ঘুমন্ত নীতুর কপালে চুমু খায় তারেক। শার্টের কলারে টাই খিচতে খিচতে জোরে চিল্লিয়ে বলে রান্নাঘরে খাবার আছে খেয়ে নিও। ডিম আর মুসুরডাল রেঁধেছি। খেয়ে নিও, আমি গেলাম। হাতে ব্যাগটা নিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে অফিসে চলে যায় তারেক। জানালা দিয়ে সকালের রোদ মুখে এসে লাগছে নিতুর। উঠতে ইচ্ছে করছে না। ইদানিং খুব অলস হয়ে যাচ্ছি, মনে হয় নীতুর।
হাই তুলে জানালার কাচ সরিয়ে তারেকের লাগানো কিছু গাছে হাত বুলিয়ে দেয় সে।”উহ বেশ ধুলো জমেছে! বলে পানির স্প্রে করে। দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেল। যেকোন ব্যপারে হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নেয়া তারেকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেই প্রথম দেখা হয়েছিল সেকেন্ড ইয়ারে। পরিচয় হল, প্রেম হল, তারেকের মনে হল আমাকে তার বিয়ে করা দরকার। বলা নাই কওয়া নাই অমনি বিয়ে করবে বলে গোঁ ধরে বসলো।
বিয়ে তো একদিন করতেই হবে কাউকে না কাউকে। তারেক এর মধ্যে একটা ট্যালেন্সি ছিল। আর ভালোবাসি তাকে। দ্বিমত করতে পারলাম না। সে বছর এপ্রিলে বিয়ে টা করে ফেললাম। নিজেরা নিজেরাই। কারো বাসায় কেউ জানে না। আমরা আমাদের মত চলছি। ক্লাস পরীক্ষা আড্ডা ঘোরাঘুরি সব চলছিল। তবে বুকের ভিতর একটা অপরাধবোধ কাজ করছিলো। মাঝে মাঝে রাতে উঠে কান্না করতাম। চোখ ফুলে যেত। সকালে তারেকের সাথে দেখা হলেই বলতো “আজকে আবার কান্না করেছ?” আমরা তখন আলাদা থাকতাম,যে যার মেসে।
বছর খানেকের মধ্যে তারেকের বাসার সবাই ব্যাপার টা জেনে গেছে। আমার শাশুড়ী খুব খুশি। কিন্তু আমার শশুর সাহেব মহা রাগ ছেলের উপর। ” ছাত্র মানুষ কাজ হইলো পড়ালেখা করা, আর তা থুইয়া করছে বিয়া “। পরে অবশ্য তারেকের বাসা থেকে সব মেনে নিয়েছিল। তারেকের বড় দুলাভাই এসে আমাদের কে একসাথে থাকার পরামর্শ দিলেন। একটা ফ্ল্যাট বাসা ঠিক করে দিলেন। আমার শশুর মাসে মাসে টাকা পাঠাতে লাগলেন। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু আমার মন কিছুতেই ভাল হচ্ছিল না। বিয়ের বছর দেড়েক পরে আমার বাবা খবর টা শুনে রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন।
” আসমত চেয়ারম্যান এর এলাকায় একটা নাম আছে, আমার এ অবাধ্য মেয়ের দরকার নেই, আমার এখন একটা ই মেয়ে “। সে আমার বড় আপু। আমি এখন আমার বাবার কাছে ত্যাজ্যপুত্রী। আমার মা খুব কান্না করেছিলেন। দু বার এসে আমার সাথে দেখা করে গিয়েছিলেন। তখন আমার বাড়ি যাওয়া বন্ধ । মা’র তারেক কে খুব পছন্দ হয়েছিল। আমার তখন শুধু নুপুর গ্রামে যাওয়ার জন্য প্রাণ আনচান করছিলো। নিজের সাথে নিজের খুব রাগ হল। ঠিক করলাম নিজেকে শাস্তি দেব। নুপুর গ্রামে আর ফিরে যাব না।আমরা একসাথে থাকি। তখন আমাদের অনার্স শেষ।
দুইজন ই চাকরির পড়াশোনা করি। আমার দাদি মাঝে মাঝে তারেকের নম্বরে ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলে ” আমার ফুলমাই কই গেলি রে, আর কতদিন পাষাণ হয়ে থাকবি রে, আমার মুখটা তোর চোখের সামনে ভাসে না”
তখন আমার মুখে কোন কথা আসেনা। কাঁদতে কাঁদতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলি। তারেক তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়। এজন্য মাঝে মাঝে সে দাদির ফোন রিসিভ করতো না। আমার বাবাকে খুব ভয় করতাম। সাহস ছিল না বাবার সাথে কথা বলার। রাগী মানুষ।
তবে আমার বাবা একজন নীতিবান লোক ছিলেন। আমার অনৈতিক কাজ তার একেবারেই পছন্দ হয় নী।
মার্স্টাস শেষ হতে হতে, তারেকের চাকুরী হয়ে গেল। ব্যংকের চাকুরী। আমার শশুর,শাশুড়ী গ্রাম থেকে এসে আমাদের দেখে গেলেন। মাঝে মাঝে আমার বড় ননদ আর আমার শাশুড়ী রান্না করে আমাদের জন্যে নিয়ে আসতেন। তারেকের শুটকি খুব পছন্দ। আমার শাশুড়ী বড় মাছের শুটকি রান্না করে নিয়ে আসতেন।আমার পরিবার থেকে তখনও আমি বিচ্ছিন্ন। শুধু আমার বড় বোনের সাথে মাঝে মাঝে কথা হত।
এত মনখারাপের মাঝেও তারেক আমাকে সবকিছু থেকে ভুলিয়ে থাকার জন্য অনেক চেষ্টা করতো। ঘুরতে নিয়ে যেত, আমরা অনেক জায়গায় ঘুরেছি। আমার কাজে সাহায্য করতো। তারেক অনেক সুন্দর রান্না করতে পারে। চাকরির খুব ব্যাস্ততা। তারপরেও বাজার করা আমাকে ডক্টর দেখানো, রান্না করা সব কিছু আনন্দের সাথে করে তারেক। আমাদের বিয়ের প্রায় ছয় বছর হতে চলেছে। আমি এখন আর খুব চলাফেরা করতে পারি না। ডক্টর নিষেধ করেছেন। আমার একটা বেবি হবে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। আমাকে তার থেকেও বেশী আনন্দ লাগছে এই কারণে যে, আজ আমাদের বাসায় আমার বাবা আসবেন আমাকে নিয়ে যেতে।
আমি নুপুর গ্রামে যাবো। তাও আমার বাবার সাথে। আমার দাদি নাকি উঠতে পারে না। মাঝে মাঝে আমার নাম ধরে সুর করে কাঁদে। আমার জীবন টা মনে হয় কান্নার মাঝে লুকিয়ে আছে। আমার বাবা রওনা দিয়েছেন। আসলে তাকে কি বলব জানিনা। শুধু জড়িয়ে ধরে কাঁদবো এতটুকু জানি। তারেক ব্যগ গুছিয়ে রেখেছে। আজকে সে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরবে। প্রথম বার শশুরবাড়ি যাবে। এ নিয়ে ওর আনন্দের শেষ নেই।