– চিন্তা করো না আবির। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুমিয়ে পড়ো।
: আচ্ছা মেঘলা চাঁদ কি দেখা গেছে?
– হ্যাঁ কালকে ঈদ।
: কালকে ঈদ, কিন্তু তোমার হাত মেহেদী রাঙাতে পারলো না।
– রাত তো এখনো পার হয়ে যাচ্ছে না চিন্তা করছো কেন।
: এবার ঈদে তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না। কিভাবে দিব। গত ১০ মাস ধরে হাসপাতালে পড়ে আছি। ইচ্ছা থাকলেও সাধ্য নেই।
– আবির আমি তোমার কাছে চেয়েছি।
: তুমি অন্য সবার মতো না। মুখ ফুটে আজ পর্যন্ত কিছুই চাওয়ার নেই তোমার। কিন্তু আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না।
– তাতে আমার কোন কষ্ট নেই। কিন্তু এখন তোমার মন খারাপে বেশি কষ্ট পাচ্ছি।
: কষ্টটা সামনের দিনগুলার জন্য জমা রাখো। আমি জানি ভাল হবো না। পা টা হারিয়ে ফেলবো চিরদিনের জন্য।
– আবির প্লিজ চুপ করো না। আমার ভাল লাগছে না।
: চিন্তা না করলে যে আমার ভাল লাগছে না। তোমার কি হবে? তোমার ভবিষ্যৎ কি?
– আবির তুমি ভাল করেই জানো আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করি না। উপরে একজন আছে, সে নিশ্চয় চালিয়ে নিবে। চিন্তা করো না প্লিজ ঘুমিয়ে পড়ো।
: মাথায় শত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার সাথে নানা শংসয়, অনিশ্চয়তা।
– আবির প্লিজ।
: আমার না ধম বন্ধ হয়ে যায়। ঘরটাকে অনেক ছোট মনে হয়। মনে হয় আমাকে কেউ গলা টিপে মেরে ফেলছে। আমি আর বাঁচতে চাই না। আমি আর পারছি না মেঘলা।
– নিজের কথাটা ভাবলে শুধু, আমার কথা ভাবলে না। এতটা স্বার্থপর কিভাবে হলে আবির। তোমার কিছু হলে আমার কি হবে?
.
মেঘলার চোখে জল জমতে শুরু করলো। মেয়েটার অল্পতে চোখ জল জমে যায়। যা অঝর ধারায় ঝড়ে পড়ে। কালকে ঈদ আজকে কান্নাকাটি করার কোন যুক্তিগতা নেই।
.
: মেঘলা তোমাকে একটা গল্প বলি, ছোট বেলায় চাঁদ রাত্রে, আমি…
– আবিরের পরিচিত গল্পের মধ্যে অন্যতম একটা। শুনতে শুনতে অবস্তু হয়ে গেছে মেঘলা। পরের অংশটুকু দাড়ি কমা সেমিকোলন সহ বলতে পারবে। এই গল্প শুনে মেঘলার আর হাসি পায় না। আবির কে খুশি করার জন্য অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে।
.
ছোট বেলার হাসি সব চেয়ে নির্ভেজাল হাসি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাসির ও পরিবর্তন হয়। যুক্ত হয় ফরমালডিহাইড।
.
আবির ঘুমানোর চেষ্টা করলেও চোখ যে তার নির্ঘুম। মাথায় যার শতো বোঝা। জীবন মরার সদীক্ষনে পা থাকবে কি থাকবে না। গত ১০ মাসে ধরে দ্বিধার মধ্যে আছে। কালকে ঈদ কিন্তু কোন প্রস্তুতি নেই আবিরের। বাকি দিনগুলার মতো চার দেয়ালে বন্ধী। বন্ধী করে রেখেছে তাদের স্বপ্নগুলো। ২ বছরের বিয়ে। রূপবতী স্তী তারসাথে ভাল একটা চাকরি। ভালই চলছিল। গতবছর ঈদের কথা এখনো চোখে লেগে আছে।
.
কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতো রোড আক্সিডেন্ট সব স্বপ্ন যেন চুরমার করে দিছে। স্বাদের বা পা থাকবে কি না আজও অজনা। উন্নত চিকিৎসা করলে হয়তো ফলাফল ভিন্ন হতে পারতো। গত দশ মাস ধরে শুয়ে থাকায় যেটুকু সম্বল ছিল তাও শেষ। সময় চলে যাচ্ছে মনের ব্যথার সাথে পায়ের ব্যথা বড্ড বেড়েছে। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কাঁদতে। আর যে সহ্য করতে পারছি না। কিন্তু ছেলেদের যে কাঁদতে নেই। ছেলেদের চোখের জল যে বড্ড বেমানান।
.
– হ্যালো ভাইয়া। কেমন আছেন?
: জ্বি ভাল। তোর কি অবস্থা।
– ভাইয়া ভাল।
: আমাকে একটা উপকার করতে পারবি।
– ভাইয়া এমন ভাবে বলছেন কেন। আপনার জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগবে। আপনি হাসপাতালে আছেন আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।
: আমাকে একটা শাড়ি কিনে দিতে পারবি?
– ভাবির জন্য?
: হ্যা।
– নিশ্চয় নীল রঙের হবে?
: একদম।
.
সূর্যের হালকা আলো জালনা দিয়ে রুমে ঢুকে রুম আলোকিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। মেঘলা পর্দা সড়িয়ে অন্ধকার রুম আলোকিত করলো।
– শুভ সকাল। ঈদ মোবারক।
: ঈদ মোবারক। কয়টা বাজে?
– সকাল ৮ টা।
: ঈদের নামাজ নিশ্চয় শুরু হয়ে গেছে।
– প্রতি উত্তরে মেঘলা কি বলবে জানা নেই। জানা নেই নতুন কোন শ্বান্তনা দেওয়ার ভাষা। সব যে ফুরিয়ে গেছে। আবির ঈদের দিন মন খারাপ করে কি লাভ বলো। সামনের বছর নিশ্চয় মিস হবে না।
– মুচকি হেসে অনেক কিছু বলার ছিল আবিরের। কিন্তু বলবে না। বলতে ইচ্ছা করছে মিথ্যা শ্বান্তনা না দিতে। কিন্তু নীরবতা যে সব চেয়ে বড় উত্তর।
– নীরবতা ভেঙে মেঘলা আবিরের হাতে নীল পাঞ্জাবি তুলে দিল। এটা তোমার জন্য।
: আবির বিষ্মিত চোখে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো কখনো প্রত্যাশা করে নাই। থ্যাংকু মিসেস। আবির মুচকি হেসে বালিশের নিচ থেকে নীল শাড়ি মেঘলা হাতে তুলে দিল।
.
মেঘলা অপলক দৃষ্টিতে অবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। একজন মানুষ নাকি সারাজীবনে সাত বারের বেশি বিষ্ময়ে অভিভূত হতে পারে না। এই সাত বারের মধ্যে একবার পৃথিবী দেখে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়। আর একবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে। দুই বারের স্মৃতি কোন কাজে আসে না। বাকি থাকে পাঁচ। মেঘলার আরও একটা কাঁটা গেছে বোঝাই যাচ্ছে। মেঘলা বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘলার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করছে। অনেক দিনের জমানো চোখের জল যা আনন্দ অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়ছে।
.
সবার ঈদ অন্য সবার মতো আনন্দ হাসি খুশিতে যায় না। সবার হাত মেহেদী তার নিজস্ব রঙে রাঙাতে পারে না। সবাই পারে না পরিবার পরিজনদের সাথে ঈদ করতে। কারো কারো ঈদ হাসপাতালের চার দেয়ালের সাদা বিছানায় সীমাবদ্ধ। আমরা কখনো তাদের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারি না। আমরা কি তাদের ঈদ আনন্দের কথা একবার ও চিন্তা করি। কি দরকার অন্যের কথা চিন্তা করে মন খারাপ করা।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা