সবার সম্পূর্ন নিজের একটা জগত্ থাকে ।এই জগত্টা সে নিজে তৈরি করে নেয়।আমার কাছে আমার ঘরটা সেইরকম এক জগত্।আমার একান্ত একটা জগত্ এখানে আমি কখনো কাউকে ঢুকতে দেই না কেন তা সঠিক জানি না।হয়ত এই ঘরটার আনাচে কানাচে আমি আমার ভালবাসা দিয়ে সাজিয়েছি তাই।আমার মনে আছে আমার বয়স তখন ১৭ কি ১৮ হবে যখন আব্বুর অফিস থেকে দেওয়া বাড়ি ছেড়ে প্রথম নিজেদের তৈরি বাসায় উঠলাম।তারপর আমায় যখন এই ঘরের দরজা খুলে দেওয়া হল তখন খুব অবাক হয়ে ঘরটা দেখছিলাম মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছিলাম ঘরটার কোথায় কি রাখবো।আমি খুব রঙ পাগল মানুষ ছিলাম হাতের কাছে তুলি আর ক্যানভাস থাকলে আমি হারিয়ে যেতাম।সাদা কালো কিছু আমার ভাল লাগতো না।আমি খুব জেদ করেই আমার ঘরটা রং করায় নি।নিজের হাতে নিজের ঘরটা রং করেছিলাম।রং করেছিলাম বললে ভুল হবে নিজের ঘরটা অন্যরকম ভাবে রাঙ্গিয়ে ছিলাম।ঘরটার প্রতিটা আনাচে কানাচে ভালবাসার রং গুলো ছড়িয়ে দিয়েছিলাম।
ছবি আঁকাআঁকির পাশাপাশি ছবি তোলার প্রতিও খুব আগ্রহ ছিল আমার।আমি প্রচুর ছবি তুলতাম আর সেই ছবি গুলোর কিছু আমার আঁকানো ছবি গুলোর সাথে দেওয়ালে জায়গা পেত।আমার একটা বড় বারান্দা ছিল।ঝুলন্ত বারান্দা।এই বারান্দা থেকে ব্যাস্ত নগরীর সাথে সুনীল আকাশ দেখা যেত।আমি আকাশ দেখতে ভালবাসতাম,আসলে মেঘলা আকাশ।আমার এই ঘরে আমি কখনো কাউকে ঢুকতে দেই নি।আমার খুব ইচ্ছে হতো মেঘ কে একদিন এই ঘরে আনবো।তাকে এনেওছিলাম ,সে যখন এই ঘরে ঢুকেছিল আনাচে কানাচে তার পোর্টেট ও ছবি গুলোর দিকে কি এক মুগ্ধ নয়নেই না তাকিয়ে ছিল আর আমি আরো মুগ্ধ ভাবে তার সেই নয়নে ডুবসাঁতার খেলতাম।আমার সেই ইচ্ছে পূরন হয়ছিল একবার না অনেক বার।
যখন তাকে বিয়ে করে এনেছিলাম,আমার এই জগত্ দেখে সে বলেছিল এটা একটা ঘর না জীবন্ত ছবি, আমার ভালবাসার জীবন্ত ছবি।আমি যদি রঙের পাগল হই তবে মেঘ ছিল রঙের জাদুকর।সে আমার সাথে মিলে আমার জগত্টা আরো সুন্দর করে রাঙ্গিয়ে ছিল হুম তখন আমার জগত্টা আমার থেকে আমাদের হয়ে ছিল ,সেখানে আমাদের ভালোবাসার রঙ্গের পাশাপাশি আমাদের ছোট্ট সোনামনির জন্য রংধনু সাজানো ছিল।
একদিন ভোরে আকাশে রংধনু উঠেছিল সেই রংধনু দেখতে দেখতে মেঘ আমায় জড়িয়ে বলেছিল,আমাদের ছোট্ট সোনামনি কে আমি এমন রংধনুময় আকাশ আর রঙ্গিন জগত্ দিতে চাই অভ্র।সেদিন তার চোখে অন্যরকম মুগ্ধতা দেখেছিলাম।আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম তার চোখের মাঝে, তাকে খুব শক্ত করে ধরে বলেছিলাম ,আমাদের বাবুটাকে আমি তোমার স্বপ্নের মত রঙ্গিন জগত্ দিবো।আমি আজো অপেক্ষায় থাকি আবার সেই মুগ্ধতার দিনের।
আজ অনেক মাস প্রায় ছয় মাস পর আমি আমার এই ঘর এই আমাদের একান্ত নিজের জগত্ টায় ঢুকছি।আগে ঢুকতাম এক রত্তি ভালবাসা নিয়ে এখন ঢুকছি শুধু হাহাকার নিয়ে।ঘরটায় এত মাস কেউ ঢোকে নি কারন সবায় জানতো এই ঘরটা আমাদের খুব ভালবাসার ।ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই পুরোনো স্মৃতি গুলো কড়া নাড়া শুরু করলো।ঘরের দেওয়াল ছবি গুলো তেমনি আছে ,আমার ক্যানভাস তেমনি আছে ক্যামেরাটাও তেমনি আছে।আজ শুধু সেগুলোর ব্যবহার হয় না।ছবিগুলোর দিকে তাকানোর সাথেই বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো।আমি আগে অসংখ্য ছবি তুলতাম সে গুলো অবশ্যই ছিল মেঘের।মেঘ বলতো এত ছবি কিসের তোলো ?আমি বলতাম আমি আমার জীবনের মূর্হুত গুলো হারাতে চাইনা।
বিয়ের পাঁচটা বছর পর যখন মেঘ আমায় জীবনের শ্রষ্ঠ খবর টা দিল তখন আমি খুশির চোটে কেঁদেই দিয়েছিলাম।আর আমার পাগল মেঘটা আমাদের সব ছবির পাশে একটা ফাঁকা জায়গা করতে লাগলো,আর আমায় বলল, “যে এই এখানে আমাদের বাবুটার ছবি হবে।তুমি কিন্তু অনেক যত্ন করে ছবি তুলবা”।আমি মেঘের গালটা টেনে বলেছিলাম,আমার বাবুটার ছবি দিয়ে পুরো ঘরটা ভরে ফেলবো তুমি দেখ।
যখন আমি প্রথম আমাদের বাবুটাকে কোলে নিলাম অদ্ভূত অনুভূতি।পালকের মত হালকা কিছুকে যে আমি আকড়ে ধরে আছি।সেদিন আমার মেঘের চোখে অনেক খুশি দেখেছিলাম যখন সে তার নবজাত শিশুকে আগলে ধরে ছিল।আমার তখন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ লাগছিল।মেঘ খুব সাধ করে আমাদের মেয়েটার নাম রেখেছিল অধরা।মেঘ বলতো আমার মেয়ে সাধারনের বাইরে হবে সকলের ধরাছোয়ার বাইরে তাই ওর নাম হবে অধরা।
আমি পুরোনো স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে ঘরের মাঝে চলে এলাম।যেখান থেকে বারান্দাটা দেখা গেল।বিয়ের আগে মেঘ কে অনেক কথা বলতাম আমার এই বারান্দার।ও চোখ বড় বড় করে বলতো,” তোমার আকাশ দেখতে এত ভাল লাগে”?আমি তখন হাসতাম আর বলতাম,”হুম অনেক,তাছাড়া আমার খুব একটা ইচ্ছে আছে”।ও অনেকবার জিগ্গেস করতো ইচ্ছে টা কি আমি বলতাম অন্যদিন।বিয়ের দিন রাতে অনেক মেঘ করেছিল।আমি মেঘ কে নিয়ে বারান্দায় বসে ওর হাত ধরে বলেছিলাম,জানো আমার ইচ্ছে টা কি ছিল ?যখন আকাশের বুকে এমন মেঘ করবে,তখন যেন এই অভ্রটার বুকেও মেঘটা থাকে।আমি আমার বুকে আমার মেঘকে নিয়ে আকাশ দেখতে চাই”।মেঘ তখন আমায় শক্ত করে ধরে বলেছিল,অনেক ভালবাসো তাই না?।তখন আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম।সেদিন মেঘ আমায় বলেছিল,
“আগলে রাখবো তোমায় অনেক যত্ন করে..
আকড়ে রাখবো তোমায় জনম জনম ধরে…
রঙ দিব তোমার ঐ স্বপ্নালু চোখে..
শুধু এভাবেই বেঁধে রেখ আমায় ভালবাসার বাঁধনে..”
আমি মেঘ কে সেদিন বলেছিলাম, “আমি জানি না আমি তোমায় কে কত টুকু ভালবাসি,আমি শুধু জানি আমি তোমায় ভালবাসি আর অনেক অনেক ভালবাসতে চাই”।আমাদের ভালবাসাটা এত বেশি ছিল যার জন্য একটা জীবনও যথেষ্ট ছিল না।
আমি ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি অসহায়ের মত।কষ্টগুলো যেন শেষ করে দিচ্ছে আজ আমায়।আমার ঘর নীল আকাশ ক্যানভাস সব আগের মতই আছে আমাদের ভালবাসাটাও আগের মত আছে।শুধু নেই আজ আমার সাথে আমার মেঘ।আমি কি এমন পাপ করেছিলাম যার শাস্তি স্বরূপ বিধাতা আমার থেকে আমার মেঘ কে কেড়ে নিল।
সেদিনের কথা মনে হতে মনের মাঝে হাহাকার শুরু হয়।সেদিন আমরা কতই খুশি ছিলাম।হাসপাতাল থেকে মেঘ আর আমার ছোট্ট পরীটাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলাম।আমি সারাক্ষন ক্যামেরাটা নিয়ে তাদের ছবি তুলছিলাম আর মেঘ আনন্দ মেশানো বিরক্তি নিয়ে বলছিল “আহ অভ্র এখন ক্ষান্ত দাও”।আর আমার পরীটা যেন তার মার কথায় আমায় তার ফকলা দাঁতের হাসি দিত।
দুইটা গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলাম।মেঘ তখনো পুরোপুরি সুস্হ ছিল না কিন্তু তারপর দিনই লাগাদার হরতাল এর ঘোষনায় মেঘ কে তাড়াতাড়ি বাড়ি নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত করলাম।একটা গাড়িতে আমি মেঘ আর ডাইভার আর আরেকটায় মা,বাবা,ছুটকি,রাতুল আর মার কোলে আমাদের ছোট্ট পরীটা।সে মার কোলে ঘুমিয়েছিল তাই তাকে আর সেখান থেকে নেই নি।
মা’দের গাড়ি আমাদের অনেক আগেই চলে যায় বাসায়।হাসপাতালের কিছু ফর্মালিটিজ পূরন করতে করতে আমার আর মেঘের দেরি হয়।
হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে আমাদের গাড়ি চলছিল বাসা উদ্দেশ্যে,মেঘ আমাকে শক্ত করে ধরে ছিল আমি বেশ খুশি ছিলাম।তারপর যা হল তা তো হওয়ার ছিল না।হঁঠাত্ চোখের সামনে গন্ডগোল দেখতে পেলাম।তারপর বিকট শব্দ।চোখের সামনে ভেসে এল আগুনের অংশ তারপর আমার সব অন্ধকার হয়ে গেল সব শেষ হয়ে গেল।
সেদিন আমাদের গাড়ির সামনে বোমা ফাটানো হয়েছিল,আর এই একটুকরো বোমা আমার থেকে কেড়ে নিল আমার হাসি আমার জীবন আমার মেঘ কে।আমি কোমায় চলে গেলাম আর আমার মেঘ চলে গেল না ফেরার দেশে।ছয় মাস পর যখন আমার সেন্স ফিরলো তখন আমি সারাজীবনের জন্য মরে গেলাম যখন শুনলাম মেঘ নেই কি কষ্ট কি আঘাত আমার মনে আচর কাটলো।সহ্য করতে পারছিলাম না।বাচ্চাদের মত ছটফটিয়ে কাঁদতাম হাহাকার করে কাঁদতাম।ধীরে ধীরে একটু সামলালাম নিজেকে।
আমি ধীর পায়ে টেবিলের কাছে রাখা মেঘের ছবিটার দিকে এগিয়ে গেলাম,তার দিকে একনজরে তাকিয়ে থাকলাম।আমার হৃদয়টা কাঁদতে লাগলো আবার,মনে মনে মেঘ কে বললাম কেন ছেড়ে গেলে আমায় এভাবে ?তখন হঠাত্ পায়ে কিছু অনুভব করলাম।তাকিয়ে দেখলাম ছোট্ট ছয়মাসের পরীর মত শিশু আমার আর মেঘের ছোট্ট সোনামনিটা হামাগুড়ি দিতে দিতে এখানে চলে এসেছে।মেঘ আমাকে ছেড়ে গেলেও আমাদের ভালবাসার অংশ টাকে রেখে গেছিল।
ছোট্ট সোনামনিটা বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে।আমি অবাক হয়ে তার দিকে লক্ষ্য করলাম তার চোখ দুটো একদম মেঘের মত।আমি আলতো করে তাকে কোলে তুললাম তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিতেই এক প্রশান্তি পেলাম।আমি আমার পরীটার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,অধরা তোর বাবার জীবন তোর মা ,সে তাকে ছেড়ে চলে গেছে,এখন তোর বাবা বেচে নেই ,তুই তোর বাবাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবি না?
পুনশ্চ: অভ্র হয়ত এখন আর আগের মত নেই তবুও বেঁচে আছে।অধরা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।এখন অধরার বয়স পাঁচ বছর ।সে তার বাবার ছায়া।সেও তার মার মত রং নিয়ে জাদু করার চেষ্টা করে।অভ্র আজো আকাশ দেখে কিন্তু রাতের আকাশ।কারন তখন তারা গুলো উঠল অভ্র সবচেয়ে উজ্জল তারা দেখিয়ে অধরাকে বলে,ঐটা আমার জীবন তোর মা।মাঝে মাঝে আকাশ দেখার সময় অধরা অভ্রকে বলে ,বাবা ঐ কবিতা টা শোনাও না ? ।তখন অভ্র তার ছোট্ট সোনাকে শক্ত করে জড়িয়ে বলে,আগলে রাখবো তোমায় অনেক যত্ন করে..
আকড়ে রাখবো তোমায় জনম জনম ধরে…
রঙ দিব তোমার ঐ স্বপ্নালু চোখে..
শুধু এভাবেই বেঁধে রেখ আমায় ভালবাসার বাঁধনে..