আজ থেকে আরো কয়েক বছর আগে আমি ভাবছিলাম আমার বাড়ির সামনের বাগানের টেবিলের তিনটি চেয়ারে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিশোর দুর্দমনীয় জেদী গণিতবিদ এভারিস্ট গ্যালোয়া এবং চার্লস ব্যাবেজ একসাথে বসে চায়ের সাথে আড্ডা দিতেন তবে কেমন হতো।
নিজেদের বিষয়ের প্রশংসা করে অন্য বিষয় কে ছোট করে ঝগড়া লাগিয়ে দিতেন, নাকি তিনে মিলে নতুন দুয়ার উন্মোচিত করতেন, যে দুয়ার খুললেই গলে যেত নতুন কোনো যুক্তি,মানুষ পেতো নতুন কোন জ্ঞানের দিশা।সেদিন আমি আমার বারান্দার চেয়ারে বসে এসব বসে ভাবছিলাম আর সামনের টেবিল টা তে সদ্য পড়া শেষ করে রেখেছিলাম ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত হওয়া এইচ.জে.ওয়েলস এর টাইম মেশিন বইটি।সেখানে লেখক দেখিয়েছেন টাইম মেশিনের মাধ্যমে যাওয়া যায় সুদূর অতীতে এবং ভবিষ্যতে। সেটা পড়েই হয়তো,টাইম মেশিন এর সাহায্যের ওপর ভর করে, ওই তিন গুনী মানুষদের নিয়ে এসে আমার বাগানে বসিয়ে বাগানের শোভা বাড়ানোর ইচ্ছা জেগেছিলো। আমি সেদিন আমার প্রিয় চেয়ার এ বসে বসে ভাবছিলাম এসব অদ্ভুত চিত্র। আমি সেদিনের মতো আজও বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তবে সেদিনের আর আজকের মধ্যে পার্থক্য আছে বৈকি। সেদিন ছিল আমার কেবল আঠারো আর আজ পচাত্তরের এ দিক সে দিক। যাই হোক, আমি কোথায় যেনো শিখেছিলাম, দৈর্ঘ্য প্রস্থ এবং বেধ-এই তিনে মিলে ত্রিমাত্রিক এবং সময়সহ কোন বস্তু হয় চার মাত্রিক। সময়ের পরিবর্তন কোন বস্তুকে বিবর্তিত হতে বাধ্য করে। তাই জন্য হয়তো আমার সেই চেয়ার টা আজ আগের মতো নেই, ভাঙ্গা চেয়ারটাতে মাকড়সার বাসা আর ধুলো আশ্রয় করে নিয়েছে। আর চেয়ারের চারটে পায়া নিতান্তই খুব ই সুস্বাদু হিসেবে ঘুণপোকার খাদ্য হয়েছে। ঘুণপোকার অন্ত্রে নাকি এমন ব্যাকটেরিয়া আছে, যা কাঠ হজম করতে সাহায্য করায়। ভাগ্যিস! ব্যাকটেরিয়া গুলো ছিলো, না হলে কাঠ খেয়ে হজম করা ওই একরত্তি ঘুণপোকার পক্ষে কোন রকমই সম্ভব হতো না।
যাক সে সব কথা।বাগানের দিকে তাকানো যাক এবার।এক সময়ে বাগানের পরিচর্যা করার জন্য কয়েকজন লোক ছিল।ফাল্গুনে বাগান সেজে উঠতো নতুন সাজে, নতুন নতুন ফুলে নবযৌবনবতী কিশোরীর মত মনে হতো। এতো সৌন্দর্য্য, এতো ফুল, এতো প্রশান্তি ছিলো সেখানে, মনে হতো এ যেনো চির বসন্ত। আর এ বসন্ত, শরৎ সমীরন অনন্ত অম্লান । কিন্তু আজ!কোথায় গেলো সেই চির বসন্ত,চির উজ্জল উচ্ছ্বসিত ফুলের মেলা। সেই চতুর্থ মাত্রার সময়ের পরিবর্তনের কারনে, আজ সেখানে নিছক সরীসৃপ, পোকামাকড় আর অন্ধকারের বাস। বাড়ির পেছনদিক টাতেও একবার চোখ বুলিয়েছিলাম। দেখলাম একটা ছেলে খেলা করছে সেখানে। কচুপাতা হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছে, ছাই ওড়াচ্ছে বাতাসে, কখনো প্রত্নতত্ত্ববিদ সেজে মাটি খুঁড়ছে পুরোনো কিছু পাওয়ার আশায়। আমি যখন বাচ্চাটাকে ডাক দিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে, সমস্ত চিত্রখানি আমার চোখের সামনে থেকে মুছে গেলো, সেই বাচ্চাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো,সেই সমস্ত মুহূর্তটা তখন চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। আবার অন্ধকার সেই পুরনো সোঁদা গন্ধ আর মাকড়সার জাল ঘিরে ধরেছে পুরো সময়টাকে।আমার কেমন যেনো বুক টা ভারী হয়ে এলো।বুঝলাম ভ্রম ছিল পুরোটা আমার।মস্তিষ্ক নাকি মানুষকে ধোঁকা দেয়, আমাকেও ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে দেখিয়ে দিল আমার শৈশব।এ নিষ্ঠুরতা, প্রকৃতির কলহাস্যে উপহাস এটাই হয়তো আমার জীবনের অনিবার্য, অসহ্য বাস্তবতা।আমি আজ একজন বৃদ্ধ লেখক, হয়তো বুড়ো হওয়ার বাতিকেই, কথা বলার কাউকে না পেয়ে কলম এটে ধরে বসে, বেশি কথা বলছি। আজ আমার অদ্ভুত কল্পনার তেজোদীপ্ত রুদ্র সময় গুলো শেষ হয়ে গিয়েছে। সময়ের স্কেলে চেপে পৃথিবী অনেক দাগ অতিক্রম করেছে। ভৌত বিজ্ঞানের নিয়মানুযায়ী আমি এখন আমি জীবন সায়াহ্নে। আমার জীবন আজ একটি দিনের গোধুলী লগ্নের মতো,খুব শীঘ্রই নামবে প্রগাঢ় অন্ধকার।আজ আমি আমার পুরনো, পৈত্রিক বাড়িটাতে ঠায় দাঁড়িয়ে নির্লিপ্তভাবে। আমার সেই নব তারুন্য নিজের কৈশোরের কথা খুব মনে পড়ছে। আর খুব বেশি করে মনে পড়ছে, এইচ.জে.ওয়েলস এর টাইম মেশিন বই খানি।
গল্পের বিষয়:
জীবনের গল্প