পারিবারিক ভাবে সুমনের সাথে আমার বিয়েটা হয়েছে।বিয়ের একদিন আগ পর্যন্তও আমরা একে অপরকে চিনতাম না।দুজন ছিলাম দুটি মেরুদণ্ডের প্রাণী।কিন্তু আজ থেকে দুজনকে একই পথে চলতে হবে।
বিয়ে সংসার এসব নিয়ে একটা মেয়ের নানা রকম স্বপ্ন থাকে।একটা মেয়ে সংসার জীবনটা নিয়ে খুব বেশি স্বপ্ন দেখে।আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি।বিয়ের আগমূহুর্ত থেকে আমি প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখা আরম্ভ করেছিলাম।
ও হ্যাঁ, আপনাদেরতো বলাই হয় নি।আজ আমার বিয়ের রাত।আসলে ফুলশয্যার ঘরে বসে এসব ভাবছি আমি।একটু পর হয়তো সুমন এই ঘরে ঢুকবে।আমার ঘোমটা তুলে মুখ দেখতে চাইবে।আচ্ছা তখন কি খুব বেশি লজ্জা লাগবে? সুমন আমার মুখ দেখে কি বলবে? খুব ভালো,নাকি খারাপ? আসলে আমি ভীষণ কনফিউজড। সুমন আসার পর কি হবে, সেটা ভেবে।
কিছুক্ষণ পর দরজা বন্ধ করার শব্দ পেয়ে আমার ভাবনার সমাপ্তি ঘটলো।সুমন ঘরে প্রবেশ করলো।আমি গুটিসুটি হয়ে খাটের এক কোণে বসে আছি।এই বুঝি সুমন আমার পাশে এসে বসবে!
কিন্তু সুমন গা থেকে বিয়ের পোশাকটা খুলে বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে সোজা সোপায় চলে গেলো।
কি ব্যাপার..? কিছুই বুঝতে পারলাম না।আমি নিচের দিকেই তাকিয়ে বসে আছি।
কেবল বসে আছি সেটা বললে ভুল হবে।আসলে আমি ফুলশয্যার খাটে বসে অনবরত অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি। এমনটাতো আমি আশা করিনি।তাহলে কেন আমার সাথে এমনটা হলো? আচ্ছা,সুমন কি অন্য কাউকে ভালোবাসে? হয়তো ভালোবাসে।তাই ও আমার সাথে কোনো কথা না বলেই আমায় এড়িয়ে চলে গেলো।
আমার সারারাত বসে বসে কেটে গেলো।
সকালে আমি ফ্রেস হয়ে রুমে ঢুকে চুপ করে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে আছি।কি করবো বুঝতে পারছি না।শাড়ি পরা নিয়ে ভীষণ ঝামেলা হয়েছে।একপ্রকার কোনোরকম প্যাঁচিয়ে শাড়িটা পরেছি।হঠাৎ উনার ফোনটা বেজে উঠলো।
আমি দৌড়ে এসে উনার ফোনটা হাতে নিয়ে উনাকে ডাকছি।
-এই যে শুনুন,
—
-উনি ভীষণ ঘুমাচ্ছে। আর ডাকবো কিনা বুঝতে পারছিনা।আবার না ডাকলে যদি পরে রেগে যান! হয়তো কোনো দরকারি ফোনও হতে পারে।তাই আবার উনাকে ডাকতে শুরু করলাম।উনি আমার ডাকে বিরক্ত হয়ে জোরে একটা থাপ্পড় মারলো আমার গালে।আর বললো,
-তুমি আমার ফোনে হাত দিয়েছো কেন? এতবড় সাহস তোমায় কে দিলো? আর কখনো আমাকে না বলে আমার কোনো জিনিসে হাত দেওয়ার সাহস দেখাবে না।যাও আমার সামনে থেকে।অসহ্য!
-আমি অশ্রুভরা দৃষ্টি নিয়ে অবাকচোখে উনাকে দেখছি।আর বুঝতে চেষ্টা করছি আসলে আমার ভুলটা কোথায় হয়েছে? কেন উনি আমাকে চড় মারলেন? ফোন ধরাতে খুব বেশী অপরাধ হয়ে গেলো আমার?
-যেতে বললাম তো তোমায়।যাচ্ছোনা কেন? যাও এখান থেকে।দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।অদ্ভুত মেয়েকে পছন্দ করলো আমার বাবা মা।এটা মেয়ে নাকি একটা হুতুম পেঁচা।জাস্ট সহ্য হয় না।এই মেয়ের সাথে কিভাবে আমি বাকি জীবনটা কাটাবো?
-আমি কোথায় যাবো এই রুম থেকে বের হয়ে? এটা উনি বুঝে না? আমি তো এ বাড়ির নতুন বউ।বাড়ির তেমন কিছু চিনিনা বললেই চলে।এখন হুট করে বেরিয়ে কার রুমে যাবো? চুপ করে খাটে বসে মনে মনে এসব ভাবছি।আচ্ছা আমি কি সত্যি অদ্ভুত? পেঁচার মতো? উনার কথাগুলো বুকের বাম পাশে খুব জোরে আঘাত করেছিলো।
-বৌমণি, দরজাটা খুলো।
-জ্বী আসছি।
-দরজা খুলতে যাবো।ঠিক তখন বারান্দা থেকে উনার কথা বলার আওয়াজ পেলাম।আমার আড়ি পাতার মতো বাজে অভ্যাসটা নেই।দরজা খুলতে যাওয়ার পথে যতটুকু শুনেছি ততটুকু ছিলো এরকম কথা,
“উফ্ আমায় জ্বালিয়ে শেষ করবে।একে জীবনসঙ্গী হিসেবে ভাবাটাও উচিৎ হবেনা।”
ব্যাস এতটুকু শুনেছি।
-বৌমণি শুনো,
-জ্বী বলো।
-বৌমণি, এটা কি পরেছো? শাড়িটা পরা হয় নি।তাছাড়া তোমার মুখটা এত্ত শুকনো কেন? ভাইয়া কিছু বলেছে?
-না না।তেমন কিছুই না।আসলে আমি শাড়ি পরতে পারি না।
-ওকে।ওয়েট। আমি পরিয়ে দিচ্ছি।
-তারপর লিজা (ননদ)আমায় শাড়িটা পরিয়ে দিয়েছে।
-বৌমণি ভাইয়া আসলে ওকে বলো তোমায় নিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য।সবাই ওয়েট করছে।
-হু।
লিজা চলে গেলো।
কিন্তু উনার ফোনে কথা বলা এখনো শেষ হয়নি।
প্রায় একটানা দুঘণ্টা কার সাথে এতো কথা বলছে? কোনো মেয়ে? হবে হয়তো।
কিছুক্ষণ পর উনি বারান্দা থেকে এসে খাটের কোণে ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।আসলে খাটের ঐ জায়গাতে আমি বসেছিলাম।মানে উনি ওভাবে
আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আর আমি নিচের দিকে।
-লিজা আসছিলো।
-কেন?(উনি)
-আমাদের জন্য সবাই নিচে ওয়েট করছে।এক সাথে নাস্তা করবে, তাই।
-তোমার সাথে নাস্তা? তাও আমি করবো? পাগল হয়ে গিয়েছি নাকি আমি?একদম আমার সাথে নাস্তা বা অন্য কিছু শেয়ার করারও সাহস দেখাবা না।যত্তসব!
-আসলে আমি খুব চাপা স্বভাবের একটা মেয়ে।সহজে নিজের মনের কথাগুলো কারো কাছে প্রকাশ করতে পারিনা।হয়তো আমার বলার মাঝে ভুল ছিলো।তাই উনি এমন রিয়েক্ট করেছেন।
উনি রেডি হয়ে কোথায় যেনো চলে গেলেন।আমি আর বেশি কিছু বলার সাহস পাইনি।উনি তো নাস্তাও করে নি।
কিছুক্ষণ পর লিজা আবার আসছে।
-কি হলো বৌমণি? তুমি নাস্তা করতে আসোনি কেন?
-আচ্ছা লিজা, তোমার ভাইয়া নাস্তা করেছে?
-হ্যাঁ, ও তো নাস্তা করেই বেরিয়েছে।
-যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেলো।(মনে মনে বললাম।)
-কি বৌমণি? চলো নাস্তা করবে।
-আমি লিজার সাথে নিচে গিয়ে নাস্তা করতে বসলাম।ওদের সবার খাওয়া শেষ।বাকি ছিলাম আমি আর লিজা।দুজনে একসাথে খাওয়া শেষ করলাম।
দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো।উনার একটা ফোনও পেলাম না।দুপুরে খেয়েছে কিনা তাও জানিনা।
প্রায় রাত ২টায় উনি ঘরে আসে।জিজ্ঞেস করবো কোথায় গিয়েছে? এতো লেট হলো কেন?
যদি আবার রেগে যান?
সেই ভয়ে কিছু বলা হয় নি।
-আপনার জন্য খাবার রেডি করছি।ফ্রেস হয়ে আসুন।
-ঐ শোন্, তোকে কয়বার বলবো? আমার পার্সোনালিটি নিয়ে বউগিরি দেখাবি না।তুই কি ভাবলি? আমি তোর মতো মেয়ের সাথে খাবার খাবো? তাও এই রাতের বেলা?যা সর্।আমি খেয়ে আসছি।
-উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন।আমি উনাকে যতই দেখছি ঠিক ততই অবাক হচ্ছি। আমার সাথে এত্ত বাজে ব্যবহার কেন করছে উনি? আমার কি দোষ?
অশ্রুভেজা চোখ নিয়ে ডাইনিং টেবিলের সকল খাবার গুঁছিয়ে ফ্রিজে রেখে দিয়েছি।কারণ খুব ইচ্ছে ছিলো একসাথে দুজনে খাবো।উনি যেহেতু খেয়ে আসছে সুতরাং আমারও খাওয়া হয়ে গেছে।এই খাবারগুলো আমার বুকে আটকে যাবে।খেতে পারবো না।
খাবারগুলো রেখে আমি রুমে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতে গেলাম।আর তখনি দেখলাম উনি ভেতর থেকে দরজাটা নক করে দিয়েছেন।অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালাম নীরব স্বরে।বাট উনি খুলেন নি।কি করবো আমি? এখন কার ঘরে যাবো? লিজার রুমে যাবো? যদি ও মা বাবাকে বলে দেয়? তাহলে তো উনারা খুব কষ্ট পাবে।আমাদের রুমটা একদম ঘরের একটি কর্ণারে।সেখানে সচারচার কেউ দরকার ছাড়া যাতায়াত করেনা।তাই আমি কারো রুমে না গিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম।কখন যে চোখটা লেগে আসলো বুঝতেই পারিনি।
চোখ খুলতেই দেখলাম আমি রুমের ভেতরে।বাট খাটে না।ফ্লোরে শুয়ে আছি।
আর উনি খাটে ঘুমাচ্ছেন।আমি তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লাম।আমি ভিতরে কিভাবে আসলাম? বুঝতে পারছিনা।উনি এনেছেন নাকি? বসে বসে ভাবছি ঠিক তখনি দরজায় কারো আওয়াজ পেলাম।
দরজা খুলতেই লিজাকে দেখলাম।ও দ্রুত রুমে প্রবেশ করে উনাকে ডাকাডাকি শুরু করলো।
-ভাইয়া একটা সুখবর আছে।উঠ্।
-কি খবর লিজা?(উনি)
-বাবা তোকে আর বৌমণিকে হানিমুনে যাওয়া পার্মিশন দিয়েছে এবং সবকিছু রেডি করে ফেলেছে।
তোরা আগামীকাল হানিমুনের উদ্দেশ্যে কক্সবাজার যাচ্ছিস।
হুররে বলে লিজা চলে গেলো।
উনি ঘুম থেকে একলাপে উঠে বলতে লাগলো,
-হানিমুন? এসব এই মেয়ের সাথে? অসম্ভব। আমার দ্বারা হবে না।আমি এক্ষুণি বাবাকে নিষেধ করছি।
-শুনুন প্লিজ,
আমার জন্য বাবা কষ্ট পাক সেটা আমি চাই না।আপনি বাবার প্ল্যানটা নষ্ট না করে আমাকে নিয়ে চলুন।প্রমিজ আপনাকে আমি জ্বালাবোনা।তাছাড়া কখনো আপনার পার্সোনালিটিতে নাক গলাবোনা।প্লিজ এই অনুরোধটা রাখুন।
পরেরদিন প্ল্যান অনুযায়ী আমরা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
যথাসময় গিয়ে পৌঁছালাম।
তারপর থেকে আমি আমার মতো রুমে বসে থাকতাম আর উনি নিজের মতো ঘুরতেন।
ভুল করেও আমাকে উনার সাথে বেরোনের প্রপোজ করতেন না।
খুব বেশি ঘৃণা করেন আমায়।আমি ঠিক তার উল্টো।উনার ঘৃণাগুলো ক্রমশ ভালোবেসে ফেলেছি।মানে উনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।তাছাড়া বাঙ্গালি মেয়েদের বিয়ের পরে স্বামী-ই তো সব।
আমরা তিনদিনের সফরে আসছি এখানে।আজকে প্রথম দিন শেষ হলো।রাতে উনি রিসোর্টে ফিরে আসলেন।আর আমার স্থান সোপায় সীমাবদ্ধ হলো।ফোনে মেবি রিতা নামের কারো সাথে কথা বলছে।ভীষণ রোমান্টিক ভাবে।আর আমি পাশে বসে না চাইতেও শুনতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ এতো রাতে বেরোনের সাহস আমার নেই।তাহলে হয়তো উনার ফোনের কথাগুলো শুনতে হতো না।উনি হয়তো আমাকে শুনিয়ে কথাগুলো বলছে।প্রায় আড়াইঘন্টা পর উনার কথা বলা শেষ হলো।
কিন্তু আমার নীরবে অশ্রু বিসর্জনের সমাপ্তি ঘটলো না।ভীষণ কাদছি।আসলে আওয়াজ করে কান্নার মাঝে তৃপ্তি আছে।নীরবে কান্নাগুলোও স্বার্থপর। তৃপ্তি টা বয়ে আনে না।
-রাত্রি,(সুমন)
-জ্বী।(আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।বুঝতে চেষ্টা করছি,হঠাৎ এতো রাতে আমায় ডাকছে কেন?)
-একটু আমার পাশে আসবে?(সুমন)
-আমি সোপা থেকে উঠে উনার সামনে পাশে গিয়ে বসলাম।জ্বী আসছি।বলুন কি বলবেন?
-তোমার হাতটা একটু দিবে?
-জ্বী। (অবাক হয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম উনার হাতের মুঠোয়।)
হাত দেওয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারলাম উনার গায়ে ভীষণ জ্বর।
তারপর সারারাত উনার সেবা করলাম।প্রায় ভোরে ঘুমিয়ে পড়লাম উনার পাশেই।
-এই মেয়ে,তুমি আমার পাশে কি করছো? তোমাকে এখানে ঘুমাতে কে বললো? তোমার তো সাহস কম নয়!
-স্যরি।
অনুতাপ প্রকাশ করে উনার পাশ থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। খোলা আকাশের নিচ দাঁড়াতে খুব ইচ্ছে করছে।বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।ধম বন্ধ হয়ে আসছে।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমার কি দোষ?
আমি কেন উনার মেজাজ খারাপের কারণ হচ্ছি বারবার?
উনি ঘুম থেকে উঠে চলে গেছেন বাহিরে।পুরো রুমটা খালি।ভীষণ খালি।আমার শূন্য হৃদয়টার মতো।
ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করলাম।লিখতে খুব ইচ্ছে করছিলো।
তাই ডায়েরির মাঝ পৃষ্ঠায় কিছু অস্পষ্ট বাক্য লিখলাম যেটা আমার কারো কাছে
প্রকাশ করার সাহস নেই।
প্রকাশ করার সাহস নেই।
ভালবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাই পরস্পর পরস্পরের প্রতি সশ্রদ্ধ মনোভাব।
তোমার কাছে আমার জন্য ভালোবাসাতো দূরের কথা শ্রদ্ধাটুকু-ই নেই।
খুব ইচ্ছে করতো,
আমার যে বর হবে,তাকে রোজ জ্বালাবো একটি বেলীফুলের মালার জন্য।
মালার সাথে ভালোবেসে আবদার করবো একটি নীল শাড়ির।
সে হালকা একটু বিরক্তিভাব নিয়ে বলবে, আমার পাগলী বউটা।
টিপ পরা নিয়ে তুমুল ঝগড়া হবে।আমি পরতে চাইবো না।সে জোর করে পরিয়ে দিবে।টিপ নিয়ে তার দুষ্টুমিতে আমি অসহ্য হবো।সে আদুরে গলায় ভালোবেসে ধমকের স্বরে বলবে,
পাগলী তোমার হাতের চুড়িগুলা নীল রঙ্গের হতেই হবে।আর কাজলটা আধো চোখে পরবে।হালকা একটু কান্না আসতেই হবে।নতুবা কাজল পরে কি আর তৃপ্তি পাওয়া যায়।
আমি ভালোবেসে সেই অশ্রুবিন্দু হাতে নিয়ে যত্ন করে বুকপকেটে জমিয়ে রাখবো,ভালোবাসার এক একটি প্রতিক হিসেবে।
আর প্রতিরাতে অন্ধকার রুম নিয়ে তোমার সাথে আমার মনোমালিন্য হবে।তুমি ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে আমার অভিমান দূর করবে।মোমবাতি জ্বালিয়ে আমার অভিমানী মুখটা দেখতে সেকি বায়না করবে! আর আমি লজ্জামিশ্রিত দৃষ্টি দুহাত আড়াল করে তোমার মোমবাতির সামনে এসে দাঁড়াবো।আর তুমি দুহাতে আমার চোখের উপর থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে বলবে, আসো তোমাকে গাঁদাফুলের মালাটা পরিয়ে দেই।
সেটা শুনে আমি রাগে চোখ বড় করে তাকাতেই তুমি হঠাৎ সেই বেলী ফুলের মালাটি আমার চুলের খোপায় পরিয়ে বলবে,
পাগলী তোমাকে পেত্নীর মতো লাগছে।তোমায় এলোমেলো চুলে বেলীফুলের মালাতেই ভালো লাগে।
এটা বলে তুমি খোপা থেকে কাঠি সরিয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিবে।মৃদু বাতাস জানালা ছাড়িয়ে আমার চুলে এসে ভাব জমাবে।আর তাতে তুমি ভীষণ ঈর্শান্বিত হবে।আর সেটা আমি লজ্জাচোখে ভীষণ উপভোগ করবো।বাতাসে মোমবাতিটি নিভে যাবে।
আর তুমি কাছে এসে বলবে,
রাত্রি,
আচমকা ভালোবাসা এসে হুট করে বলে বসলো, “চলো”, যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যাই, যাবে?
আমি ভালোবেসে বলবো,
যাবো।
আচ্ছা এইরকম দিন কি তুমি আমাকে দিতে পারোনা সুমন?
ডায়েরিটার লেখা শেষ করে পেছনে তাকাতেই দেখি উনি দাঁড়িয়ে আছে।আমি তাড়াহুড়ো করে ডায়েরিটা আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি।
উনি হয়তো বুঝতে পারে নি।
-রাত্রি,সকালের ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত।
-উনার কথা শুনে অবাক হলাম।আমাকে উনি স্যরি বলতে আসছে? ব্যাপারটা কি?
না,ঠিক আছে।কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
-নাহ্।
কিছু হয় নি।
উনি আর কিছু বললেন না।চুপ করে খাটে শুয়ে পড়লেন।
আমি একটু সাহস করে কপালে হাত দিয়ে দেখলাম উনার আবার জ্বর এসেছে।আপনি দুপুরের খাবারটা খেয়ে ফেলুন।আমি ঔষুধ খাইয়ে দিচ্ছি। অন্তত জ্বরটা চলে যাবে।
-তুমি ফ্রেস হয়ে আসো।একসাথে খাবো।
-আমার সাথে?
-হু।
-কি ব্যাপার! উনার কিছু হয়েছে কি?আমি মনে মনে ভীষণ ভাবছি।আজ হঠাৎ আমার সাথে খাওয়ার ইচ্ছা জাগার কারণটা কি?আমি ফ্রেস হতে চলে গেলাম।
প্রায় দেড়ঘন্টা পর ফ্রেস হয়ে এসে দেখি উনি রুমে নেই।আমি এসে পাগলের মতো পুরো রুমসহ রিসোর্ট উনাকে খুঁজলাম।কিন্তু উনি কোথাও নেই।হঠাৎ দেখলাম রিসোর্টের অনেকটা দূরে সমুদ্রের পাশে একটা জায়গায় খুব ভীড়।
আমি এগিয়ে গেলাম, কি হয়েছে সেটা দেখার জন্য।
গিয়ে দেখি একটা লোক সমুদ্রের সামনে বসে আছে।আর ক্রমাগত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার দুচোখ বেয়ে।
দেখলাম উনার সামনে ছোট্ট ছোট্ট কতগুলো চিরকুট পড়ে আছে।উনার সামনে থেকে ঐগুলা নিয়ে সবাই পড়ছে।উনি কাউকে কিছুই বলছেনা।হতাশা নিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে।আমি একজন মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, উনার এরকম বসে থাকার কারণ কি?
মেয়েটা বললো,
বিয়ের পর থেকে এই লোক উনার স্ত্রীকে বিন্দুপরিমাণ ভালোবাসতো না।কেবল আঘাত করতো তার মনে।বিভিন্নভাবে মেয়েটাকে মানসিক আঘাত করতো।উনাদের বিয়ের একবছরের মাথায় বাবা মা জোর করেই কক্সবাজার পাঠিয়েছে এই আশায়।যাতে ছেলেটা তার বউকে একটু বুঝতে পারে।ভালোবাসতে পারে।কিন্তু উনি বরাবরই আগের মতোই ছিলো।কোনো চেঞ্জ তার মধ্যে হয় নি।এসব সহ্য করতে না পেরে বউ সমুদ্রের ঢেউয়ে উনার সামনে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে।আর উনার স্ত্রীর ব্যাগের মধ্যেই একবছরের জমানো এই চিরকুটগুলো ছিলো।
আমি মেয়েটার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।কিছুটা আমার লাইফের সাথে মিল।ভীষণ খারাপ লাগছে লোকটার জন্য।
আমি আর সুমনকে খুঁজলাম না।সোজা রিসোর্ট চলে আসলাম।চারদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।এই বুঝি আরো একটি রাত্রি নেমে আসবে।আর এভাবে সময়গুলো হারিয়ে যাবে।চারদিক গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।
আমিও নিজের রুমে চলে গেলাম।
কিন্তু সুমন এখনো আসেনি।
কিছুক্ষণ দরজায় কে যেনো নক করলো?
নিশ্চয় সুমন?
আমি দরজা খুলে দেখলাম, হ্যাঁ সত্যিতো সুমন।দরজা বন্ধ করে ও ক্রমশ আমার সামনে আসছে।আমি ভীষণ আপসেট হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হলো আপনার? কিছু লাগবে?
-হু।একটা নীল শাড়ি,লাল টিপ,হাতে নীল কাচের চুড়ি, এলোচুলে বেলী ফুলের মালা পরিহিত একটি নীল পরী লাগবে।
দিবে আমাকে? সেই নীল পরীটাকে।
-আমি হা হয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে আছি।
-আরো আছে।
ঘর অন্ধকার,হাতে মোমবাতি আর জানালা খোলা থাকবে।মৃদু বাতাস আমার নীল পরীকে ওর আয়ত্বে নিতে চেষ্টা করবে এবং মোমবাতির আলোটা নিভিয়ে দিবে।সেই সুযোগে আমি ক্রমশ নীল পরীর মাঝে হারিয়ে ফেলবো নিজেকে।
তবে টিপ নিয়ে ঝগড়া কিন্তু হবেই হবে।
-আপনি এসব কি করে জানলেন?
-কেন? আমার বউয়ের ছোট্ট ডায়েরি থেকে।
-আপনি এতো দুষ্টু! চুপেচুপে আমার ডায়েরি দেখা হচ্ছিলো?
-পরমহিলা নয়তো।বউয়েরই ডায়েরি ছিলো।
-ইশ্ রে!
-রাত্রি, আমায় ক্ষমা করে দিও।
-আগে বেলীফুলের মালা,তারপর ক্ষমা।
-এহ্ রে! ভুলে গাঁদাফুলের মালা নিয়ে আসছি।
-কথা নেই আপনার সাথে,হু।
-আমার পাগলী বউটা দেখছি অভিমান করছে।এদিকে আসো তো।পেত্নীর মতো লাগছে।
-আমি উনার কাছে যেতেই চুল থেকে কাঠিটা খুলে এলোচুলে হাত বুলিয়ে বেলীফুলের মালাটা পরিয়ে দিয়েছে।
নীল শাড়িটা দিয়ে বললো পরার জন্য।আমি হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছি।
আর উনি কেমন যানি একটা হাসি দিয়ে কাছে এসেই বললো,কি শাড়ি পরতে পারোনা? তাতে কি হয়েছে? আমি আছি তো।
-যাক অবশেষে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার জন্য একটা লোক পেলাম।
-জানো রাত্রি,আজ সমুদ্রের পাশে বসে থাকা এক অসহায় লোককে দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগলো।কষ্টও হলো।আমি ঐ লোকটার মতো একই ভুল করতে চাইনা রাত্রি।
-ঠিক তখনি বুঝতে পারলাম রহস্য।সুমন আসলে ঐ লোকটাকে দেখেই ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।
ওসব বাদ দিন।আপনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন তাতেই আমার পরম পাওয়া।কিন্তু আমার রোজ একটা করে বেলীফুলের মালা চাই, চাই।
-পাগলী, সেটাই রোজ হবে।
“তোমার কাছে আমার যত ঋণ সে ঋণ কভু শোধ হবার নয়, যতই করি অর্থ ব্যয় আর যতই করি দিবস অপচয়!