– ‘এখনও আমাকে ভালোবাসবেন না?’
– ‘ঠাসসসসসসস’
ফারাহ নয়ন ভরা জলে তাওহীদের দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম স্বামীর হাতের একটু স্পর্শ পেয়েছে। স্বামীর ভালোবাসা না পাক রাগ অভিমানের ছোঁয়া তো পেয়েছে। সেটা আবার এই থাপ্পড়ের জন্য! তা না হলে তো এই ছোঁয়া টুকু তার পাওয়া হতো না। ফারাাহর বুকটা কান্নায় ফেঁটে যাচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অবাক দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
রাতের আকাশ অন্ধকার চারপাশ। কোথাও আলো নেই। আকাশে তাঁরারা নিভু নিভু করে জ্বলছে। রাতের আঁধারে জোনাকিরা লোকচুরি খেলছে। তাওহীদ বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষ করে বাসর ঘরে ডুকে।
– ‘আসসালামু আলাইকুম’
– ‘রাখেন আপনার সালাম।কি করেন আগে বলেন।’
নব বউয়ের মুখে এমন বাণী শুনে তাওহীদ বাক শূন্য হয়ে যায়। কি বলবে ভাষা হারিয়ে ফেলে। চুপ করে দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
– ‘এই যে কোথায় হারিয়ে গেলেন? এভাবে কি দেখেন? বলবেন না কি করেন?’
– ‘মানে? আমি আপনার কথাটা বুঝলাম না।’
– ‘না বোঝার কি আছে? ফুটবল বুঝেন না ফুটবল? সারা দেশ ফুটবল নিয়ে মেতে আছে আর আপনি ফুটবল বুঝেন না?’
– ‘আপনি কি আমাকে ঠিক করে বলছিছেন?’
– ‘বাব্বাহ কথা জানে!’ তা আপনি কোনদল সাপোর্ট করেন? যদিও আমার মন একটা বলছে তবুও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি।’
– ‘আমি ব্রাজিল দল সাপোর্ট করি।’
– ‘কিহ!'(চোখে মুখে একরাশ হতাশার ছাপ)
– ‘হ্যাঁ, আমি ছোট থেকেই ব্রাজিল দল সাপোর্ট করি।’
– ‘এ হতে পারেনা। এমন অন্যায় আমার সাথে হতে পারেনা। তহলে এসব কি?’
ফারাহ মোবাইলটা হাতে নিয়ে তাওহীদের ছবি দেখায়। তাওহীদ ফুটবল হাতে নিয়ে আর্জেন্টিনা পোশাক পরে আছে। এই ছবি দেখে তাওহীদও বোকা হয়ে যায়। ফারাহ কান্না করছে আর বলছে।
– ‘আমার প্রথম ভালোবাসা বাবা-মা, দ্বিতীয় ভালোবাসা আর্জেন্টিনা, আর তৃতীয় ভালোবাসা যে আমার স্বামী হবে তার জন্য তুলা।মনে কত আশা ছিল আমার জামায় আর্জেন্টিনা হবে। দু’জনে মিলে খেলা দেখব আর গোল গোল বলে গলা ফাটাব। কিন্তু সব মিথ্যা হলো। ঐ ঘটকের বাচ্ছার জন্য আমার সব আশা ইচ্ছা শেষ হয়ে গেল।’
মনে মনে তাওহীদ বলছে।
– ‘এ কেমন মেয়ে আমার কপালে জুটল স্বামীকে বানায় তৃতীয় ভালোবাসা? স্বামীর ভালোবাসা থেকে দলের ভালোবাসা বড়! আল্লাহ জানে আর কি দেখতে হবে আর কি শুনতে হবে।’
হঠাৎ কান্না থামিয়ে একটা হাসি উপহার দিয়ে ফারাহ বলে
– ‘আচ্ছা আপনি আমার জন্য আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করতে পারবেন না?’
– ‘একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি! আপনি আমার জন্য ব্রাজিল সাপোর্ট করতে পারবেন না?’
– ‘ব্রাজিলে কে আছে কি আছে আমাকে ব্রাজিল সাপোর্ট করতে হবে?’
– ‘আর্জেন্টিনায় কে আছে কি আছে আমাকে আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করতে হবে?’
– ‘কি এতো বড় কথা? আর্জেন্টিনায় কেউ নেই? কিছু নেই? আর্জেন্টিনায় মেসি নেই? ম্যারাডোনা নেই? আপনি খেলায় বুঝেন না।’
– ‘পেলে, কার্লোস, রোনাল্ডো, রোনালদিনহো, কাকা, আর বর্তমানে নেইমার এরা কি? আরো তো কত নাম বললাম না। আর মেসি তো মশা।কি খেলবে? সে তো মশাদের গুরু হয়েই পারে না। সে খেলবে ফুটবল! তাকে বলে প্লেয়ার?’
– ‘মুখ সামলে কথা বলেন। কয়টা ব্যালেন ডিয়ার জিতসে জানেন? কয়বার গোল্ডেন বোট পেয়েছে বলতে পারবেন? আসছে আমার খেলা শিখাইতে কে ভালো প্লেয়ার বোঝাইতে।
– ‘বিশ্বকাপের কথা বললেন না? ও এই কথা কি করে বলবেন? সে তো ক্লাবের প্লেয়ার, সে তো জাতীয় দলের প্লেয়ার না।’
– ‘এখন আসছে দল ক্লাব শিখাইতে। আপনাদের নেইমার কি ঘোড়ার ডিমটা ছিড়ছে? এখন মেসিকে নিয়ে বলতেছেন? আর সেভেনআপ খেয়েও এভাবে বলতে লজ্জা করেনা? আবার আসছেন এই টিমকে নিয়ে কথা বলতে?’
– ‘হ্যাঁ, খাইছি তো কি হইছে? খেলায় হার জিত থাকেই। আমরা তো হাত দিয়ে গোল দেইনা মাঠে রেসলিং খেলি না। আমরা ফুটবলের শিল্প খেলি।’
– ‘অনেক বলছেন অনেক কথা শুনছি আর শুনতে চাচ্ছি না। সেভেন আপ টমের সাথে কথা বলে ইমেজ নষ্ট করতে চাইনা। একটা কথা বলি শুনে রাখেন।’
– ‘জি বলেন।মন ভরে বলেন আমি শুনছি।’
– ‘যদি আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করতে পারেন। মেসিকে ভালোবাসতে পারেন। ব্রাজিলকে সেভেনআপ খাওয়া টিম বলতে পারেন। তবেই আমার ভালোবাসা পাবেন।যদি না পারেন।তাহলে ভুলেও স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবেন না।আমাকে স্পর্শ করার সাহস দেখাবেন না।’
তাওহীদ চুপ করে কথাগুলো শুনে যায়। তার বুকের ভিতরটায় কেমন যেন একটা কষ্ট অনুভব করে।এক দৃষ্টিতে ফারাহর দিকে তাকিয়ে থাকে।
– ‘কি হলো অন্যরুমে যান।’
তারপর ফারাহ মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পরে। ফারাহ মনে মনে অনেক খুশি হয়। কিন্তু এই খুশি কথাগুলো যে একদিন কাল হবে তা সে জানে না।
রাতের আকাশ তাওহীদ তাঁরা গুণার চেষ্টা করছে। আজ তার বাবা মাকে খুব মনে পরছে। তার বাবা মা বলত তার জন্য লালটুকটুকে বউ আনবে। যে তাকে খুব ভালোবাসবে।কিন্তু তার পূর্বেই তাঁরা ঐ পাড়ে পাড়ি জমায়।আজ লালটুকটুকে বউ ঠিকই আসছে। কিন্তু তার ভালোবাসা তাওহীদের কোনদিন পাওয়া হবে না। হঠাৎ অনুভব করে চোখের কোণে পানি জমেছে। পানি মুছে আঁধার রাতের জোনাকির খেলায় মন দেয়। মনের অজান্তেই মাউথওরগানটা হাতে ওঠে আসে।
ফারাহ চুপ করে ভাবছে। সে কাজটা ঠিক করেছে নাকি ভুল করেছে? এসব কথা আজকে না বললেও তো পারতো! সে ফুটবল ভালোবাসে তাই বলে বাসর ঘরে ফুটবল দল নিয়ে ঝগড়া করতে হবে? তারপর কতকিছু বলল! আবার শেষে কি করল এক কঠিন শর্ত দিয়ে বসল? এই ছেলের সম্পর্কে যা শুনেছে তা যদি সত্য হয় তাহলে তো খবরেই আছে। আমি এখন তার কাছে ক্ষমা চাইব? না আমি ক্ষমা চাইতে পারব না। যা হবার তাই হবে তবুও হার মানব না।
হঠাৎ মাউথওরগানের সুরের শব্দ তার কানে ভেসে আসতে থাকে। মাউথওরগানের টোনটা শুনার সাথে সাথে তার হৃদয়টা ছেদ করে ওঠে। তাওহীদ আপন মনে মাউথওরগান বাজিয়ে যাচ্ছে। তার মনের সকল দুঃখ কষ্টকে ভুলার চেষ্টা করছে। ফারাহ চুপ করে শুনে যাচ্ছে।
একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ফারাহর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ডিম লাইটের আলোতে দেখে তাওহীদ নিচে বিছানা করে ঘুমিয়ে আছে। কষ্টের একটা শীতল হাওয়া তার বুকে বয়ে যায়।
দূরের মসজিদ থেকে আযানের মধুর ধ্বনি ভেসে আসে। তাওহীদ নামাজ পড়তে ঘুম থেকে জেগে ওঠে।তাওহীদ পাশে ফিরে দেখে, ফারাহ ঘুমে কাতর হয়ে আছে। ফারাহর মায়া ভরা মুখটা দেখে, তাওহীদের মনে সুখের ঢেউ খেলে।
– ‘এই যে, এই যে শুনছেন? ঘুম থেকে ওঠে নামাজ পড়েন।’
– ‘হু কি হয়েছে?’
– ‘বলতেছি ফজরের আযান দিয়েছে, ঘুম থেকে ওঠে নামাজ পড়েন।’
নামাজ পড়ে তাওহীদ চা করতে চলে যায়। আবার ফারাহ ঘুমিয়ে যায়।
সূর্য উঠছে।তাওহীদ চা খাচ্ছে আর সূর্য ওঠা দেখছে। সূর্যের রশ্মি ফারাহর চোখে মুখে এসে পরে। ফারাহ পাশে ফিরে দেখে, টেবিলের উপরে চায়ের কাপের সাথে এক টুকরো কাগজে কেউ কিছু লিখে রেখেছে।হাতে নিয়ে লিখাটা পড়ে।
“যদি মন চায় চা’টা খেয়ে নিবেন।যদিও ভালো বানাতে পারিনা। তবুও আমার চা আমার কাছে অমৃত লাগে।”
মুচকি হেসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে এক চুমুক দেয়। ফারাহ চায়ের সাগরে হারিয়ে যায়। মনে মনে ফারাহ বলে, ‘ছেলে মানুষ হয়েও এতো ভালো চা কিভাবে বানাতে পারে?’ ফারাহ চা খাচ্ছে আর রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছে।
সময় বয়ে যেতে থাকে, দুই পৃথিবীর মানুষগুলি একদিন একদিন করে এক পৃথিবীর ছাদে দিন কাটাতে শুরু করে। কখনও দেখা হয়, কখনও কথা হয়, কখনও চোখে বলা হয়।আবার কখনও কথা না বলেই দিন পার হয়।মাউথওরগান বাজিয়ে কখনও তাওহীদ নিজে কাঁদে। আবার কখনও ফারাহকে কাঁদিয়ে ছাড়ে। ফারাহ মাউথওরগান বাজানো এবং কান্না করার রহস্য বুঝতে পারেনা। ধীরে ধীরে দিন যেতে থাকে এই রহস্য বের করতে ইচ্ছা করে। এবং তাওহীদ ভালোবাসতে মনটা কাঁদে।
