রাহাদ অপলকে চেয়ে আছে মায়ার দিকে। ঘুম চেহারাতে অনেক সুন্দর লাগছে মায়াকে। রাহাদের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে মায়া। বাসের জানালা দিয়ে আসা বাতাস মাঝে মাঝে মায়ার চুল উড়িয়ে রাহাদের মুখ ঢেকে দিচ্ছে। চুলে মায়ার মুখও ঢেকে যাচ্ছে। রাহাদ চুল গুলো সরাচ্ছে না।কারণ এভাবে মায়াকে অনেক সুন্দর লাগছে।
.
রাহাদ আর মায়া পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের গন্তব্য কোথায় তারা জানেনা। হাত একবারেই খালি। টাকা পয়সা খুব কম।শুধু মায়া কিছু এনেছে আর রাহাদের কাছে কিছু আছে। ভালবাসাতে দু’জন দু’জনকে আপন করে পেতেই বুঝি ;অজানাতে তাদের এই হারিয়ে যাওয়া।বাস চলছে আপন গতিতে আর রাহাদ অপলকে দেখছে মায়াকে, অদ্ভুত এক মায়া এই মেয়েটার মুখে। যার কারণে রাহাদকে সবকিছু ছেড়ে পালাতে হচ্ছে।
.
সমাজ তাদের মেনে নিবেনা। কারণ রাহাদ মুসলিম আর মায়া অন্য ধর্মের। ধর্ম তাদের ভালবাসাকে সবমসময় আলাদা করে দিবে।সমাজ তাদের এক হতে দিবেনা। কিন্তু তারা আলাদা হতে চায় না।তাইতো সবাইকে ছেড়ে দু’জনে এক হওয়ার জন্যে অজানাতে পাড়ি জমিয়েছে।
.
রাহাদ আর মায়ার পরিচয়টা একটু ভিন্ন ভাবে হয়।রাহাদের বাবা হলো ডাকপিয়ন।নিজের এলাকা, পাশের এলাকা প্রায় কয়েকটা গ্রামেই চিঠি বিলি করে রাহাদের বাবা।সেদিন রাহাদের বাবা অসুস্থ ছিলেন। আর অনেকগুলো চিঠিও সেদিন ছিলো। যা বিলি করতেই হবে।রাহাদ তার বাবার অসুস্থতা দেখে ;বাবার কাছে বলে, নিজেই সেই দিনের চিঠি বিলি করার দায়ত্বটা নেয়।তার বাবা জিঙ্গেস করে সবার বাড়ি চিনবি । রাহাদ বলে গ্রামের ছেলে আমি চিনবোনা এটা কোন কথা।বাবার সম্মতিক্রমেই চিঠি বিলি করতে যায় রাহাদ।
.
সব চিঠি বিলি করা শেষ।মানে যার যার চিঠি তার তার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। হাতে আর একটা চিঠি সেটা হল পাশের এলাকাতে।আর চিঠিটা ছিলো এক হিন্দু বাড়ির। সেদিন রাত হয়ে যাওয়াতে আর ঐ চিঠি নিয়ে যায়নি।
.
পরের দিন খুব ভোরে চিঠি নিয়ে যায় হিন্দু বাড়িতে। বাড়িটা বাউন্ডারি করা। সামনে গিয়ে ঠুক্কা দিয়ে নক করে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বাসার ভেতর থেকে একজন মহিলা বললো কি চায়।রাহাদ বললো চিঠি এসেছে কলকাতা থেকে।তখন ঐ মহিলা মায়া নাম ধরে বললো।মায়া মা চিঠিটা রাখতো।
.
তখন একটা মেয়ে বের হয়ে চিঠি নিতে আসলো।সেই প্রথমরদেখা,প্রথম মনে প্রেম জাগা।রাহাদ সেই মেয়ে মানে মায়াকে দেখে মূর্তির মতো হয়ে যায়। রাতের আকাশের চাঁদটা অনেক আগেই আকাশ থেকে হারিয়ে গেছে।কিন্তু এই কোন চাঁদ। তাহলে রাতের ঐ চাঁদটা কি এখানে। না এখানে কেমনে আসবে। এই চাঁদটার মুখে যতটা মায়া আছে ;ততটা মায়া ঐ চাঁদে নেই।যাই হউক ঘুর কাঁটিয়ে চিঠিটা মায়ার হাতে তুলে দিলো।চিঠিটা হাতে দেওয়ার সময়, রাহাদের হাতটা মায়ার হাতের স্পর্শ পেল।হঠাৎ করেই যেন কোন অজানা অনুভূতির ভালো লাগা কাজ করলো মনে। যাকে বলে লাভ ইজ ফাস্ট সাইড।
মনে হলো যেন তারা দুজন জনম জনমের চেনা।
.
সেদিনের পর থেকে রাহাদ প্রতি সপ্তাহে একটি করে চিঠি নিয়ে যায়’সেই বাড়িতে’।আর সেটা অন্য ঠিকানাতে নয় রাহাদের ভালবাসা মায়ার ঠিকানাই। মনের আবেগ অনুভূতি দিয়ে লেখা চিঠি প্রত্যেক সপ্তাহে একটি করে দিয়ে আসে মায়ার কাছে।
.
এদিক দিয়ে মায়া প্রতি সপ্তাহেই যেন আকাশ থেকে পড়ে। প্রতি সপ্তাহে প্রেরকহীন চিঠি আসে তার কাছে।যেখানে প্রেরকের মনের অনুভূতি মায়াকে গিরে তার ভালবাসার কথা লেখা থাকে।এতো সুন্দর করে কেউ চিঠি লিখতে পারে : তা মায়ার জানা ছিলো না এতোদিন। কিন্তু বুঝতে পারেনা ;কে সেই অচেনা মানুষ। যে প্রতি সপ্তাহে তাকে চিঠি দেয়, চিঠিতে কোন ঠিকানা নেই । মায়াও আস্তে আস্তে সেই অচেনা চিঠি প্রেরকের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।অদ্ভুত ভাবে লেখা সেসব চিঠি।মায়া আজ ভাবে প্রতিদিন কেনো একটি করে চিঠি আসেনা।তার অপেক্ষা করতে হয় একটি সপ্তাহের।
তারও মন চাই সেই ঠিকানাই চিঠি লিখতে ;যেখান থেকে এতো সুন্দর চিঠি আসে তার কাছে।কিন্তু সেতো ঠিকানা জানেনা।
.
এদিক দিয়ে রাহাদ প্রতি সপ্তাহে ঠিক চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। তার প্রতি সপ্তাহে চিঠি দিতে ভালো লাগেনা। রাহাদ চাই প্রতি দিন চিঠি দেওয়া যেত যদি।বা সপ্তাহে চিঠির বদলে একবার মনের অনুভূতি তার সাথে কথা বলে বুঝাতে পারা যেত। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না।রাহাদ মুখিয়ে আছে ,কোনদিন মায়া তাকে বলবে ;যে প্রতি সপ্তাহে ঠিকানাহীন চিঠি কেমনে করে আসে। কে দেয় এই চিঠি।
সেই দিনটা রাহাদের জন্য খুব একটা অপেক্ষা করেনি।হঠাৎ একদিন মায়া রাহাদকে বাড়ির পেছনে ডেকে নেয় যখন রাহাদ চিঠি দিতে আসে। বাড়ির পেছনে গিয়ে রাহাদ অবাগ হয়।কেননা অধরা তাকে প্রশ্ন করে
—আপনি কি আমাকে ভালবাসেন?
রাহাদ কি বলবে বুঝতে পারছিলো না।তবুও সত্যিটাই প্রকাশ করলো।
–তার মানে আপনেই চিঠি গুলো আমাকে লিখেন।আপনার সাহস তো কম না।
আমি যদি এখন আমার বাসায় বিচার দেয় তখন কি হবে।
—জানিনা কি হবে।তবে আমার বিশ্বাস আপনি বিচার দিবেন না।
—-কেনো দিবোনা বিচার। এতো কনফিডেন্স কেমন করে হলো।অতিরিক্ত কোন কিছু ভালো নয়।
–জানিনা কেমন করে হলো।। তবে আমি আপনাকে ভালবাসি এটাই সত্য।আপনার প্রতি ভাললাগা আমার কাছে জনম জনমের মনে হয়।আমার চিঠি গুলো অবশ্যই আপনার মনে সেই অজানা মানুষটির প্রতি ভালবাসার জন্ম দিয়েছে ; যে মানুষটি আমি। আর যদি ভালবাসা না জন্ম নেয় তাহলে বিচার দেন। আমি বুঝে নেবো আমার ভালবাসা আমি জানাতে পারিনি।আমার ভালবাসার আবেগগুলো আপনার কাছে উপস্থাপন করতে পারিনি।
.
—আপনি জানেন আমাদের ধর্ম আলাদা। সমাজ কখনোই মেনে নিবেনা।
—চাই না সে সমাজ যেখানে ভালবাসার দাম নেই।শুধু আপনি পাশে থাকলে আমি নতুন সমাজ গড়তেও রাজি।যেখানে আপনি আর আমি থাকবো।যদি দু’জনার মধ্যে ভালবাসা থাকে ;তাহলে সমাজ দিয়ে কি হবে ।
—আমাকে নিয়ে পালাতে পারবেন।
এমন কথা শুনার জন্য রাহাদ প্রস্তুত ছিলোনা। তবুও মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো।তবুও প্রশ্ন করলো
–কিন্তু কেনো পালাবো?
–কারণ তুমি মুসলিম আমি হিন্দু। সমাজ তোমার পরিবার আমার পরিবার কেউ তো আর আমাদের সম্পর্ক মেনে নিবেনা।তুমি জানো
তোমার দেওয়া চিঠিগগুলো একেকটা কতবার করে পড়েছি।এতো আবেগ দিয়ে লেখা ভালবাসার কথা যা মিথ্যে হবার নয়।চিঠির ভাষা গুলো তোমার প্রতি আমার মনে ভালবাসার জন্ম দিয়েছে। যা ভুল যাওয়া বা ভুলে দূরে যাওয়া আমার দ্বারা সম্ভব না।আর তুমি জানোনা,বাসায় আমার বিয়ের কথা চলছে ,কিন্তু এখন আমি যেভাবে আছি।সেখানে তোমাকে আমার অনেক প্রয়োজন। সব দিক বিবেচনা করে দেখেছি আমাদের পালাতে হবে।না হয় কেউ আমাদের মেনে নিবেনা।আর যদি না পালাতে চাও,তবে এখান থেকেই চলে যাবে পেছন ফিরে একবারো তাকাবেনা।আর কখনো আমার কাছে চিঠি পাঠাবেনা।
—তোমাকে ভালবেসেছি ,স্বয়নে স্বপনে তোমাকেই আমার পাশে চাই।আমরা পালাবো।
.
সেই দিনের পর তাদের ভালবাসার সূর্য উঁকি দেয় মনের আকাশে।মায়া এখনো ঘুমাচ্ছে রাহাদের কাঁধে মাথা রেখে। তারা পালিয়ে যাচ্ছে তাদের ভালবাসার নতুন ইতিহাস গড়তে।
হঠাৎ বাসের ভেতর গান ছেড়ে দিলো। “চলো না হারিয়ে যায় দূর অজানাই, যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেহ নাই “।
গল্পের বিষয়:
ভালবাসা