তুনি

তুনি

সকাল_৭টা ……….

অফিস যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।

লোকাল বাসগুলোও আজকাল সকালবেলা অনেক জামপ্যাক্ট থাকে।

অনেকসময় তো সিটও পাওয়া দুস্কর হয়ে যায়।

তো অনেকগুলো টেনশন মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

হঠাৎ আমার বাম হাতের মধ্যাঙ্গুলিতে কিছু একটার স্পর্শ পেলাম।

মনে হল আঙ্গুলটাকে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

অনেকটা বিষ্ময় নিয়ে নিচের দিকে তাকালাম……….

.

দেখলাম প্রায় দুই – আড়াই বছরের কোন এক সম্ভ্রান্ত

পরিবারের একটা মেয়ে আমার হাত ধরে রেখেছে।

 

মেয়েটা কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের, বুঝলাম তার পোশাক-আশাক দেখে।

দেখেই বুঝা যাচ্ছে কোনরকম হাটতে পারে বাচ্চাটা।

 

আমি ওর দিকে তাকাতেই,ও আমাকে বলল,

“বাব্বা কোলে ” বলেই হাতদুটো বাড়িয়ে দিল আমার দিকে।

আমি স্বভাবতই ছোট বাচ্চাদের প্রতি একটু দুর্বল।

আর

বাচ্চাটাও একটু বেশিই কিউট।

তাই কোলে তুলে নিলাম। স্বভাবতই ছোট ছোট

গালগুলোতে একটা চুমু দিলাম।

কি আশ্চর্য! সেও আমার গালে একটা হামি খেল।

আমি তো অবাক। ওর বাবা-মা এই কিউট

পিচ্চিটাকে কে এইভাবে ছেড়ে দিল?

আমি হলে তো বুক থেকে সরাতামই না।

অবাক হয়ে আশপাশে তাকাতে লাগলাম।

অপেক্ষা করতে থাকলাম, এখনই হয়ত অর মা-

বাবা দৌড়ে আসবে।

 

প্রায় পনের মিনিট ওকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু ওর

মা-বাবার তো কোন খোঁজ-খবরই নেই। ওকে কিছু

জিজ্ঞেস করাটাও বোকামি।

বাচ্চা মেয়ে, নামটাও মনে হয় জানে না।

এদিকে আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিছু

একটা তো করা দরকার।

বাধ্য হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম কি?”

আমকে অবাক করে দিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,

“তুনি”।

বুঝে নিলাম ওর নাম তুলি। কিন্তু তুনি নামটা অনেক

আদুরে। ভাল লাগল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আর

কোন তথ্য সে দিতে পারল না।

এদিকে আমি পড়লাম বিপাকে। এতটুকু

মেয়েকে এখানে একা রেখে যাওয়া সম্ভব না।

আবার বাসায় গেলে অফিসে দেরি হয়ে যাবে।

বাধ্য হয়ে ওকে নিয়েই বাসে উঠে গেলাম।

সোজা অফিসে এনে আমার টেবিলের উপর

বসিয়ে দিলাম। কলিগরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

একজন তো বলেই ফেললেন, “প্রশান্ত দা

বিয়ে তো এক সপ্তাহ পর। এর আগেই

বাচ্চা নিয়ে চলে এলেন?”

সঙ্গে সঙ্গে হাঁসির রোল পড়ে গেল।

আর আমি নির্বোধ বালকের মত সব সহ্য করলাম।

হঠাৎ তুনির দিকে তাকিয়ে দেখালাম সেও হাসছে।

এটা পিচ্চিদের একটা বৈশিষ্ট্য,

যে কাউকে হাঁসতে দেখলে হাঁসে।

কিন্তু আমি অবাক হলাম।

মাকে ছাড়া এতটুকু বাচ্চা এখনও আছে কিভাবে?

তাও আবার অপরিচিত পরিবেশে…!!!

.

পিয়নকে ডেকে তুনির জন্য জুস আর চিপস

নিয়ে আসলাম।

চিপস খেল না। অনেক কষ্ট

করে কোলে নিয়ে জুসটা খাওয়ালাম। খাওয়ানোর

পর টেবিলে বসিয়ে বললাম, “মামনি,

এখানে চুপটি করে বস। বাবা কাজ করি। ঠিক আছে?”

সেও মাথা নেড়ে সায় দিল।

তাকে সামনে রেখে কাজ শুরু করলাম ।

কলিগরা অনেক কিছুই বলল। পরে সব বুঝিয়ে দিতেই

চুপ হল।

.

মেয়ে কলিগগুলো কিছুক্ষন পর পর

এসে তুনিকে আদর করে যাচ্ছে, গাল

টেনে দিচ্ছে।

কিছুই বলছে না সে। আমি তাকে যতই দেখছি ততই

আশ্চর্য হচ্ছি।

অফিসে প্রায় পাঁচ ঘন্টা হতে চলছে, এতক্ষন পর্যন্ত

মেয়েটা একটা টু শব্দটিও করে নি।

এটা তো ছোট বাচ্চাদের বৈশিষ্ট্য না।

.

কাজ করতে করতেই হঠাৎ ওর

দিকে তাকিয়ে দেখি কিছুক্ষন পর পর হাই তুলছে।

তাও বসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

বুঝলাম এই মেয়ে সাধারণ মেয়ে না বাপু।

কিন্তু ওকে তো ঘুমাতে দেয়া উচিত।

হাত বাড়িয়ে কোলে নিলাম। কোলে আসার প্রায়

সঙ্গে সঙ্গেই তুনি ঘুমিয়ে পড়ল।

এখন কি করি? এখানে তো কোন বিছানার

ব্যবস্থা নেই। আর আমি কোলেও রাখতে পারব না।

কিছু কাজ করতে হবে।

হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি এল।

তুনিকে টেবিলের উপর একটা টাওয়েল বিছিয়ে এর

উপর শুইয়ে দিলাম। আর মাথার নিচে কিছু ফাইল

দিয়ে বালিশ বানিয়ে দিলাম।

ব্যাস আমি নিশ্চিন্ত।

.

কিছুক্ষন পর পিয়ন এসে বলল ,এমডি স্যার

মিটিং ডেকেছেন,

কনফারেন্স মিটিং।

শুধু আমার না অফিসের সবার কাছেই

সবচেয়ে বোরিং মিটিং এটা। তাছাড়াও তুনি ঘুমুচ্ছে।

যাই হোক পিয়নকে বললাম, সে যেন তুনির

দেখাশোনা করে।

পিয়ন সায় দিল। আমিও মিটিংয়ে চলে এলাম।

.

বোরিং মিটিং শুরু হল। মিটিংয়ের আগে সবাই

মিলে আমকে অগ্রিম বিয়ের শুভকামনা জানালেন।

তুনিকে নিয়েও কিছু কথা হল। এমডি স্যার আমার উপর

একটু স্নেহপরায়ণ।

তিনি কিছু কথা বললেন,তারপর মিটিং শুরু করতে যাবেন,

ঠিক সেই সময় পিয়ন এসে জানাল, তুনি ঘুম

থেকে উঠে আমাকে না পেয়ে খুব

কান্নাকাটি করছে।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। যে মেয়ে মা-

বাবাকে ছাড়া এতক্ষণ ছিল সেই মেয়েই

আমকে এক

নজর না দেখেই কান্না করছে….!!!

অদ্ভুত!

এমডি স্যারকে বুঝিয়ে বললাম,

তুনিকে মিটিংয়ে আনলে তেমন সমস্যা হবে না।

আমার কথা রাখলেন এমডি স্যার।

তারপর আমি তুনির কাছে গেলাম।

কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা চোখ

ফুলিয়ে ফেলেছে। আমকে দেখেই

কাঁদতে কাঁদতেই হাত বাড়িয়ে দিল সে।

আমি কোলে নিতেই কান্না থামল।

একটু আদর করে মিটিংয়ে নিয়ে আসলাম। আসার

আগেই অবশ্য ওকে বলে দিয়েছি ,সে যেন

কোন শব্দ না করে।

আমার বিশ্বাস ছিল, তুনি কোন সমস্যা করবে না।

ঠিকই সারা মিটিং সে আমার

কোলে চুপটি করে বসে থাকল। একটা টু শব্দও

করেনি। যাই হোক আজকের মিটিং টা সবার ভালই

গেল।

কারণ এই তুনিই …………………

.

