বিয়ের ৭ মাস পর আমার স্বামী আমাকে ডিভোর্স দিলো ৷ সীমাহীন কষ্ট বুকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে হল ৷ বাবা, মায়ের কথামত মদখোর স্বামীকে ডিভোর্স দিতে একপ্রকার বাধ্যই হই ৷ তবে আমার স্বামীরই চাওয়া ছিল আমার সাথে সে সংসার করবেনা ৷ বাপের বাড়ি সুখে-দূঃখে দিন অতিবাহিত হলেও পাড়া-প্রতিবেশী তথা সমাজের লোকদের কটু কথা শুনতে শুনতে জীবনটা বিষিয়ে উঠছিল ৷ বিরক্তিকর প্রতিটা সময় কাটিয়ে যাচ্ছিলাম ৷ একেক জনের একেক রকম কথা ৷
একেকটা কথা বুকে তীরের মত হয়ে বিঁধতে থাকে ৷ কেউ কেউ বলতো, “দেখো কি অপয়া মহিলা, বিয়ে না হতেই তালাক দিয়ে আসছে; নিশ্চয় আরেক ভাতারের উপর নজর পড়েছে!” কেউ তো বলতো, “স্বামীর ঘর তার ভাললাগেনা, গোপনে পর-পুরুষের সাথে নোংরামী করতে স্বামীকে তালাক দিয়ে আসছে!” আরো যত প্রকার বাজে কথা আছে শুনতে হচ্ছিল ৷ অথচ যখন স্বামীর অমানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শ্বশুর বাড়ি থেকে বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি চলে আসতাম, তখন এসব প্রতিবেশীরা বলতো, “ঐ কসাই জামাইকে ছেড়ে আসো, কত মেয়ে তালাক দিয়ে চলে আসছে! পারলে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা করো!”‘
আর আজ তাদের মুখে এসব কথা হারিয়ে গেছে ৷ উল্টা এখন আমার উপর তারা অকথ্য ও অসহনীয় কটু কথা নিয়ে এসে মুখের উপর ছুঁড়ে মারছে! বাবা, মায়ের অনুপ্রেরণায় আমি এসব সহ্য করে চলতে থাকি ৷ বাবা, মা আমার জন্য পাত্র দেখা শুরু করলে তাদের সোজাসাপ্টা বলে দিই, “আমি বিয়ে করব না”! কিন্তু তারা আমাকে জোর করতে লাগল ৷ তাদের ভাষ্য বিয়ে করতেই হবে আমাকে!
জীবন শুরু না হতেই ধ্বংসের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম ৷ সেই আমাকে আবারো ধ্বংসের মধ্যে পা ফেলতে হবে ভাবতেই কষ্ট লাগছিল ৷ তবুও বাবা, মায়ের কথামত দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হল! কতদিন আর বাবা, মায়ের আন্ডারে কাজ করব? এসএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করে কি বা চাকরির আশা করতে পারি? যেসব কোম্পানিতে চাকরির জন্য যাওয়া হয় তারা কুপ্রস্তাব করে বসে ৷ নিজের মান সম্মানকে জলাঞ্জলি দিয়ে জব করব এটা কল্পনাও করতে পারিনা! বিয়ে করে নিলাম ৷
আমার নতুন স্বামীর নাম ফাহাদ চৌধুরী ৷ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার! সংসার জীবনের প্রতি অনীহা তৈরি হয়ে আছে ৷ এরপরও ভয়ে আছি! সবসময় ভাবি ফাহাদ আগের স্বামীর মত যেন না হয়! সংকল্প করলাম ফাহাদকে মনপ্রাণ উজার করে ভালবাসা দেব! সেই মোতাবেক চলছিল আমার সংসার জীবন! প্রথম তিনদিন ভালই চলছিল ৷ কিন্তু তিনদিন পর আমাদের বাসায় ফাহাদের কাজিন আসলো ৷ সব সময় ফাহাদের সাথে তার কথা বার্তা আর ঢলাঢলি দেখে মোটেও সহ্য হলোনা ৷ এক রাতে ফাহাদকে ধীরস্থীর ভাবেই বললাম,
___আপনার কাজিনের সাথে এত কথাবার্তা মোটেও ভাললাগছেনা! ফাহাদ এর জবাবে কিছুই বললনা শুধু মুচকি হাসলো ৷ পরের দিন সকালে তার কাজিন বাসা থেকে চলে গেল ৷ ৫ দিন আমাদের বাসায় ছিল ওর কাজিন!
আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম সে চলে যাওয়ায় ৷ ফাহাদ জব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ৷ রাত ১০ টার আগে ফিরতোনা একটা রাতও ৷ বড় একা হয়ে গেলাম ৷ রাতে এসেই সে না খেয়েই ঘুম ৷ বলে খেয়ে আসছে ৷ রাগে কষ্টে দূঃখে একা একা জোর করে দু-মুঠো ভাত খেতে হতো! বুঝতে পারলাম আবারো আমি সেই নরকের মধ্যে এসে পড়েছি ৷ দম বন্ধ হয়ে আসছিল দিনকে দিন ফাহাদের আচরণে! তাকে অফিস টাইমের ফাঁকে ঠিক দুপুর বেলায় ফোন দিয়েও একটা মিনিট কথাও বলতে পারতাম না ৷ বলতো ব্যস্ত ৷ এভাবেই চলছিল! শ্বাশুরি আম্মার ভালবাসা পেয়ে এবং ওনার অনুপ্রেরণায় মনে একটুর জন্য হলেও সাহস সঞ্চয় করি যে ঝড়ের পর শান্তি আসবেই!
আমি তখন ৭ মাসের অন্তসত্তা ৷ ফাহাদ অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ৷ আমি ভেবেছিলাম হয়তো চাকরি চলে গেছে তাই হয়তো অফিসে যাচ্ছেনা ৷ তার মন মরা চেহারা দেখে বলার সাহসও পেতাম না যে কেন অফিসে যাচ্ছনা? সাহসই হয়ে উঠতোনা ৷ তবে যতদিন ধরে সে অফিস যাচ্ছেনা ততোদিনে লক্ষ্য করলাম সে আমাকে ঘরের একটা কাজও করতে দেয়না সব কাজ সেই করে ৷ এমনকি আমাকে গোসল পর্যন্ত করিয়ে দিতো ৷ চুল আঁচড়ে দেওয়া, রাত্রে মাথা বুলিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া, নিচতলা থেকে উপর তলায় সিড়ি বেয়ে আমাকে ওঠা নামা করানো সব করতো ৷ তার এমন ভালবাসা পেয়ে ভুলেই গেলাম ফেলে আসা ১১ টা মাসের কথা ৷ মনে হলো আমি ভালবাসার স্বপ্নপুরীতে বাস করছি প্রিয়তম স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ৷ আমার হ্নদয় একটাবারের জন্যও বলে উঠলো, “আমি আমার স্বামীর প্রেমে পড়ে গেছি!”
সেদিন গায়ে খুব জ্বর ছিল ৷ প্রসব বেদনাও উঠেছে ৷ মনে হচ্ছিল হাজারো চাকু দিয়ে লজ্জাস্থানে আঘাত করা হচ্ছে, মাথায় পেড়েক ঢুকানো হচ্ছে আর বুকে অসংখ্য হাতুড়ির পিটুনি দিচ্ছে শতশত লোক! হাসপাতালে নেওয়া হয়নি আমাকে ৷ দাই, আমার আম্মা, শ্বাশুরি পাশে বসা ছিল ৷ আমি বারবার শুধু ফাহাদের নাম বলে চিৎকার করছিলাম আর অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মাতালের মত উল্টাপাল্টা বকছিলাম ৷ আমার স্বামী চাচ্ছিল আমার পাশে আসতে ৷ কিন্তু দাই আমার স্বামীকে আসতে দিচ্ছিলেন না ৷ ফাহাদ আমার চিৎকার চেঁচামেচি আর ব্যাথায় গোঙানী শুনে সহ্য করতে না পেরে বাচ্চা ছেলেদের মত কাঁদছিল ৷ খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে ফাহাদের অশ্রুভেজা মুখটা লক্ষ্য করছিলাম ৷ যখন প্রসব বেদনা বেড়ে গেল তখন আর ফাহাদ নিজেকে শামলাতে পারলোনা ৷ ঢুকে পড়লো রুমে ৷ ফূঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বারবার বলছিল, “কিচ্ছু হবেনা তোমার, আমি পাশে আছি ৷ আমার আল্লাহ তোমার কোনো ক্ষতি করবেনা!”
ফাহাদের এমন ভালবাসা মিশ্রিত সহানুভূতির ও সাহস যোগানো কথাগুলো শুনে দু-চোখ শীতল হয়ে গেল সুখের অশ্রুতে ৷ অন্যরকম ভাললাগা হ্নদয়ে এসে ভড় করলো ৷ ভুলে গেলাম আমি সন্তান ভূ্মিষ্ট করতে যাচ্ছি ৷ এর পনের মিনিট পরপরই আমার মনে হলো জ্ঞান হারিয়েছি ৷ তার দু মিনিট পর নবজাতক শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনলাম ৷ বূঝতে পারলাম আমি মা হয়েছি ৷ ফাহাদের ভালবাসার প্রতিফল পেয়েছি! ফুটফুটে মেয়ে সন্তান হয়েছে আমাদের ৷ ওর বাবা ওকে কোলে তুলে নিলো ৷ ফাহাদের মুখে হাসি ৷ দু-চোখ অশ্রুতে ভেজা! বুঝতে পারলাম এই দিনটার অপেক্ষাতেই সে ছিল! মেয়ের বয়স যখন ৩ বছর ৷ তখন ওর হাতে একদিন একটি চিঠির খাম দেখতে পেলাম ৷ চিঠির খামটা হাতে নিয়ে পত্রটা বের করে আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম ৷ ফাহাদ চিঠিটা লিখেছে! সে লিখেছে,
_প্রিয়তমা স্ত্রী,
আমার ভালবাসার চাদরে জড়িয়ে সবসময় যেন সুখেই থাকো এটাই কাম্য! তোমাকে আজ কিছু কথা বলব! জানিনা চিঠিটা তোমার হাতে কবে পৌঁছেবে, তবুও লিখছি ৷ তোমার মনে প্রশ্ন জমে আছে হয়তো ৷ আমার কাজিনের সাথে ওরকম প্রেমময় আচরণ কেন করলাম? এর উত্তর, আমি তোমাকে পরীক্ষা করেছি যে আমার প্রতি তোমার আগ্রহ কেমন? স্বা্মীর সাথে অন্য কোনো মেয়েকে দেখে তুমি জেলাস ফিল করো কিনা? হ্যাঁ, তোমার চোখে মুখে অভিব্যক্তিতে সেটা পরিলক্ষ্যিত হয়েছিল এমনকি তুমি কাজিনের বিরুদ্ধে অভিযোগও করেছিলে! অফিসে বেশি সময় দেওয়া, তোমার ফোন রিসিভ করে তেমন কথা না বলা, বাসায় এসে রাতের খাবার না খাওয়া সবই তোমার ধৈর্য্য পরীক্ষা করতে করেছিলাম ৷ তুমি সেই পরীক্ষায় সফলও হয়েছো ৷
অফিসে এতগুলো মাস ধরে শ্রম দিয়েছি পরবর্তিতে যেন তোমাকে সময় দিতে পারি ৷ তোমার প্রেগনেন্টের সময়গুলোতে আমি পাশে থাকতে পেরেছি ৷ অফিসে না গিয়ে তোমার পাশে থেকে টাকার চিন্তা করতে হয়নি কারণ আগের ১১টি মাস প্রচুর শ্রম দিয়ে দু মাসের স্যালারি পরিমাণ টাকা বেশি উপার্জন করেছিলাম ৷ বসও কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তোমার জন্য ছুটি দিয়েছিল আমাকে! হ্যাঁ, আমি সবসময় তোমার মত একজন মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে চেয়েছিলাম ৷ সেই চাওয়া পূরণ হয়েছে! আমি তোমাকে ভালবাসি বউ, অনেক বেশি ভালবাসি!”
ইতি,
তোমার পাগল স্বামী ফাহাদ! চিঠিটা পড়ে চোখের পড়া ধরে রাখা সম্ভব হয়নি ৷ সুখের অশ্রুতে চোখটা ভিজে গেল মুহূর্তে! হ্নদয়টা সুখের পরশে কেঁপে উঠলো!
যখন আমার মেয়ে অনিতার বয়স ১৯ বছর তখন মেয়েটা এক ছেলের খপ্পরে পড়লো ৷ অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার টাকা চেয়ে বাসা থেকে বের হলো ৷ কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যায় তার ফেরার কোনো নাম গন্ধ নাই ৷ রাত্রে ফোন দিয়ে আমাকে শুধু বলল, “আমি পালিয়েছি মা, এছাড়া কোন উপায় ছিলনা, আমাকে ক্ষমা করে দিও!” এত বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা ৷ ওর বাবা খবরটি পেয়ে আমার সামনে শুধু মুচকি হেসেছিল ৷ কিন্তু লুকিয়ে ছাদে গিয়ে কখনো মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে সে কি কান্নার কান্না ৷ কতটা কষ্ট পেয়েছিল সেটা তার চোখ মুখের দিকে তাকালে বুঝতে পারা যেত! মনে মনে বলতাম, “হয়তো জীবনে অনেক বড় পাপ করেছিলাম সেটার শাস্তি আজ পাচ্ছি, আমার স্বামীকেও শাস্তি দিচ্ছি!”
অনিতা বাড়ি ছাড়ার ২ মাস সাত দিন পর বাসায় চলে আসলো ৷ আমাদের সাথে কোনো কথা বললোনা!
হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির এডমিশন পেপার ধরিয়ে দিলো ৷ বুঝতে পারলাম সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে ৷ ওর বাবা এখনো রেগে আছে মেয়ের উপর! কিন্তু যখন অনিতা বলল,
_তোমরা কেমনে ভাবলে আমি তোমাদের এত ভালবাসা পেয়ে বড় হয়েছি সেই আমি এতবড় ভুল করব? এইচএসসিতে অনেক ভাল রেজাল্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি ৷ সবই তোমাদের ভালবাসায় সহযোগিতায় ৷ সেই আমি কারো সস্তা ভালবাসার টানে তোমাদের ভালবাসাকে কবর দিয়ে বাড়ি ছাড়ব? কখনো না! আমাকে তোমরা যতটা ভালবাসো তারচেয়ে বেশি তোমাদের ভালবাসি! হ্যাঁ, আমি সেই মানুষটার জন্য তাকে পরীক্ষার ছলে বাড়ি ছেড়েছিলাম এটা সত্য, তাকে পরীক্ষাও করেছি কিন্তু সে সফল হয়নি ৷
আমি আগে পরে কখনোই তার জন্য চিরতরে বাড়ি ছাড়তাম না ৷ সে আমার নেওয়া পরীক্ষায় সফল হলে সম্পর্ক চালিয়ে যেতাম কিন্তু সে সফল হয়নি ৷ আর এটা করে আমি নিজের ভবিষ্যতটা খুঁজে নিয়েছি ৷ তোমাদের ভালবাসাকে উপেক্ষা করিনি তবে নিজেকে নিয়ে গেম খেলেছি ৷ দুটা মাস বাইরে ছিলাম স্টাডির জন্যই ৷ তোমাদের ছেড়ে থাকা কষ্টসাধ্য ছিল ৷ তাই এমনটা করে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি ৷ আমাকে ক্ষমা করে দিও!” ফাহাদ আমাদের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধু বলল, “অনেক বড় হয়ে গেছো, মায়ের মত বোকা হওনি; বুদ্ধিমতি হয়েছো ৷ তবে একটা কথা মনে রেখো জীবনে কিছু ভুল করতে নেই যে ভুলের কোন ক্ষমা হয়না ৷ তেমনি একটা ভুল প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে পালানো!”