আজ একমাস হল রং তুলিতে হাত দেয়নি অয়ন।রিক্তার চলে যাওয়াটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা আর সাথে নিজের অক্ষমতাটাকেও ,রিক্তা চলে যাবার সময়ই যেটা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।গতকাল রিক্তা শেষবারের মতো এসেছিল অয়নের কাছে।মনে অনেক আশা নিয়ে অয়ন গিয়েছিল সেই আর্টগ্যালারীর পাশের কদমগাছটার পাশে যেটা তাদের অনেক ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।মনের ভিতর একটা সুপ্ত আশা সে বহন করে চলেছিল যে রিক্তা হয়তো সব সমস্যা এবার মিটিয়ে আবার কাছে আসবে।ভালোবাসলে বোধহয় এরকম অবাস্তব চিন্তা সবসময় মাথায় ঘোরে!নিজের ভুলটা তখনই ভাঙলো অয়নের যখন রিক্তার বিয়ের কার্ডটা সে হাতে পেলো,এবং তার সাথে পেলো কিছু ব্যাঙ্গোক্তি।রিক্তা খুব ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দিল অয়নকে যে তার মতো ভবঘুরে,ছবি পাগল,রোজগারবিহীন ছেলেকে বিয়ে করাটা কতটা বোকামি।তাই নিজের বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে সে এক ডাক্তার পাত্রকেই বেছে নিয়েছে স্বামী হিসেবে।গতকাল বাড়ি ফেরার পর থেকেই উন্মাদের মতো লাগছিল অয়নের।এক ধাক্কায় সে ফেলে ভেঙে ফেলেছিল তার প্রিয় রঙের শিশিরগুলো।রিক্তা যে তার জীবনের রং কেড়ে নিয়ে এভাবে বর্ণহীন করে দেবে তাকে সে কখনো ভাবেনি এর আগে।
রিক্তার সাথে তার অবনতি ঘটেছিল প্রায় পাঁচ মাস আগে থেকেই।সম্পর্কের শেষ টা ঘোষণা করে রিক্তাই মাসখানেক আগে।তারপর সে অয়নের আর কোনো ফোন রিসিভ করেনি।সারাদিন বিষন্নতায় কাটিয়েছে অয়ন,কিন্তু এই একমাস সে অপেক্ষা করেছেযে রিক্তা ফিরে আসবে এবং গত রাতেই সেই অপেক্ষার বিফলতা প্রমাণ করেছে রিক্তা।
ভোর হতে না হতেই সূর্যের স্মিত রশ্মি এসে ছড়িয়ে পড়ল অয়নের মুখে।সারারাত রিক্তার কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল ছিলো না।রিক্তার সন্মোহনী চোখের চাহনী তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে।বারবার মনে পড়েছে রিক্তার সাথে তার গভীর ভালোবাসার মুহুর্ত গুলো।রিক্তার মতো সুন্দরী প্রেমিকা ছিল বলে অয়নের খুব গর্ব ছিল। সে বরাবরই সুন্দরকে অন্বেষণ করে এসেছে।রিক্তার শরীরের প্রতিটা খাঁজ সে বারবার ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে ক্যানভাসে।ক্যানভাসে আঁকা রিক্তার ছবিগুলো যেন আজ অয়নের দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপ করে।সারাটা দিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেই কাটিয়ে দিলো অয়ন।পরের দিন রিক্তার বিয়ে।এই একই শহরে থেকে রিক্তা অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে এটা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে উঠছে।বিকেল তখন পাঁচটা উদ্ভ্রান্তের মতো হাওড়া স্টেশনে এসে পৌছালো অয়ন।পরের দিন ভোরের ট্রেনে টিকিট কেটে ফেলল আসামের।এই শহরে আর থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে।
এরপর কেটে গিয়েছে দুই বছর।আসামে এসে একটা স্কুলে পড়ানোর কাজ পেয়েছে অয়ন।স্কুলে পড়ানোর পর বাকি যে সময়টুকু হাতে পায় সেই সময়টা প্রকৃতির আনাচে কানাচে ছবি এঁকেই কাটিয়ে দেয়।প্রকৃতির সৌন্দর্যকেই তার ক্যানভাসে এখন সে তুলে ধরে।এখানে এসে আরও একজনকে পেয়েছে সে, পারমিতা। পারমিতা অয়নের কলেজের ক্লাসমেট ছিল।আসামের মেয়ে সে,কোলকাতায় হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করত।এখন আসামেরই একটা কলেজের লেকচারার সে।অয়ন আসামে আসার পর হঠাৎই একদিন রাস্তায় দেখা তার পারমিতার সাথে।পারমিতাও অবাক অয়নকে সেখানে দেখে।তারপর কথায় কথায় পারমিতা জিজ্ঞেস করে অয়ন কোথায় এসে উঠেছে ইত্যাদি, এভাবেই নতুন করে আবার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দুজনের।পারমিতা খুবই সাধারণ দেখতে একটা মেয়ে,রূপের চটকদারী বলতে কিছুই নেই।কিন্তু ওর মধ্যে থাকা ব্যাক্তিত্বটা অয়নকে অনেক বেশী কৌতুহলী করে তোলে।অয়নের মনে পড়ে কলেজে পড়তে পারমিতা খুব সাধারণ আর শান্তশিষ্ট মেয়ে ছিল বলে সবাই ওকে অতটা পাত্তা দিত না।কলেজে পড়া সব ছেলেরা তখন পোশাকি সৌন্দর্যে মত্ত।একমাত্র অয়নের সাথেই পারমিতার কিছুটা আলাপ ছিল।তবে সেই আলাপ শুধুমাত্র পড়াশুনার আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল,বন্ধুত্ব অব্দি গড়ায়নি।তারপর কলেজ পাশ করে অয়ন চলে যায় আর্ট কলেজে আর পারমিতা মাস্টার্স করে।যোগাযোগটাও স্বাভাবিক ভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।তারপর রিক্তার থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অয়ন যখন সব ছেড়ে চলে আসে তখন পারমিতা কে আবার পায়।তার সাথে সখ্যতা তৈরী হবার পর অয়ন ধীরে ধীরে চিনতে শুরু করে পারমিতাকে। রিক্তাকে ভোলার জন্য যে লড়াইটা করতে হয়েছিল অয়নকে সেখানে পারমিতা সবসময় ওর পাশে ছিল। অয়ন এই দুই বছরে বুঝতে পারে যে অতি সাধারণের মধ্যেও কিরম অসাধারণত্ব লুকিয়ে থাকতে পারে।পারমিতা যেন জাদু কাঠির ছোঁয়ায় তার জীবনটা অনেক সুন্দর এবং শান্তির করে তুলেছে।অয়নের ভালোবাসাটা এভাবেই জিতে নিয়েছে পারমিতা।পড়ন্ত বিকেলে অয়নের হাতের মধ্যে হাত রেখে যখন পারমিতা অয়নের কাঁধে মাথা রাখে তখন এক চরম প্রশান্তি পায় অয়ন। রিক্তার সুগঠিত শরীরী কাঠামোর ঝলকানি আর নাড়াতে পারেনা অয়নকে।
অয়ন আগের থেকে অনেক পরিণত হয়েছে।সম্পর্কের ভরসা এবং স্থায়ীত্বের গুরুত্ব সে এখন বোঝে।বাহ্যিক সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে অন্তরের সৌন্দর্যের যে সন্ধান সে পেয়েছে তার মর্যাদা করতে জানে সে।ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ বোঝার পর পারমিতাকে আর এক মুহুর্তের জন্য দূরে রাখেনি সে।একমাস হল বিয়ে করে সুখে নতুন সংসার শুরু করেছে তারা।
নতুন সংসারে পারমিতা তার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে অয়নকে।নিজের পটু হাতে সংসারটাকে সুন্দর করে গুছিয়েছে পারমিতা।বিয়ের পরও কোনোরকম স্বাধীনতা কেড়ে নেয়নি অয়নের থেকে,একতরফা দায়িত্বের দায়ভারেও পিষ্ঠ করে মারেনি তাকে।আগের মত এখনও প্রকৃতির আনাচে কানাচে ঘুরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলোকে ক্যানভাস বন্দী করে অয়ন।মাঝে মাঝে অয়নের সাথে পারমিতাও যায়।পাহাড়ের কোলে বসে অয়নের সাথে সেও প্রকৃতিকে উপভোগ করে আর অয়ন যখন ছবি আঁকে তখন মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখে।বিয়ের পর হানিমুনটা সারা হয়নি।তাই দুজন মিলে ঠিক করল দিল্লী যাবে হানিমুনে প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক শিল্পকলা ও ঐতিহ্যকে উপভোগ করতে।
আজ কলকাতায় ফেরার কথা তাদের। আর দুই দিন পর দিল্লীর ট্রেন।অনেকদিন পর কলকাতায় আসছে দুজনে, তাই কলকাতায় পা রেখেই হোটেলে কোনমতে সুটকেসগুলো রেখে দুজনে বেড়িয়ে পড়ল শহর ভ্রমণে।ব্রিজের ওপর থেকে সন্ধ্যের শহরটাকে বড় সুন্দর লাগে।অয়ন আর পারমিতা একসাথে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ালো।সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে।জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।পারমিতার চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। অয়ন চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিল পারমিতার মুখ থেকে।তারপর ওকে আদর করে বুকে টেনে নিল।অনেক্ষণ নিজেদের মত সময় কাটিয়ে হোটেলে ফিরবে বলে রওনা দিল।কিন্তু একটু এগোতেই দেখল একটা মেয়ে উদ্ভ্রান্তের মত নদীর পাড় ধরে ছুটতে ছুটতে পারমিতার সামনে দিয়ে বেড়িয়ে গেল।ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগায় পারমিতা মেয়েটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল কিছুটা,আর সঙ্গে সঙ্গে জলের মধ্যে ঝপ্ করে কিছু পড়ার শব্দ হল।আলো আঁধারিতে পরিষ্কার দেখা না গেলেও ওরা বুঝতে পারলো যে মেয়েটিই জলে ঝাঁপ দিয়েছে।অয়নকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পারমিতা চিৎকার করে পাড়ের মাঝিদের ডাকল।মাঝিরা গিয়ে কোনোরকমে মেয়েটিকে যখন পাড়ে তুলল তখন মেয়েটি চেতনা হারিয়েছে।মেয়েটার চুলগুলো এলোমেলো,জামাকাপড় অবিন্যস্ত,চোখে মুখে কালো ছাপ- দেখেই মনে হচ্ছে কোন বড় ঝড় বয়ে গেছে।হাল্কা আলো এসে পড়েছে মেয়েটার মুখে।অয়ন তাকাতেই চমকে উঠলো!! কাকে দেখছে এটা ও?? রিক্তা!! এতদিন পর এভাবে দেখা হবে সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি।
আশেপাশের লোকেদের তৎপড়তায় কিছুক্ষণ পর সুস্থ হল রিক্তা।রিক্তা অয়নকে চোখের সামনে দেখে অবাক।পারমিতা রিক্তাকে তার বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করল কিন্তু রিক্তা কোনো কথা বলেনি।শেষে পারমিতা বলল যে ওকে লোকাল থানায় নিয়ে যাবে সেখান থেকে পুলিশ ওকে ওর বাড়ি পৌঁছে দেবে।থানায় গিয়ে অফিসারকে সব কিছু জানিয়ে ফর্ম্যালিটি গুলো সারতে পারমিতা একজন মহিলা পুলিশের সাথে গেল।রাত হয়ে গেছে।থানা মোটামুটি ফাঁকা।রিক্তা ও অয়ন পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছে।অয়ন দেখল যে রূপ নিয়ে রিক্তার এত অহংকার ছিল আজ তার সব গিয়েছে।কিছুক্ষণ পর রিক্তাই প্রথম কথা বলল।
-কেমন আছো অয়ন??এতদিন পর তোমার সাথে এভাবে দেখা হবে ভাবিনি।
— হ্যাঁ, আমিও এখন এখানে থাকি না। আমি আর আমার স্ত্রী কলকাতায় এক বিশেষ কারণে এসেছি।কিন্তু একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে,আজ যে ঘটনাটা ঘটলো এটার কারণ কি? কৌতুহল থেকেই প্রশ্নটা করলাম।তুমি তো খুব সুখী দাম্পত্য জীবন পেয়েছিলে।
অয়নের কথা শেষ হতে না হতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল রিক্তা।রিক্তার মুখ থেকে যা শুনলো অয়ন তা হল প্রচন্ড বড়লোক শ্বশুরবাড়ির ও স্বামীর প্রচুর অর্থ থাকলেও তাদের মনটা একদমই বড় ছিলো না।তার ব্যস্ত স্বামীর স্ত্রী কে দেওয়ার মত সময় ছিল না।বাইরে বিভিন্ন মেয়ের সাথে সম্পর্ক,রিক্তার উপর মানসিক অত্যাচার বেড়েই চলেছিল।তার উপর গত একবছরে দুইবার রিক্তার মিসক্যারেজ হয়।এই অবস্থায় রিক্তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দেবার কথা বলে আর তারপরই এই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত।
অয়ন কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না।
–আমাকে বাঁচাতে পারো অয়ন?তুমি তো একসময় আমাকে খুব ভালোবাসতে,আজ কি আমরা নতুন করে সব শুরু করতে পারি না?
রিক্তার কথা শুনে মনে একটা খারাপ লাগা তৈরী হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ওর এই কথাটা শুনে হাসি পেল অয়নের। মনের বিশালতার যে স্বাদ সে পেয়েছে পারমিতার থেকে তার সামনে সব হাতছানিই তুচ্ছ।পারমিতা ফিরতেই অয়ন পারমিতার হাতটা শক্ত করে ধরে রিক্তার সামনে দিয়ে বেড়িয়ে গেল।রিক্তা অবাক হয়ে দেখল একদিন যাকে সে তুচ্ছ বলে অবজ্ঞা করেছিল আজ সে তাকে প্রত্যাখ্যান করে বেড়িয়ে গেল।
রাস্তায় বেড়িয়ে পারমিতা অয়নকে বলল,
“উফ্ এত শক্ত করে হাতটা কেন ধরে রেখেছ বলতো?রিক্তা কি আমাকে কিডন্যাপ করে নিতো নাকি?”
অয়ন বেশ অবাক হয়ে গোলগোল চোখ করে বলল,”তুমি কি করে জানলে যে ও রিক্তা?”
পারমিতা মুচকি হেসে বলল,”তুমি যখন আসাম আসো প্রথম, তখন তোমার ঘরে ওর একটা ছবি দেখেছিলাম।পরে অবশ্য তুমি ওটা পুড়িয়ে ফেলেছিলে সেটাও জানি।আচ্ছা রিক্তাকে দেখে ওর কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না?”
অয়ন তাকিয়ে দেখল পারমিতার চোখে ভালোবাসা হারানোর ভয়।অয়নের একটু অভিমান হল।পারমিতার কি একটুও বিশ্বাস নেই অয়নের উপর!এতই কি ঠুনকো অয়নের ভালোবাসা!!
অয়ন সংক্ষেপে “না” বলে পারমিতার হাতটা চেপে ধরে এগোতে লাগল হোটেলের দিকে।
পারমিতা অয়নের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো যে ওর অভিমান হয়েছে।অয়নের অভিমান ভাঙানোর উপায় ও জানে।লাজুক হেসে বলল, “ভালোবাসো আমাকে খুব তাইনা?”
অয়নও পারমিতাকে জড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে বলল,”ভালোবাসি”।
অয়নের বুকে মাথা রেখে পারমিতা শুনতে পেল মধ্যরাতের নির্ঝুম আকাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে “ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি”।
…………………………………………………… সমাপ্ত ………………………………………………