জীবন প্রদীপ
লিখেছেন- আপসারা নুর তিথি
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আমি বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁতে ইচ্ছে করছে না। একটা সদ্য কিশোরী বাড়ির আঙিনায় দু’হাত মেলে দিয়ে মুক্ত পাখির মতো ভিজছে। তার মা চিল্লাচ্ছে, “অনু ঘরে আয় বলছি। আর ভিজিস না মা। জ্বর বাধাঁবি তো” মেয়েটা পাত্তা দেয় না। নিজের মতো ভিজতে থাকে। হাত পা ঠাণ্ডায় জমে যায়। বারবার হাঁচি আসে। আমার ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠে।
“মা, ও মা, মাআআআআআ”
শ্রেয়ার ডাকে আমার হুশ ফিরে। ছেলেবেলার স্মৃতিতে এতো মগ্ন ছিলাম যে মেয়েটা কখন থেকে ডাকছে শুনতেই পাই নি। আমি হাটুগেড়ে বসে শ্রেয়াকে কাছে টেনে কপালে চুমু দিয়ে বললাম, “কি মামনিটা?”
“খাবে না? চলো। তোমার খাওয়ার সময় হয়েছে তো। বাবাই বলেছে ঘড়ির বড় কাটাটা যখন একদম টুয়েলভের এর উপরে থাকবে তখন তোমাকে খাওয়াতে”
আমি অবাক হয়ে তাকাই। এইটুকুন মেয়ে। এই তো গতমাসে পঞ্চম জন্মবার্ষিকী পালন করলাম। সে যেন আজ আমার মা হয়ে উঠেছে। আনন্দে নাকি বেদনায় জানি না! কিন্তু আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। শ্রেয়া ওর ছোট ছোট হাতগুলো দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “পচা মেয়েরা কাঁদে। তুমি কি পচা মেয়ে?”
কী অদ্ভুত! এই কথাটা তো আমি শ্রেয়ার কান্না থামাতে বলতাম। আমি মেয়েকে জড়িয়ে ধরলাম। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। পৃথিবীটা এতো সুন্দর কেনো?
মেয়ে আমার ছোট ছোট হাত দিয়ে ভাতের লোকমা তুলে দিচ্ছে। আমি খাচ্ছি আর ভাবছি স্বর্গে কি এর চেয়েও বেশি সুখ আছে?
.
আমার ঘুম খুব পাতলা। অল্প আওয়াজে ভেঙে যায়। ইদানীং ঘুম ই আসে না। কড়া ঘুমের ঔষধ খাই তবুও ঘুম আসে না। মাঝরাত! কোনো কারণ ছাড়াই আমার ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় হাত রেখে দেখি মেয়ে, মেয়ের বাবা কেউ পাশে নেই। মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়ের বাবা নামাজে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ে আমার তার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে অনুসরণ করছে।বাবার মতো হাত বেঁধেছে নাভির উপর। কী পাগলী মেয়ে! নামাজ শেষে শাহেদ মেয়েকে দেখি হাত বাধা শিখিয়ে দিচ্ছে। আমি নিরব দর্শক হয়ে বাবা-মেয়ের কান্ড দেখছি। নিয়ত শুনে বুঝলাম শাহেদ তাহাজ্জুদের নামাজে দাড়িয়েছে। মেয়ে অমনি বাবাকে অনুসরণ করে রুকু সেজদা দিচ্ছে। আমার চোখে কিছু স্মৃতি ভেসে উঠে।
“শাহেদ তোমার সমস্যা কী? রোজা রাখো না কেন? হ্যাঁ? তোমার মতো একজন সুস্বাস্থ্যবান মানুষ যদি রোজা না রাখে!”
“অন্যন্যা! তুমি তো জানো আমি ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করতে পারি না”
“এটা কেমন কথা? কাল থেকে সব রোজা রাখবা। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বা। নয়তো এই ঘরে ঢোকা তোমার জন্য বন্ধ”
শাহেদ মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি জোর করে তাকে নামাজ পড়তে পাঠাই। সে যায়। ফিরে কলিংবেল দিলে আমি দরজা না খুলেই জিজ্ঞাসা করি, “নামাজ পড়েছো?”
সে ইতস্তত করে। বলি, “আজ ঘরের বাইরে থাকো। তোমার ঘরে আসতে হবে না।”
“তোমার জন্য আইসক্রিম এনেছি। গলে যাবে তো। খুলো না, লক্ষ্মীটি!”
“লাগবে না আমার আইসক্রিম। তুমি ঘরে ঢুকবা না ব্যস। তুমি আমার কোনো কথা শুনো না”
অনেক অনুনয় বিনয় চললো। কিন্তু আমার মন গলেনি। অবশেষে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে। কাল থেকে নামাজ রোজা সব করবো। এইবার তো দরজা খোলো”
“সত্যি তো? আমার দিব্যি কিন্তু”
শাহেদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “হ্যাঁ তিন সত্যি। তোমার দিব্যি করে বলছি কাল থেকে সব নিয়মিত পালন করবো। এইবার তো দরজা খোলো”
আমি দরজা খুলে দিলাম। দেখি সে আইসক্রিমে একদম মাখামাখি। আমি হেসে বললাম, “একদম উচিত কাজ হয়েছে। যাও গোসল করে আসো। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি”
শাহেদ গোসল করে এসে আমাকে পাশে টেনে বসায়। তারপর নিজ হাতে খাইয়ে দেয়।
ফোপানো কান্নার আওয়াজে আমি পাশ ফিরলাম। দেখি শাহেদ মোনাজাত ধরে কাঁদছে। লোকটা আজকাল তাহাজ্জুদের নামাজও পড়ে। কী অদ্ভুত না! অথচ এই লোকটার সাথে আমার সময় আল্লাহ্ বেশি দিন রাখলো না। আমার ঐ টুকুন মেয়েটাও জানে যে তার মা আর বেশি দিন তার কাছে থাকবে না। পৃথিবীটা এতো নিষ্ঠুর কেন? আমি বালিশে মুখ গুঁজে নিলাম। আমি চাই না আমার কান্নার আওয়াজ শাহেদ কিংবা শ্রেয়ার কানে যাক। শাহেদের ধরা গলায় মোনাজাতে বলা প্রতিটা শব্দ আমার হৎপিণ্ডকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে। ঐ মানুষটা আর আমার বাচ্চাটার প্রার্থনা কি আল্লাহ্ শুনবে না? আমায় কি আর কয়েকটা দিন সময় দিবে না?
.
সারাদিন আমার কোনো কাজ নেই। চুপচাপ বসেই থাকি। ভুলটা আমারি ছিলো। আমি গাফিলতি করে নিজের অসুখের পাত্তা দেই নি। এখন ভুগতে হচ্ছে আমার নিষ্পাপ মেয়েটাকে আর তার বাবাকে। যখন অসুখটা বাড়াবাড়ি হলো তখন ডাক্তারের কাছে গেলাম। জানতে পারলাম আমি নাকি ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে আছি। এখন অপারেশন করেও কোনো লাভ নেই। হয়তো অপারেশন টেবিলেই মারা যাবো! তারচেয়ে ঔষধপত্র, থেরাপি যতোদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে! ডাক্তার বলেছিলো এই কয়েকটা দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে কিন্তু জীবনের শেষ দিনগুলো অন্তত নরকে কাটাতে চাই না। ঘরে দুটো স্বর্গ রেখে হাহাকারময় হাসপাতালে থাকলে আমার জীবনবাতি যে আরো আগে নিভে যাবে।
শাহেদের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে পারিবারিক পছন্দে। কিন্তু আমরা সংসার সাজিয়েছিলাম একদম নব্য প্রেমিক প্রেমিকার মতো। সে অফিসে থাকলে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলতাম। মাঝরাতে উঠে আইসক্রিমের বায়না করতাম বলে সে আমার জন্য আলাদা একটা ছোট ডিপ ফ্রিজ কিনে আনলো। আর তাতে হরেক রকমের আইসক্রিম এনে রেখে দিতো। আমার এখনো মনে পড়ে মানুষটা যেদিন জানতে পারলো আমার ভিতর একটা স্বত্ত্বা বেড়ে উঠছে তার কি খুশি! শ্বশুর শ্বাশুড়িসহ ঘরভর্তি মানুষের সামনে আমাকে কেমন জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। বাচ্চাদের মতো করে বললো, “অন্যন্যা সত্যি! সত্যি আমি বাবা হবো?”
আমার তো লজ্জায় একাকার অবস্থা। ততোক্ষণে অবশ্য ঘর থেকে সবাই বের হয়ে গেছে। আমি নাক টেনে দিয়ে বললাম, “পাগল তুমি? কী যে পাগলামি করো না!”
রোজ বিকেল হলেই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসতো। আমার মনে পড়ে না কখনো খালি হাতে এসেছে নাকি। সবসময় চকলেট, ফুল, টেডি কিছু না কিছু থাকতোই। বাসায় যতক্ষণ থাকতো একটা সেকেণ্ডের জন্য আমার হাতটা ছাড়তো না। শ্বাশুড়িমা শ্বশুরকে দেখিয়ে বলতো “শিখো ছেলের কাছ থেকে কিছু। তুমি তো আমায় ভালোই বাসো না” তা শুনে শ্বশুর মিটিমিটি হাসতো। আমিও হাসতাম ঘরে বসে। হঠাৎ করেই একটা এক্সিডেন্ট হলো। শ্বশুর আব্বাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। কত ছুটাছুটি করে রক্ত জোগাড় করে চার পাঁচ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হলো। কিন্তু শেষ ভরসা হলো না। আমাদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শ্বাশুড়িমাও স্বামীর মৃত্যুটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলেন না। স্ট্রোক করলেন! আর এখনো প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। ভালোবাসার মানুষ হারানোর কী নিদারুণ কষ্ট! আচ্ছা আমার মৃত্যুতে যদি শাহেদের এমন কিছু হয়। আমার মেয়েটার কী হবে? মানুষটারই বা কী হবে? একের পর এক ধাক্কা কিভাবে একা সামলাবে সে? এতো কষ্ট কি মানুষটা সইতে পারবে? তার মতো ভালো মানুষটার সাথেই আল্লাহ্ এমন কেনো করছে? মানুষটা কি সুখের মুখ দেখতে পারবে না? আমি আর ভাবতে পারছি না। মাথায় কেমন যেন একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেনো ক্রমাগত হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে।
আমি শাহেদকে ডেকে বললাম, “তোমায় একটা কথা বলি? রাখবে আমার কথা?”
শাহেদ কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে আমার কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে আমার দু’হাত নিজের দু’হাতে নিয়ে বললো, “আমি আমার মহারাণীর কোন কথাটা শুনি না? আদেশ করুন মহারাণী”
“রেগে যেও না। শোনো আমার কথা। আম্মা বিছানায় পড়ে আছে। মেয়েটা এখনো অনেক ছোট। তুমি একটা বিয়ে করো শাহেদ। আমি যাওয়ার আগে একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ দেখে যেতে চাই”
শাহেদ নিজের হাতগুলো আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ওর চোখ টকটকে লাল হয়ে গেছে। ও রেগে গিয়ে বললো, “এইসব ফালতু কথা আর বলবা না। আমার জীবনে অন্যন্যা ছাড়া আর কেউ আসবে না।”
তারপর আমার বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বললো, “আর তুমি কোথাও যাবে না কোথাও না। আল্লাহ্ এতো নিষ্ঠুর না। আমার থেকে তোমাকে কেড়ে নিবে না”
শাহেদ শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। হঠাৎ করে চোখের সামনে সব ঘোলা হয়ে আসলো। খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আবছাভাবে দেখলাম কারা যেনো দৌড়ে আসছে। কে আসছে? শাহেদ?
.
যখন চোখ খুললাম। দেখি আমি একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। সারাদেহ মুখ জুড়ে কত কিছু লাগানো। আমার মনে হচ্ছে আমি যেনো অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। শ্রেয়াকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ডাক্তার রাজি হচ্ছে না। আমি অস্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছি ডাক্তার বলছে, “পেসেন্টের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা এই মুহুর্তে ভিতরে কাউকে এলাও করতে পারবো না”
আমি নার্সকে অনুরোধ করলাম। তারা শুনছেই না। ডাক্তারকে ডাকছে। আমার অবস্থা নাকি খুব খারাপ। আমি বুঝতে পারছি না। বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে একটু দেখবো। ডাক্তার হয়তো বুঝেছিলো আমার হাতে আর সময় নেই তাই অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও শ্রেয়া আর শাহেদকে ভিতরে ঢুকতে দিলো। কিন্তু বলে দিলো আমাকে বিরক্ত না করতে। চুপচাপ দেখে চলে যেতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শ্রেয়া এসেই আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। মাকে ছাড়া মেয়েটা কি কখনো থেকেছে নাকি? শ্রেয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো, “মা তোমার কিছু হবে না। আমি মাটির ব্যাংক ভেঙে সব টাকা মসজিদে দিয়ে এসেছি। বাবাইকে বলে ফকিরকে খাবার কিনে দিয়েছি। বাবাইয়ের সাথে নামাজ পড়েছি। বাবাই বলেছে আল্লাহ্ তোমাকে একদম সুস্থ করে দিবে”
মেয়েটা ফুঁপিয়ে কাঁদে, মুখ তুলে আমার হাত ধরে বলে, “এই তোমার গা ছুঁইয়ে বলছি আমি আর দুষ্টামি করবো না। লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবো। মিসের হোমওয়ার্ক করবো। তুমি আমায় ঘুমপাড়ানি গান শুনাবে তো মা?”
আমি কোনো কথা বলতে পারছি না। একদিকে নিদারুণ কষ্ট অনুভূত হচ্ছে অন্যদিকে একটা সাজানো বাগান দেখছি। শ্রেয়া খেলছে। আমি আর শাহেদ হাসছি। দম বন্ধ হয়ে আসছে। শাহেদের হাতটা খুব ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। ঠিক যেমনভাবে শ্রেয়া পৃথিবীতে আসার দিন শক্ত করে আমার হাতটা ধরে রেখেছিলো। সেই তীব্র যন্ত্রণাতেই মানুষটার ছোঁয়ায় কী যে এক স্বর্গীয় সুখ অনুভূত হচ্ছিলো। আমি জানি সে হাতটা ধরলেই আমার যন্ত্রণা কমে যাবে। একদম কমে যাবে। আমি শ্রেয়ার মাথায় একটা হাত রেখে আরেকটা হাত বাড়িয়ে দিলাম শাহেদের দিকে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। দু’চোখে কি নিকষ কালো পর্দা নেমে আসছে। আর একটু সময়? অন্তত শাহেদের হাতটা ধরার সময়টুকু। শাহেদের হাতটা এতো ধীরে কেনো এগোচ্ছো? আমার প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। প্রচুর। প্লিজ শাহেদ হাতটা একবার ধরো। একবার! শেষ একটা দীর্ঘ শ্বাস!