সৎ মা

সৎ মা

তিনি আমার সৎ মা এটা আমি আমার বিয়ের আগেও জানতাম না ।
যেই মা নিজের জীবনের চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসে তিনি আমার সৎ মা ।
এগুলো আমার বিয়ের আগের দিন জানতে পারি ।
পাড়ার একজন চাচা আমাকে বললেন বিয়ের আগে তোমার মায়ের কবরটা জিয়ারত করে এসো ।
আমি তো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
মায়ের কবর মানে ? আপনার মাথা ঠিক আছে ?
আমার মা তো বাড়িতেই আছে চাচার সাথে খুব রাগারাগি করে বাড়ি চলে আসলাম ।
মন খারাপ করে বসে আছি,
মা জিজ্ঞেস করলো কিরে বিয়ের আগেই মন খারাপ করে বসে আছিস ?
মেয়ে তো তোর পছন্দের, তোর ইচ্ছেতেই বিয়ে হচ্ছে !
আচ্ছা তুমি তো আমার মা ?
হ্যাঁ, কিন্তু এগুলো এখন জিজ্ঞেস করছিস ?
তাহলে চাচা এগুলো কি বললো মায়ের কবর জিয়ারত করবো ? কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে আছে চাচার সাথে রাগারাগি করে এসেছি !
আচ্ছা মা চাচা এগুলো কি বললো ? সত্যিই তুমি আমার মা তো ?
মা কয়েক মিনিট নিশ্চুপ হয়ে বসে পড়লো নিরবে কান্না শুরু করে দিল আমি মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম চোখের জল মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম মা তুমি কাঁদছো কেনো কিছু তো বলো ?
মা কিছুটা স্বাভাবিক হয় বললো চাচা ঠিকই বলেছেন
আমি তো বড় ধরনের আঘাত পেলাম !
মা তুমি এগুলো কি বলছো ?
ঠিকই বলছি আজ থেকে ঠিক ২৬ বছর আগের কথা তোর বাবা যখন আমাকে বিয়ে করে তখন তোর বয়স মাত্র ৮ মাস তার ঠিক ১ মাস আগে তোর মা মারা যান ।

বিয়ের রাতে তোর বাবা আমাকে শুধু একটা কথাই বলেছিলেন আমাকে ভালোবাসতে হবে না শুধু আমার ছেলেটাকে মায়ের স্নেহ দিও ।
তোমার প্রতি আমার ভালোবাসায় কোন কমতি হলে আমাকে হাজারো অভিযোগ করো কিন্তু আমি কোন অভিযোগ করবো না তবে আমার ছেলেটা যেন কোনদিনই জানতে না পারে ওর মা মারা গেছে ও ওর সৎ মায়ের হাতে পড়েছে, কালকে হয়তো তুমিও তোমার সন্তানদের যত্নের জন্য থাকলে না তারাও তো সৎ মায়ের হাতে পড়তে পারে তাদের পালনের জন্য যদি আমাকে তৃতীয় বিয়ে করতে হয় ? কারণ আমার সন্তানদের পালনের জন্য আমার কোন আপন জন নেই । বিয়েই আমার একমাত্র ভরসা ।

তেমনি তুমিও আমার সন্তানটার জন্য শেষ ভরসা ।
বাকিটা তোমার ইচ্ছা ?
তোর বাবার কথা গুলো শোনার পর কিছুক্ষণের জন্য নিরব হয়ে গেছিলাম এগুলোর জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না, যে এমন একজন কে বিয়ে করতে হবে যার মনে ইতিমধ্যে একজনের স্মৃতি রয়েছে, কিন্তু আমরা গরিব বলে ইন্টার পরিক্ষা দেওয়ার পর এক সন্তানের বাবার সাথে বিয়ে করতে হয় ।

চুপ করে ছিলাম বুঝতেছিলাম না কি বলবো তারপর হুট করে বলে দিলাম ও আজ থেকে আমার সন্তান ও কোন দিনও জানতে পারবে না আমি ওর সৎ মা ।

তোর বাবা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আর আমিও কোন কষ্ট ছাড়াই মা হয়ে গেলাম ।
তারপর তুই ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিস তোর হাঁসি দুষ্টুমি প্রথম হাটা প্রথম মা ডাক এগুলো আমাকে পাগল করে দিত তোর হাঁসিতেই আমি খুশি ছিলাম, তুই হয়ে উঠলি আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, তোর মা ডাকে আমি বেহেস্তের সুখ খুঁজে পাচ্ছিলাম ।

আমার মাঝেই তোর সুখ আর তোর মাঝেই আমার পূর্ণতা, আমার আর দ্বিতীয়বার মা হওয়ার ইচ্ছা জাগেনি শুধুমাত্র তোর জন্য তোকে নিয়েই আমার সুখের সংসার ।

যখন তোর বয়স ৫ বছর কোন একটা কারণে তোকে মারি, পাড়ার এক মহিলা বলেছিল নিজের মা হলে এভাবে মারতে পারতো না সৎ মা বলেই মেরেছে ।

জানিস সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সারা রাত ঘুমাতে পারিনি, আমি কখনোই তোকে পরের ছেলে ভাবতাম না তাই হয়তো কষ্টটা একটু বেশিই পেয়েছিলাম ।

আমি তোর বাবার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা শহরে চলে যাবো, যেখানে তোকে কেউ বলবে না তোর নিজের মা নেই ।
সব আত্মীয় স্বজনদের বলে দিলাম কেউ যেন না বলে আমি তোর সৎ মা ।

তোকে শহরের একটা স্কুলে ভর্তি করলাম মায়ের নাম আমারটা দিলাম তোর বাবা শুধু একটু আড় চোখে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো ।
এভাবেই চলতে থাকে আমাদের সোনালী দিন গুলো তুই এস এস সি তে খুব ভালো রেজাল্ট করলি জানিস সেদিন আমি খুব স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম তোকে বলতে চাচ্ছিলাম তোর মায়ের কবরটা জিয়ারত করে আয় কিন্তু বলতে পারিনি ।

কিন্তু রোজ নামাজে আপুর জন্য দোয়া করতাম তোকে লুকিয়ে আমি আর তোর বাবা তোর মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে অনাথ বাচ্চাদের খাবার দিতাম ।

তারপর যখন তুই চাকরি পেলি মাসের প্রথম বেতন আমার হাতে দিয়েছিলি আর একটা শাড়ি সেদিনও বলতে চাচ্ছিলাম তোর মায়ের আত্মার শান্তি কামনা করে কিছু গরিব লোকদের জন্য খাবারের আয়োজন কর, এতটা স্বার্থপর হতে পারলাম না এজন্য সেদিনও কিছুই বলতে পারলাম না, নিরবে চোখের জল ফেললাম ।

তারপর তোর বাবা তোর বিয়ের জন্য আলাপ করতো তখন মনে মনে খুব খুশি হতাম কারণ আমি তোর বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে পেরেছি আজ তুই আমার পরিচয়ে এত দূর সত্যিই সেটা এক অদ্ভুত অনুভূতি ।
তোর বিয়ে ঠিক হলো, আমার ছেলের বিয়ে আমিতো খুশিতে আত্নহারা ।
কিন্তু আর স্বার্থপর হতে পারলাম না, নিজে বলার সাহস পেলাম না এজন্য তোর চাচাকে দিয়ে বললাম তুই যেন আপুর কবরটা জিয়ারত করে বিয়ে করতে যাস ।

এগুলো বলতে বলতে মা অঝোরে ধারায় কান্না করতে লাগলো
আর বলছে আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা আমি তোর সৎ মা, আপু সত্যিই খুব ভাগ্যবতী তোর মত সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছেন ।
আমি প্রচন্ড কান্নায় মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
মা আমি তোমারই ছেলে তুমিই আমার মা, তুমি আমাকে এত বেশি ভালোবাসে বড় করেছো আমাকে কিছুই বোঝার সুযোগ দাওনি ।
সেই মা আমাকে গর্ভে ধারণ করলেও তুমি আমাকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছো শুধু তোমারই কারণে আজ আমি এতদূর ।

মহান আল্লাহর কাছে অপরিসীম শুকরিয়া তিনি তোমাকেই আমার মা হিসেবে দিয়েছেন, আমার কাছে মায়ের ভালোবাসার চেয়ে মহান আর কিছুই নেই । আর এই ভালোবাসা তোমার থেকেই আমি পেয়েছি ।

এই এভাবে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ কাঁদবে ? চলো সন্ধ্যা হয়ে আসছে বাসায় চলো, যুথির ডাকে বাস্তবে ফিরে এলাম, এখন থেকে মন খারাপ হলেই মায়ের কবরের পাশে এসে দাড়িয়ে থাকি, মাঝে মাঝে মা-বাবা দুজনেই আমাদের সাথে আসে ।

মা এখনও আমাকে আমার মায়ের অভাব বুঝতে দেয় না, মা এখনও আমাকে মাঝে মাঝে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়, সত্যিই খুব ভালো লাগে সেই মূহুর্ত গুলো । আমি বড় হয়ে গেলেও আমার মায়ের কাছে এখনও সেই ছোট্ট খোকই রয়ে গেলাম ।

(হাজার বছর বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সকল মা বাবা)

_______সমাপ্ত_______

গল্পের বিষয়:
জীবনের গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত