একপা দুইপা তিন নাহ্ আর এগোবেনা বাণী| অনেক দিন অনেক পা ফেলেছে, কিন্তু কই? পৌঁছাতে তো পারেনি| কি অসহনীয় কষ্ট, এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় পা দুটো যেন অচল হয়ে যায়|ওর আদরের ধন সাতরাজার মানিককে ছেড়ে যেতেই বা পারে কই?
ঘরে খাটের একপাশটিতে বসে জানলার বাইরে বিষন্ন হয়ে তাকিয়েছিলো বাণী, মন তার উথালপাথাল| যাবার ইচ্ছা বিন্দুমাত্র নেই,তবু যেতে হবে হয়তো| কিন্তু কেন? অন্য কিছুর জন্যতো পিছুটান নেই,শুধু তার সন্তান| তার সন্তানকে ছেড়ে যেতে হবে সেই আশঙ্কা বাণীকে দিনরাত ত্রস্ত করে রাখে|
খাটে ঘুমন্ত তনয়কে দুচোখ ভরে দেখে বাণী, কি সুন্দর দেখতে হয়েছে| বাণীর ছোটবেলার ছবিটা ঠিক তনয়েরই মতো| পাড়ার সবাই বলে মায়ের মুখের আদল পেয়েছে ছেলে, বাণীর খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছিলো, ভাগ্য ভালো আর হলো কই ছেলের? কাঁদতে পারলোনা বাণী,তার শুকনো চোখে কিছুতেই জল এলোনা| দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও,সেই দীর্ঘশ্বাস ঘুমন্ত ছেলেকেও ছুঁয়ে গেল| কাঁদলে তার মনটা একটু হালকা হতো|
বাণী বেরিয়ে এলো ঘর থেকে| তনয়ের খাবারের সময় হয়ে গেছে,বাড়ির কারোরই সেকথা খেয়াল নেই| গোটা বাড়ীজুড়ে মিলনের বিয়ের ব্যস্ততা| বাইরের ঘরে তারই পরিকল্পনা করছে ননদ ননদাইরা| সেখান থেকে ফিরে শাশুড়ির ঘরে গেল বাণী| শাশুড়ি তখন নতুন হবু বৌমার সুখ্যাতি শোনাচ্ছে তার বোনকে| সেখান থেকেও বাণী ফিরে চলে এলো| মিলন কোথায় কে জানে, বাণীর চোখ এদিক ওদিক মিলনকেই শুধু খোঁজে| এমন সময় তনয়ের কথা মনে পড়ে যায় ওর,ছুটে আসে তনয়ের কাছে|
তনয়ের কখন যেন ঘুম ভেঙে গেছে| কাঁদতে কাঁদতে একেবারে খাটের ধারে চলে এসেছে| বাণী প্রাণপণে আটকায় তনয়কে| তবু তনয় শান্ত হয়না,ওর কান্না বেড়েই চলে| একসময় বাইরের ঘর থেকে ছুটে আসে ওর পিসিরা| তনয়কে ধরে ফেলেই বলে ওঠে, ভাগ্যিস সময়ে এসেছি| নাহলে কি যে হত | ওরা লক্ষ্যও করেনা তনয়ের হাত থেকে ছিটকে পড়া ঝুমঝুমিটা শূন্যে ভেসে খাটের উপর তনয়ের বালিশের পাশেই আবার সুরক্ষিত হয়| একটা ছোট্ট বাতাসের ঘূর্ণি ওঠে ঘর জুড়ে| ছুটে এসেছিলো মিলনও| ও অবাক চোখে দেখে তনয় দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে ফোকলা মুখে হেসেই চলেছে| টাটকা রজনীগন্ধার মালা পরানো ছবির ভিতরে তখন বাণীও হাসিমুখে তাকিয়ে তার ছেলেরই দিকে|
সেদিকে তাকিয়ে মিলন তনয়কে কোলে নিয়ে মনে মনে বলে, আমি জানিনা বাণী,তনয়ের নতুন মা কেমন হবে| ওর ঠাম্মার আশা পূর্ণ হবে কিনা,তবে তুমি যেমন আছো,তেমন করেই তনয়ের কাছে থেকো| তনয়কে রক্ষা ক’রো,নিষ্ঠুর মৃত্যু তোমায় কেড়ে নিলেও আমরা তোমায় কিছুতেই যেতে দেবোনা,তাইতো অন্যদের কথায় তোমার আত্মার মুক্তির ব্যবস্থা আমি করিনি| যদি প্রয়োজন বোঝো তুমিই ইঙ্গিত দিও,আমি তোমার চলে যাবার সব ব্যবস্থা করে দেবো|
মিলনের প্রতিশ্রুতিতে বাণীর বুক থেকে দুশ্চিন্তার বোঝাটা যেন নেমে গেল| ছেলেকে ছেড়ে সে এখন যেতেও চায়না, মিলনের কথায় তাই ছবির ভিতর থেকেই পরিতৃপ্ত হাসিতে তার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো|
………………………………………. (সমাপ্ত) ……………………………………..