুই নেই।একা মানুষ,রান্নাটাও নিজেরই করতে হয়।
আমার কথায় রফিক সাহেবের মুখটা একটু মলিন হয়ে গেলো।উনি মুখে হাসি ভাব এনে বললেন,
-চলুন তাহলে নামিয়ে দেই আপনাকে।
-আপনার এই গাড়ি বাজারের ভেতরে ঢুকবে না।আমি রিক্সা নিয়েই যেতে পারবো।
-আপনি গেলে মিমি বেশ খুশি হতো।
-আচ্ছা ভাই,ওকে অন্যদিন খুশি করবো।আজ না।
-আচ্ছা আসি তাহলে।
-হ্যা,সাবধানে যাবেন।

মিমি।রফিক সাহেবের একমাত্র শালিকার নাম।এটাকে আমার গলায় ঝুলানোর জন্যে বেশ উঠেপড়ে লেগেছেন উনি।

বৃষ্টি একটু কমেছে।এখন বের হওয়াই যায়।ভিজতে হবে একটু।তবুও সমস্যা নেই।জ্বর আসলে অন্তত অফিস তো ছুটি পাওয়া যাবে।

আমি বের হতেই পেছন থেকে কেও ডেকে উঠলো।বেশ মিষ্টি গলায় ডাকলেও কণ্ঠটা আমার বেশ পরিচিতই মনে হলো।

আমি পেছনের দিকে ঘুরতেই দেখি সুপ্তি দাঁড়িয়ে।হাতে ওর ছাতাটা আমার দিকে ধরে আছে।আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই উনি বললেন,

-ছাতাটা নিয়ে যান।

যার জন্যে রফিক সাহেবকে এড়িয়ে চলি ইনিই সে।সুপ্তি।আমার অফিসের কলিগ।ওকে যে আমি পছন্দ করি এটা ও বুঝতে পারে কিন্তু ও যে আমাকে পছন্দ করে এটা ওর কাজের মাঝেই টের পাই।কাজের চাপ থাকলে নিজে থেকে এসে কাজ করে দেবে,মাঝে মাঝে মাথা ধরলে নিজে গিয়ে চা বানিয়ে আনবে।এরকম অনেক আছে।

আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম,
-ছাতাটা নিলে আপনি ভিজে জাবেন তো।
-আমি বৃষ্টি থামলে চলে যাব।

বলে কি মেয়েটা।এই বৃষ্টি থামবে বলে মনে হচ্ছে না।তাছাড়া এখনই প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে।এসময় ওকে এখা রেখে কিভাবে যাব।

আমি বললাম,
-আপনি বরং চলে যান,আমি যেতে পারবো।
-তাহলে চলুন একসাথেই যাই,আপনার বাসার ওইদিক দিয়েই যাব তো।
-ধন্যবাদ।কিন্তু আমার যে একটু বাজার করতে হবে।
-চলুন,আমিও যাব।

কথাটি বলে মেয়েটা আর দাড়ালো না।ছাতা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।এই ছোট ছাতাতে দুজনের বেশ কষ্টই হচ্ছে।কিন্তু অনুভুতিটা দারুন।ইচ্ছে ছিল ওকে নিয়ে একদিন বৃষ্টিতে ভিজবো।রাতে আমার হাড় কাপানো জ্বর উঠবে।আমার এ অবস্থায় মেয়েটা রাত জেগে জলপট্টি করবে।মুখে থাকবে ভয়ের ছাপ।সকালে যখন জ্বরটা কমে যাবে তখন ওর মুখের কোনের মুচকি হাসিটা দেখে শান্তিতে বুক ভরে যাবে।

এই মাছটা দেন।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে এসে গেছি সে খেয়ালই নেই।সুপ্তির কথায় আমি মাছ ওয়ালার দিকে তাকালাম।বেশ বড় একটা মাছ উনি ব্যাগে ভরে দিলেন।এর মাঝে মাছও পছন্দ করে ফেলেছে মেয়েটা।আমি সুপ্তির দিকে তাকাতেই উনি বললেন,

