সুবোধ বালকের মতো বসে আছে প্রদীপদা। একদিকে ডিজিটাল ব্যানারে বসা প্রদীপদা, অন্যদিকে সমুদ্র আজিজ। দু’জনের মাঝখানে ছবি আঁকার সরঞ্জাম। পাশেই স্টান্ডে দাঁড়িয়ে আছে রঙিন ব্যানার, তাতে লেখা– “পৃথিবীর যেকোন লোকের অবিকল জীবন্ত ছবি আঁকা হয়। সমুদ্র আজিজ (ফাইন আর্টস, চ.বি.)।” ব্যানার দেখেই নিশ্চিত হই দাড়িগোঁফয়লা ভদ্রলোকের নাম সমুদ্র আজিজ। সারাদিন প্রচন্ড খাটুনির পর রাতে বাসায় বউ-বাচ্চা নিয়ে টিভি দেখা কি আড্ডা দেয়ার সময়টা কবিতাচর্চায় খতম করা প্রদীপদা ঠাস করে বসে যায় সমুদ্রের বিজ্ঞাপনী ভাষায়। বিপরীত লিঙ্গ হলে হয়তো রসিকজন বলতেন, “মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন!”
প্রদীপদার লম্বাটে কেশরাজিকে বারবার নড়নচড়নের আমন্ত্রণ জানায় অভয়মিত্র ঘাটের বেশরম বাতাস। বারংবার কেশরাজি ঠিক করতে গিয়ে প্রদীপদার বিখ্যাত বদনখানিও খানিক নড়ে ওঠে। সমুদ্র আজিজ তাতে বিরক্ত হচ্ছে কি না বোঝা যাচ্ছে না তিনি বরং ধ্যানির মতোন চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন, হ্যাঁগো, একটু স্থির থাকতে হবেক! সাদা কাগজের বুকে পেন্সিলের দাগ বাড়ছে ক্রমশ; প্রদীপদা আর সমুদ্র আজিজের মুখোমুখিতে গড়িয়ে যাচ্ছে কর্ণফুলীর জল, কাছে ঘেষছে কাহাতক উৎসাহী ভ্রমণপিয়াসীদের চোখ।
২.
আচমকা দুপুরের দিকে আমার মুঠোফোনে প্রদীপদার তলব। আড়তের হিসবে নিয়ে তখনো কাহিল হলেও কলদাতা যখন প্রদীপদা এবং কথার শুরুতে তার বিখ্যাত সালামে গলে যাই আমি। প্রদীপদা জানায়, তিনি দেওয়ানহাট ধনীয়ালা পাড়ায় নেমন্তন খেতে এসেছেন এক আত্মীয়ের বাসায়। চাটগাঁ শহরে ধনীয়া চাষের পর্যাপ্ত জায়গা দেওয়ানহাটে না থাকলেও ওদিকের এলাকাগুলোর নাম বেশ চমক দেয়া; পানওয়ালা পাড়া, সুপারিওয়ালা পাড়া নামগুলো শুনে পাঠক হয়তো ভাববেন, ও জায়গায় বুঝি পান আর সুপারির বাম্পার ফলন হয়! পান-সুপারির আড়ত না-ই থাক, তবুও অমন নামের বরকতে এলাকাগুলো মোটামুটি বিখ্যাত। তা ধনীয়ালা পাড়ার কথা পাড়তেই, এই ভরদুপুরে প্রদীপদাকে বলি, তরকারিতে ধনেপাতা দিয়েছে তো? হাসাহাসির পর্ব শেষে প্রদীপদা জানায়, আধঘন্টার মধ্যেই তিনি আমার আস্তানায় আসবেন পিসিতোভাই উজ্জ্বলকে নিয়ে। বিদেশফেরত উজ্জ্বলদা আর প্রদীপদাকে নিয়ে সময় কাটানো কেবল আমার কেন যে কারো পক্ষেই বেশ উপভোগের। দুই-দা খুব পয়সয়লা তা নয়, শ্রমদেয়া মানুষ তারা, হাসিয়লা আর ভদ্রজন। আমের মৌসুমে আড়তে ব্যস্ততা ঘন তবুও গতপরশু পাওয়া সুসংবাদে আমিও প্রায় অস্থির, কোথাও ঘুরে আসা দরকার। ভর-বিকেলে আড়তে পাইকার থাকে না বটে বাসায় কিংবা উপহারের আম কিনতে আসেন অফিসফেরত সাহেবেরা। সরকারি কি অসরকারি অফিসের এসব সাহেবদের কারো গলায় ঝুলে দামি টাই, কারো হাতো ব্যাগ। দিনান্তের ক্লান্ত মুখ দিয়ে তাদের নানা প্রশ্ন বের হয়। আমগুলো কি রাজশাহীর? আমাদের করিৎকর্মা বিক্রয়কর্মী বেলাল জবাব দেন, “জ্বে সাহেব, রাজশাহীর। ডাইরেক রাজশাহী থেকে আনা। পাশের গদিতে খাগড়াছড়ির আমও পাবেন। উপরে বড়, নিচে ছোট দিয়ে দুই নম্বরি করি না আমরা। মাল দেমু ভালা, টাকাও নেমু ভালা। দেমুনে সাহেব?”
ক্রেতাদের কেউবা হেসে জানতে চান, “আমে কি ফরমালিন দেন আপনারা?” পরস্পরের মুখ দেখাদেখি করে একচোট হেসে নেই আমরা। এনাম ভাই, যাকে মোটাইয়্যা বলে ডাকি; তিনি ধীরলয়ে উত্তর করেন, ” মন্ডিতে ঢুকতে দেখছেননি গাড়ির লাইন? সবটাতেই আম। দিনে কত গাড়ি ঢুকে জানেন? এখানে মাল জমিয়ে রাখার সিস্টেম নাই।
গাড়ি ঠিক টাইমে আনলোড করতে না পারলে ভাড়ার ডেমারিজ, সমিতির জরিমানা। আমের কেজি কত, কত দিয়ে কিনছেন আপনারা? কয় খাচি আম বেচলে এক কেজি ফরমালিন পাবো জানেন? দেশে এত আম হচ্ছে, কোন দোষে ফরমালিন দেবো? উন্নত দেশ হলে রপ্তানিই করতো ম্যালা আম। এখানে দাম না পেয়ে মরে যাচ্ছে বেপারিরা। শিক্ষিত মানুষ এমন কইলে মাথামুথা ঠিক থাকেনি স্যার? এই, এটা ওজন কর, স্যারকে দে এটা…”
ক্যাশ থেকে পোটলা হেসে বলে, নো সমেস! বিচিত্রসুন্দর বিকেলটা পেছনে ফেলে আমি, প্রদীপ-উজ্জ্বলদা রিক্সা ধরি জিপিও বরাবর। গতপরশু পাওয়া নিয়োগপত্রের ডুপলিকেটকপি পোস্ট করে নাক বরাবর এগিয়ে আবারো রিক্সা ধরি; গন্তব্য অভয়মিত্র ঘাট।
৩.
বাদাম ভাঙতে ভাঙতে দুই-দা আর আমি চাখতে থাকি অভয়মিত্র ঘাটের আশপাশ। আহা, বিভূঁই হলে এই জায়গাটার কত কদর হতো! পরিকল্পনা নিয়ে নিজের সৌন্দর্য পয়সায় বিলোতে ওসব দেশগুলোর জুড়ি মেলা ভার। কর্ণফুলীর বুকে জাহাজগুলোর আরামসে জাবরকাটা দেখে প্রদীপদা লম্বাটে কেশরাজি কপাল থেকে সরিয়ে প্রস্তাব করে, চলেন, নদীর ও-পাড়ে যাওয়া যাক। পারাপারের নৌকোয় যাত্রির অভাব নেই। জোয়ান-বুড়ো, নর-নারী, প্রেমিক-প্রেমিকায় গমগম করছে পুরো এলাকা। এই নদীর বুকে কবে কার বধূ নাকের নথ হারিয়েছে কে জানে– কোনকালে বজরায় বেড়াতে আসতো মনুমিয়া, তা দূর-অতীত। ইঞ্জিনের নৌকো চলতে থাকে তেরছা– আমার মতো দুষ্টু যাত্রীরা লোনাপানিকে ছুঁয়ে দিয়ে মজা লয় বেশুমার। চলন্ত নৌকোর পেটে বসে নজর দেই কর্ণফুলীর বুকে– ঢেউয়ের ভেতর যেন পস্ট দেখতে পাই ঝড়বিক্ষুব্ধ দরিয়ায় সলিলসমাধি পাওয়া লোকদের মুখ। ধক করে ওঠে বুক, কেউ না-দেখে মতো বোতাম-খোলা বুকে থুথু দেই হালকা, কালেমা পড়ি মনে মনে। কর্ণফুলীর ব্রীজের ইয়া-বড় পিলারগুলো যেন বলে ওঠে, সাহস রাখ্ চাটগাঁইয়া নওজোয়ান! জাহাজের পাশ দিয়ে যেতে নৌকোগুলো যেন সাক্ষাত আন্ডা, কচুরিপানার মতো যেখানে আঁকড়ে আছে যাত্রীকূল।
নদীর এ-পাড় ও-পাড় ঘুরে ক্লান্ত ত্রি-যুবক দখিনা বাতাস গায়ে মাখার আয়োজনে বসি পাথরে পাছা রেখে। জোড়ায় জোড়ায় পয়দার দুনিয়ায় আপাতত বিজোড় আমরা নানাজনকে আবিস্কার করি নয়াভাবে। রসের হাটে বেরসিক পুলিশের হানাও পড়ে মাঝেমধ্যে, ভর-সন্ধ্যায় অপ্রস্তুত কাউকে পেলে পাকড়াও করে, মালপানি হাতিয়ে নেয়। চা বিক্রেতাকে কাছে ডাকি। আদা-লেবু চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমাদের মুখ মুখোশ এড়িয়ে গেয়ে ওঠে,”ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে, অভাগিনীর দুঃখের কথা বুঝাইয়্যম হারে…” তিন অভাগা খলখল হেসে ওঠি নিজেদের বেসুরো গলার কাছে ধরা খেয়ে। মিনিট তিনেক পরেই প্রদীপদা “পাইলাম ইহারে” স্বরে ইঙ্গিত দেয় ব্যানারসমেত শিল্পের পসরা নিয়ে অনতিদূরে বসা লোকটির দিকে। কাছে ঘেষে দেখি, এলাহী কারবার!
৪.
নানা কথা আর গাল খরচ হলেও আমাদের মূল ফোকাসড প্রদীপদা আর সমুদ্র আজিজের “মুখোমুখি বসিবার” ফসলের দিকে। ততক্ষণে শিল্পী ও সমঝদার নয়, আরো ম্যালা লোক ঘিরে থাকে তাদের। শিল্পী সমুদ্রের মুখে চওড়া হাসি, মলিন চেহারা আর বহুল ব্যবহৃত জামার ভেতর তার মনে হয়তো ভেসে উঠছে, আজ বাসায় রান্নাটা মন্দ হবে না! এরকম কাস্টমার রোজ আসে না, আজকের কাস্টমার যে স্পেশাল, তা দরদামে তর্ক না করাতেই বুঝে ওঠেন সমুদ্র আজিজ। কত শখ করে বেচারা ফাইন আর্টসে পড়েছিল। মনের শখ মিটেছে বটে, চাকরির বাজারে নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। কাগজে পেন্সিলের দাগ দিতে দিতে বলে যাচ্ছেন, “বুঝলেন, অনেকেই অন্য বিষয় না পেয়ে বাংলা পড়েন, পাছে জিগালে বলে, বাংলা নিয়েছি মাতৃভাষার খেদমত করতে! হাহাহা… মিথ্যে তেনারা বলেন, আমি বলি না। বিশ্বাস করুন, আমাদের সময়ে ফাইন আর্টস পড়ার মতো উঁচু রুচি বেশিরভাগ গার্ডিয়ানদের ছিল না। আর স্টুডেন্ট? মাত্র হাতেগোনা। এখন তো সব কমন হয়ে গেছে। এইতো আঁকছি, দিন চলে যাচ্ছে।” টুকটুক করে শেষ টানটা দিয়ে প্রদীপদার মুখের কাছে আঁকা ছবিটা ধরে সমুদ্র আজিজ বলেন, “দেখছেন, একেবারে আপনার কার্বনকপি!” এতক্ষণ যে ধৈর্য আর হাসি ছিল প্রদীপদার মুখে তা স্কেচ দেখেই উধাও!
“এই নেন আপনার টাকা…” অনেকটা শ্লেষ-বিরক্তি প্রদীপদার কণ্ঠে। ম্যানিব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার কড়কড়ে নোট বের করে ছুঁড়ে দেন সমুদ্র আজিজের দিকে। সমুদ্র যথাসম্ভব হাসি ধরে বলেন, “ছবি কি মন্দ হয়েছে দাদা? ভালো করে দেখুন না একবার। ভাই, আপনারা বলুন তো, স্কেচটা কেমন হলো…” উপস্থিত জনাদশেক উৎসাহী দর্শনার্থীর দিকে মিনতিমাখা দৃষ্টি শিল্পীর। আমি নিজেও অবাক প্রদীপদার এমন আচরনে। যে মানুষ গোষ্ঠী ধরে গালাগাল করলেও হাসতে থাকে সমানে, তিনিই এমন অগ্নীশর্মা! “এটা কোন স্কেচ হলো? এই স্কেচ তো আমার বউও চিনবে না! আপনি শ্রম দিচেন টাকাটা নেন, এই ছবি আমি নেবো না”– প্রদীপদার কণ্ঠে চন্দনাইশের কাঁচালঙ্কার ঝাল! সমুদ্র আজিজের সামনে পাতা মাদুরের মতো ডিজিটাল ব্যানারে তখনো শুয়ে আছে প্রদীপদার ছুঁড়ে দেয়া নোটটা। উৎসুখ দর্শকেরা ক্যানভাসারের মধুর বাহাস উপভোগ করছে হাসিতে, হল্লায়। উজ্জ্বলদা চুপ ঘটনার ঘনঘটায়। বেউপায় আমি প্রদীপদাকে শান্ত করার যাবতীয় আয়োজনে ব্যর্থ হয়ে তব্ধা খেয়ে যাই অনেকটা। সমুদ্র আজিজ শিল্পের দায় কাঁধে নিয়ে প্রদীপদাকে সান্ত্বনা দেন, “দেখুন না, কপাল, চুল, কান হুবহু আপনি। ছবিটা নেন প্লিজ।” আকাশের দিকে একবার, সমুদ্রের দিকে আরেকবার তাকায় প্রদীপদা। ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে নিজের স্কেচটা নিয়ে দুই কদম সামনে গিয়ে– “যা শালার স্কেচ” বলেই কর্ণফুলীর জলে সম্প্রদান কারকের শেষ দফা চর্চাটা সারেন প্রদীপদা।
ভিলনের পদধ্বনি প্রদীপদার বেহুদা আচরণে দেখা গেলেও সমুদ্র আজিজ যেনবা ঝড়ের কবলে পড়া নায়কের সর্বশেষ সংস্করণ! আড়চোখে দেখি, সমুদ্র আজিজও এগুচ্ছে কর্ণফুলীর জলের দিকে…