ফারাহ চা খাচ্ছে আর ভাবছে। আজ কতগুলো দিন হয়ে গেল মানুষটার সাথে তেমন দেখা হয় না। তেমন কথা হয় না। ঝগড়া হয় না।মানুষটার সাথে দেখা করতে হবে। কথা বলতে হবে।ঝগড়া করতে হবে। মানুষটার মনের ভিতর ডুকতে হবে। সকল দুঃখ কষ্ট দেখতে হবে। মানুষটার সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে। আমি জানি না, আমি কিছু জানি না।
তাওহীদ আপন মনে সূর্য ওঠা দেখছে। এক চুমুক এক চুমুক করে চা খেয়ে যাচ্ছে। ফারাহ তাওহীদের পাশে এসে দাঁড়ায়।
– ‘সূর্য ওঠা দেখছেন?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘প্রতিদিন আমাকে সাথে নিয়ে দেখতে পারেন না?’
ফারাহকে এক নজর দেখে তারপর তাওহীদ বলে
– ‘ঠিক আছে।’
– ‘কি ঠিক আছে।? আপনি এতো ভাব নেন কেন হ্যা! সব সময় এতো মুড নিয়ে থাকেন কেন? ব্রাজিল দল করেন বলে কি সব কিছু কিনে নিয়েছেন? এখনও সময় আছে ব্রাজিল দল ছাড়েন।’
– ‘মানে! কি বোঝাতে চাচ্ছেন? আচ্ছা আপনার সমস্যাটা কি? আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবেই চলছি। তবুও আপনার শান্তি মিলে না? কি করলে শান্তি মিলবে?’
স্বামীর এমন বাণী শুনে ফারাহ খিল খিল করে হেসে ওঠে। ফারাহর হাসি দেখে তাওহীদের আরো রাগ উঠছে।তাওহীদ বুঝতে পারছে না, সে হাসির কি বলল?
– ‘বাব্বাহ! আমার স্বামী তো ভালো ঝগড়া করতে জানে। কি করলে শান্তি মিলবে? আবার আমাকে বিয়ে করেন। আমাকে ভালোবাসেন।আমার দলকে সাপোর্ট করেন। এবং আমার দলকে ভালোবাসেন।’
– তাওহীদ চুপ করে ফারাহর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটাকে যতো দেখছে ততো অবাক হচ্ছে। সে রাগে রাগে কথা বলল আর ও হেসে খেলে কথা বলে যাচ্ছে।
– ‘এই যে শুনেন মার্কেট থেকে আর্জেন্টিনা পতাকা, আর্জেন্টিনা শাড়ি, আর্জেন্টিনা চুড়ি, আর্জেন্টিনা পায়েল, নেল পালিশ, ঠোঁট পালিশ এবং ইত্যাদি ইত্যাদি যা পান নিয়ে আসবেন।’
– তাওহীদ চুপ করে শুনে যাচ্ছে। সে ভাবছে মেয়েটা কত অধিকার নিয়ে আদেশ দিল। অথচ তাদের মাঝে অধিকারের কোনো খুঁটি নেই।
রাত্রি আকাশ। আকাশে তাঁরারা নিভু নিভু করছে। রাতের আঁধারে জোনাকিরা লোকচুরি খেলছে। তাওহীদ নিজের দুঃখ কষ্ট ভুলতে মাউথওরগান বাজাচ্ছে। ফারাহ মোমবাতি জ্বালিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজতে শুরু করে। তারপর আস্তে আস্তে তাওহীদের কাছে যেতে থাকে। তাওহীদ কারো উপস্তিতি পেয়ে বাজানো বন্ধ করে দেয়। ফারাহর মনটা বিষন্নতায় ঢেকে যায়।
– ‘কি ব্যাপার বাজানো বন্ধ করে দিলেন কেন?’
– ‘ভালো লাগছে না তাই।’
– ‘আচ্ছা বলেন তো আমাকে কেমন লাগছে?’
– ‘ভালো, খুব ভালো।’
– স্বামীর এমন কথা শুনে ফারাহর মনটা খারাপ হয়ে যায়।
– তাওহীদ ভাবল্যাশহীন চোখে ছুটে চলা গাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ফারাহ বিষন্ন মনে তাওহীদকে দেখছে। তার চোখে পানি ছল ছল করছে। সে তাওহীদের কাছ থেকে অন্যকিছু শুনতে চেয়েছিল। এবং অন্যকিছু আশা করেছিল।
– ‘এই যে শুনছেন?'(তাওহীদকে ছুঁয়ে)
– ‘আপনি আমাকে কেন স্পর্শ করলেন? আপনি আমাকে পেয়েছেনটা কি? যখন যা মনে চায় তাই বলবেন? যখন যা মনে চায় তাই করবেন? আমাকে আপনার কি মনে হয়?’
– ফারাহ অপরাধীর মতো চুপ করে আছে।
– ‘আপনি আপনার মতো থাকেন। আমাকে আমার মতো থাকতে দেন। আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেন। ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবেন।’
– তাওহীদের মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে চোখে অশ্রু বইতে শুরু করে। তার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে ওঠে। এখন তাওহীদকে কি বলবে? ফারাহ ভাষা পাচ্ছে না। চুপ করে তাওহীদকে দেখছে।
সকালের সূর্য। ফারাহ বিষন্ন মনে সকালের সূর্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার চোখের নিচে কালি জমেছে, মুখটা শুকনো হয়ে আছে। কি ভেবেছিল কি হলো? কার ভালোবাসার কথা ছিল এখন কে কার ভালোবাসায় পরেছে! আজ কতগুলো দিন পার হয়ে গেল। তাওহীদ তার সাথে ঠিকমতো দেখা করেনা। তার সাথে ঠিকমতো কথা বলেনা। কিন্তু প্রতিদিন চা দেওয়া ও চিরকুটের কথা ভুলে না। ফারাহ চিরকুটটা পড়ে চা খাবে আর কাঁদে। ফারাহ কিছু বললে চুপ করে থাকে উত্তর দেয় না। শুধু এক নজর তাকাবে। তাওহীদের এই তাকানো ফারাহ সহ্য করতে পারেনা। তার বুকের ভিতরটা সাথে সাথে কেঁদে ওঠে।সে দৌড়ে নিজের রুমে যাবে তারপর একা একা কাঁদবে।নিজেকে বিভিন্ন ভাবে গালি দিবে। কারণ তার জন্যই আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে। তাওহীদও কষ্ট পায় কিন্তু এই কষ্ট তার কাছে কিছু নয়। বাসর রাতেই সব কষ্ট পেয়েছিল।
ফারাহ জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চিন্তা করছে। এই রাগ অভিমানের অবসান কিভাবে হবে? কিভাবে একটু ভালোবাসার সূচনা হবে? সে ভাবছে আর ভাবছে।
ফারাহ নতুন করে সাজছে।তাওহীদের দলের হয়ে সাজছে। তাওহীদ মাউথওরগান বাজাচ্ছে। ফারাহ খুশি মনে তাওহীদের পাশে এসে দাঁড়ায়। সে খুশি মনে তাওহীদকে বলে
– ‘আমাকে কেমন লাগছে?’
ফারাহকে দেখার পর তাওহীদের মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে কি বলেছে ব্রাজিল দলের জার্সি পড়তে? সে কি বলেছে ব্রাজিলের রঙে নিজেকে রাঙ্গাতে? এই সব করলেই কি ভালোবাসা পাবে?
– ‘এখনও আমাকে ভালোবাসবেন না?’
– ‘ঠাসসসসসসস।’
এই জন্যই তাকে থাপ্পড় দেয়।
তাওহীদ ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নিজেকে অপরাধী মনে করছে।ফারাহকে থাপ্পড় না দিলেও তো পারতো? কেন তাকে মারতে গেল? তার কি কোনো অধিকার আছে? ফারাহ তাওহীদের পাশে এসে কাঁদতে থাকে। কিন্তু ফারাহর এই কান্না শুনে আবার মেজাজ গরম হতে থাকে।
– ‘এই যে, এই যে আমাকে আর একটা থাপ্পড় দেন না! তাহলে আর একবার আপনার হাতের ছোঁয়া পেতাম।কোনদিন তো আপনার ছোঁয়া পেলাম না। আজ থাপ্পড় না পেলেও তো আর পাওয়া হতো না।’
– ফারাহর কথা শুনে তাওহীদের বুকের ভিতরটা কেমন করে যেন ওঠে।বুকের ভিতরটায় একটা মাড় পরে।এখন তার খুব ইচ্ছা করছে তাকে একটু ছুঁয়ে আদর করতে।কিন্তু অভিমানটা না করছে।
– ‘কি হলো আমাকে মারবেন না? দেন না আর একটা চড়!’
– তাওহীদ চুপ করে আছে।
– ‘বাসর ঘরের ঐ কথা গুলোর জন্য আমাকে এভাবে কষ্ট দিলেন? এবং নিজে এভাবে কষ্ট পেলেন? এতে কি লাভ হলো? একবার আমার ভুলটা ধরিয়ে দিতেন? আমি চলে যাচ্ছি ভালো থাকবেন।’
– ‘এই মেয়ে, একবার পা বাড়ালে পা ভেঙে এই ঘরে সারাজীবন আটকিয়ে রাখব।’
– ‘কে হয় আমি আপনার?
– ‘চুপ একদম চুপ কোন কথা নয়।’
ফারাহর হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে আসে। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাওহীদের হাতের স্পর্শ পেয়ে ফারাহ কাঁদছে। তাওহীদ চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ আঁকে।
– কেন আপনি আমাকে তখন এই শর্ত গুলো দিয়েছিলেন? আমার কষ্ট হয়নি? আপনাকে পেয়েও আবার হারালাম আমার কষ্ট হয়নি। আপনি আপনার দল সাপোর্ট করেন। আমি আমার দল সাপোর্ট করি। তাতে ভালোবাসাকে কেন টানব? কেন নিজেদের সম্পর্ক নষ্ট করব? ভালোবাসা ফুটবল হৃদয়ে থাকবে। আমাদের ভালোবাসা অন্তরে থাকবে।
– ‘ভালোবাসে ফারাহ আপনাকে এই তাওহীদ খুব ভালোবাসে।’
ফারাহ কিছু বলতে পারছে না।তাওহীদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
– ‘আমাকে ভালোবার কথা বলবেন না? কত ভাবেই না ভালোবাসা প্রকাশ করতে চেয়েছেন?’
ফারাহ অভিমানী চোখে তাকায়।তারপর কানে কানে বলে
– ‘ভালোবাসে ফারাহ ভালোবাসে আপনাকে ফারাহ তার জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসে।’
ফারাহ তাওহীদের বুকে মাথা রেখে আছে।সুখের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই প্রথম স্বামীর বুকে মাথা রাখার সুযোগ হয়েছে। এই সুযোগ সে আর হারাতে চায় না। তাওহীদ এক হাতে ফারাহকে জড়িয়ে ধরে রাখছে। এক হাতে মাথায় চুলের বিলি কাটছে। দু’জন টিভির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ফুটবল খেলা দেখছে। মাঝে মাঝে গোল গোল বলে চিৎকার করছে। আবার ভালোবাসার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।