রাত ২ টা!
এই ঠাণ্ডা শীতেও পুরো ঘেমে ভিজে গেছি! আজ আবার সেই স্বপ্নটা দেখলাম! ছোট্ট একটা নদী, সে নদীতে মেয়েটা সাঁতার কাটছে, কিন্তু সেই মেয়েটা কে? কি মায়াবী চেহারা তার, তার সামনে যেন সব কিছু মলিন।
সকালে হতেই আম্মু বলল, কিরে কখন যাবি?
আমি- কোথায়?
আম্মু- কেন তোর আতিক চাচার ছেলের বিয়ে না? আমাদের তো যাওয়া হবে না, তুই চলে যা। দুই দিন আগেই যা বিয়ের বাড়ী অনেক মজা করবি।
আমি- হ্যাঁ তাই তো। আমি তো ভুলে গেছিলাম, আচ্ছা দুপুরে খেয়ে রওনা হয়ে যাবো।
সন্ধ্যা হতে হতে আমি নিয়তপুর পৌঁছে গেলাম। সে দিন আমি আর বাড়ী থেকে তেমন বের হলাম না, আমি যেন ভালো ভাবে থাকতে পারি, তাই বিয়ে বাড়ীর অদূরে তাদের এক ভাইয়ের বাড়ীতে আমাকে থাকতে দিলো।
রাতে আমি শুয়ে গেলাম! স্বপ্ন দেখছি আমি একটা মেয়ে সেই নদীতে গোসল শেষ করে একটা বড় বাড়ীতে প্রবেশ করলো। আমি আবার ভয় পেয়ে জেগে উঠলাম!
.
সকাল বেলা আমি দাত ব্রাশ করতে করতে বাড়ীর পিছনে দাঁড়ালাম! কিন্তু তখন-ই আমার একটা জিনিস পরিচিত মনে হলো, স্বপ্নে যে রকম রাস্তা দেখলাম, নদীর পাড় নিচু আর তারপর আসতে আসতে উচু হয়ে যাচ্ছে, তারপর একটা বড় বাড়ী।
আমি ভাইয়া কে জিজ্ঞেস করলাম!
আমি- ভাইয়া! এই দিকে কি কোন নদী আছে?
ভাইয়া- নদী আছে না, ছিল! সে অনেক আগের কথা! তুমি কীভাবে এই নদীর কথা জানো?
আমি- তাও কতো দিন আগে ছিল?
ভাইয়া- তাও ১০০ বছর আগে তো হবেই। এখন ছোট ছোট খাল হয়ে আছে, অনেক যায়গায় সেটাও ভরাট হয়ে বাড়ী হয়ে গেছে,
আমি আর কিছু বললাম না, নাস্তা করে আমি সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম! আমি হাঁটলেও আমি আমার স্বপ্নের কথা ভাবছি, এক স্বপ্ন কেন বার বার দেখছি, নিশ্চয় এর কোন কারণ আছে, মেয়েটা কে? সে কি বলতে চাচ্ছে? ভাইয়া বলল, যে এখানে ১০০ বছর আগে নদী ছিল তার মানে মেয়েটা কম করে হলেও ১০০ বছর আগে এখানে গোসল করেছে, তার মানে সে আত্মা?
আর আমি আত্মার প্রেমে পড়েছি? সত্যি তাই! কিন্তু তারপর মেয়েটার কি হলো? সে কি এখন ও বেঁচে আছে?
কিন্তু মোড়ের ওপর তো বর্তমানে আতিক চাচার বাড়ী। আর আমার স্বপ্নের মতে মেয়েটা তো এই বাড়িতেই প্রবেশ করলো।
আমি চাচাদের বাড়ী যাবার সাথে সাথেই আমাকে আবার খেতে দেওয়া হলো, আমি দুই বার মুখে দিয়ে একটু চা খেলাম! আর আমি আঙিনায় হাঁটছি, বাড়ীর এক পাশে একটা অনেক পুরাতন নিম গাছ আছে, অবশ্য ভালো করে দেখলাম, ওটার একটা বড় ডাল কাটা হয়েছে, অথচ যে অংশ ঘরের জানলা ভেঙ্গে ঢুকছে সেই অংশ কাটে নি,
মনে মনে ভাবলাম, এরা আবার পাগল না তো?
.
বিয়ে আগের দিন!
পাশের এলাকাতেই বিয়ে তাও পছন্দের তাই এতো ঝামেলা নাই, দুপুরে ছাদে উঠে একটা জিনিস খেয়াল করলাম, ছাদের যে পাশে নিম গাছ আছে, সে পাশে ছাদের ওপর আরও ২ টা ঘর আছে, কিন্তু ওগুলো তালা মারা, আর পুরো বাড়ী লাইটিং করা হলেও সেই অংশ লাইটিং করা হয় নি।
সব কিছু আমাকে যেন বার বার ভাবতে বাধ্য করছে। সেই মেয়ের সাথে নিশ্চয় এই বাড়ীর কোন সংযোগ আছে, আর সাথে এই নিম গাছের সাথেও, বর্তমান সময়ে এতো মোটা নিম গাছ কেউ রাখে না, আমি আমার জীবনেও এতো মোটা নিম গাছ দেখিনি, মনে হচ্ছে একটা গাছেই একটা বাড়ীর যতো ফার্নিচার লাগবে সব এই গাছে হয়ে যাবে, হয়তো বেশি হবে।
সন্ধ্যার পর লাইটিং শুরু হলো। আমাকে ভাইয়া এসে মানা করলো, ছাদে যেন না উঠি আর ঐ রাতে ঐ নিম গাছের যেন পাশে না যায়।
উনি বলাতে আমার সন্দেহ আরও প্রকট হয়ে গেলো। সবাই অনেক আনন্দ ফুর্তি করলেও আমি কেন জানি মনে মনে একটা অশান্তির মধ্যে আছি,
রাত ২ টা! আমি আজ বিয়ের বাড়িতেই আছি। হটাৎ মনে হলো, ছাদ থেকে কেউ যেন নামছে, আমি ঘর থেকে বের হলাম, তারপর দরজা দিয়ে আঙিনায় আসলাম। কিছু দেখতে পেলাম না, তারপর আমি চুপ করে বসে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ আমার পাশ দিয়ে চলে গেলো। কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু খালি পায়ের ছাপ পড়ছে, আর সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি এক মুঠ মাটি উঠালাম! সদ্য ভিজা নরম মাটি। আসতে আসতে সে ওপরে উঠে গেলো।
আমার আর সাহস হলো না ছাদে যাবার! আমি ঘরে গিয়ে চুপ করে শুয়ে গেলাম!
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম! কি যেন মনে হলো, আমি নিমের একটা ডাল ভেঙ্গে সেটার দাতল করা শুরু করলাম, কারণ আমি জানি, নিম গাছের অনেক উপকারিতা।
কিন্তু আমার ডাল ভাঙ্গা দেখেই আতিক চাচা ভয় পেয়ে গেলো। আমাকে তাড়াতাড়ি এক হুজুরের কাছে নিয়ে গিয়ে আমাকে ঝার-ফুক দেওয়া শুরু করলো।
আমি- আপনি এসব কেন করছেন? আমিত কোন বড় কিছ করি নি, আর গাছের একটা ছোট্ট ডাল-ই তো ভেঙ্গেছি, আমাদের এলাকায় কতো গাছের আমি ডাল ভাঙ্গি।
.
আতিক চাচা- বাবা! তুমি জানো না, এই গাছে একটা অজানা আত্মা বাস করে, এক বার আমার ছেলে ডাল ভাঙ্গে তার হাত – পা অবশ হয়ে গেছিলো, অনেক হাকিম কবিরাজ ডেকে সেই হাত পা আমি ঠিক করি, আমি রাগ করে এই গাছ বিক্রি করে দেয়, কিন্তু যে মানুষ এই গাছ কিনে এই গাছ কাটতে শুরু করলো, ওপর থেকে একটা বড় ডাল পড়ে সে মারা গেলো, অথচ সেই ডাল তার কর্মচারীরা বেশি কাটে নি, একটু মাত্র কেটেছিল।
তখন থেকেই এই গাছ কে অভিশপ্ত গাছ বলা হয়, আমারা এই বাড়ী বিক্রির ও কথা বলি, কিন্তু সবাই এই অভিশপ্ত গাছের জন্য ভয়ে কিনে না। তুমি বাবা! আর আমাদের বাড়ী যেও না, আমার ভাইয়ের বাড়ীতে রাতে থেকে কাল সকালেই চলে যেও।
আমারা চাই না আমাদের জন্য তোমার কোন বিপদ হয়।
আমাকে আতিক চাচা ওনার ভাইয়ের বাড়ীতে রেখে চলে গেলো। আমাকে বাড়ীর বাইরে যেতেও নিষেধ করলো, সারা দিন খুব মন খারাপ করে থাকলাম, কারণ যে বিয়ের জন্য আমি এসেছি আমার বিয়ে তে যাওয়া হলো না, অবশেষে দেখলাম চাচা নিজে আমার জন্য খাবার নিয়ে আসলো, বলল, আমার ছেলের জন্য বিয়ের বাড়ীর খাবার নিয়ে এসেছি।
ওনাদের ভালোবাসা দেখে সত্যি আমি বিস্মিত হয়ে গেছি।
সারা দিন আর বের হলাম না, রাতে ভাইয়া(বর) আমাকে ফোন করলো,
ভাইয়া- আমি বাবার কাছে সব শুনেছি, তুমি মন খারাপ করো না। কাল সকালেই আমি তোমার ভাবীকে নিয়ে আসবো, সকালেই তুমি তোমার ভাবীর হাতের নাস্তা খেতে পারবা, ভালো পরোটা বানাতে পারে সে।
.
রাত প্রায় ১২ টা! কেমন জানি একটা চিৎকার শুনলাম! আমি দরজা খুললাম, মনে হচ্ছে এটা আতিক চাচার বাড়ী থেকেই আসছে, আমি আতিক চাচার বাসায় ফোন করলাম কিন্তু কেউ সেটা ধরলো না, আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম, আমি একজন কে জিজ্ঞেস করলাম, সে বলল, নতুন বউ কে ভুতে ধরেছে, সে বলছে “এই বাড়ী আমার তোরা সবাই চলে যা”
আমি বুঝে গেলাম, এটা মিথ্যা না, তার মানে আমি যে মেয়েকে স্বপ্নে দেখি, এটা সেই মেয়ে, যে ভাবীর শরীরের ওপর ভর করেছে।
আমি দ্রুত চাচার বাড়ী গেলাম! চাচা আমাকে দেখে বলল, বাবা তুমি এসো না, তোমাকে দেখে ফেললে তোমাকে সে ছাড়বে না।
আমি- চাচা! আমাকে সময় দেন। দেখতে দেন আমাকে।
চাচা- আমি কবিরাজ ডেকেছি, সে আপাতত এই পানি পড়া দিয়েছে,
আমি- আমার কথা শুনেন, আমি পারবো!
এরপর আমি ঘরে গেলাম, দেখলাম ভাবীকে বাঁধা আছে, খুব খারাপ লাগলো, নতুন বউয়ের সাথে আজ কি হচ্ছে, তবে আতিক চাচাদের দোষ দিলে হবে না, এই পরিস্থিতিতে যে পড়বে সেই বুঝতে পারবে।
আমি- চাচা, চাচী আর ভাইয়া থাকেন, বাকী সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যান।
আতিক চাচা- কিন্তু বাবা?
আমি- যা বলছি করেন।
সবাই চলে গেলো, আমি ভাইয়া কে বললাম, আমি কি ভাবীর হাত ধরতে পারি? ভাইয়া বলল ঠিক আছে।
আমার একটা ভরসা আছে, যেহেতু সে আমাকে স্বপ্নে দেখা দেয়, তাছাড়া আমি তাকে অনুভব করি তাহলে সে নিশ্চয় আমার ক্ষতি করবে না।
আমি খুব সাহস করে সামনে গেলাম, তারপর ওনার হাত পা বাঁধা দড়ি গুলো খুলে দিলাম,
আমি- খুব রাগ হচ্ছে?
আত্মা- তুই কেন এখানে এসেছিস? চলে যা তুই? এদের কেউ যেতে বোল, এই বাড়ী শুধুই আমার।
আমি- তুমি তো রোজ আমার স্বপ্নে এসে দেখা দাও। এতো মায়্যা ভরা মুখটা দেখতে আসা কি পাপ? কেন করছো এসব বলো, আমাকে বলো।
আত্মা- এই বাড়ী আমাদের ছিল! শত বছর আগের কথা! আমার বাবা অনেক বড় ব্যাবসাদার ছিলেন তাই অনেক মানুষ আসতো ওনার সাথে! আমি ওনার এক মাত্র মেয়ে ছিলাম। কিন্তু তখন কার সময় ভালো যাচ্ছিলো না, প্রায় মারা-মারি হতো, আমাদের চাচারা তখন ভারতের দিল্লিতে বাস করতো, কিন্তু বাবা এই বাড়ী ছেড়ে যাবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেয়।
আর এভাবেই একদিন রাতে আমাদের বাড়ীতে আক্রমণ চালানো হয়, আমাদের সবাইকে মেরে ফেলে ওরা। তখন থেকে আমি এই বাড়ী রক্ষা করছি, এই বাড়ী শুধু আমাদের, ইনারা জোর করে এখানে বসে আছে। চলে যেতে বলো এদের।
আমি- দেখো, পৃথিবীতে কোন কিছু স্থায়ী না। আজ থেকে ৫০০ বছর আগে কি এই যায়গা তোমাদের ছিল? আজ থেকে ৫০০ বছর পর এই বাড়ী কেন? এই দেশ কোথায় থাকবে কেউ জানে না। সৃষ্টিকর্তার নিয়ম হচ্ছে পরিবর্তন শীল! এটা মেনে নিতেই হবে, এখন যদি দাত তুলে ফেলার ভয়ে দাত না ওঠানো হয় তবে নতুন শক্ত দাত কীভাবে বের হবে?
ওনারা ও এই যায়গা কিনেছে, আমি শুনেছি এই দেশ ভাগ করার সময় অনেক মানুষের অনেক ক্ষতি হয়েছে, অনেকে মেনে নিয়েছে, তুমিও মেনে নাও।
আত্মা- না আমি মানবো না।
আমি- কেন? তোমার বিয়ে হলে কি তুমি শ্বশুর বাড়ী যেতা না?
আত্মা- আমার আবার বিয়ে?
আমি- আমি আছি না? তোমাকে বিয়ে না করতে পারি, তোমাকে ভালো তো বাসি, ঘরের মধ্যে এক বিছানাই শুতে না পারি, বারান্দায় বসে একটু কথা তো বলতে পারি? কি যাবা না আমার সাথে?
আত্মা- আমি তো তোমাকে সেই ছোট বেলা থেকেই অনেক ভালোবাসি।
আমি- কি?
আত্মা- হ্যাঁ! তখন তুমি অনেক ছোট! হয়তো বয়স ৭-৮ বছর হবে। তোমাদের সবাই এই বাড়ী বেড়াতে এসেছিলা, সবাই এই গাছ কাঁটার কথা বলে আর তুমি এই গাছে পানি দিয়েছিলা, তখন থেকেই ভালোবাসি।
আমি- এই গাছটার জন্য অনেক সমস্যা হচ্ছে, এই গাছ টা কেটে নেই?
আত্মা- কাটো কিন্তু একটা শর্ত আছে, গাছ বিক্রি করতে পারবে না, গাছটা ওনারা তোমাকে দিয়ে দিবে। তাহলে আমি ছেড়ে দিবো।
আতিক চাচা- আচ্ছা আমি নিম গাছ ইমরান কে দিয়ে দিবো, সাথে গাছ কাটতে যতো খরচ হবে সব দিয়ে দিবো।
আত্মা- ঐ তোকে কথা বলতে কে বলল রে?
আমি- ছি! উনি আমাদের বাবার মতো ওনার সাথে কেউ তুই বলে?
আত্মা- উনি তোমার গুরুজন আমার না। আমার বয়স ওনার থেকে আরও ৭০ বছর বেশি, তুমি হয়তো আমার বয়স ভুলে যাচ্ছো
আমি- আমি তো তোমাকে স্বপ্নে ১৬-১৭ বয়সের মেয়ে দেখতে পাই, তাই আমি সেটায় মনে করি। তাহলে কাল সকালে গাছ কাটবো?
আত্মা- আচ্ছা!
এরপর ভাবী ভালো হয়ে গেলো। আমি হাত ধরে ছিলাম, ভাবী সেটা দেখে, এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো।
ভাইয়া তার পাশে গেলো, তাকে সব ঘটনা খুলে বলল, আর অভয় দিলো, যে আর এই রকম হবে না।
.
সকালে গাছ কাঁটার জন্য সবাইকে ডাকা হলো, কিন্তু ভয়ে কেউ গাছের নীচে আসছে না। আমি গাছের ওপরে উঠলাম, কারণ যদি কিছু হয় সেটা আমার হোক। আমি প্রথম ডাল কাটলাম, তারপর আমার দেখা দেখি, সবাই গাছ কাটা শুরু করলো, টানা ৩ দিন ধরে গাছ কাটা শেষ হলো,
অবশেষে আমি বাড়ী ফিরে আসলাম।
রাতে আমি চা নিয়ে বারান্দায় গেলাম! ভাবছি এই কয়েকদিন আমার জীবনে কি কি ঘটে গেলো।
পিছন থেকে চেয়ার দুলতে শুরু করলো। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম!
আত্মা- তুমি আবার কবে থেকে আমাকে দেখে ভয় পাওয়া শুরু করলে?
আমি- না এভাবে হুট করে আসলে ভয় তো পাবোই, একটু নক করে আসতে পারো না?
আত্মা- আমি মানুষ নাকি যে নক করে আসবো? আচ্ছা চলে যাচ্ছি।
আমি- মানুষ না আবার মেয়েদের মতো রাগ তো ঠিক-ই করতে পারছো। এখন বলো চা খাবা?
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা