কেউ একজন করোনা আক্রান্ত হওয়া মানেই তাকে ছুড়ে ফেলার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে।
জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আমার মামনির জ্বর, কাশি দেখা দেয়। এরপর এভারকেয়ার (Apollo) হসপিটালে করোনার টেস্ট করাতে দেয়া হয়। পরদিন দুপুর ৩.৪৪ এ আমাদের ফোনে জানানো হয় যে মামনি কোভিড পজিটিভ। ঐ মুহূর্তে আমরা চারজন মামনির ঘরে বসে গল্প করছিলাম। নিমেষেই মুখের হাসি উধাও। মামনিকে আলাদা রুমে থাকার ব্যবস্থা করে আমরা অন্য রুমে চলে এলাম। আমার চিকিৎসক স্ত্রী তাসনিম সাথে সাথেই করোনা চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব মেডিসিনের ব্যবস্থা করল।
আমরা তিনজন একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম কখনই মামনির সামনে কান্নাকাটি করবোনা বরং তাকে সাহস দেব।কিন্তু মামনি সন্ধ্যায় আমাদের ডেকে কোথায় ফ্ল্যাটের আর জমির কাগজপত্র আছে, কোন গহনা আমার বোন উপ্তিকে দেবে আর কোনটা তাসনিমকে এসব বলতে থাকলো। তখন আমরা কেউই নিজেদের সামলে রাখতে পারিনি। পরদিন যখন রিপোর্টের হার্ডকপি আনতে যাচ্ছি তখন বারবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি যাতে ফোনে জানানো রিপোর্ট ভুল হয়। কল্যানপুর থেকে বসুন্ধরার পথ যেন শেষই হচ্ছিল না। অবশেষে পজিটিভ রিপোর্টই হাতে পেলাম।
মামনি আলাদা রুমে থাকতেন কিন্তু কখনই আমরা তার রুমের দরজা লাগাতে দেইনি। আমরা রুমে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতাম, মাঝে মাঝে গিয়ে অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক করতাম, তাসনিম গিয়ে স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক, পিঠ চেক করত, উপ্তি গিয়ে গল্প করত। কখনই আমরা তাকে একাকিত্ব অনুভব করতে দেইনি। আমরা অবশ্যই মাস্ক পরিহিত অবস্থায় যেতাম, মামনির কন্টাক্টে যাওয়ার সময় ফেসশিল্ড ব্যবহার করতাম এবং ফিরে এসে নিজেদের স্যানিটাইজ করতাম। রাতে ঘুমানোর পর অন্তত দুইবার করে দেখতে যেতাম। আমি পরপর দুইদিন হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুম থেকে উঠেছি। খুব অসহায় লাগত। কয়েকজন আত্মীয় আর মামনির ব্রাঞ্চ ছাড়া কাউকেই জানাইনি। সবাই যে যার অবস্থান থেকে মতামত দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
বাসাতেই চিকিৎসা চলছিল মামনির। এরই মধ্যে এপোলো হসপিটালের করোনা স্পেশালিষ্ট Dr.K.F.M Ayaz এর সাথে একদিন ভিডিও কনফারেন্সের ব্যবস্থা করা হয়। উনি মামনির সাথে কথা বলেন এবং তাসনিমের দেয়া প্রেসক্রিপশন চেক করে দেখে বলেন সবই ঠিক আছে। তার পরামর্শ মতে মামনির ১০ রকম ব্লাড টেস্ট এবং চেস্ট এক্সরে করানো হয়। সবগুলো রিপোর্টেই সিরিয়াস কিছু পাওয়া যায়নি। কিন্তু করোনা ধীরে ধীরে তার কাজ চালাতে থাকে। এরই মধ্যে মামনিকে নেবুলাইজেশন, Remdisivir ট্যাবলেট ও Clexane ইনজেকশনও দেয়া হয়।হঠাৎ করে ঈদের আগেরদিন রাতে মামনির অক্সিজেন স্যাচুরেশন একবার ৯১, আরেকবার ৮৬ হয়ে যায়। তখন আমাদের আর দ্বিতীয় চিন্তা করার অবসর ছিল না। বাসার উল্টা পাশে অবস্থিত ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিট থাকলেও সেখানকার উচ্চ মুল্যের সিকিউরিটি চার্জ আর কনসালটেন্টদের সম্পর্কে ধারণা না থাকায় আমার স্ত্রীর পুরনো কর্মস্থল ধানমণ্ডি পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু সাথে কে যাবে আর কে থাকবে? উপ্তি যেতে চায় কিন্তু তাকে প্রথমেই না করে দেই কারন তার পক্ষে এতটা কষ্ট করা সম্ভব হত না। আমি যাব এবং মামনির সাথে থাকবো। তাসনিমকে বলি ভর্তি করিয়ে দিয়ে চলে এসো বাসায় কারণ তোমার Co morbidity আছে। কিন্তু সে রাজি হয়না, বলে তার সাথে থাকা জরুরি। নইলে পরিবর্তিত সিচুয়েশন আমি একা সামলাতে পারবোনা। তাসনিম তার সাবেক কলিগদের সাথে ফোনে কথা বলে খুব দ্রুত কেবিনের ব্যবস্থা করে ফেলে। আমরা যাওয়ার পর তারা মামনিকে প্রাথমিক চেকআপ করেই কেবিনে পাঠিয়ে দেয়।
দেখতে দেখতে ঈদের দিন শুরু হয়ে গেছে। একই কেবিনে আমি, মামনি আর তাসনিম। বাইরের আকাশ কাঁদছে, আর আমাদের ভিতরটাও কাঁদছে। গোসল হয়নি, খাওয়া হয়নি কিন্তু দুপুর হয়ে গেছে। পপুলারে বাইরের খাবার নিয়ে যাওয়া নিষেধ তাই কিছু আনতেও পারছি না। আর আনবোই বা কিভাবে ঈদের দিন তো সবই বন্ধ। কনসালটেন্ট আসলেন আর মামনিকে অভয় দিয়ে বললেন আপনার পাশে যে আছে তার ক্লিনিক্যাল আই অনেক ভাল। আপনি বেশ ভালো আছেন এবং নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। চেস্ট এক্সরে দেখে সেভাবে কিছু বোঝা না যাওয়াতে তাসনিম তাকে বলে যে ভাইয়া একটা সিটি স্ক্যান করাতে হবে কারণ আমি স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক, পিঠ চেক করার সময় ভালো মনে হয়নি। তখন উনি কনফার্ম হওয়ার জন্য সিটি স্ক্যান করাতে বলেন এবং তাসনিমকে এত বেশি এক্সপোজড হতে বারণ করেন। কিন্তু সে তার মতই নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে মামনিকে চেক করে গেছে। পরবর্তীতে মামনির ফুসফুসে ইনফেকশন ধরা পড়ে। অর্থাৎ যা আশঙ্কা করা হয়েছিল তা সত্যি।
এরপর প্রয়োজনীয় সকল ট্রিটমেন্ট, ডিউটি ডক্টরদের সার্ভিস এবং সর্বোপরি ডাক্তার ফুয়াদ ভাইয়ার পরামর্শে আমরা মামনিকে ৭ দিন পর বাসায় নিয়ে যেতে সক্ষম হই। প্রতিদিন টেস্ট , গাদাখানেক মেডিসিন আর ইনজেকশন নিতে দেখে আমি নিজেই দিশেহারা হয়ে যেতাম। মামনিকে এতটা অসহায় আমি কোনদিন দেখিনি। এতটা দুর্বল হয়ে গেছেন যে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ধরে তুলে দিতে হয়, নামাজ পড়ার পর আর বসে থাকতে পারেন না।
আমরা মামনির সাথে একই কেবিনে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা কাটিয়েছি। বাসাতেও তার কাছে গিয়েছি যখন যেভাবে দরকার হয়েছে। এখন তিনি করোনা নেগেটিভ হলেও শারীরিক ভাবে একেবারেই দুর্বল। মামনি নেগেটিভ হওয়ার পর আমরা তিনজনই টেস্ট করিয়েছি। আল্লাহর রহমতে সবাই নেগেটিভ। একজন করোনা রোগীর সাথে বসবাস করলেই করোনা হয়না, তাকে ছুঁলেই করোনা হয়না। আশংকা আছে, আশংকা থাকবে। সব মেনে নিয়ে একজন করোনা রোগীকে সাহস দিতে হবে আর নিজের ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে চলতে হবে। আমরা এখন নেগেটিভ মানেই যে পরে পজিটিভ হবোনা এমন কোন কথা নেই। কিন্তু মামনিকে সার্বক্ষণিক সেবা দিয়ে আমরা কেউই অন্তত আক্রান্ত হইনি।
অথচ মামনি নেগেটিভ হওয়ার পর একদিন আমি লিফটে উঠার পর আমার একজন প্রতিবেশী যিনি সবসময় আমার সাথে কথা বলেন তিনি সালামের উত্তর পর্যন্ত না দিয়ে নেমে গেলেন। অন্যদিন আরেক প্রতিবেশীর স্ত্রী আমি লিফটে উঠার পর লিফট থেকে নেমে যান। আবার আমার বাসার গৃহকর্মীকে বলা হয় আমাদের বাসায় যাতে না যায়। বড় তো হয়েছি আমরা , কিন্তু মননে বেড়ে উঠিনি। আবারও বলছি একজন করোনা রোগীর সেবা করলে কেউ অচ্ছুৎ হয়ে যায় না।তার থেকে আপনার ছড়ানোর আশংকা আছে।
কিন্তু নিজেকে প্রতিরোধ করার দক্ষতা আপনার থাকতে হবে এবং সেটা অবশ্যই অন্যের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না। মামনি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তার সব ফোনকল আমিই রিসিভ করেছি। আমি কেন তার ফোন ধরছি, তাকে কেন গায়ে হাত দিয়ে তুলছি এসব কথাও অনেকেই বলেছেন। আমার ভালোর জন্যই বলেছেন। কিন্তু জীবনের যেই অনিশ্চিত সময়টা আমি পার করেছি সেখানে নিজের কথা চিন্তা করার অবকাশ আমার আসেনি। আমার মায়ের মাহাত্ম্য বর্ণনা করার নয়। আমি এক বাক্যে স্বীকার করি মামনি ছাড়া আমি একটা Big Zero.
আপনাদের দোয়ায় মামনির শরীর ধীরে ধীরে ভাল হচ্ছে। কিন্তু তাকে যে আমরা এই পর্যায়ে আনতে পেরেছি সেজন্য কিছু কিছু মানুষের প্রতি আমার চরম কৃতজ্ঞতা। Dr. বাসিত ভাইয়া , Dr. তিথি আপু সার্বক্ষণিক নির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করেছেন। মামনির ব্রাঞ্চের ম্যানেজার বৃষ্টি আন্টির কথা না বললেই না। উনি সর্বদাই মামনিকে সুস্থ হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।কখনই অফিসিয়াল ঝামেলার কথা মাথায় আনতে দেননি। আমি যাতে অর্থ সংকটে না পড়ি সেজন্য অনলাইনে টাকা তোলার সময় উনি দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছেন। এই মানুষ গুলোর অবদান অনস্বীকার্য। আল্লাহ সবার মঙ্গল করুন।