ইকবালের বন্ধুরা ইকবালের স্ত্রী লুবনার অগোচরে যখন বললো ভাবিকে বিয়ের সময় যেমন সুন্দরী লেগেছে এখন কিন্তু তেমন লাগছেনা।আবার কেউ কেউ বলেও ফেললো ভাবির বয়স টা মনে হয় ইকবাল ভাইয়ের চেয়ে বেশি।সবাই হো হো করে হেসে দিল।লুবনা দূর থেকে শুধু ইকবালের দিকে তাকিয়ে আছে।সে কোন কথা বলছেনা।বার বার কপালের ঘাম মুছছে।লুবনা নিজের রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে বার বার নিজেকে দেখছে।চোখের নিচে কালিটা যেন প্রখর হয়ে আছে।ইকবাল বন্ধুদের বিদায় দিয়ে এসে লুবনাকে জিজ্ঞেস করলো কি বেপার তুমি আর গেলেনা ওখানে?
লুবনা কথা বলছেনা।
ইকবাল লুবনার গায়ে হাত রেখে বললো কি বেপার কি হলো?
লুবনা চেঁচিয়ে বলে দেখ আমায় টাচ করবিনা।তোর মতন ছেলেকে বিয়ে করাই আমার অপরাধ হয়েছে।
ইকবাল লুবনার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলে এসব এর মানে কি?তুই করে বলছো কেন?
লুবনা কেঁদেই যাচ্ছে।
ইকবাল রুম থেকে গিয়ে ওর মাকে বললো লুবনাকে কিছু বলেছো তুমি?
মা চেঁচিয়ে বলে উঠলো ওরে আমি কি বলবো?কি বলার আছে?সারাদিন রুম দিয়া বের হয়না।একটু কাজে হাত দেয়না।এর নাম বউ?না আছে চেহারা না আছে গুন।বার বার বলছি সমবয়সী মেয়েরে বিয়া করিস না।এরা স্বামীরে সম্মান দেয়না।আরে আমার মনে হয় ওর বাচ্চা হবার ক্ষমতাও নাই।
ইকবাল মায়ের উপর রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ইকবালের মা তখন ও লুবনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে এমন হলে ছেলে আমার ঘর ছাড়া হয়ে যাবে।আমার এতো সুন্দর ছেলের কপালে ওমন বউ ছিল?আমার স্বামী সারাদিন কাজ করে এসে ঘরে এসে শান্তি পাইতো আমারে দেখে।আর আমার ছেলের কপালে সে শান্তিও নাই।
লুবনা দরজার আড়ালে দাড়িয়ে বলে ছেলেরে সুন্দরী দেখে বিয়ে দিলেই পারেন।
শাশুড়ি উঠেই বলে আমার ছেলের মাথা কি আর সুস্থ রাখছো?সে তো তুমি ছাড়া কিছু বুঝেনা।মাথা চিবায়া খাইয়া ফেলছো।পারলে তুমি আমার ছেলেরে ছাইড়া যাও। তা তো যাইবানা খালি বড় বড় কথা।
লুবনা বিছানায় শুয়ে কাঁদছে। জীবনে ক্ষমতা অর্জন করা যায় কিন্তু চেহারা যেটা চাইলেই পরিবর্তন করা যায়না। রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পরলো।হঠাৎ ইকবালের আসার শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে যায়। ইকবাল ফ্রেস হয়েই লুবনার পাশে এসে শুয়ে পরলো।গা থেকে সিগারেট এর গন্ধ আসছে।লুবনা টের পাচ্ছে খুব।বিয়ের আগে অনেক কষ্টে এ অভ্যাস ছাড়িয়েছিল লুবনা।ইকবাল আবার সেই সিগারেট হাতে নিয়েছে।নিবে নাই বা কেন?একসময় যাকে ভালোবেসে সিগারেট ছেড়েছিল আজ তাকে যে আর ভালোলাগছেনা এই ভেবে লুবনা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ইকবাল চোখ বন্ধ করতেই লুবনা ফোন নিয়ে বারান্দায় গেল।ইকবাল ঘুমায় নি সে খুব ভালো করেই জানে।বিয়ের পর ঘরে এক দন্ড শান্তি নেই যেখানে সেখানে ঘুম আসবে কি করে।
ফোন কানে নিয়ে লুবনা বললো আসলে ইকবালের সাথে আমি সুখী নই।ও আমাকে কোন সুখ দিতে পারেনি আর পারবেও না।প্লিস আমায় তুমি নিয়ে যাও।
ইকবাল এর মাঝেই পিছনে এসে বলে কাকে বলছো?
লুবনা ফোনটা রেখে দিয়ে বলে কাকে আবার?আমার কাজিন কে চিনতে না?যে আমায় বিয়ে করার জন্য পাগল ছিল আমি তাকে কল দিয়েছি।
ইকবাল লুবনার হাত ধরে বলছে লুবু কি বলছো?আমার উপর কিসের রাগ তোমার?সেই ৭বছর থেকে তুমি আমায় চিনো আমি কখনো কি তোমায় ঠকিয়েছি?
লুবনা হাত ছিটকে রুমের ভিতরে গিয়ে বলে সে সময় আর এখন আলাদা।আমার আর তোমায় ভালোলাগেনা ইকবাল।অসহ্য লাগে তোমাকে।আমি নতুন ভাবে শুরু করবো সব।
ইকবাল হেসে লুবনাকে কাছে টেনে বলে পাগলি অভিনয় করছো?আমি জানি আমি ছাড়া তোমার ঠিকানা আর কোথাও নেই তুমি আমায় ছাড়া ভাবতেই পারোনা।মায়ের উপর রাগ তোমার?সব ঠিক হয়ে যাবে।
লুবনা ফোন টা হাতে নিয়ে কাজিন মুন্নাকে কল দিয়ে বললো আচ্ছা তুমি ইকবাল কে একটু সত্যিটা বলে দেও আমাদের সম্পর্কের কথা।
ইকবাল থ হয়ে তাকিয়ে আছে।
ওপাশ থেকে মুন্না বলছে কি আর বলবো।তুমি আমায় ভালোবাসো।আর পরের মাসে ওকে ডিভোর্স দেয়ার পর আমরা বিয়ে করছি।আচ্ছা ইকবালের কথা বাদ দেও।তুমি বলো বেনারসি কি কালার কিনবো নীল নাকি লাল?
ইকবাল হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বললো আমার কাছ থেকে একবার যাবার চেষ্টা করে দেখ আগে তোকে খুন করবো তারপর নিজে আত্মহত্যা করবো।
লুবনা ইকবালের হাত ওর গলায় নিয়ে ধরে বললো আমায় মেরেই ফেলো তুমি।কারন এর চেয়ে মরে যাওয়া ও ভালো। আমি তোমার সাথে আর থাকতে পারছিনা।আমি মুন্নাকে কথা দিয়েছি।ইকবাল স্তব্ধ হয়ে লুবনার দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ লাল হয়ে আছে।ছেলেরা চাইলেই ঘৃনায় কাঁদতে পারেনা।তাদের আবেগ ভিতরেই চাপা পরে থাকে।ইকবাল রুম থেকে বের হয়ে গেল।লুবনা জানে ও আড়ালে গিয়ে কাঁদবে। এমন আগেও হয়েছে।যখন তারা ভার্সিটি লাইফে ছিল।লুবনার বাসা দিয়ে বিয়ে ঠিক করেছিল।আর ইকবাল তখন বেকার।চাইলেই লুবনার দায়ীত্ব নিতে পারবেনা।তখনো এভাবে বন্ধুর বাসার ছাদ এ গিয়ে কান্না করেছে।লুবনা গিয়ে যেই জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে ওমনি হেসে বলে কই কিছুনাতো।লুবনা ওর চেয়েও বেশি ভালোবাসতো ওর অন্ধভাবে লুবনাকে চাওয়ার প্রতি।আজ সেই অন্ধ ভাবে চাওয়াটাতে ঘুণ ধরেছে মনে হয়।তাই একটা মুক্তির প্রয়োজন।মেঝে থেকে ফোনটা উঠিয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হলো লুবনা।শাশুড়ি কোন কথাই বলছেনা।লুবনা বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর ই ইকবাল রুমে এসে সারাঘর লুবনাকে খুঁজছে। ইকবাকের মা উঠেই বলে সে বাসায় নেই।চলে গেছে যেন কই।আসবে ফিরে চিন্তা করিসনা।
ইকবাল: বলে গেছে ও?
ইকবালের মা মুখ বাঁকিয়ে বলে তোমার রূপসী বউ কাউকে বলে যাওয়া দরকার মনে করে?
ইকবাল ফোন হাতে নিয়ে বার বার লুবনাকে কল করছে আর সুইচঅফ পাচ্ছে।
মা এই শহরে ওর আপনজন বলতে মামা আছেন তাও অনেক দূরে বাসা।এতো রাতে ও একা একা ওর বিপদ হতে পারে।
ইকবালের মা ইকবাল এর কাছে এসে বলছে বাপ ওই মাইয়া না থাকতে চাইলে বাদ দে বাপ।নতুন করে সংসার কর।দেখ আমি চাইলেই মেয়ে ঠিক করতে পারি তোর জন্য।এই মেয়ে তোরে সুখ দিতে পারবোনা দেখিস তুই।
ইকবাল কোন কথা না শুনে রাস্তায় চলে গেল খুঁজতে। এতো রাতে কই খুঁজবে এই ভেবে এলোমেলো হচ্ছে।হঠাৎ ইকবালের নম্বরে অচেনা নম্বরের কল।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠে বলছে ইকবাল লুবনা আমার কাছে।চিন্তা করোনা।
ইকবাল: কে আপনি?
ওপাশ থেকে যেই বললো মুন্না ইকবাল রেগে বললো লুবনাকে ফোনটা দিন।
লুবনা ফোন নিয়ে কথা বলছেনা।
ইকবাল রেগে বলছে তুই মুন্নার কাছে কেন গেলি?
লুবনা: তুই করে বলবানা বলে দিচ্ছি।
ইকবাল: আমি জানতে চাই তুই কেন গেলি?আমার সাথে কি তোর ডিভোর্স হয়েছে?
লুবনা হেসে বলে মনের ডিভোর্স অনেক আগেই হয়েছে।
ইকবাল: ও আচ্ছা বাহ খুব ভালো বলেছিস।এর জন্য ই আমি বেকার অবস্থায় তোকে বিয়ে করছিলাম।যে যাই বলেছে আমি কানে তুলিনি।
লুবনা: হুম অসুন্দরী বউ কে নিয়ে দিনের পর দিন থেকেছো এটাই অনেক।
ইকবাল: একটাও কথা বলবিনা।তোর দরকার নাই আমাকে।আমি ছাড়ি নি তোকে তুই ওই মুন্নার জন্য আমায় ছেড়েছিস।আসলে আমি কাপুরুষ ই। মা ঠিক ই বলে।শোন পরের সপ্তাহেই বিয়ে করছি।তুই থাক মুন্নার সাথে।এই বলে ফোন কেটে দিল।
ওপাশে লুবনা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
মুন্না উঠে বলছে লুবনা চল আমি তোকে দিয়ে আসি।দেখ সমাজ,মানুষ দিয়ে কি করবি?ইকবাল তো ভালোবাসে।
লুবনা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে না ও ভালোবাসেনা এখন।ও আমায় ঠকাতে পারছেনা তাই নিজের মনের বিরুদ্ধে আমার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এখন ও বিয়ে করবে দেখো ও খুব শান্তিতে থাকবে।
মুন্না: এসব কি বলিস?আর তুই?
লুবনা হেসে বলে আমি চাকরি নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবো।শুধু আমায় কয়েকদিন একটু জায়গা দেও ভাইয়া।ইকবাল বাসায় এসেই মাকে বললো মা আমি এক সপ্তাহ মাঝে বিয়ে করতে চাই।তুমি মেয়ে ঠিক করো।
ইকবালের না উদ্বিগ্ন হয়ে বললো কি হইছে?বিয়ে এতো জলদী করা সম্ভব?
ইকবাল: আমি এতো কিছু জানতে চাইনা।তুমি পারলে বলো না হলে আমি করবো রাস্তাঘাট এর কাউকে।
ইকবালের মা ইকবালের মাথায় হাত দিয়ে বললো না বাবা থাক আমি ই এইবার খুঁজে আনবো যদিওবা একটা মেয়ে আমার পছন্দের আছে।দেখি তারা রাজি হয় কিনা।
ইকবাল রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে সিগারেট ধরালো।সিগারেট শেষ হতেই চোখ লেগে গেল।ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বলে লুবু গোসল এর জন্য পানি ধরে রাখোতো।
এই বলেই বিছানার অপাশে দেখে খালি।কেউ নেই রুমে।বারান্দার দরজা খোলা।পর্দা বাতাসে বিরামহীন ভাবে উড়ছে।
ফোন টা হাতে নিয়ে দেখছে কল শূন্য।লুবনাকে কল দিতেই সাথে সাথে রিসিভ করলো।
ইকবাল চুপ করে আছে।
ওপাশ থেকেও কথা বলছেনা।
ইকবাল: তুমি কি শেষবারের মতন ভেবে নিয়েছো মুন্নার সাথেই থাকবা?
লুবনা: হুম
ইকবাল: কি করে থাকবে লুবনা?আমার কথা মনে পরবেনা?হয়তো আমার অনেক টাকা পয়সা নেই।চাকরিটা নতুন নিয়েছি তবে একদিন তো টাকা হবে।
লুবনা: মুন্নার ইনকাম সম্পর্কে ধারনাই করতে পারবেনা।
ইকবাল: টাকা ই সব?
লুবনা: হুম টাকা ই সব। দুনিয়ায় এটাই সুখ।২বছর পর দেখো আমায় কেমন দেখায়।রানীর হালে থাকবো আমি।
ইকবাল: তাহলে আমায় বেকার অবস্থায় ভালোবেসেছিলে কেন তুমি?
লুবনা চুপ করে আছে।
ইকবাল: যাক যা বলতে কল দিয়েছি বিয়ে করছো কবে তোমরা?
লুবনা: খুব তাড়াতাড়ি।
ইকবাল: আমিও।
লুবনা: কবে?
ইকবাল: জানাবো।
লুবনা ফোন কেটে দিয়ে বুকে ফোন চেপে ধরে কাঁদছে।
বেশ তো ছিল সেই সম্পর্কের দিনগুলি।বিয়েটা করার পর ই কেন যেন সব ওলট -পালট।যেই আমি ওর জন্য লাকি ছিলাম আজ একেবারেই আনলাকি। ওর লজ্জার কারন হয়ে গেলাম।
ইকবালের মা ইকবাল কে খাবার দিতে এসে খুশি খুশি মুখে বলে দেখ বাবা কত কিছু রান্না করলাম নিজের হাতে।খা আজ আমি পাশে বসে দেখি।
ইকবাল:মা পরে খাই।
ইকবালের মা মুখ মলীন করে বলছে এতো কষ্ট করে রান্না করলাম আমি।
ইকবাল নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেয় মাকে দেখিয়ে খাচ্ছে।
ইকবালের মা এর মাঝেই উঠে বলে শোন বাবা।এই ঘর সম্পত্তির মালিক তুই।আমার আর কোন সন্তান ও নাই।তোকে যে কোন মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হবে।এখন শোন নিচতলার রায়হান ভাইর মেয়েকে চিনিস?রুপা?
ইকবাল: নাম শুনেছিলাম।বিয়ে হয়েছিল না?
ইকবালের মা উঠে বলে ওই তো বিয়ের ৩মাস পর ই জানতে পারে ছেলে নেশাখোর। তাই ছেড়ে দিয়েছে।মেয়ে খুব সুন্দরী। আর ওর একবার সংসার ভেঙেছে ওই বুঝবে তোর ভাঙার কষ্ট।আর তোকে সবার ই পছন্দ।আশা করি না করবেনা।
ইকবাল তখন বিছানার বাম পাশের দেয়াল টায় লুবনা আর ওর ছবির দিকে তাকিয়ে আছে।
ইকবালের মা তা বুঝতেই বলছে ওসব ভাবিস না।ওসব কিছু রাখবোনা ঘরে আর মনেও পরবেনা।
ইকবাল ওর মায়ের হাত ধরে বললো মা লুবনা দোষ করলে করেছে তবে ওর ছবি দোষ করেনি।ও আমার হাত ধরে বাসার অমতে চলে এসেছিল।আমি ওকে আটকে রাখতে পারিনি।
মা মুখ ভেংচি দিয়ে উঠে বলে চুপ থাক।আমি কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি?ওর অন্য কোথায় লাইন আছে ভাবছিস আমি কিছু শুনিনাই।আমি কালা না।
ইকবাল: আচ্ছা মা বিয়ে পরে করি।কিছুদিন যাক।
ইকবালের মা রেগে বলে মেয়ে অনন্তকালের জন্য রেখে দিবে নাকি?না না আর তোর কথা শুনবোনা।পরের শুক্রবার ওকে আংটি পরিয়ে রাখবি।ঈদ এর পর বিয়ে করবি।এর মাঝে ওই মেয়েকে তালাক দিবি।একদিন আমার কথা ভাববি যে মা ঠিক ই করেছিল।
ইকবাল অফিসে চলে গেলো। অফিসের রুমেও ডেক্স এর উপর লুবনার ছবি রাখা।কি করে ভোলা যায় যে মানুষ টা বাস্তবে রক্তের মতন মিশে আছে!
লুবনাকে আবার কল দিলো।
কি বেপার আবার কল দিচ্ছো কেন?
ইকবাল: ভয়েস এমন শুনাচ্ছে কেন?
লুবনা: ঠান্ডা লেগেছে।
ইকবাল: ইসলামে অবিবাহিত অবস্থায় ছেলে মেয়ে থাকা উচিৎ নয়।
লুবনা রাগে কষ্টে বার বার নিশ্বাস ফেলছে
ইকবাল: শুক্রবার আমার বিয়ে ঠিক হতে যাচ্ছে।
লুবনা: বাহ!
মেয়ে খুব সুন্দরী?
ইকবাল: দেখিনি।
লুবনা: দেখে নিও।
ইকবাল: দরকার নেই।তুমি এসো মুন্নাকে নিয়ে।
লুবনা: আসবো।এই বলে ফোন কেটে মেঝেতে ফেলে দিলো। টুকরো টুকরো হয়ে গেল ফোন সাথে টুকরো হলো বন্ধন।
মুন্না রুমে এসে বলে কি হয়েছে?
লুবনা মেঝের একপাশে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বলে ভাইয়া ও বিয়ে করছে।কিভাবে পারে ও?আমার কপালটাই
খারাপ, খুব খারাপ।যার জন্য মা বাবা ছাড়লাম আজ সে আমায় এতো জলদী মুছে ফেলতে পারলো।
মুন্না চুপ করে আছে।মনে মনে ভাবছে লুবনা তোকে আমিও ভালোবেসেছিলাম।ছোট থেকে সবাই আমায় তোর বর
বলে ক্ষেপাতো কিন্তু সেই স্বপ্ন তুই ও এভাবে ভেঙে দিয়েছিস!
এরপর ইকবাল যতবার লুবনাকে কল দিয়েছে ফোন অফ পেয়েছে।ইকবাল কোন ভাবেই লুবনাকে জীবন থেকে
মুছে ফেলতে পারছেনা।
বলতে বলতে আর একদিন বাকি।তারপর ই ইকবাল নতুন কোন সম্পর্কে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে।অফিসের নাম করে
পার্ক এ গিয়ে একা বসে আছে।
ইকবাল এর মায়ের কল আসলো।
বাবা রূপাকে নিয়ে তো বের হতে পারতি?
ইকবাল: মা সেই সময় কি চলে যাচ্ছে? এতো তাড়াহুড়া কিসের?
ইকবালের মা হেসে বসে আচ্ছা আজ তাড়াতাড়ি আয় বাসায়।আর শোন অনুষ্ঠান আমাদের বাসায় ই হবে। তোর
বন্ধুদের বলে দিস সবাইকে।বেশি কেউ না শুধু আপনজন থাকবে।
ইকবাল: আচ্ছা বলে কেটে দিল।
বন্ধুদের সবাইকে বলতেই কেউ কেউ সান্তনা দিচ্ছে।কেউ আবার খুশির ভান করে মজা করছে।অনেকে আবার
বলছে তারা আগেই জানতো এটা টিকবে না।
ইকবালের মাঝে মাঝে মনে হয় সব কিছু ছেড়ে একা হয়ে যেতে। সে উপায় ও নেই।
রাত ৮টা নাগাত মুন্না লুবনাকে জানালো ইকবাল মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছে।জ্ঞান ফিরছেনা।
লুবনা শুনেই কান্না জুড়ে দিলো। মানুষটার যে ভালো চাইতেই দূরে সরে আসা।মানুষটার ক্ষতি সহ্য করা যে কখনোই
সম্ভব নয়।
মুন্নাকে নিয়ে হসপিটাল গেল।যেতেই মুন্নার এক ফ্রেন্ড ওই হসপিটাল এর ডক্টর।তার কাছে জিজ্ঞেস করতেই সে
বললো ইকবাল এখন সুস্থ তবে আর হাটতে পারবেনা মে বি।লুবনা কেঁদে বসে পরলো।
ইকবালের মা এসে লুবনাকে বলছে আমার ছেলেরে শেষ করার জন্য তুই আসছোস আবার?আমার ছেলে তোর জন্য
এমন বিপদে পরছে।তুই এখন ই চলে যা নইলে আমি এই হসপিটাল এ ওকে রাখবোনা।ইকবালের মাকে বলা হলো
ইকবালকে সকালেই বাসায় নিয়ে যেতে। লুবনাকে ইকবালের মা ইকবালের আশেপাশে আসতে দিলো না।একবার
চোখের দেখাও দেখতে দিলনা।
ইকবাল ওর মাকে বলছে আজ না রূপাকে আংটি পরানোর কথা?
ইকবালের মা চোখ মুছে বলে তুই সুস্থ হয়ে নে।
ইকবাল: না যেহেতু বেঁচে আছি আজ ই আংটি পরাবো। তুমি তাদের আসতে বলো।আমার ফ্রেন্ড রাও আসবে।
ইকবালের মা হাসি মুখে চোখ মুছে ভাবছে ছেলের মাথা থেকে ওই মেয়ে সরেছে তাহলে।লুবনা বাসায় গিয়ে নিজের
ইকবালের ছবি নিয়ে কাঁদছে।
মুন্না এসে বলে চল ইকবাল কে দেখে আসি বাসায় গিয়ে।
লুবনা: আজ ওর বিয়ে ঠিক হবার কথা।
মুন্না: হুম আজ গেলে মানুষ এর মাঝে ওর মা কিছু বলতে পারবেনা।
লুবনা: না থাক।
মুন্না: ওকে দেখতে ইচ্ছে করেনা?ওর এতো বড় বিপদের পর ও না?
লুবনা: হুম খুব ইচ্ছে করে।দূর থেকে দেখতে পারলেও হবে।
দুজন তৈরী হয় ইকবালের বাসার দিকে রওনা হলো।বাহির থেকেই দেখছে সারাবাড়ি বাহারি বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে।যেমন টা লুবনার বিয়েতে হয়নি।
অনেক আগ থেকেই হয়তো ইকবাল তার মা এসব আয়োজন করেছে।
লুবনা বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।
মুন্না উঠে বলে কিরে যাবি না।অনুষ্ঠান শুরু হবার আগেই চলে আসবো দেখে।
লুবনা: ভাইয়া আমি শক্ত থাকতে পারবো ওকে দেখার পর?আচ্ছা মেয়ে কি খুব সুন্দরী?
মুন্না: তা জানতে হলে উপরে যেতে হবে।
সারাবাড়ি লোকজন এর আনাগোনা। বাসায় গিয়ে দেখছে ড্রয়িং রুমেই সবাই বসে।লুবনা ভিতরে যেতেই ইকবাল
লুবনাকে দেখে তাকিয়ে আছে।
মেয়েটার মাত্র কয়েকদিনে মুখ শুকিয়ে গেছে।
ইকবাল কে দেখে বার বার ভিতর থেকে কান্না চলে আসছে।
পাশেই এক মেয়ে সুন্দর ভাবে সেজেগুজে বসা।লুবনা ওর দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে ফেললো।
ইকবালের মা বার বার কথা ঘুরিয়ে বলছে কি বেপার আংটি পরাবে কখন।অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে।
ইকবাল ওর মাকে বলে মা পরাচ্ছি।আমার কিছু কথা আছে।
পাশে থাকা রূপার বাবাকে বলে আংকেল আপনি কি জানেন ডাক্তার বলেছে আমি আর কখনো হাটতে পারবোনা।আমার মনে হয় এসব আপনার জানা উচিৎ।
মেয়ের বাবা উঠে বলে কই আমরা তো এসব জানিনা।
মেয়ের মা ইকবালের মাকে বলে কি বেপার ভাবি আমাদের তো এসব বললেন না।বলেছেন কয়েকদিন হাটতে বারন করেছে তাই হুইল চেয়ালে চলাফেরা করবে।
ইকবালের মা থতমত খাচ্ছে বারবার।
মেয়ে উঠে গিয়ে বলে বাবা একবার আমি ঠকেছি তাই বলে বারবার।আমি এতো বোঝা হয়ে গেছি যে না জেনেই বিয়ে দিতে চাও?এই বলে রুম থেকে চলে গেলো।
সাথে মেয়ের মা-বাবাও চলে গেলো।
ইকবালের মা রাগ করে বলে ওই মেয়েকে দেখে তুই এমন করলি তাইনা?ওই মেয়ে কি তোকে এই অবস্থায় মেনে নিবে নাকি?সব ই জানা আছে।ভালোবাসা সব ই পালায়।আমার আর কি!আমার ছেলে আমি তো ফেলে দিতে পারবোনা।
ইকবাল লুবনার দিকে তাকিয়ে বলে ওকে নিতে বলবোনা।এমন পঙ্গুর সাথে থেকে আজীবন নষ্ট করবে নাকি!ওর ভবিষ্যৎ আছেনা।
লুবনা ইকবালের পাশে এসে বসলো মেঝেতে।হুইল চেয়ার ধরে বললো,পঙ্গু হও আর যাই হও আমার কাছে তুমি আগেও যেমন ছিলে এখনো তেমন।এতোদিন তোমারটা খেয়েছি -পরেছি আজ না হয় আমি চাকরি করে তোমার সেবা করলাম।কি এটুক করতে দিবা আমায়?এই বলে কাঁদছে।
ইকবালের মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
ইকবাল ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে কি মা দেখলে আমি মানুষ চিনতে ভুল করিনি।ও আমি পঁচে গলে গেলেও আমায় ছেড়ে যাবেনা।
ইকবালের বন্ধুরা সবাই হেসে বলে ইকবাল ভাবতেই পারিনি আমরা ভাবির মন এতো বড়। এর মাঝেই আরেকজন উঠে বলে আমি লুবনাকে আগে দেখেই বুঝেছি মেয়েটা ইকবাল কে খুব ভালোবাসে।সম্পর্ক কি আজ থেকে সেই কবে থেকে জেনে আসছি।
ইকবালের মা বলে লুবনা ওকে নিয়ে রুমে যাও।
হুইল চেয়ার নিয়ে ভিতরে যেতে নিলেই ইকবাল বলে দাড়াও।বাকিটা না হয় আমি ই যাই।
লুবনা: মানে?
ইকবাল নিজের পায়ে উঠে দাড়ালো।
লুবনা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সাথে ইকবালের মাও।বন্ধুরা সবাই অবাক হয়ে বলে এ কিরে?
ইকবাল হেসে বলে আমার কিছুই হয়নি।
লুবনা: তাহলে এসব অভিনয়?
ইকবাল: হুম অভিনয় না করলে জানতাম কি করে তুমি অভিনয় করেছিলে?মাঝে মাঝে অভিনয় করতে হয় নাকি মুন্না ভাই?
মুন্না হেসে বলে হ্যা একদম
লুবনা মুন্নার দিকে তাকিয়ে বলে তার মানে ভাইয়া এসব তুমিও জানতে?
ইকবাল: ভাইয়াই তো আমায় কল দিয়ে বললো লুবনা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।বাদ বাকি ভাইয়ার ই প্লান।
ইকবালের মা উঠে বলে তুই আমার সাথেও অভিনয় করো?
ইকবাল ওর মাকে ধরে বলে মা তাহলে কি জানতে তোমার ছেলেকে কে ভালোবাসে?আর কে ভালোবাসে সম্পত্তি কে?লক্ষি মা আজ তোমার ছেলে সুস্থ কাল যে পঙ্গু হবেনা তার কোন গ্যারান্টি আছে?ওই মেয়ে তখন তো ছেড়ে যেত আমায়।
মা কাঁদছে আর বলছে মুখে কিছু আটকায়না তোর।এই নে এই আংটি ওকে পরিয়ে দে।
ইকবাল হেসে ওর মায়ের কপালে চুমো দিয়ে বলে আমি জানতাম আমার মা অবুজ না।
আংটি লুবনাকে পরিয়ে দিল।লুবনা নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে।
বন্ধুরা সবাই বললো আমরা এইবার ইকবালের বিয়ে ধুমধাম করে দিবো আগেরবার বেটা একা একা বিয়ে করেছে।
লুবনা মুন্নার কাছে গিয়ে বললো আজ তুমি না থাকিলে এতো কিছু আমি পেতাম না।
সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে আড্ডা শেষ এ ঘুমাতে গেল।লুবনা ইকবাল রুমে গেলো।
লুবনা: আবার ভেবে দেখো কালো মেয়েকে বিয়ে করবে কিনা?
ইকবাল: উম..আচ্ছা তাহলে ওই মেয়েকেই করি কি বলো? সুন্দরী আছে।
লুবনা ইকবালের কলার ধরে বলে একদম পঙ্গু বানিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখবো বুঝলা?তারপর সারাদিন ঘরে বসে আমাকেই ভালোবাসবা।
ইকবাল: আমার চোখ দুটা তুমি নিজের চোখে লাগিয়ে দেখতে পারো?
লুবনা: কেন?
ইকবাল: তাহলে বুঝতা আমার চোখ তোমায় কত সুন্দর দেখে।আমি মিথ্যে বলিনা।সব চোখ এর ই দোষ।
লুবনা জড়িয়ে ধরে বলে এ জীবনে তোমার কাছ থেকে যেতে চাইনা আর।
ইকবাল নাক মলে বলে পরকালে যেতে চাও বুঝি?একদম খুন করে নিজে মরবো দরকার হলে।
সব বন্ধুরা এসে হাজির।সবাই হো হো করে হেসে বলে ইকবাল আজ আমাদের সাথে ঘুমাবি চল।
ইকবাল: কেন রে?এমন শাস্তির মানে কি বুঝলাম না।
বন্ধুরা উঠে বলে আরে বেটা বিয়ে হয়নায় এখনো।
ইকবাল লুবনার দিকে তাকিয়ে বলে ওরা কি বলে এসব পাগলের মতন?তুমি।কিছু বলো।
লুবনা: যাও বের হও রুম দিয়া।ইসলামে অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে একসাথে থাকতে নেই ভুলে গেলা?
ইকবাল মুচকি হেসে বলে ও আমার লজিকে আমারে কাত করা হচ্ছে?আচ্ছা বেপার না।আমারো সময় আসবে।লুবনা দরজা বন্ধ করে ওদের ছবির দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। এ কান্না সব কষ্ট মুছে দেয়ার কান্না।এমন কান্না আজীবন কাঁদলেও কোন আক্ষেপ নেই।
……………………………………………… সমাপ্ত ………………………………………………