আজকে বাসে উঠেই আমার চোখ এদিক ওদিন ঘোড়াঘুড়ি করলো কিছুক্ষন । পরিচিত একটা মুখ খুজছি ।
কোথায় তুমি?
কোথায় ..
এই তো পেয়েছি ।
কাঙ্খিত চেহারাটা দেখতে পেয়ে মনটাই ভাল হয়ে গেল । আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম মেয়েটি এই বাসের ভিতরই থাকবে ।
এটা আমি মাঝে মাঝে ভেবে খুব অবাক হই । অন্য আর কোন বাসে না কেবল মেয়েটি যে বাসটাতে থাকে কেবল সেই বাসটাতেই আমি উঠি ।
একদিন না , প্রতিদিন ।
মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় লোকাল বাসে । খুব সাধারন ঘটনা দিয়ে শুরু । আমার কম্পাসে যাওয়ার জন্য আমাকে অন্তত একটা বার বাস বদল করতেই হয় । সাধারনত সবাই গুলিস্তানেই নামে । কিন্তু আমার ঐ ভিড়ের ভিতর বাসে উঠতে একটু কষ্টই হয় । তাই আমি একটু আগে আগেই নেমে পড়ি ।
প্রেস ক্লাবে নেমে একটু হেটে সচিবালয়ের মোড় থেকে বাসে উঠি । প্রথম যেদিন বাসে উঠেছিলাম মেয়েটি একদম শেষ সিট টার আগের সিটে বসে ছিল ।
আমি ভিড় ঠেলে একটু পেছনের দিকে হাজির হই । মেয়েটির দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম মেয়েটি আমার দিকে অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে আছে । আমি অবাক হলাম ।
মেয়েটির তাকানোর ধরনটা দেখে মনে হল যে আমি সম্প্রতি চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে এসেছি । আমাকে এই লোকাল বাসে উঠতে দেখে সে খুব অবাক হয়েছে ।
এমন একটা ভাব যেন মেয়েটা মনে মনে ভাবছে
এই বান্দর এখানে কি করে ?
এর তো গাছের ডালে ঝোলাঝুলি করা উচিত্!!
এই বেটা বাসের হান্ডেল ধরে ঝোলাঝুলি করে ক্যান ?
সত্যি বলব প্রথম দিন মেয়েটির এই তাকানোর ধরনটা আমার ভাল লাগে নি মোটেও ।
আর বারবার তাকানো ও যাচ্ছিল না । মেয়েটা আবার কি মনে করে বসতে পারে । কিছুক্ষন পরেই একবারে শেষের দিককার একটা সিট খালি হয়ে গেলে আমি ঐ সিট টাতে গিয়ে বসি ।
এখান থেকে মেয়েটা কে ভাল করেই দেখা যাচ্ছে । মেয়েটা বাদামী রংয়ের একটা চুড়িদার সেলোয়ার কামিজ পরে আছে । হাতে একটা বড় হ্যান্ড ব্যাগ । আর একটা এপ্রোন ।
আচ্ছা মেয়েটা তাহলে ডাক্তার ।
সলিমুল্লায় পড়তে পারে অথবা আমাদের ক্যাম্পাসের পাশে যে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ আছে সেটায় পড়ে ।
পরদিন ঠিক আবার দেখা হল মেয়েটার সাথে ।
একই বাসে । আমি পরদিন একটু অবাক হলাম । এর আগে আমি বেশ কয়েকটা বাস আমি ছেড়ে দিয়েছে । ইচ্ছা করেই ছেড়ে দিয়েছি । কেবল এই বাসটা দেখে আমার মনে হল যে কোন মূল্যেই হোক এই বাসে আমার উঠতেই হবে । এমন টা মনে হবার কোন মানে নেই । কেবল মনে হল তাই উঠে পড়লাম !
আমি এই চিন্তাটা বেশি আমল দিলাম না । কিন্তু পরপর তিন দিন যখন একই ঘটনা ঘটলো তখন আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম ।
বারবার কেবল মনে হতে লাগল যে এটা কি কোন ইশারা ?
কেন এমন হবে !
সামনে দিয়ে দশ বারোটা বাস চলে যায় আমার উঠতে ইচ্ছা করে না কেবল যে কোন একটা বাস আসতে দেখেই আমার মনে হয় এই বাসে আমার উঠতে হবে । আর বাসে উঠেই আমার মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে যায় ।
আশ্চার্য বিষয় !
এই কয়দিনে মেয়েটার মনের ভাবও পরিবর্তন হয়েছে । চেহারা দেখলেই বোঝা যায় ! আর আমার কেন জানি মনে হয় মেয়েটাও এই একই ব্যাপার লক্ষ্য করেছে ।
এটা অবশ্যই একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় ! এতো গাড়ীর মাঝে প্রতিটা দিন আমাদের দুজনেয় একটা বাসের ভিতরেই দেখা হয় ।
যদি আমরা এক বাস কাউন্টার থেকে উঠতাম বা একই কোম্পানীর বাসে উঠতাম সেই তাহলে একটা কথা থাকতো !
এই রুটে প্রায় চারটা কোম্পানীর বাস চলে । মেয়েটা একেক দিন একেক বাসে আসে ।
এইটা অবশ্যই একটা বিশ্ময় কর বিষয় ।
আমি যেমন বিষয় টা ডাক্তারনীও নিশ্চই বিষয়টা লক্ষ্য করেছে ।
করতে বাধ্য !
আজ যখন বাসে উঠে মেয়েটার চেহারা খুজছিলাম বুকের ভিতর কেমন একটা অদ্ভুদ অনুভুতি হতে লাগলো । মনের একটা জায়গা বলছিল যে মেয়েটা কে আমি দেখতে পাবো আবার মন্য অন্য একটা অংশ বলছিল যে আজ হয়তো মেয়েটাকে আমি দেখতে পাবো না !
যখন মেয়েটির কাঙ্খিত চেহারাটা দেখতে পেলাম মনের ভিতর একটা আনন্দের অনুভূতি হল ।
মেয়েটার সাথে চোখা চোখি হল ।
মন বলছে মেয়েটাও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল । আমার ওঠার জন্য অপেক্ষা করছিল ।
কিছুক্ষন ভাবলাম কি করবো ? বাস আজ মোটামুটি ফাকাই । মেয়েটি আজও শেষ সিটের আগের সিটে বসে আছে । পেছনের সারিটা একদম ফাঁকা । মেয়েটার পাশের সিট টাও কিন্তু ফাঁকা রয়েছে ।
আজ কি বসবো মেয়ের পাশে বসবো ? কিন্তু মেয়েটার পাশে জানলার সিট টা ফাঁকা । বসতে হলে মেয়েটাকে ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে ! এটা মোটেই শোভন হবে না !
তাহলে ?
পাশে বসতে পারলে ভাল লাগতো !! কিন্তু মেয়েদের মন বলে কথা ! কখন যে কি চায় বোঝা বড় মুশকিল !!
আমি আসতে আসতে এগোতে লাগলাম । ঠিক যখন মেয়েটার কাছ গিয়ে হাজির হলাম তখন একটা অদ্ভুদ ব্যাপার হল ।
মেয়েটা যে সিট টাতে বসে ছিল সেখান থেকে পাশের সিটে চলে গেল ।
যদিও আমি সিওর না কিন্তু আমার মনে হল যে মেয়েটা আমার বসার জন্যই সিট টা খালি করে দিল । যদিও এমন একটা কাজ করার কোন কারনই নাই ।
কিন্তু মেয়েদের আচরন বোঝা যে বড় ঝামেলার কাজ !
এখন দিতো কাজ হতে পারে !
আমি যদি মেয়েটার পাশে গিয়ে বসি মেয়েটা বিরক্ত হতে পারে । যদিও কিছু বলতে পারবে না । কারন এটা পাবলিক বাস । ফাকা সিটে যে কেউ বসতে পারে ।
কিন্তু মনে মনে যদি ভাবে যে পিছনে এতো সিট থাকতে মেয়ে দেখে আমি ইচ্ছে করেই মেয়েটির পাশেই বসলাম ! যদিও কিছু বলতে পারবে না তবুও নিজের কাছেই এমন টা ভাবতেই কেমন লাগছে !
আর দ্বিতীয় হল আমি যদি মায়েটির পাশে না বসি তাহলে মেয়েটি হয়তো ভাববে যে সে আমার জন্য বসার সিট ফাকা করে দেওয়া সত্তেও আমি বসলাম না মেয়েটির পাশে !! মেয়েটি মন খারাপ করতে পারে !
কি করি এখন !!
কি করি ??
যা থাকে কপালে ! বসেই পড়ি পাশে !!
মেয়ে টা যা ভাবলে ভাবুক !!
আমি দুরুদুরু বুক নিয়ে বসেই পড়লাম মেয়েটার পাশে !!
কিছু ক্ষন কি করবো ঠিক বুঝতেই পারলাম না ।
মেয়েটার দিকে কি তাকাবো?
তাকালে মেয়েটা আবার কি মনে করবে ?
কি করি ?
কি করি ?
যাহ !! যা ভাবে ভাবুক ! নিজের মনকে বুঝালাম । একবার তাকাবো মেয়েটার দিকে । যদি দেখি চেহেরার ভাবটা অন্য রকম । মানে মুখে যদি বিরক্তির কোন ছায়া থাকে তাহলে আর তাকাবো না । এখান থেকে উঠে চলে যাবো !
আচ্ছা ঠিক আছে । তাকাই । রেডি …. ১ …..। ২……৩
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে !
আহা !! কি নমনীয় চেহারা !
এই না হলে ডাক্তারের চেহেরা ! আমার তো মনে হল রুগি যদি একবার এই ডাক্তারনীর চেহারা দেখে তাহলে এমনিতেই তার রোগ অর্ধেক ভাল হয়ে যাবে !
আমি আমার মাথা ঘুরিয়ে নিলাম । আবার কি তাকাবো?
আর যাই হোক মনে তো হল না যে, মেয়েটা বিরক্ত হয়েছে ! আর একবার তাকানো যায় !
এবার তাকিয়ে দেখি মেয়েটা জানলার দিকে তাকিয়ে আছে । কিন্তু আমার মনে হল যে মেয়েটা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও তার পুরো মনোযোগ আমার দিকেই !
কথা কি বলবো ?
বল যায় !
কিন্তু কি বলবো ?
কি দিয়ে শুরু করবো ? নাম ?
নাকি অন্য কিছু ?
তোমার নাম কি?
নাহ ! প্রথম বারে তুমি বলা ঠিক হবে না ।
আপনার নাম কি ?
নাহ! যদি মেয়েটা বলে নাম জানার কি দরকার ? তখন আমি কি বলবো ?
কি বলবো?
থাক ! আজ কেবল পাশে বসেই থাকি ?
কালকে না হয় জিজ্ঞেস করা যাবে !!
কিন্তু কালকে কি মেয়েটার পাশে কি বসতে পারবো ?
-আপনি কোথায় পড়েন ?
ও মাই গড !!
দেখি মেয়েটাই আমার সাথে কথা বলল ।
-আমি ?
মেয়েটি হাসলো ।
-আপনিই !
আমি বললাম ।
-কোন সাবজেক্ট ?
-সি এস ই
-বাহ !
এখন আমার কি করা উঠিৎ ! এবার তো নাম জানতেই পারি ! না ঠিক না । আমিও আগে জানতে চাই ও কোথায় পড়ে ।
-আপনি কোথায় পড়েন ?
-আপনাদের ভার্সিটির পাশে যে মেডিক্যাল কলেজ আছে না ঐ খানে !
-আচ্ছা !
এবার কি বলবো ? কি জানতে চাইবো ?
এই মেয়ে তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড আছে ?
মাথা খারাপ ?
বাস ততক্ষনে মেয়েটির কলেজের কাছে চলে এসেছে । মেয়েটি বলল
-আমার নামতে হবে !
মেয়েটির কন্ঠসর এবার আমার সত্যি খুবই ভাল লাগলো ! এমন ভাবে বলল যেন আমার কাছে অনুমুতি চাইছে ! আচ্ছা আমি যদি বলি না আমি আপনাকে যেতে দিবো না ! তাহলে কেমন হয় ?
নাহ !
আমি উঠে জায়গা করে দিলাম । মেয়েটি যখন নেমে গেল তখন মনে হল মেয়েটির নাম তো জানা হল না !
বাস ততক্ষনে চলতে শুরু করেছে ! আমি জানলা দিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে !
আহা !! কি সেই চাও নি !
আমি তখন একটা পাগলামো করে বসলাম ! জানলা দিয়ে মুখ বের করে জোড়ে চিৎকার করে বললাম
-কি তোমার নাম?
মেয়েটা কিছু বলল কিন্তু বাসটা এতো দুরে চলে এসেছে যে আমি শুনতে পারলাম না ।
কি নাম বলল ?
নেমে পড়বো নাকি ? না অনেক দুর চলে এসেছি !
মেয়েটা এখনও দাড়িয়ে আছে !
এদিকে তাকিয়ে আছে !
দিনটা কেমন করে যেন কাটলো !! বার বার মনে হলে বাস থেকে নেমে পড়লেই মনে ভাল হত ! রাতের বেলা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার হল !
আমার মনের ভিতর থেকে মেয়েটাকে কিছুতেই বের করতে পারছিলাম না । একটা কথাই কেবল মনে হতে লাগলো যে বাস থেকে মানে পড়লেই মনে হয় ভাল হত !
মেয়েটা তো নাম বলেছিল । আমি শুনতে পারি নি ।
পরদিন সকাল সকাল আমি জাহির হলাম । আজকে মেয়েটাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবো যে তার নাম কি ! আরো অনেক কথা জানতে চাইবে !
জানতে চাইবো !
চাইতেই হবে !
আস্তে আস্তে কত বাস আসলো আবার কত বাস গেল । কিন্তু এক জায়গায় দাড়িয়েই রইলাম ।
আধা ঘন্টার মত দাড়িয়ে থাকার পর আমার কাঙ্খিত বাস টা এল । ঐ তো ! কিন্তু…………।
কিন্তু বাসটা তো দাড়াচ্ছে না ।
তাকিয়ে দেখি সিগলাম ছেড়ে দিয়েছে ।
এই বাসতো থামছে না ! আমি নিশ্চিত যে ডাক্তারনী ঐ বাসেই আছে !
আমি দৌড়াতে শুরু করলাম কিন্তু কোন লাভ হল না !
কো ন সিনেমার দৃশ্য হলে অবশ্য কাজ হত । নায়ক দৌড়ে বাসের হ্যান্ডের ধরে উঠে পড়তো ! তারপর নায়িকার সাথে দেখা হত !
কিন্তু আমি আর সেই নায়ক না !
কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলাম বাসটা চলে গেল ।
আমার কাছে কোন সুনিশ্চিত খবর নাই কিন্তু আমার মন বলছে মেয়েটা ঐ বাসেই আছে । মেয়েটা ঐ বাসেই ছিল ।
মনটাই খারাপ হয়ে গেল । কত দিন পর মেয়েটার এক বাসে যেতে পারলাম না ।
আচ্ছা মেয়েটা কি আমার কথা ভাবছে !
প্রতিদিন তো এই জায়গা থেকেই আমি বাসে উঠি আজ যখন উঠলাম না তখন মেয়েটা কি ভাববে আমার কথা !
আমি বাসটার চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম । ঠিক তখনই দেখলাম বাসটা সিগলাম পার হয়েই ওপাশে থেমে গেল । আর আমার চরম ভাবে অবাক করে দিয়ে বাস থেকে ডাক্তারনী নেমে পড়লো !!
আমি লক্ষ্য করলাম আমার বুকের ভিতর কেমন একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে ।
মেয়েটা নেমে পড়লো কেন ?
আমার জন্য ?
সত্যি কি আমার জন্য ?
ডাক্তারনী রাস্তার ওপাশে চুপচাপ ছাড়িয়ে রইলো আমার দিকে তাকিয়ে !
এখন কি করবো ?
যাবো?
আরে গাধা যাবি না মনে ?
তুই একটা আস্ত বেকুব !
কালকেই নেমে পড়লে কি হত !
তুই যেটা পারিস নি মেয়েটা সেটা করেছে ? এখনও বলতেছিস যাবি কি না !!
রাস্তা পার হয়ে মেয়েটার মেয়েটার সামনে এসে দাড়ালাম ! মেয়েটা তখনও তাকিয়েই আছে আমার দিকে ! মেয়েটার চাহনি আমাকে বলতেছে আমাদের নতুন গল্প শুরু হতে চলেছে !