আজ আবার আমার হবু বৌ  নীলাঞ্জনার সাথে বিয়ের

আগের

শেষ ডেট করার কথা। বিকাল পাঁচটায়।

.

তুনিকে নিয়েই পার্কে চলে গেলাম।

ওকে একটা ললিপপ ধরিয়ে দিলাম। আর আমি কিছু বাদাম

কিনে নিলাম।

তারপর আমরা বাপ-

বেটি একটা বেঞ্চে বসে নীলাঞ্জনার জন্য

অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কথায় আছে অপেক্ষার প্রহর অনেক কষ্টদায়ক।

কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল অপেক্ষার প্রহর

অনেক আনন্দের। কারণ এই তুনিটাই।

কিছুক্ষন পর পর ওর দিকে তাকিয়ে একটা হাঁসি দেই।

সেও মুখ থেকে ললিপপটা বের

করে আমকে একটা হাঁসি ফেরত দেয়।

এভাবে সুন্দর

কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত করতে লাগলাম।

.

অনেকক্ষণ পর নীলাঞ্জনা এল।

আমি ঠাট্টা করে তুনিকে বললাম, এইত মাম্মি।

..

তুনিও খুব সুন্দর করে “মাম্মি কোলে”

বলে নীলাঞ্জনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

কিন্তু নীলাঞ্জনা কোলে নিল না। ও বলল,

-কিসের মাম্মি,

কিসের বাপি?

-এইত তুমি মাম্মি আর আমি বাপি।

-এই তোমাকে না বলেছি কতবার আমার সাথে রহস্য

করে কথা বলবা না।

-আচ্ছা আচ্ছা বাবা।

তারপর নীলাঞ্জনাকে সকালের সব ঘটনা বললাম।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে নীলাঞ্জনা খুবই রিএক্ট

করল। ও মনে করল তুনি আমার কোন পাপেরই

ফসল।

হাজার বার বোঝানোর পরও নীলাঞ্জনা বুঝতেই

চেষ্টা করল না।

আমাকে কিছুক্ষন যাচ্ছে তাই বলে চলে গেল।

আমি কিছুই বললাম না। শুধু মুখ বুজে সব শুনলাম।

তারপর পিছন থেকে ওর পথের

দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এতক্ষন তুনির দিকে একবারও তাকাই নি। চোখ

পড়তেই

দেখি, ললিপপটা হাতে নিয়ে বসে আছে মেয়েটা।

ও কি কিছু বুঝেছে?

অবশ্য বোঝার কথাও না।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে দিল আমার

দিকে।

তারপর ওকে কোলে নিয়ে আমি বাসার

দিকে রওয়ানা হলাম…।

 

(২)

তুনিকে নিয়ে প্রথমে থানায় গেলাম। তারপর যাবতীয়

কাজ কর্ম করলাম। থানা জিনিসটাই আমার কাছে চরম

বিরক্তিকর। থানায় অনেক ঝামেলা। মানুষ আর

আসামি মিলে একেবারে ভরপুর।

তো যাই হোক, কাজ সেরে থানা থেকে বের

হবার

সময় ওসি সাহেব আমাকে থামিয়ে বললেন, “মিস্টার

প্রশান্ত, আপনার এই মেয়েটা খুবই শান্ত। থানার মত

জায়গায়

কোন শব্দ না করেও এখন পর্যন্ত আছে।”

কথাটা গতকাল বললেও অবাক হতাম। কিন্তু আজ সারাদিন

তুনির এই অনন্য

স্বভাবটা দেখতে দেখতে আমি অভ্যস্ত

হয়ে গেছি। তাই আমি খুব একটা আশ্চর্য হলাম না।

ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে তুনিকে নিয়ে বাসার

দিকে রওয়ানা হলাম।

 

দরজা খুলল আমার ছোট বোন নিতু।

খুলেই বলল,

-কিরে এই পিচ্চিটা কার?

এমা! কি কিউট!

বুঝলাম এখন হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

কিন্তু আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিতু

তুনিকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল।

আমি ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই নিতু বলল,

-কিরে বন্ধ করছিস কেন?

-তো কি করব?

-ওর বাবা-মা কই?

-জানি না।

-জানি না মানে? এইটা কার

মেয়ে একটা চুরি করে নিয়ে আসলি?

-ধেৎ যা এখান থেকে।

নিতু তুনিকে নিয়ে রান্নাঘরে মায়ের কাছে গেল।

আমি চুপ করে আমার রুমে এসে চেঞ্জ

করতে লাগলাম।

তারপর বসে বসে ভাবতে লাগলাম, মায়ের প্রশ্নের

প্রাথমিক মোকাবেলা কি হতে পারে……

 

কিছুক্ষণ পর মা আসল। কোলে তুনি। খুব

হাঁসছে মেয়েটা।

মনে মনে বললাম, “হাঁস হাঁস , তোর তো এখন হাঁসার

সময়। আর আমি কাঁদি………”

মা খুব স্বাভাবিকভাবেই

জিজ্ঞেস করলো,

-কিরে এই পিচ্চি পরীটাকে কোত্থেকে আনলি?

-কই আনলাম? আনি নাই তো।

-আচ্ছা পুরো ঘটনাটা বল দেখি…………

…………বুঝলাম মাকে মনে হয় তুনি আমাদের

দলে নিয়ে এসেছে।

তারপর সব ঘটনা বললাম। সব শুনে মা বলল,

-এখন কি করবি?

-কি করব তো বুঝতে পারছি না।

-কিছু একটা তো করতে হবে, নাকি?

-কি করব? থানায় খবর দিয়েছি।

-ও আচ্ছা দিয়েছিস। তাহলে ঠিক আছে।

তারপর তুনিকে নিয়েই মা আর নিতু চলে গেল। এখন

আরেকটা বিরাট পাহাড় সমান ঝামেলা হল

বাবাকে বোঝানো।

কিন্তু কিভাবে যেন মা বুঝিয়ে শুনিয়ে বাবকেও ঠিক

করে ফেলল।

যাক…

আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, ঘর

সামলানো গেল।

কিন্তু বাইরের কি হবে…………

 

ব্যাপারটা কেমন যেন একটু দ্রুতই ঘটে গেল।

অনেকটা স্বপ্নের মত………

কিছুক্ষণ পর নীলাঞ্জনার বাসা থেকে ফোন এল।

ফোনটা মার মোবাইলে আসল।

স্বভাবিকভাবেই মা লাউড স্পিকারে আমাদের

শুনিয়ে শুনিয়ে কথা বলা শুরু করলেন।

 

আমার হবু শ্বাশুড়ি অনেক কথা বললেন।

যদি একটা ছুড়ি দিয়েও কেটে দিতেন তাহলেও

মনে হয় এতটা খারাপ লাগত না।

তার সব কথার মূল কথা হল আমরা তাদের

ঠকাতে চেয়েছিলাম। ভাগ্যিস তুনি মেয়েটা এল।

নাহলে তো তার মেয়ে নীলাঞ্জনার জীবনটা তছনছ

হয়ে যেত। মায়ের কোন কথাই তিনি শুনলেন না।

না না মাকে তো তিনি কথাই বলতে দেন নি। নিজেই

ফোন করে নিজেই বলে আবার নিজেই খট

করে মোবাইল রেখে দিলেন।

 

কয়েকঘন্টা আমদের ঘরটা যমপুরীর মত নিস্তব্ধ

ছিল।

নিরবতা ভাঙল আমার ফোনের রিংটোনে।

থানা থেকে ফোন এসেছে।

ওসি সাহেব জানালেন যে, তুনি কোন ঘর

থেকে হারায় নি।

“স্বপ্নচাতক” নামক এক

এতিমখানা থেকে হারিয়ে গিয়েছে তুনি।

অতএব আগামীকাল সকালে আমার প্রথম কাজ দাড়াল

তুনিকে ফেরত দিয়ে আসা।

 

এখন মোটামুটি ঘরে একটু শান্তি বিরাজ করছে। বলাই

বাহুল্য , এর কারণ তুনিই। আমাদের ঘরে কোন

ছোট

বাচ্চা কাচ্চা নেই।

সুতরাং বাচ্চা কাচ্চা আসলে যা করে আর কি, দৌড়াদৌড়ি,

লাফালাফি, জিনিসপত্র আগোছালো করা, এসমস্ত কাজ

গুলো আমাদের ঘরে অনেকদিন হয় না।

আমরা মনে করলাম তুনি আবার সেই

সতেজতা ফিরিয়ে আনবে।

কিন্তু তুনি এসব কিছুই করল না,

কিন্তু সতেজতা ঠিকই ফিরিয়ে আনল।

ওর খেলা হল, একপাশে মা আর আরেকপাশে নিতু

থাকবে।

তুনি দৌড়ে একবার মার কাছে যাবে, আরেকবার

যাবে নিতুর কাছে।

তেমন ভালভাবে হাটতে পারে না তুনি।

যেটুকু হাটতে পারে ওটুকু দিয়েই

সবাইকে মাতিয়ে রাখছে। এমনকি বাবাকেও……..

 

বাবা সোফায় বসে কি যেন পড়ছিল, তুনির হাটার

পথে একবার গিয়ে বাবার পা ধরে বসে থাকল।

বাবা কোলে নিতেই তুনি বাবার গোঁফ ধরে ঠুশ

করে দিল এক টান।

সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাঁসতে হাঁসতে শেষ। বাবাও

হাঁসছেন।

এই কয়েকঘন্টায় তুনি সবাইকে অনেক আপন

করে ফেলল…………

 

সকালে ঘুম

থেকে উঠে নাস্তা সেড়ে তুনিকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম

ওর আসল ঠিকানার উদ্দেশ্যে………

কোনরকমে খুঁজে বের করলাম এতিমখানা টা।

অনেক হাই ফাই টাইপ এতিম খানা।

এতিমখানা সম্বন্ধে তেমন আইডিয়া আমার নেই। কিন্তু

এই এতিমখানাটা আসলেই অন্যরকম।

 

যাই হোক অফিসে খোঁজ নিতেই

তারা তুনিকে চিনে ফেলল।

ওরা ওকে ভেতরে নিয়ে গেল। এই

পরিসরে আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে কথা বলার

একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।

কিন্তু উনি জানালেন তুনির ব্যাপারটা ক্লাসিফাইড।

উনি যতটুকু

জানেন তাই বললেন। আর ওই অতটুকু শুনেই আমার

মাঝে একাধারে রাগ আর দুঃখ জমাট

বাধতে লাগল………..

 

তুনির বাবা এই শহরের একজন নামকরা ব্যাবসায়ি।

কোটিপতি যাকে বলে।

কয়েক মাস আগে ওর মা একটা রোড

এক্সিডেন্টে মারা যান। আর এই

পরিসরে তিনি দ্বিতীয়

বারের জন্য বিয়ে করতে যাচ্ছেন। তাই পথের

কাঁটা তুনিকে এই এতিমখানায় রেখে গেছে।

 

আমি কিছুক্ষন কথা বলতে পারলাম না………………

অনেকক্ষন পর……..

তুনিকে শেষ বিদায় দিতে হবে।

ওকে যখন আমার সামনে আনা হল তখন আমার

গলাটা কেমন যেন ধরে এল।

কথা বলতে পারছি না আমি। ওখানকার একটা মহিলার

কোলে তুনি।

ওকে দেখে বুকের বাম

পাশে একটা চিনচিনে ব্যাথা করতে লাগল।

নাহ ওর অসহায়ত্বের জন্য নয়…… আমার নিজের

অসহায়ত্বের জন্য…….

এটা ভেবে যে আমি কি কাপুরুষ……..

.!

একটা বাচ্চা মেয়েকে আশ্রয় দিতে পারলাম না…!

ওকে কোলে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ

দাড়িয়ে থাকলাম। তুনিও আমার বুকে পরম আস্থায়

ঘাপটি মেরে থাকল।

ও কি জানে, আমার মনে কি ঝড় বইছে…………?

 

তারপর এল সেইক্ষন……

কিছুতেই যেন ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।

আমি জানি, তুনিকে আমি যদি এখন রেখেও যাই তারপরও

ও এখানে থাকবে না।

তাই বুক থেকে সামনে এনে বললাম,

“মামনি , কিছুক্ষন থাক এখানে।

বাবা আবার এসে নিয়ে যাব তোমায়।”

কথাটা মিথ্যা। আমার এই কথাটাতে তুনি কখনো কিছুই

বলে নি। কিন্তু আজ যেন সেও

বুঝতে পারছে আমি আর ফিরে আসব না।

আমাকে ছাড়তেই চাচ্ছে না। আমিও যেন আর

পারছি না।

পা দুটো জড় হয়ে আছে। নড়তেই পারছি না।

আমদের বাবা-মেয়ের ক্ষনিক অভিনয় টা হয়ত

কর্তৃপক্ষের কাছে ভাল লাগছিল না । জোর করেই

ওরা আমার কোল থেকে তুনিকে নিয়ে গেল।

কেমন যেন মনে হল তুনিকে না আমার কলিজাটাই

নিয়ে গেল ওরা………

 

আমি হাটার চেষ্টা করলাম। হাটতে পারছি না।

পা গুলো অবশ হয়ে আছে যেন।

অফিসে গেলাম না। বাসায় ফিরে এলাম। আমার মুখ

দেখেই মা সব বুঝে ফেললেন। কিছু বললো না।

আমিও আমার রুমে এসে শুয়ে পড়লাম।

লক্ষ্য করলাম ঘরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

মা-বাবা-নিতু সবাই কেমন যেন মনমরা হয়ে আছে।

ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করলাম।

চোখ বন্ধ করলেই শুধু তুনির কথাই

মনে পড়ে,ভেসে উঠে সেই নিষ্পাপ

আদুরে মুখটা…….

 

প্রায় দুই-তিন ঘন্টা এভাবে চলল।

আমার কানের মধ্যে শুধু

একটা ধ্বনি বাজছে ………..বাব্

বা………… বাব্বা………

……কোলে……

 

নাহ আর পারলাম না।

মাকে ডেকে সব কথা খুলে বললাম।

ভেবেছিলাম মা আমাকে কোন প্রবোধ দেবেন।

কিন্তু মা আমাকে যা বললেন তাতে আমি কি করব ঠিক

বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মা বললেন, “তুই এখন

যদি মেয়েটাকে না নিয়ে আসিস তাহলে আর বাসায়

আসবি না……”

 

কিছুক্ষন পর………. হাটছি আমি।

না না আসলে দৌড়াচ্ছি।

নাহ উড়ছি।

আসলে কি করছি আমি নিজেই জানি না। গন্তব্য

“স্বপ্নচাতক”…………

কিসের উপর দিয়ে যে এলাম নিজেই জানি না।

আমি পৌঁছাতেই ওখানকার লোকটা বলল,

-আরে ভাই আসছেন?

আমি তো ভাবছিলাম আপনাকে ফোন করে আনব।

-কেন? কি হয়েছে?

-আপনি যাবার পর থেকে তুলি তো কোন খাবার খায়ই

নি বরং ননস্টপ কান্না করে যাচ্ছে।

-বলেন কি?

-হ্যা। এই কিছুক্ষন আগে কাঁদতে কাঁদতেই

ঘুমিয়ে পড়েছে।

-আচ্ছা ওকে কি আমি নিয়ে যেতে পারি না?

-হ্যা অবশ্যই পারেন ।

একচুয়েলি আপনাকে সেজন্যই ফোন

দিতে চাচ্ছিলাম।

যদি আপনার আপত্তি না থাকে আর কি………..

-আমার আপত্তি ?

আশ্চর্য!

আমি তো এসেছিই তুনিকে নিতে……

 

কিছুসময় পর,,,,,

আমি এখন বাসায়।

আর আমার কোলে ছোট্ট

একটা ডানাকাটা পরী ঘুমুচ্ছে।

 

কিছুক্ষণ পর মা এলেন। বললেন,

-কিরে কিছু খেতে দিবি না মেয়েটাকে?

-হ্যা অবশ্যই। ঘুম থেকে উঠুক আগে।

তারপর

-আচ্ছা একটা কথা বলি?

-হুম বল।

-তোর বিয়েটা তো অনিশ্চিত হয়ে গেল রে।

আমি একটা রহস্যময় হাসি দিলাম।

তারপর বললাম, “যার এমন একটা পরীর মত ছোট্ট

মেয়ে আছে, তার কি কোন বউয়ের প্রয়োজন

আছে?

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ 

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত