বুকের ওড়না ঠিক করতে করতে
ঘর থেকে বাহিরে বের হলো চাঁদনী ।
পাশের বাড়ির রহমান চাচার ছেলে দুলালের হাঁক ডাকে উঠোনে এসে দাঁড়ায় ও।দুলাল
চাঁদনীকে এক নজর দেখেই
চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
–“কিরে, চাঁদনী তোর বাপে কই?”
–“বাবায় হাঁটে গেছে আর মা গেছে খালা বাড়িতে”।
“তাইলে কি তুই আজ বাড়িতে একা”?
নোংরা কন্ঠে কথাটা বলে উঠলো দুলাল।
চাঁদনী তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো।
দুলাল নামের ছেলেটার কথাগুলো একদম ভালো লাগে না ওর। ছেলেটার দৃষ্টি একদম নোংরা। চোখ একেবারেই স্থির থাকে না।
অনেকদিন ধরে মনে মনে ভাবছে এই কথাটা বড় ভাই আমিনুলকে বলবে কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না। আজ কথাটা বলতেই হবে।
না হয় দুলালের নোংরামি ধীরেধীরে বাড়তে থাকবে। খারাপ চরিত্রের মানুষদের কখনো পাত্তা দিতে নেই তাহলে নিজেরি বিপদ।
কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে বলতে রান্নাঘরে গিয়ে চাল ধুয়ে ভাত বসালো চাঁদনী। একটুপরে ভাত উতরিয়ে পড়তে লাগলো শুকনো মাটির চুলোয়।চাঁদনী কয়েকটা ডাল চুলো থেকে হালকাভাবে উঠিয়ে উপরে রাখলো।
মাটির চুলোর আগুন বলে কথা।কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। একবার তেতে গেলে ঠান্ডা করা মুশকিল।
সাঝের বেলা হাট থেকে ফিরলো চাঁদনীর বাবা রহমত আলী। কতগুলো মুড়ির মোয়া, একটা ব্যাগ আর এক বোতল কেরোসিন নিয়ে ফিরলো সে। কেরোসিন তেলের বোতল আর ব্যাগটা চাঁদনীর মা আলেয়ার হাতে দিয়ে,মুড়ির মোয়ার পোঁটলাটা হাতে নিয়ে বারান্দায় বসলো সে।
ডাক দিলো চাঁদনী আর ছোটো ছেলে কাশেমকে।
বড় ছেলে আমিনুল তার সাথে হাঁটে গিয়েছিলো কিন্তু সে এখনো ফেরেনি।জোয়ান ছেলেপুলেদের মন সাহসে ভরা। রাত বিরাতে বাড়ি ফিরতে ভয় পায় না তারা।আমিও একসময় এমন ছিলাম..
কথাগুলো বলতেই মুহূর্তের মধ্যে সে তলিয়ে গেলো তার শৈশব আর কৈশোর জীবনের স্মৃতিতে । আহ!
দিনগুলো তখন কতই না ভালো কেটেছিলো।
বাবার ডাক শুনে এক দৌড়ে ছুটে এলো ওরা।বাবার হাতে খাবার জিনিস দেখে তারা খুব খুশী।
একটুপরে রহমত মিয়া তার জামার পকেট থেকে এক মুঠো চুড়ি বের করে চাঁদনীর হাতে দিলো। চাঁদনী অনেকদিন বাবার কাছে বায়না ধরেছিলো এক মুঠো লাল কাঁচের চুড়ির জন্য।
আজ চুড়িগুলো হাতে পেয়ে সে খুব খুশী।
সবচেয়ে পছন্দের খাবার ফেলে রেখে সে এই সাঝের বেলা এক দৌড়ে চলে গেলো ওর বান্ধবী আঁখির কাছে, চুড়িগুলো দেখাতে।আঁখির বাবা যখনই ওর জন্য চুড়ি আনে, তখনই আঁখি কয়েক গোছা চুড়ি তুলে রাখে চাঁদনীর জন্য। চাঁদনী নামের মেয়েটার জন্য আঁখির বড্ড মায়া।
মায়া নামক জিনিসটা একবার হৃদয়ে স্থান করে নিলে সেখান থেকে আর বের হতে চায় না।
ভালবাসা আর ঘৃনার হাঁটে তার স্থান বড় পরিপক্ব। কোন একসময় যদি ভালবাসা অথবা ঘৃনা নামক স্থানে ভাঁটা পড়ে তাহলেই মায়া নামক জিনিসটার রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। মায়া জিনিসটা বড্ড কঠিন!
তাই তো চাঁদনী এই সাজের বেলা ওদের বাড়ির দিকে দৌড়াচ্ছে।
পাছে বাবা মা যে তাকে যেতে মানা করছে তা সে কানেই তুললো না।
প্রায় মিনিট বিশেক পর ফিরে এলো ও।
সন্ধ্যায় সবার ঘরে ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে উঠতে লাগলো ।দিনশেষে এখন সবারই ঘরে ফেরার পালা তাই যে যেখানেই থাকুক না কেন ধীরেধীরে ঘরের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে।
এই সন্ধ্যা বেলাটা হলো ভালবাসার এক চমৎকার মিলনস্থল।
একটুপরে বাড়ির আনাচকানাচে সমস্ত জায়গা নিরব হয়ে যাবে যেখানে দিনেরবেলা ছিলো অসংখ্য মানুষের হৈচৈ আর কলরবে মুখরিত।
আলেয়া বিবি রান্না ঘরে কুপি জ্বালিয়ে তার আলোতে বসে বাজার থেকে আনা মাছ রান্না করছে আর বাবা এবং কাশেম চুলোর পাশে চাটাই বিছিয়ে গল্প করছে। একটু পরে আমিনুল ও এসে সেখানে উপস্থিত হলো। আমিনুল তার বাবার মতো একজন কৃষক বললেই চলে। সারাদিন ক্ষেতে খামারে পড়ে থাকে।
রান্না শেষে রাতের খাবারের পর যে যার রুমে চলে গেলো। কিছুক্ষন টিন ভেদ করে পাশের ঘর থেকে বাবা আর মায়ের কথা শোনা গেলো।
একটু পরে সব থেমে গেলো। চারিদিকে শুনশান নীরবতা।
কুপির আলো জ্বালিয়ে চাঁদনী তার ঘরে বসে পড়ছে। পড়ছে বললে ভুল হবে।
চাঁদনী চুপিচুপি একটা কাগজে কি যেনো লিখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। একটু পরে সে চুপেচুপে তার ট্রাংক খুলে কয়েকটা কাগজ বের করে গুনতে লাগলো।
গোনার পর দেখা গেলো সেখানে মোট ২৩ টা চিঠি জমেছে। হ্যাঁ, এতক্ষন চাঁদনী চিঠি লিখছিলো।সে প্রায় রাতেই চিঠি লিখে। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে চিঠিগুলো লেখা তাকে কখনো চিঠিগুলো দেয়া হয়ে ওঠে না।
তার সামনে গেলেই চাঁদনীর বুক আর হাত পা কাঁপতে থাকে সাথে প্রচন্ড লজ্জা লাগে। কিন্তু একদিন সে চিঠি গুলো ঠিকই দিয়ে দিবে তার মনের মানুষকে সকল লজ্জা অতিক্রম করে।
একটুপরে বাবার নাক ডাকার শব্দ শোনা যায়,দূরে হঠাৎ করে বিকট শব্দ করে একটা শেয়াল ডেকে ওঠে।একটুপরে চাঁদনীও ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।
রাত গভীর হয়। হাজার বছরের পুরনো সেই রাত।
খুব ভোরে রহমান চাচার আযানের সুরে ঘুম ভেঙে যায় ওর।ভোরের আলো এখনো ফুটে ওঠেনি চারিদিকে আবছা অন্ধকার।
উঠানে হঠাৎ মানিকের গলা শুনতে পেলো চাঁদনী।
মানিক এই মুহূর্তে গরুগুলো নিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছে।
চাঁদনীর ইচ্ছে করছিলে এই আবছা অন্ধকারে চিঠিগুলো নিয়ে মানিকের হাতে গুঁজে দিতে।হয়তো এই আবছা অন্ধকারে চাঁদনীর লজ্জিত মুখ মানিকের চোখে পড়বে না।
একটু পরে চাঁদনী একাই হেসে ওঠে তার কল্পনাগুলোকে কেন্দ্র করে। চিঠি আর দেয়া হয়ে ওঠে না।
হ্যাঁ, এই সকাল থেকেই চাঁদনীর শুরু হয় ভাবা আর এই ভাবনা শেষ হয় ঘুমোনার পর।
একটুপরে দূরে কয়েকটা মোরগ একসাথে ডেকে উঠলো এবং তড়িঘড়ি করে চাঁদনী বিছানা থেকে নেমে গেলো।
উঠোন ঝাড়ু দিয়ে ও কিছুক্ষণ বসে রইলো।
মা শুকনো খাবার সেধে গেছে কিন্তু এখনো হাতমুখ ধোঁয়া হয়নি বলে হাতে তুলেনি।এখন
চারিদিক ফর্সা হয়ে গেছে ।
পুকুরপাড়ে ফুলী আর পরী ভাবি বসে বসে থালাবাসন মাজছে আর গল্প করছে। তাদের গল্পগুলো শুনতে চাঁদনীর ভালোই লাগে কিন্তু এই মুহূর্তে গল্প শোনার সময় নেই ওর।
আজ স্কুলে যেতে হবে।
মা সেই কখন থেকে ভাত বেড়ে ডাকাডাকি করছে।
চাঁদনী এবার চৌদ্দ বছরে পা দিলো। লেখাপড়া করতে তার তেমন একটা ভালো লাগে না।
আজকাল বাবা মা প্রায়ই ওর বিয়ের কথা বলে। চাঁদনী আড়াল থেকে কথাগুলো শুনে লজ্জা পেয়ে মুচকি মুচকি হাসে।তারও ইচ্ছে করে বঁধু বেশে কারো বাড়িতে পা রাখতে এবং পরী আর ফুলী ভাবিদের মতো ছোট্ট একটা সংসার গুছিয়ে নিতে। মানিকের সাথে ওর বিয়ে হলে ভালোই হতো। দুজন মিলে ছোট্ট একটা সংসার গুছিয়ে নিতো আর বছরখানেক পরে তার কোলজুড়ে আসতো একটা ছোট ছেলে অথবা মেয়ে। আর ভাবতে পারেনা চাঁদনী, লজ্জায় ওর চোখ বুঁজে আসে।
“চাঁদনী, এই চাঁদনী! কই গেলি তুই? আজ স্কুলে যাবি না”?
আঁখি জোরে জোরে কথাগুলো বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে চাঁদনীকে খুঁজতে লাগলো।
আলেয়া বিবি কোথা থেকে এসে যেনো দুইটা মোয়া এনে আঁখির হাতে গুজে দিয়ে বললো,
এগুলো খেতে খেতে স্কুলে যেতে।
একটুপরে চাঁদনীর দেখা মিললো।
অতঃপর দুজন মিলে স্কুলের পথে পাড়ি জমালো।
পথে যেতে যেতে অনেক গল্প হলো।
পথে হঠাৎ আমিনুলের সাথে ওদের দেখা হয়ে গেলো।
আমিনুল কোন কথা না বললেও আঁখির মুখটা হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
ব্যাপারটা চাঁদনীর চোখে পড়লো না।
আমিনুল অনেকদিন ধরে পাশের বাড়ির জমিলাকে মনে মনে পছন্দ করে। আহ! কাজল পড়া মেয়েটা সত্যিই অপরুপ সুন্দরী !
কথায় কথায় কেবল হাসে।
আচ্ছা, ও কি জানে ওর এই জটিল হাসি কারো না কারো হৃদয়ের স্পন্দন এক সেকেন্ডের জন্য হলেও থামিয়ে দেয়!
স্কুল থেকে ফিরেতেই চাঁদনী উপলব্ধি করলো পরী
ভাবি, চাচা, চাচীসহ আরো অনেকের কান্নার আহাজারিতে পুরো বাড়ি ভারী হয়ে গেছে।
বাড়ি ফেরার পথে কয়েকজন মানুষকে বলাবলি করতে শুনেছিল ও,
পূব পাড়ায় কে যেনো পানিতে পড়ে মারা গেছে!
ওরা কথাটা তেমন কানে তোলেনি।
কিন্তু এখন চাঁদনীর বুকের মধ্যে কেবল তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো।
মায়ের মুখে শুনতে পেলো যে পরী ভাবির ৪ বছরের বাচ্চা ছেলে মিরাজ নাকি পানিতে পড়ে মারা গেছে।
আলেয়া বিবির চোখ থেকে কেবল পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
চাঁদনীর চোখ দিয়েও অনবরত পানি ঝড়তে লাগলো।
আজ সকালে স্কুলে যাওয়ার সময়ও ছেলেটাকে দেখে গেছে সে।
চাঁদনীকে দেখে প্রায় কয়েকবার ফুপি,ফুপি করে ডেকেছিলো।এখনও চাঁদনীর চোখে ভাসছে মিরাজের হাসিমাখা ছোট মুখটা।
সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ঘটে গেলো এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। কেউ বুঝতেই পারলো না।
বুঝলে হয়তো ছোট্ট ছেলেটাকে সবাই চোখে চোখে রাখতো।
হায়রে মৃত্যু!
নিমিষেই সে এই পৃথিবী থেকে কাউকে না কাউকে উধাও করে ফেলতে পারে!
মৃত্যু নামক জিনিসটা যদি জানতো কতটা মায়া আর ভালবাসা ফেলে একটা মানুষ অন্য জগতে প্রবেশ করছে তাহলে হয়তো সেও মায়ায় পড়ে যেতো।
হঠাৎ ভীড়ের মাঝে মানিকের দেখা মিললো চাদনীর। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে একজন আরেকজনের চোখের ূি দিকে। চাদনীর টলমল করা চোখ দুটো নজর এড়ালো না মানিকের।
চাঁদনীর ইচ্ছে হচ্ছিলো মানিকের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরতে। প্রিয় মানুষগুলোকে জড়িয়ে ধরে কঠিন কষ্টের মাঝে একটু হলেও একটু শান্তি পাওয়া যায় মনে।