-টাকাটা দিন।
-ভাই কত।
-মাত্র নয়শো টেহা।

কথাটি বলেই মাছওয়ালা দাত কেলিয়ে একটা হাসি দিলেন।আনন্দের হাসি। আমি টাকাটা দিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি সুপ্তি নেই। আরে এই মেয়েটা আবার কোই গেলো।একটু দূরে তাকাতেই দেখি মেয়েটা মাংসের ওই দিকে যাচ্ছে।মেয়েটা দেখছি আজ পকেটের বারোটা বাজিয়ে দেবে।

সুপ্তিদের বাসা আমার বাসা থেকে দু বিল্ডিং পরেই।বেশ কয়েকবার ওদের বাসায় যাওয়া হয়েছে।তবে সুপ্তির রুমে কোনদিন ঢোকা হয়নি।

সেদিন অফিস থেকে বাসায় আসতেই সুপ্তির ফোন এসে হাজির।এই মেয়েটা প্রতিদিনই ফোন দেবে।সেটাও ঠিক আমি রুমে ঠোকার সাথে সাথেই।জিজ্ঞেস করবে বাসায় পৌছেছি কিনা।ব্যাস।আমি ফোনটা ধরতেই সুপ্তি বললো,

-বাসায় পৌছেছেন?
-হ্যা, আসলাম মাত্র।
-আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।
-সবকিছুই শেষ।রান্না করতে হবে,তারপর খাওয়া।
-এখন আপনি রান্না করবেন?
-হ্যা,বুয়া আসেনি।

-আপনাকে কিছুই করতে হবে না।আপনি যান ফ্রেশ হয়ে আসুন।কথাটি বলেই মেয়েটা ফোনটা রেখে দিল।আরে রান্না না করলে খাব কি।

আমি আর কিছু না ভেবে সবকিছু রেখে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই কলিং বেল বেজে উঠলো।উফ এখন আবার কে।আমি বিরক্তি ভাব নিয়ে দড়জাটা খুলতেই দেখি দাড়ওয়ান চাচা দাঁড়িয়ে।আমি কিছু বলার আগেই উনি আমার দিকে একটা টিফিন বাটি এগিয়ে দিয়ে বললেন,

-একজন দিয়ে গেলো,আপনাকে দেওয়ার জন্যে।

আমারজন্যে।আমার জন্যে কে আবার এটা পাঠালো।আমি টিফিন বাটিটা হাতে নিতেই ফোনটা বেজে উঠলো।সুপ্তির ফোন।আমি ফোন ধরতেই মেয়েটা বললো,

-একটা টিফিন বাটি পেয়েছেন?
-হ্যা পেয়েছি,কিন্তু আপনি জানলেন কিভাবে?
-আমিই পাঠিয়েছি।

সুপ্তির কথায় আমি আর কিছু বললাম না।তার মানে এর জন্যেই তখন ও রান্না করতে নিষেধ করেছিল।মেয়েটাকে যতই দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।আমার জন্যে এই রাতের বেলা খাবার পাঠিয়েছে।

এদিকে মেয়েটা মাংস কেনার পর কাচা বাজার করে আমার দু হাত একদম ভরিয়ে ফেলেছে।বাজার করতে আসলাম আমি আর করলেন উনি।মেয়েটা পারেও বটে।

কিন্তু এগুলা রান্না করবো কিভাবে সেটা ভেবেই ঘেমে যাচ্ছি।

আমার এ অবস্থা দেখে মেয়েটা মুচকি মুচকি হাসছে।ফাজিল মেয়ে একটা।নিজে বেশ আরামেই হেটে যাচ্ছে আমার হাতে সব বাজার চাপিয়ে।

রিক্সাটা বাসার সামনে এসে থামতেই সুপ্তি নেমে গেলো।আরে আসলাম আমার বাসার সামনে আর নামলেন উনি।আমি নেমে ভাড়াটা দিয়ে বাজারগুলা নামাতেই সুপ্তি এসে বললো,

-দিন আমাকে দিন।
-আরে না,আপনি রিক্সায় উঠুন।

-আপনি এগুলা একা নিয়ে যেতে পারবেন না,আমি বরং একটু এগিয়ে দেই।এই রিক্সা তুমি যাও।

কথাটি বলেই মেয়েটা কিছু বাজার নিজেই নিয়ে উপরের দিকে হাটা দিল।আমি আর কিছু বললাম না।বাজার নিয়ে ওনার পেছন পেছন রুমের দিকে গেলাম।

এতগুলা বাজার,মাছ,মাংস আপনি একা রান্না করতে পারবেন?

সুপ্তির কথায় আমি ওনার দিকে অসহায় দৃষ্টিতেই তাকালাম।আসলে যেদিন বুয়া আসে না সেদিন শুধু ডিমভাজি আর ভাত রান্না করি।এটুকুই।কিন্তু এসব কিভাবে রান্না করবো।

সুপ্তি মনে হয় আমার মুখের কথা বুঝে গেলো।রুমে ঢুকে সোজা রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,

-আপনি বরং ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেন,এদিকটা আমি দেখছি।

সুপ্তির কথায় আমি ফ্রেশ হয়ে বের হলাম।মেয়েটা মাথায় যে এটা ছিল আগে জানতামনা।ও হয়তো তখন রফিক সাহেবকে বলা কথাটা শুনে ফেলেছিল।রফিক সাহেবকে বলেছিলাম,

বাজার করে বাসায় গিয়ে রান্না করতে হবে।মেয়েটা ঠিক শুনে ফেলেছিল।ও জানতো আমি রান্না করতে পারিনা।আর বাজারে গেলে তো পচা গুলাই আমার ভাগ্যে জোটে।তাই মেয়েটা শুরু থেকে প্লান করে রেখেছিল এসব।

রাতের খাবারটা সুপ্তির সাথেই খেলাম।মেয়েটা বেশ ভাল রান্না করতে পারে।যদি প্রতিদিনই এরকম রান্না খেতে পারতাম।

সুপ্তি না চাইলেও ওর সাথে বের হলাম ওকে বাসায় পৌছে দেওয়ার জন্যে।এই দু বিল্ডিং পরেই ওদের বাসা।সুপ্তিদের গেইটের সামনে আসতেই আমি বললাম,

-এভাবে প্রতিদিন রান্না করে খাওয়ালে মন্দ হতো না।
-তো কাউকে বিয়ে করে নিলেই তো হয়।সে আপনাকে প্রতিদিন রান্না করে খাওয়াবে।
-সে কি আপনার মত রান্না করতে পারবে।
-অবশ্যই পারবে।আচ্ছা আসি তাহলে।
-আপনি কি আমার রাঁধুনি হবেন?

আমার কথায় সুপ্তি কিছু বললো না।মুচকি হেসে ভেতরে চলে গেলো।আমিও ঘুরলাম বাসার উদ্দেশ্যে।
মেসেজ টোনটা বাজতেই আমি ফোনটা বের করে মেসেজটা চেক করলাম।সুপ্তির মেসেজ।ছোট্ট করে লেখা,
আমি তোমার পার্মানেন্ট রাঁধুনি হবো।জায়গা হবে কি আমার তোমার ওই বুকের বা পাশটায়।
মেসেজটা দেখে আমি ছোট্ট করে রিপ্লে দিলাম,

-বা পাশটায় অনেক আগেই জায়গা দখল করে আছো।এখন শুধু পার্মানেন্ট করা বাকি।

মেসেজটা দিয়েই ফোনটা পকেটে রেখে দিলাম।আজ বেশ ভালই লাগছে।সোডিয়ামের আলোতে কেমন যেন নিজেকে অন্যরকন লাগছে।কেমন যেন ভাল লাগা কাজ করছে।সোডিয়ামের আলোতে ডুবে যাচ্ছি আর ভাবছি,
পাইলাম,আমি পাইলাম,অবশেষে আমি উহাকেই পাইলাম।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত