যে ভালোবাসা কোনদিন শেষ হয়না

যে ভালোবাসা কোনদিন শেষ হয়না

সময়টা শ্রাবণ মাস ছিলো, প্রচুর ঝড় আর বৃষ্টির দিন। অচেনা একটি শহরে দুজন হারিয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা করে পা বাড়িয়ে ছিলাম এক অনিশ্চিত জীবনের পথে। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার আমি এবং আমার হিয়াবতি। কোথায় যাবো, আমাদের পরবর্তী ঠিকানা কোথায় হবে কোন কিছুই আমাদের জানা ছিলো না। অচেনা শহরের গলিতে আমরা যে কথাটি জানতাম সেটা হলো শুধু ভালোবাসার। ভেজা শরীরেই যখন হিয়াবতি আমাকে জরিয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেছিলো এই পাগল সুখ কি পাও? তার প্রশ্নের উত্তরে আমার বুকের হৃদস্পন্দন যেন কয়েক হাজার গুন বেড়ে গিয়েছিলো। সুখের জোয়ারে চক্ষুদ্বয়ের কোনায় কোনায় সুখপানি এসে জমা হয়ে জানান দিচ্ছিলো, আমি আজ শুধুমাত্র সুখি নই, আমি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক যার কাছে এমন এক হিয়াবতি রয়েছে, যার নামে সমগ্র পৃথিবীর ভালোবাসা কুরবান।
নির্জন রাস্তায়, একে অপরকে জরিয়ে ধরে ঠিক কতক্ষন ছিলাম তা জানা নেই। তবে সময়টা যতক্ষনই হোক না কেন, এই সুখের সময়ের বিবরণ দেবার মত শব্দগুচ্ছ সৃষ্টি করা অসম্ভব লাগছে আমার কাছে। শ্রাবণ মাসের সেই বৃষ্টির মধ্যে আমাকে জরিয়ে রেখেই আমার হিয়াবতি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। আমি যখন বুঝতে পারলাম হিয়াবতির দেহ থেকে তার রুহ আলাদা হয়ে গিয়েছি। তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরা সেই দেহ নিথর হয়ে পড়লো। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম তাকে জরিয়ে ধরেই। আমি চাইনি এই মুহুর্ত কেটে যাক, আমি চাই আজ এই পৃথিবী থেমে যাক, সময়ের চাকা যেন আর কোনদিন না ঘুরে, এখানে সব স্তব্ধ হয়ে যাক। এইখানেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক, শত জনম অপেক্ষা করে পাওয়া এই সুখ কোনভাবেই যেন হারিয়ে না যায় এই কামনা মনের মাঝে বিরাজমান। আর হিয়াবতির কোমল দেহ আমার বুকে, আর আমি নিরব এক বোবাপাথর প্রেমিক, ঠায় আকাশের দিকে তাকিয়ে, হাজারটা প্রশ্ন বিধাতার কাছে রেখে দিয়ে, উত্তরের অপেক্ষা করে যাচ্ছি। চোখ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি ঝরছে, যে পানির রেশ বৃষ্টির পানির কাছে তলিয়ে যাচ্ছে বার বার, চোখের পানির প্রশ্নগুলোকেও বৃষ্টি নামক পানি রাক্ষুসে হয়ে গিলে গিলে খেয়ে গেলো।
আরমাত্র কয়েক মাইল দুরেই কন্যাকুমারী নদী, আমার আর হিয়াবতির ঠিকানা এই কন্যাকুমারীর নদী। আমি তাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কন্যাকুমারী নদীতে তাকে নিয়ে ভেসে যাবো নাম না জানা কোন এক তীরদেশে। তাকে কাঁধে তুলে, কন্যাকুমারী নদীর দিশায় হাঁটতে লাগলাম। যত টা কদম দিলাম নদীর পথে ততইবারই এক দীর্ঘ নিশ্বাস রেখে গেলাম এই পথের মাঝেই। অবশেষে নদীর তীরে আসার পর। হিয়াবতিকে নদীর কিনারায় শুয়েই রেখে, আমি ভেলা বানানোর জন্য কলা গাছ, আর বাশের ব্যবস্থা করতে পার্শ্ববর্তী গ্রামে ছুটে গেলাম। সেখান থেকে তিনটি কলাগাছ এবং বাশের ব্যবস্থা করে, একটি ভেলা তৈরি করে তাকে সেটায় উঠালাম, এবং আমিও উঠে পড়লাম। পায়ের জোরে ভেলাকে নদীর মধ্যবর্তী স্থানে এনে হিয়াবতিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলাম। এবার ছেড়ে দিলাম ভেলাকে নদীর স্রোতের কাছে, নিয়ে যাক যেথায় খুশি আমাদের, নিয়ে যাক নাম না জানা এক তীরদেশে। তাকে ভেলার উপরে রেখেই শুয়ে থাকা অবস্থায় অতি যত্নে রাখা ডায়রী আর কলমটা বের করে জীবনের শেষ গল্পটি লিখতে শুরু করলাম।
স্বপ্ন দেখার জন্যই মানুষ বেঁচে থাকে। স্বপ্নহীন কোন মানুষ বাঁচতে পারেনা। আমার স্বপ্ন দেখার সময়টা শুরু হয়েছিলো বাল্যকালেই। জন্মের কয়েক মাস আগেই বাবা মারা গিয়েছিলেন। কোলেপিঠে করে মানুষ করা আমার মা যখন আমার বয়স ৮ তখনই পরপারে পারি জমান। আপন বলতে যখন কেউ ছিলো না। তখন আপনের দাবী নিয়ে আমার খালা আমাকে লালন পালন করেছিলেন কয়েকবছর। যতই বড় হচ্ছি ততই বুঝতে পারলাম, সেও আমার আপন না। আমাকে লালন পালন করার পেছনের একটাই কারণ ছিলো, আমার বাবার যতটুকু স্বয়সম্পত্তি আছে তা নিজের করে পাবার জন্য। তারঘরেও সন্তানাদি ছিলো, সে তাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। খালু তো আমাকে সহ্য করতে পারেনা বললেই চলে। কথায় কথায় খালুর মুখে যে কথাটি শুনতাম তা হচ্ছে, জমির ফ্যাসাদ না হলে কোনদিন এই আপদ ঘাড়ে তুলতাম না। খালুর সেই কথা বুঝতে বুঝতে আমার বয়স তখন আঠারো। উনিশ বছর বয়সে আমি সবকিছু তাদের নামে করে দিয়ে একটি কথাই বলেছিলাম, ‘‘দুর্বলতার সুযোগ নিতে আপনের পরিচয় না দিয়ে শত্রু পরিচয় দিয়েও নিজ কাজ হাসিল করা যায়”। তারা আমার কথা কতটুকু বুঝতে পেরেছিলো তা আমার জানা নেই, তবে তাদের যথেষ্ট বুদ্ধি রয়েছে, যার ভিত্তিতে আমি বলতে পারি আমার কথা ভালো করেই বুঝতে পেরেছে।
ঘর ছেড়ে তো বের হয়ে গিয়েছি, শেষ কোথায় আশ্রয় পাবো তা জানা নেই। লোকমুখে শোনা, ঢাকায় নাকি সবাই বাস করতে পারে, ভেদাভেদ রয়েছে এখানেও তারপরেও যে যার মত বাঁচতে পারে। এখানে কেউ কাউকে চিনে না, কেউ কারো জন্য কাঁদে না, কেউ কারোও জন্য ভালোবাসা দেখায় না। স্বার্থপরতার আরেক নাম ঢাকা। আমিও এমন একটি শহরে যেতে চাই, যেখানে কেউ কারোও আপন না, নিজ নিশ্বাসকে কেন্দ্র করে সবার বেঁচে থাকার চেষ্টা মাত্র।
কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা কিভাবে আসা যায়, তা খোজ করতে লাগলাম। খোঁজ পেলেও গাড়ি ভাড়া ছিলো না আমার কাছে। অনেক মালবাহী ট্রাক ঢাকা যাবার জন্য মাল বোঝাই করতেছে। একজন ড্রাইভার এর কাছে গিয়ে আমার অসহায়ত্বের কথা বললে, সে তার সাথে ঢাকা নিয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা করে তবে তার ট্রাকের মাল তুলে দিতে হবে, এবং ঢাকা যাবার পর সেই মাল গোডাউন পর্যন্ত পৌছে দিতে হবে। তার কথায় রাজি হয়ে, মাল তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। রাত ৯ টা নাগাত সে ট্রাকের চাকা ঘুরিয়ে ঢাকার পথে চলতে লাগলো। পরের দিন সকাল ১০টার সময় ঢাকা আমিন বাজার এসে পৌছালাম। এখানে আসার পর, তার ট্রাকের সব মাল নামিয়ে দেবার পর, সে আমাকে খুশি হয়ে ২০টাকা দিলেন। আমি টাকাটা হাতে নিয়ে, কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। এই টাকার জন্য আপন পর হয়ে যায়, পর আবার আপন হয়ে যায়। এত শক্তি নিয়ে চলতে থাকা এই কাগজের জন্যই হয়ত পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। স্কুলবইতে পড়া যে পৃথিবী আমি চিনি বাস্তবতার পৃথিবী তার ঠিক উল্টো গতিতে চলে। টাকার ছাপ দেখতে দেখতে কখন যে চোখের কোনে পানি জমলো, সেই সময়টা যেন কোন এক দৈত্যের মত এসে চোখের লোনাজল বের করে চলে গেলো।
আমাকে বিদায় দিয়ে ড্রাইভার সাহেব চলে গেলো। এই শহর আমার জন্য অচেনা তেমনি অচেনা এখানকার মানুষ। কয়েক ঘন্টা একই জায়গায় দাড়িয়ে রইলাম, কেউ একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করলো না, কেন আসছো, কার কাছে আসছো। সবাই ব্যস্ত টাকা উপার্জনের জন্য। চারিপাশের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে দুপুর শেষ হয়ে বিকেল হতে চলল। ইতিমধ্যে পেটদানব নাড়া দিয়ে উঠলো, পেটের মধ্য থেকেই দানবটা চেঁচাচেমি করতে লাগলো ‘‘আমার ক্ষুদা পেয়েছে আমাকে খাবার দে”। তার ডাকে সাড়া না দিয়েও উপায় নাই। পকেট হাতরিয়ে টাকার নোটটাকে বের করে কয়েকবার দেখে, খাবারের সন্ধানে একটি হোটেলের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেখানে ডালভাত খেয়ে ৫ টাকা দিয়ে, বাকি ১৫ টাকা বুঝে নিয়ে আবার অনিশ্চয়তার শহরে বেড়িয়ে পড়লাম।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেঁচে থাকার জন্য, একটি কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় কাজের হামাগুড়ি দিলাম সারাদিন, কোন কাজ বা থাকার ব্যবস্থা হলো না। রাত্রীবেলা ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমিন বাজারের ওভার ব্রিজের উপর শুয়ে রইলাম। ভোরের ডানা আকাশে মেলার আগেই, অনেক ট্রাক ভর্তি মালগাড়ী দেখতে পেলাম বাজারের সামনে। ট্রাকগুলো দেখে আমার গতকালের কথা মনে পড়ে গেলো। আমি ট্রাক থেকে মাল নামিয়ে দিয়েছিলাম বলে ড্রাইভার আমাকে ২০ টাকা দিয়েছিলো। যদি আজকেও সেই কাজ করা যায়, তবে পেটের জোগান হয়ে যাবে। যে ভাবনা সেই কাজ, ব্রিজ থেকে নেমে বিভিন্ন ড্রাইভারের কাছে গিয়ে কাজের কথা বললাম। অনেকেই কাজ দিতে রাজী হয়ে গেলো। আমার জীবনের প্রথম কাজ শুরু করলাম, কুলির কাজ হিসেবে। টানা ৩ দিন ব্রিজের উপরেই থেকেছি, এবং ভোর বেলা কাজ করে যে টাকা পেয়েছি সেই টাকায় পেট পালতেছি। এভাবে চলতে চলতে একজন দোকানদারের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো। তার সাথে কথা বলে থাকার ব্যবস্থা করে নিলাম। সেই যে আমার কুলির কাজ শুরু হয়েছিলো টানা ৩ বছর আমি একই কাজ করে বেশ ভালোই ছিলাম।
হয়ত পেটে ভাতে আর থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম কিন্তু মনকে ভালো রাখার কোন উপায় এখনো বের করতে পারিনি। ভাগ্যবশত আমি কয়েক ক্লাসের গন্ডি পেড়িয়েছিলাম। ইংরেজি না জানলেও বাংলা লিখতে পড়তে তেমন কষ্ট হতো না। অবসর সময়ে ডায়রী ভর্তি শুধু আমার চাওয়া পাওয়ার কথা লেখা শুরু করলাম। যদিও আমার লেখা পড়ার মত মানুষ ছিলো না, তবে লিখতে ভালোবাসতাম। অবসর সময়টা ছুঁ করে কেটে যেত লেখার মধ্যে।



একদিন ভোরবেলা গাড়ি থেকে মাল নামিয়ে গোডাউন এ রাখতেছিলাম, আমিন বাজারের রাস্তা কোনকালেই ফাঁকা ছিলো না। পাখির ঝাকের মত হাজারো গাড়ি এই রোডে শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে চলে যাচ্ছে হরদম। এই চলন্ত রাস্তাতে হুট করে একটা দুর্ঘটনা ঘটলো, এক মোটর আরোহীকে প্রাইভেট গাড়ি ধাক্কা মারার কারনে, মোটর আরোহি কয়েকবার পল্টি খেয়ে রাস্তার উপর পড়ে রইলো। মাথার উপর রাখা বস্তাটা মাটিতে নামিয়ে ছুটে গেলাম তাকে ধরতে, মাথা ফেটে গেছে মাথা থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগলো। আমি ছোট বেলা থেকেই রক্তকে বেশ ভয় পেতাম, কিন্তু লোকটার অবস্থা বেশ সুচনীয় হবার কারনে সেই ভয়টাও চলে গেলো। তাকে আড়পাজ কোল করে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে ছুটে গেলাম। সেখানে নেওয়ার পর ডাক্তার সাহেব আমাকে বললো, এইটা পুলিশ কেইস, ঢাকা হাসপাতাল নিয়ে যান। আমি ঢাকা আসার পর একবার ঢাকা হাসপাতাল গিয়েছি, কিন্তু লোকটার অবস্থা ভালোনা, এখনই যদি তার প্রাথমিক চিকিৎসা না হয় তবে রক্তক্ষরণের কারণে মারাও যেতে পারে। আমি ডাক্তারকে অনুরোধ করলাম, সে যেন তার প্রাথমিক চিকিৎসা হলেও করে দেয়, তারপরে আমি তাকে ঢাকা হাসপাতাল নিয়ে যাবো। সে আমার কথায় রাজী হলো, এবং লোকটির প্রাথমিক চিকিৎসা করলো। চিকিৎসা চলাকালীন তার রক্তের টান পড়লে, ভাগ্যবশত ভাবে আমার রক্তের গ্রুপ তার সাথে মিলে গেলে, তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।
তারপর তাকে আর ঢাকা হাসপাতালে নিতে হয়নি, পুলিশ কেইস করে, তার চিকিৎসা সেলিনা হাসপাতালেই করানো হলো। সে দুইদিন পর্যন্ত অজ্ঞান ছিলো, আমি প্রতিদিন কাজ শেষ করে তার খবর নিতে আসতাম। পুলিশ তার পরিবার খুঁজে বের করে ইতিমধ্যে তাদের জানিয়ে দিয়েছে। তার পরিবার আসার পর আমি হাসপাতালে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।
সেই দিনের ঘটনার একমাস পর, একদিন লোকটি আমিন বাজার এসে আমার খোঁজ করতে লাগলো। আমাকে খুঁজে বের করে, অনেক প্রশংসা এবং ধন্যবাদ জানালো। তার সাথে আমাকে তার বাসায় এক অনুষ্ঠানের নেমন্তন্ন দিয়ে গেলো। সেখানে যেতে সংকোচবোধ হলেও, ভেতরে ভেতরে এক আনন্দ কাজ করতেছিলো, এতগুলো বছর ধরে কেউতো আর আমাকে এভাবে ডাকেনি। তার ডাকে সাড়া না দিয়েও পারলাম না। বড়লোক মানুষদের সাথে আমার মত মানুষের চালচলন আকাশ পাতাল ব্যবধান। কি পোষাক পড়বো, সেখানে গিয়ে কিভাবে কথা বলবো, কোন কাজ থেকে বিরত থাকবো, ইত্যাদি অনেক ভাবনাই আমাকে পেরেশানি দিতে লাগলো। অবশেষে আমার পছন্দের কালো শার্ট আর প্যান্ট পড়ে তাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
আজ এখানে তার বড় মেয়ের বিয়ে, উপহার হিসেবে তার জন্য দামী কিছু না আনতে পারলেও খালি হাতে আসিনি। আমাকে দেখে সে সবার সাথে আদবের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো, তার সাথে তার জীবন বাঁচানোর জন্য শতশত প্রশংসার ঝুড়ি খুলে বসলো। বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে, চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। নানান সাজে মানুষ এসেছে, কেউ কোর্ট টাই, কেউ ধুতি কুর্তা আরও নাম না জানা নানান ফ্যাশনের কাপড়। অধিকাংশ মহিলা শাড়ী, উঠতি বয়সী মেয়েরা, লেহেঙ্গা থ্রিপিস সহ জিন্স টপ পড়েও অনেক মানুষের ভিড় জমেছে। এরই মধ্যে মাইকিং হলো, নাচের অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে, আমি সময় বিলম্ব না করে নাচের অনুষ্ঠান দেখতে চলে গেলাম। দশজন মেয়ে আর দশজন ছেলে মিলে গ্রুপ ডান্স করবে। সবাই স্টেজের উপর উঠে নাচ শুরু করলো। আমি সবার সামনের লাইনে দাঁড়িয়ে নাচ উপভোগ করতেছিলাম। এমন সময় পেছন থেকে কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে সাইডে চাপানোর চেষ্টা করতেছে। নাচের অনুষ্ঠানে মগ্ন ছিলাম তাই খানিকটা বিরক্ত লাগছিলো ব্যাপার টা। কোন মহাশয় আমাকে ডিস্টার্ব দিচ্ছে তা যাচাই করার জন্য ঘুরে তাকালাম, ঘুরে তাকানোর পর তাকে বলার মত কোন শব্দ আমি পেলাম না। এ কোন মহাশয় না এ যে এক মহীশয়নী। বাংলা শাড়ীটা খুব সুন্দর করে কুঁচি দিয়েছে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত কুমারের তৈরি মাটির অলংকার পড়েছে, কপালের এক মধ্যখানে ছোট টিপ পুর্ণিমা চাঁদের মত লাগছে। হাতে পায়ে লাল রাঙ্গা মেহেদি দিয়ে অপরুপ সাজে সজ্জিত। প্রথম কোন মেয়েকে দেখে, আমার বুকের মধ্যে উথানপথন শুরু হয়েছে, আমি একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। সে আমার অবাক হওয়াকে উপেক্ষা করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সে সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাততালি দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার উৎচ্ছাস এত বেশী হয়ে যাচ্ছিলো যে মাটি থেকে দুই ফিট উপরে উঠে যাচ্ছিলো, আনন্দের জোয়ারে। আমি পুরো অনুষ্ঠান শুধু তাকে দেখে গেলাম। তার চঞ্চলতা, তার লাজুক হওয়া, তার কন্ঠ স্বর, তার মায়াবী মুখ সব কিছুই আমাকে গ্রাস করতে লাগলো। তার সাথে কথা বলার জন্য হৃদয়টা ছটফট করতে লাগলো, কিন্তু সাহস হলো না তার সাথে কথা বলার। আজকের এই অনুষ্ঠানে যদি তার সাথে কথা না হয়, তবে হয়ত আর কোনদিন কথা হবে না। এই ভাবনা মনে আসলেও ঘাবড়ে যেতাম, যাকে পাইনি, তাকেই হারানোর কষ্ট অনুভব করতে লাগলাম। এই অনুভবের নাম কি তা জানা নেই।
এক সময় অনুষ্ঠানও শেষ হতে চলল। সবাই যে যার বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, কিন্তু মেয়েটার সাথে কথা বলা হয়ে উঠছে না। যখন আমারও বাসায় চলে আসার সময় হলো, আংকেল এর কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় সে ওখানে উপস্থিত ছিলো। আমি বার বার কথা বলতে গিয়ে আটকিয়ে যাচ্ছিলাম। আংকেল মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলে জানতে পারলাম, মেয়েটা তার বড় ভাইয়ের। চিটাগাং থেকে এসেছে, বিয়ের অনুষ্ঠানে। সাধারন হায় হ্যালো তেই আমাদের কথা শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু তার সাথে কথা বলার তৃষ্ণা আমার বেড়েই যাচ্ছিলো। কোন রাস্তা খুজে পেলাম না, কথা বলার।ইতিমধ্যে কন্যাকে বিদায় দেওয়া হয়েগেছে, রাত ১১টার বেশী বাজে, আমার চলে আসার সময়টাও হয়েগেছে। যখন আমি চলে আসতে ছিলাম, আংকেল, মেয়েটা সহ আরোও কয়েকজন আসলো আমাকে বিদায় দিতে, বাড়ির পাশ দিয়েই মেইন রাস্তা সেখান থেকেই আমাকে বাস ধরতে হবে। তারা সকলে রাস্তা পর্যন্ত এসেছে, কিন্তু আমার যাবার ইচ্ছা হচ্ছে না। মনে মনে ভাবছি যেন এখানেই সময়টা থেমে যাক, আমি আরোও কিছুক্ষণ মেয়েটাকে দেখে মনের সুধা মিটাই। কিন্তু আমার ভাবনা কোনদিন বাস্তবে পরিনত হবেনা এই ভাবনাটা আমার হৃদয়কে কুকড়ে খাচ্ছে।
আমি বাসের জন্য অপেক্ষা করছি, বাস আসলেই আমাকে চলে যেতে হবে এই স্বপ্নের জগতকে এখানে কবর দিয়ে। হটাৎ মনে পড়লো, আমার প্যান্টের পকেটে আমার ছোট ডায়রীটা রয়েছে, মাথায় একটি ভাবনা আসলো, এই ডায়রীটা যদি তাকে কোনভাবে দেওয়া যেত তবে মন্দ হতো না। তবে সবার সামনে এমনটা করাও সম্ভব না। তাই বুদ্ধি আটলাম, বাসে উঠার সময় ইচ্ছে করে ডায়রীটা ফেলে দিবো, যদি আল্লাহ চায় তার সাথে আমার আবার কথা হবে, আবার দেখা হবে তবে এই ডায়রীটা সেই পাবে। বাসে উঠার সময় নিজ ভাবনার মত ডায়রীটা ফেলে দিলাম। পেছন ফিরে আর তাকালাম না, যদি কেউ বুঝে যায় এই ভয়ে, বাস চলতে লাগলো আমিনবাজারের দিকে। বাস যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, আমার স্বপ্ন ততই পেছনে পড়ে যাচ্ছে। স্বপ্নকে বুকের মধ্যে আটকে রেখে বাস থেকে নেমে বাসায় চলে গেলাম। কিন্তু সেই মেয়ের কথা কোনভাবেই ভুলতে পারলাম না, সে ডায়রীটা পেয়েছে নাকি রাস্তার উপরেই যাযাবরের মত পড়ে আছে, এই ভাবনাটা আমাকে সবচেয়ে বেশী ভাবিয়েছে। বিছানায় শুয়ে যতই ভেবে যাচ্ছি, ততই যেন এক হাহাকার সৃষ্টি হচ্ছে বুকের মাঝে। ভাবনার শহরে হাটতে হাটতে কখন যে চোখ বুঝে গিয়েছে, তা বলা মুশকিল। পরের দিন থেকে সেই আগের রুটিন নিয়ে জীবন চক্রে জরিয়ে পড়লাম।
তারপর থেকে কেটে গেলো আরোও দুই বছর, তার কোন খবর পেলাম না। শুধু আশাতেই বুক বেঁধে গেলাম। আবার জীবন রুটিনের কোন কিছুই পরিবর্তন হলো না। দুই বছর পর সেই আংকেলের সাথে আবার দেখা হয়ে গেলো, তার থেকে জানতে পারলাম তারাও চিটাগাং এ বাস করে এখন। ঢাকা শহরের এই যান্ত্রিকতা পেড়িয়ে তারা গ্রাম্য প্রাকৃতিক পরিবেশে সুখেই নাকি আছে। কথার তালে সে বলে উঠলো, আমার একটি জিনিস নাকি তার ভাইয়ের মেয়ের কাছে আছে, এবং সে ঐ জিনিসটা আমাকে ফেরত দিতে চায়। এজন্য সে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চায়। কথাটি শুনতেই আমার বুকে এক সুখের বাতাস বয়ে গেলো, কয়েকদিন আগেই একটি মোবাইল কিনেছি, সেই নাম্বারটা আংকেলকে দিয়ে দিলাম। আংকেল বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আর আমি সেই সময় থেকে অপেক্ষা করে যাচ্ছিলাম কখন এই মোবাইলের রিং বেজে উঠবে আর অপরপ্রান্ত থেকে এক মায়াবী কন্ঠ ভেসে আসবে, আর সে বলবে আমি সেই মানুষ।
টানা তিনদিন অপেক্ষা করার পর, মোবাইলের রিং বেজে উঠলো। আমার ভাবনার মতই অপরপ্রান্তে মায়াবী কন্ঠধারী সেই মেয়েটি ছিলো, যার এক নজর চোখের চাওনি, আমার সারাজীবনের কারাদন্ড, যার মুখের একটি বুলি, আমার জনমভরের সুখ, যার হাতের একটু স্পর্শ আমার ইহকালের বেহেশত। আমাদের কথা চলতে থাকলো, নানা গল্প আর জীবনচক্রের গল্প। একবছর আমাদের ফোনেই আলাপ হলো, তাকে আমি নিজের মত করে নাম দিলাম হিয়াবতি। তার নামে সর্বদা কবিতা, গল্প ডায়রী ভরে লিখতাম, আর তাকে শোনাতাম। বছর শেষে তার সাথে দেখা করতে চিটাগাং গেলাম, চিটাগাং শহরের মুরাদপুরে তার সাথে আমার প্রথম দেখা, এবং ভালোবাসার প্রকাশ করি। সেও রাজী হয়েছে। আমাদের সম্পর্ক এখন মানবতার সম্পর্ক থেকে আত্মার সম্পর্কে পরিনত হয়েছিলো।
তার সাথে কেটে গেলো আরোও কয়েকবছর, রাগ অভিমান, আর ভালোবাসার গল্পঝুড়িতে সময়ের মোড় কোনদিক থেকে কোনদিকে যায় তা বোঝাও মুশকিল। ভালোবাসার চার বছর পর, একদিন জানতে পারলাম তার বাবা নাকি তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে তাদের স্থানীয় এক ছেলের সাথে। আমি আশাহত হবার আগেই সে বলে ফেললো, আমি এ বিয়ে করবো না, তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও, নয়ত আমার লাশ বের হবে এই বাড়ি থেকে। আমার তো এই পৃথিবীতে কেউ নেই, আমার জীবন নিয়ে তেমন ভাবনা কোনদিন কাজ করেনি। কিন্তু হিয়াবতির তো সবাই আছে, আমার মত এক দিনমজুর এতিমের জন্য সে সবাইকে কষ্ট দিবে এটাও মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিলো।
আমি চিটাগাং এর পথে পা বাড়ালাম। সামনে কি হবে তা আমি জানি না। তবে ভালো খারাপ যেটাই হোক না কেন তা মেনে নেবার প্রতিজ্ঞা করলাম নিজের কাছেই। আমি সরাসরি হিয়াবতির বাড়িতে উঠলাম, এবং তাদের সবাইকে আমার নিজ কথা, হিয়াবতির কথা জানালাম। আগে থেকেই জানতাম তারা আমাকে মানবে না, হয়ত অপমান করবে, কিন্তু গায়ে হাত দিবে তা জানা ছিলো না। হিয়াবতির বড় ভাই আমার দিকে তেড়ে এসে, আমাকে চড় মেরে বসলো। কোন কিছু বললাম না, চুপচাপ দাড়িয়ে রইলাম। যখন পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাহিরে, তখন হিয়াবতি কে বললাম, ‘‘সব ভালোবাসা বাস্তবতা পায়না। কিছু ভালোবাসা অপেক্ষা করে, পরকালে পাবার জন্য। তোমার জন্য চাইলে জীবনটাই দিতে পাড়ি, তেমনি পাড়ি তোমার জন্য বাঁচতে। আমি কোনদিন পরিবার, বন্ধুত্ব, আত্মীয় এসব মানুষের সোহাগ আদর, ভালোবাসা কিছুই পাইনি। তুমি পেয়েছো তাই হয়ত বুঝতেছো না, এই মানুষগুলোকে কত প্রয়োজন জীবনে চলার পথে। আমি প্রতিদিন দিন মজুরীর কাজ করে, যা পাই তা দিয়ে তোমাকে কত ভালো রাখতে পারবো তাও জানা নেই। তাই আমি বলছি তুমি তোমার পরিবারের কথা মেনে নেও, আমাদের ভালোবাসা কবিতার শব্দ হয়ে, বাতাসের মোড় হয়ে, নদীর ঢেউ হয়ে, আজীবন থাকবে। তুমি আমার হিয়াবতি ছিলে, আছো, থাকবে। তোমাকে হয়ত দেহ থেকে আলাদা করতেছি, কিন্তু আমার নিশ্বাসে তুমি সর্বদা চলাচল করবে। প্রতিজ্ঞা করতেছি, জীবনের যে মোড়েই থাকো তুমি, তোমার কষ্টের সময়, দুখের সময় আমি হাজির হয়ে যাবো। তুমি ভালো থেকো, অনেক ভালো থেকো।”
কথাগুলো বলে আমি যখন ফিরে আসছিলাম, তখন হিয়াবতি পাগলের মত চিৎকার করে আমাকে আটকাতে চেয়েছে, কিন্তু আমি আমার অনিশ্চিত জীবনে তাকে এনে তার কষ্টের দাবীদার হতে চাইনি। নিজের অনুভূতিকে পাথরে পরিবর্তন করে সেখান থেকে চলে আসলাম। সেই চলে আসার পর, শুধু কল্পনায় হিয়াবতিকে লালন করলাম পুরো ৩০ টি বছর।



ত্রিশ বছর পর, হিয়াবতির খবর পেলাম। এখন আমি আর কুলির কাজ করিনা, আমিনবাজারে নিজ দোকান নিয়েছি, বিয়ে আর করা হয়নি, কারো সাথে মনের লেনদেন ও করা হয়নি। হিয়াবতির স্বামী আমাকে খুঁজে বের করেছে হিয়াবতির শেষ স্বপ্ন পুরণ করতে। হিয়াবতিকে আমি সর্বদা বলতাম তাকে নিয়ে কন্যাকুমারী নদীতে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাবো কোন এক নাম না জানা তীরে। তার স্বামীর থেকে জানতে পারলাম, বিয়ের এক বছর পরেই হিয়াবতির সাথে তার ডিভোর্স হয়ে যায়। ডিভোর্সের কারন ছিলো, হিয়াবতির একটি কথা, ‘‘তুমি আমার স্বামী হয়ে আমার দেহকে পেয়েছো, কিন্তু আমার মনটা অন্যকারো কাছেই আছে।” অনেক চেষ্টা করেও তার মন থেকে আমাকে মুছতে না পারার কারণে তারা আলাদা হয়ে যায়। আর এতটি বছর সে আমার সাথে যোগাযোগ করেনি, অভিমানের কারণে। সে একা থাকবে তারপরেও অভিমান ভেংগে আমার কাছে ফিরবে না।”
তার স্বামীর থেকে পরের ঘটনা যা জানলাম, তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সে বাঁচা মরার লড়াই করছে হাসপাতালের বেডে বয়সের ভারে নানা রকম রোগ-ব্যাধির সাথে যুদ্ধ করে আর পেড়ে উঠছে না। আমি তার প্রাক্তণ স্বামীর সাথে ছুটে গেলাম চিটাগাং। ত্রিশ বছর আগে এই চিটাগাং এর শহরকে পেড়িয়ে ঢাকায় আসা, আর যাওয়া হয়নি সেখানে। আজ ভাগ্য আবার নিয়ে যাচ্ছে আমাকে হিয়াবতির কাছে।



সোজা হাসপাতালে গিয়ে উঠলাম। ৩০৪ নম্বর রুমের শায়িত আছে আমার হিয়াবতি। হিয়াবতি এখন আর আগের মত নেই, চুলে পাক ধরেছে, শরীরের চামড়ায় ভাজ পড়েছে, দেহ নিথর হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার চোখ আজও দীপ্ত তারার মত জলজল করছে। আমাকে দেখে সে মুখ অন্যদিকে ঘুড়িয়ে নিলো, আমি ধীরপায়ে তার কাছে গিয়ে আস্তে করে বললাম ‘‘হিয়াবতি কেমন আছো” সে আমার কথার কোন উত্তর দিলো না। একই কথা কয়েকবার বলার পর, সে বলল ‘‘আমাকে নিয়ে চলো কণ্যাকুমরী নদীর মাঝে, ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাবো নাম না জানা কোন এক তীরে। তোমার দেওয়া প্রতিজ্ঞা রাখার সময় এসেছে।” তার কথা শুনে আমার চোখের কোনে জল ছলছল করে উঠলো। বলার ভাষা পেলাম না, তার হাত ধরে বেডের নিচে বসে পড়লাম। তার হাতের স্পর্শে আমি জীবনের পরিপূর্ণ সুখ পেলাম।
তাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য, সবার কাছে অনুমতি চাইলে, সবাই একটি কথাই আমাকে বলেছিলো, ‘‘তোমার হিয়াবতি কোনদিন আমাদের সাথে ছিলো না। সর্বদা সে তোমার শহরে বিচরণ করতো, তোমার নিশ্বাসের সাথে তার নিশ্বাস চলতো। নিয়ে যাও তাকে কন্যাকুমারী নদীতে ভেসে যেতে তাকে সুখের জোয়ারে।
হাসপাতাল থেকে তাকে নিয়ে বের হবার সময়, ডাক্তারগণ আমাকে জানালেন, তার অবস্থা বড়ই শোচনীয়, যে কোন সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। সবাইকে আমি একটি কথাই বলেছি, পৃথিবীতে কেয়ামত চলে আসুক, সমস্ত মানুষ একদিনেই শত্রু হয়ে যাক, তারপরেও হিয়াবতিকে দেওয়া স্বপ্ন পুরণ করেই দম নিবো। যে ভালোবাসা গত কয়েকযুগ ধরে লালন হচ্ছে মনের ভিতর সে ভালোবাসা আজ গিয়ে বাস্তব হতে যাচ্ছে।”
কথাগুলো বলে তাকে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। কন্যাকুমারী নদীর উদ্দেশ্যে।
হাতের তৈরি কলাগাছের ভেলায় ভাসতে ভাসতে অন্ধকারে কোন তীরে এসে পৌছে গিয়েছি তা জানা নেই। হাতের ডায়রীতে গল্পটি লেখা শেষে হিয়াবতিকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে সুখ সাগরে ভেসে গেলাম ভালোবাসায় ভালোবেসে দেওয়া স্বপ্ন পুরণের স্রোতে।
সেই উত্তাল রাতে কন্যাকুমারী নদী আমাদের নিয়ে এসেছিলো এক ছোটগাঁও ফুলঝুড়ি গ্রামে। সেখানেই হিয়াবতিকে দাফন করা হয়, আর ভালোবাসার প্রহরী হয়ে আমিও সেই গ্রামে নিজ ঠিকানা তৈরি করে বাস করতে লাগলাম। আজ আমার হিয়াবতি অন্ধকার কবরে শায়িত কিন্তু অনুভব করি আমার প্রতি নিশ্বাসে। তার কবর পাশেই বসে বলে যাই, আমার লেখা কবিতা, সেই কবিতাকে সুর করে গাওয়া গানগুলো। সব ভালোবাসা বাস্তব হয়না, কিছু ভালোবাসা অপেক্ষা করে পরকালের। তাই আমিও অপেক্ষারত আছি, সেই অনন্তকালের ভালোবাসা পাবার জন্য। যার কিছু নেই, তার কাছে থাকে শুধু অপেক্ষা, স্বপ্ন পুরণের অপেক্ষা, ভালোবাসার অপেক্ষা।অপেক্ষার আরেক নাম ভালোবাসা, যে ভালোবাসা কোনদিন শেষ হয়না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত