হোটেলের রুমটা নিজের মতো করে একটু গুছিয়ে নিয়ে পাঁচ বছরের অর্ণার হাত ধরে নীচে যাচ্ছিল রীতি | সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আটকে গেলো পা জোড়া, ভাঁজ পড়লো কপালে; মেমরিটাকে কয়েক সেকেণ্ড আগের ফ্ল্যাশ ব্যাকে নিয়ে গিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ব্যাক্তিটির মুখটা আরেকবার মনে করলো রীতি, আবারও অতিরিক্ত একটি ভাঁজ পড়লো কপালে, কোনওরকমে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে দেখতেই দেখলো সেদিক থেকেও পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছে সেই অবয়ব | স্তব্ধ অপলক দু জোড়া চোখ , নীরব ঠোঁট, বয়ে গেল অনেকটা সময়;
—“কি গো? কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি,” সম্বিত্ ফিরলো অর্ণব এর ডাকে |
—“হ্যাঁ, চলো” আনমনা উত্তর দিলো রীতি |
—“আরে, দাঁড়াও দাঁড়াও, ওনাকে ওভাবে দেখছিলে, পরিচিত বুঝি?”
অপরদিকের পা জোড়া সামনে এগিয়ে এলো, বাড়িয়ে দিলো করমর্দনের হাত,
—“হাই, আমি গৌরব, রীতিকার কলেজের বন্ধু , অনেকদিন পর দেখা তাই দুজনেই চমকে গেছিলাম |”
—“বাহ! দার্জিলিং এ এসে একজন পরিচিত পাওয়া গেল তাহলে | বাই দ্য ওয়ে, আমি অর্ণব চৌধুরী, রীতিকার হাসবেন্ড”— করমর্দনের জন্য বাড়ানো হাতটিতে হাত রাখলো অর্ণব |
—“পরে দেখা হবে” দৃঢ় হেসে বললো গৌরব |-মৃদু হেসে পিছন ঘুরল রীতিকা |
“এখনও অহংকার যায়নি, একবারও কথা বললো না আমার সাথে; তবে, কলেজের মোস্ট আকর্ষণীয় ছেলেটির চোখের নীচে বেশ গভীর ডার্ক সার্কল পড়েছে, বলিরেখাও স্পষ্ট ; আচ্ছা ও কি একা এসেছে নাকি সস্ত্রীক ?” নানা প্রশ্ন ভিড় করছে রীতিকার মনে |
“মামনি, তোমার অমলেট এখনও শেষ হলো না? আমার শেষ, আমি ফার্স্ট, ইয়ে |”
মেয়ের কথায় চমকে উঠে প্লেটে হাত দিতেই রীতি বুঝলো ডবল ডিমের অমলেটটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে |
—“এই, তুমি কিছু খাচ্ছো না, শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
—“হুম, মাথাটা একটু ধরেছে |”
—“আগে বলবে তো? চলো চলো ঘরে চলো, আজ আর ঘুরতে যাবো না, তোমার শরীর ঠিক হলে যাবো |”
—“না না, তোমরা দুজন ঘুরে এসো, আমার একটু ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে |”
একপ্রকার জোড় করেই অর্ণব আর অর্ণাকে পাঠিয়ে দিলো রীতি | ওর যে একা থাকাটা খুব দরকার |
বাইরের আকাশটা বেশ থমথমে, রুমের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রীতি | সেদিনও পরিবেশটা এরকমই ছিলো, সদ্য কুড়ির যুবতী রীতিকা সেন তখন পদার্থবিদ্যার প্র্যাকটিকাল রুম থেকে ক্লাস রুমের দিকে এগোচ্ছে |
–“এই যে, মিস ব্রিলিয়ান্ট, আরে এই যে হলুদ শালোয়ার তোমাকে বলছি |”
ঘুরে দাঁড়ায় রীতি, “রীতিকা, আমার নাম রীতিকা সেন |”
—“সে যাই হোক, বলছি গ্রাফটা আমায় একটু বুঝিয়ে দেবে?”
—“যাই হোক নয়, রীতিকা সেন, নামের উপর অনেক কিছুই নির্ভর করে, এই ধরো যেমন নাম পাল্টালে প্র্যাকটিকালও পাল্টে যায় আর গ্রাফও |”
—“ওকে, রীতিকা সেন,
আমাকে গ্রাফটা একটু বুঝিয়ে দেবেন?”
—“নিশ্চয় |”
সেদিনই গৌরবের সাথে প্রথম পরিচয় রীতিকার, গ্রাফ পেপারের সবুজ ছক থেকে শুরু করে, মাল্টিপ্লেক্সের এসি সিট পেরিয়ে সে সম্পর্ক কখন যে প্রিন্সেপ ঘাটের সাদা থামে পৌঁছে গেছে বুঝতে পারেনি রীতিকা | কেউ কাউকে অফিসিয়ালি “আই লাভ ইউ” বলেনি তবে সম্পর্ক টা গড়িয়েছে অনেকদূর, অন্তত রীতিকার তাই ধারণা | এই ধারণাটায় ভাঙলো ঠিক একটা বছর পর, কলেজে নতুন জুনিয়রদের নবীন বরণে রসায়নবিদ্যার একটা টুকটুকে ফর্সা, মসৃণ চুল, লাল লিপস্টিক আর কালো শিফন শাড়ি পড়া মেয়েটার হাত ধরে প্রবেশ করলো গৌরব | যে কোনো তরুণের হৃদয়ে আগুন ধরানোর জন্য মেয়েটার চোখ দুটোই যথেষ্ট ; আর ওই আইলাইনার টানা চোখের কাছে রীতিকার কাজল টানা চোখ, নীল ঢাকাই জামদানী অনেকটাই ফিকে | তবুও রীতিকা নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো, পরিচিত কেউ হবে এই কথাটার মাধ্যমে | রীতিকার সমস্ত চেষ্টায় জল ঢেলে গৌরব রীতিকা সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল-“রীতিকা, এই হচ্ছে আমার গার্ল ফ্রেন্ড |”
—“হাই, আমি তিথি |” লাল নেলপালিশ পড়া একটা হাত করমর্দনের জন্য এগিয়ে এসেছিল রীতিকা দিকে |
জলভরা চোখে রীতি গৌরবের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো- “আগে বলিসনি তো?”
গৌরব সহাস্যে উত্তর দিয়েছিলো-“সারপ্রাইজ |”
কিছুক্ষণ পর গৌরবকে ফাঁকা পেয়ে রীতি ডিপার্টমেন্টে নিয়ে গিয়েছিল ওকে | ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করেছিল-“আমাদের এই এত গুলো মাস কি মিথ্যে গৌরব?”
—“মানে? তোকে আমি বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি কখনও আর তাছাড়া তুই বেশ সেকেলে, কলেজের হ্যান্ডসাম হাঙ্কের প্রেমিকা তুই কীভাবে হবি?”
—“মানে? প্রিন্সেপ ঘাটে হাতে হাত রেখে হাঁটা, ভিক্টোরিয়ার চুম্বন সব মিথ্যে?”
—” এই সেকালের মানসিকতার জন্যই তুই আমার অযোগ্য, আরে বাবা বিদেশে লোকে হাজার জনকে চুমু খায়, তাই বলে কি সবাইকে বিয়ে করে?”
না, আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি রীতিকা, কলেজ যাওয়াও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলো, কোনওরকমে গ্রাজুয়েশন করে হায়ার স্টাডির চলে গিয়েছিলো বাইরে |
তারপর কেটে গেছে অনেক গুলো বছর, রীতিকা পুরনো স্মৃতি গুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তবুও তার আঁচড়গুলো কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে, অর্ণব তার কিছুটা জানে, কেবল ওকে নামটা বলেনি রীতি, অর্ণবও জানতে চায়নি |
পুরোনো স্মৃতি গুলোর কড়াঘাতে ছেদ পড়ে দরজার টোকায়, চোখ মুছে দরজা খোলে রীতিকা | সাদা টি-শার্ট পড়ে গৌরব দাঁড়িয়ে |
—“ভিতরে আসতে বলবি না?”
—“হুম, আয়” |
ভিতরে এসে বিছানায় বসে গৌরব | রীতি চেয়ার নিয়ে বসে |
—“অনেক সুন্দর হয়ে গেছিস? এত মর্ডান হলি কবে?”
—“সবটাই সময় রে, কী করছিস এখন?”
—“একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে আছি | তুই?”
—“কলেজে পড়ায় রে | কেমন আছিস বল?”
—“চলে যাচ্ছে রে |”
—“আর তিথি?”
—“ছ মাসের মাথায় ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, একজন ডাক্তারকে পেয়ে |”
—“ওহ |”
—“আচ্ছা রীতিকা, আমরা কি সব নতুন করে শুরু করতে পারিনা?” রীতিকার হাত দুটো চেপে ধরে গৌরব |
—“বিয়ে করিসনি?”
—“না, সব ছেড়ে তুই চলে আয় রীতি, আমি সাদরে তোকে গ্রহণ করবো |” রীতিকার ঠোঁটে ঠোঁট ডোবাতে যায় গৌরব | হাত দিয়ে আটকে দেয় রীতি |
—“আসলে কী জানিস ভালোবাসার জন্য একটা সুন্দর মন দরকার হয়, যেটা তোর নেই, তাই সেদিনের হ্যান্ডসাম হাঙ্ক হওয়া সত্ত্বেও আজ তুই একা | রূপ তো চিরস্হায়ী নয় গৌরব |”
মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে গৌরব |
—“আর আমার কাছে আসিস না, আর সেদিনের জন্য ধন্যবাদ, সেদিন তুই না ঠকালে আজ অর্ণবকে পেতাম না | পি.কে.ডি স্যার ঠিকই বলতেন “অস্হায়ী তারাদের না জ্বলাই ভালো |”
মাথা নীচু করে বেড়িয়ে যায় গৌরব, আর অর্ণবের পা জোড়া সরে যায় আড়ালে |
এক অদ্ভুত শান্তি লাগছে রীতির | ঘরে প্রবেশ করে অর্ণব |
—“তোমাকে আমার কলেজ লাইফের কথা বলেছিলাম মনে আছে অর্ণব?”
—“হ্যাঁ |”
—“এই সে| গৌরব দত্ত |”
—“ঘরে ঢুকতে গিয়ে কিছুটা শুনতে পেলাম , একটাই কথা বলবো তোমায় |”
অবাক হয়ে অর্ণবের দিকে তাকাই রীতি |
সিরিয়াস সিরিয়াস মুখ করে অর্ণব বলে-“আহারে, বেচারা গৌরব |”
হো হো করে হেসে ওঠে রীতি | অর্ণব ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে | গুটি গুটি পায়ে ওদের মাঝে ঢুকে যায় অর্ণা | দুজনেই মেয়েকে জড়িয়ে নেয়, হাসি ছড়িয়ে পড়ে রুম নাম্বার তিনশো চার এ |