খাটের উপর দুপা তুলে বসে আছি। আমার চোখের সামনে মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে যে মানুষটির মৃত্যু হবে তার নাম লিলিং। সে একজন চাইনিজ মেয়ে। তার সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৭ সালে যখন আমি মালয়েশিয়াতে আসি, তখন থেকে। মালয়েশিয়ার আমপাং এল.আর.টি ষ্টেশন থেকে বের হয়ে ডানদিকে যে থানা রয়েছে সেই রাস্তা ধরে মিনিট দুই হেটে গেলেই চাইনিজ কলোনি। আমি আর লিলিং এখানেই থাকি। তার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিলো কে.এল.সি.সি তে যাকে সবাই মালয়েশিয়ার টুইনটাওয়ার বলে চিনে।
প্রতি কাশিতে কাশিতে জমাটবদ্ধ রক্ত ছুটে আসছে তার ভেতর থেকে। দুহাতে দুমড়ে মুচড়ে ধরছে বিছানার চাদর। কয়েকবার অতি শক্ত করে আমার হাত ধরেছিলো সে, কিন্তু আমার কোন অনুভুতি নেই। আমি শুধু দেখে যাচ্ছি কিভাবে দেহ থেকে প্রানটা চলে যায়। মানুষের জন্ম হয় মরার জন্য। কিন্তু মানুষ কখনো মরতে চায়না। বার বার বাচতে চায়, আজীবন বেচে থাকতে চায়। লিলিং এর ছটফটানি দেখে আমার এটাই মনে হচ্ছে সে আরো কিছুদিন বাচতে চায়, কিন্তু মৃত্যু একদিন সকল পরিচয় মুছে দিয়ে কবর নামের পরিচয়পত্রের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিবে, এটাই বাস্তব, এটাই চিরন্তন সত্য। না ধর্ম, না বর্ন কোন কিছুর সাথেই লিলিং এর সাথে আমার যায়না। কিন্তু একটি সম্পর্ক রয়েছে পৃথিবীতে যা ধর্ম, বর্ন, সমাজ সব কিছুর থেকে উর্ধ্বে সেটা হচ্ছে আত্মার সম্পর্ক। আজকে লিলিং এর এমন দুর্বিষহ দিনে আমি বার বার অতিতে হারিয়ে যাচ্ছি। আর আমার অতিতের পুরো ঘটনাটা যেন আমি লিলিং এর আকুতি ভরা দুচোখের মাঝেস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সাল ১৯৯৭ জাহাজে করে মালয়েশিয়ার পথে অবৈধভাবে যাত্রা শুরু করেছিলাম।
টানা ১২ দিন লেগেছিলো মালয়েশিয়ার বর্ডার এ আসতে। আমি একা ছিলাম না সেখানে আমার মত শতশত বাঙ্গালী ছিলো জাহাজের মধ্যে। কয়েকজনের মৃত্যু তো জাহাজেই হয়ে গিয়েছিলো, যারা পিপাসা আর ক্ষুধার যন্ত্রনা কে জয় করতে পেরেছে তারাই অবশেষে মালয়েশিয়া নামক দেশে এসে পৌছাতে পেরেছে। জাহাজে যে পরিমাণ খাবার ছিলো তার থেকে কয়কগুন বেশী মানুষ ছিলো। যাদের মনেতে শুধু এক স্বপ্ন আর আশা ছিলো। তারা গরীবি চায়না, তারা অভাব চায়না, তারা ভালোভাবে সমাজে বাচতে চায়। পরিবার পরিজন সবার মুখে দেখতে চায় আনন্দের হাসি। পাচ দিনের মধ্যেই জাহাজে সংরক্ষিত খাবার শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সেদিন থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ক্ষুদা কতটা কষ্টদায়ক। তার আগে যে বুঝতাম না এমন নয়। এর আগেও ক্ষুধার্ত থেকেছি অনেকবার, কিন্তুচোখের সামনে যখন শত মানুষের আত্মচিৎকার শুনতাম, আমাকে খাবার দাও আমাকে পানি দাও তখনযেন পেট নামক বস্তুটা দ্বিগুণ ক্ষুধার্ত হয়ে যেত। আরে আমাকে আগে দেও, তাকে পরে দাও, আমাকে আরোও দাও, আগে আমি বাচি এসব আকুতি নিয়ে জাহাজের মধ্যে সেই নিকৃষ্টতম দিনগুলো কাটিয়েছি।।
সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মুখে নিলে কলিজা পর্যন্ত ধরে যেত, পিপাসায় যখন অতিষ্ট হয়ে যেতাম বাধ্য হয়ে সেই পানি মুখে নিতাম, উফ এমন পানি জীবনে খাইনি, পানি না যেন লবন মিশ্রিত শরবত। প্রতিদিন সকালে একটি পাউরুটি আর একটি কলা খেতে দিতো, রাতেও একই খাবার ছিলো। যদি কেউ একটু বেশি খেতে চাইতো জাহাজের ক্যাপ্টেন গুলো কি বেদম মারটাই না দিতো। তাদের বুট জুতার লাথি, পাথর হাতের ঘুষিতে নাক মুখ দিয়ে কলকলিয়ে রক্ত ঝড়তো। রক্তাক্ত দেহ নিয়ে নিথর অবস্থায় দিনের পর দিন অজ্ঞান হয়ে পরে থাকতো অসহায় মানুষগুলো। কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে যদি মারা যেতো, তাদের না হত জানাজা, না দেওয়া হত কবর। দুইজন সিপাহি এসে, একজন দুহাত, আরেকজন দুপা ধরে ছুড়ে ফেলে দিতো সমুদ্রে। সেই মৃত মানুষগুলো তখন সামুদ্রিক প্রানীর খাবার হয়ে যেতো। আমাদের সেই জাহাজে একজন মানুষ ছিলো যার নাম রবিন। জাহাজে আসার পর থেকেই তার সাথে আমার ভালো খাতির জমে যায়। সারাদিন তার সাথেই কেটে যেত? আমরা জাহাজের ভেতর থেকে বের হতে পারতাম না।
বাহিরের আলোবাতাস আসার জন্য ছোটছোট ছিদ্র করা ছিলো সেই ছিদ্র দিয়ে কখনো সমদ্রের ঢেউ কখনো সুর্যের সোনালী কিরন দেখেই নিজেকে শান্তনা দিতাম, এইতো চলে এসেছি আর মাত্র কিছুপথ বাকি। তারপর আমরা দেখবোসোনালী নতুন আলো, নতুন স্বপ্ন, খুজে পাবো নতুন করে বেচে থাকার কারন। একদিন রবিন আর আমি সেই ফুটো দিয়ে সমুদ্রের ঢেউ দেখছিলাম, এর মধ্যে রবিন বলে উঠলো “আরে সুমন মালয়েশিয়া গিয়ে কি করবি” তার প্রশ্নটা আমাকে কিছুক্ষন ভাবাতে বাধ্য করলো, আসলে আমি নিজেও জানিনা মালয়েশিয়া আমার জন্য কি রেখেছে, আর আমিইবা কেন যাচ্ছি। শুধু বার বার একটি কথা কানে ভেসে আসতে লাগলো, রবিন এর প্রশ্ন শুনে, অনেক দূরে চলে যা এতদুরে যাবি যেন কোনদিন তোর ছায়া ও আমাকে দেখতে না হয়। এই চলে যাবার নির্দেশ আমি অমান্য করতে পারিনাই তাই হয়ত দূরে যাচ্ছি অনেক দূরেযেখানে গেলে আমার ছায়াও সে দেখতে পারবেনা। কথাটি আবার মনে আসতেই বুকটা কুহু কুহু করে কেদে উঠলো। এক নাম না জানা যন্ত্রনার পোকা কলিজা কুটকুট করে খেতে শুরু করেছে।
দুচোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে যে কোন সময় ঝরে পড়বে ঝর্নার মত। না না পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। তারা কাঁদলে অমঙ্গল হয়, তারা চোখের পানি যেন কেউ না দেখে এই শিক্ষা তারা জন্মের পরেই পেয়ে যায়। আর এতগুলো মানুষের সামনে কিছুতেই চোখের পানি পড়তে দেওয়া যাবেনা। এর জন্য সময় আছে রাত অনেক রাত, অন্ধকার রাত, যখন সবাই ঘুমে মগ্ন তখন কাঁদতে হবে নয়ত কোন ঝড়বৃষ্টির দিনে ভিজতে ভিজতে কাঁদতে হবে, যেন চোখের পানি আর বৃষ্টির পানির সাথে তলিয়ে যায়। আমি কোনভাবে নিজেকে সামলিয়ে নিলাম উলটো রবিন কে জিজ্ঞেস করলাম “তুই কেন যাচ্ছিস” সে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলতে লাগলো, আর বলিস না। আমি জাহাজের কুলির কাজ করতাম। হাড়ভাংগা পরিশ্রম করেও তেমন আয় করতে পারতাম না, অভাব অনটন যেন পিছুই ছাড়েনা, ঘরে পঙ্গু বাপ, ভাই বোন আর নাই, মা বাসা বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু আমাদের দুজনের আয়ের টাকা বাবার চিকিৎসাতেই শেষ হয়ে যায়। কখনো পানি খেয়ে রাত কাটাই কখনো মুড়ি খেয়ে।
জীবনে অতিষ্ট হয়ে গেছি কয়েকবার মরতেও চাইছিলাম,তারপর জাহাজের এক ভাই বললো সে নাকি আমাকে মালয়েশিয়া নিয়ে যেতে পারবে জাহাজে করে কিছু টাকা খরচ হবে কিন্তু মালয়েশিয়া তে গেলে নাকি আমি অনেক টাকা আয় করতে পারবো। সেজন্য মায়ের হাতের চুড়ি, কানের নাকফুল সব বিক্রি করে মালয়েশিয়া যাচ্ছি, বুকেতে একটি স্বপ্ন বেধে যেদিন আবার বাংলাদেশে ফিরে আসবো সেদিন অনেক টাকা হবে, আমাদের কোন অভাব থাকবে না। বাবার চিকিৎসা ভালো জায়গায় করাবো, আর মা কেও কাজ করতে দিবো না। একদমে কথাগুলো বলে সে জাহাজের ছিদ্র দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। যেন সে পানির উচ্ছল ঢেউয়ের খেলাতে তার স্বপ্নকে পুরন হবার আনন্দ দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ লক্ষ করলাম, তার দুচোখ বেয়ে পানি ঝড়তেছে, আমি গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললাম “ঐ রবিন কি হইলো” চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতে লাগলো “কিছুনা দোস্ত, চোখে জানি কি আইসা পড়লো।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না তাকে বুকে টেনে নিয়ে বললাম “দেখিস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে”। তার মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠলো, এমন হাসি যেন কয়েক বছর পর তার মুখে খেলেছে। তারহাসিতে নিজের বুকটাও ভরে উঠলো আনন্দে, তার চোখ বেয়ে আবার পানি গড়ালো। এবার সে আমি কাদিনি বলে বাহানা করেনি, আমাকে শক্ত করে ধরেই বলতে লাগলো “বন্ধু গরীব হোক আর ধনী, বন্ধু কিন্তু জীবনে আসেই আনন্দ দেবার জন্য, সাহস দেবার জন্য। মা বাবার পর পৃথিবীতে এই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই স্বার্থহীন হয়, এছাড়া কোন সম্পর্ক স্বার্থ ছাড়া হয়না। সারাজীবন এমনি বন্ধু হয়ে পাশে থাকিস সুমন।” রবিন এর মুখে বন্ধুর কথা শুনে আমার কারো কথা মনে পড়েগিয়েছিলো। রবিনকে জোর গলায় বলতে ইচ্ছে করেছিলো, জীবনে সব বন্ধু স্বার্থহীনভাবে আসেনা রে পাগলা, কিছু বন্ধু সাজার নাটক করে স্বার্থ হাসিল করে চলে যায়। কিন্তু রবিনের এই আনন্দে তার আমি কোন বাধা দিতে চাইনা। থাকুক না মানুষ একটু সুখে যে যেভাবে সুখে থাকতে পারে থাকুক। এই সুখ নামের বস্তুটার জন্যই তো মানুষ শত যন্ত্রনা কষ্ট বুকে লালন করে বেচে থাকে, স্বপ্ন বুনে যায় সুখ পাবার।
অনেক ঝড়ঝাপটা, ক্ষুদার যন্ত্রনা পিপাসার যন্ত্রনা নিয়ে কেটে গেলো জাহাজের সেই অভিশপ্ত ১২ টা দিন। অবশেষে আমরা মালয়েশিয়ার বর্ডার এ এসে নামলাম। আমাদের নামিয়ে দেওয়া হলো জংগলের মাঝামাঝি স্থানে। মাইল দুয়েক হেটে গেলেই আমরা মালয়েশিয়ার বাসস্থান পাবো। আমাদের সাথে একজন লোক ছিলো সে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো জোহরবারু। সেখানে রাখা হলো সপ্তাহখানেক আমাদের সবার জন্য বানানো হলো নকল ভিসার কপি। যদি রাস্তাঘাটে পুলিশ ধরে আমরা যেন এটা দেখিয়ে বেচে যেতে পারি। তারপর আমাদের নিয়ে আসা হলো মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর এ। তখন সবে মাত্র টুইনটাওয়ার এর কাজ শুরু হয়েছে মালয়েশিয়াতে। হাজার হাজার শ্রমিক প্রয়োজন সেখানে। আমি রবিন সহ আরো অনেক লোককে সেখানে কাজে ঢুকানো হলো।
আমার আর রবিন এর মালয়েশিয়ার যাত্রার দুমাস পেড়িয়ে গেলো। রবিন প্রতিমাসে টাকা পাঠাতেশুরু করলো দেশে। মোবাইল এর তখনো খুব চলাচল হয়নি তাই কথা বলার মাধ্যম ছিলো চিঠি কিংবা কোন টিএন্ডটি নাম্বার। রবিন এর মায়ের সাথে প্রায় রবিন পোস্ট অফিস এর নাম্বার দিয়ে কথা বলতো আজকাল জোর গোলায় তার মাকে আদেশ দেয় সে যেন বাসা বাড়িতে কাজে না যায়, বাসায় থেকে বাবার সেবা করার জন্য কঠোর নির্দেশ ছেলের। মাও বাধ মেয়ের মত রবিন এর কথা মেনে নিলো। রবিনের আনন্দ দেখে আমার কাছেও খুব ভালো লাগতো। আমার মা বাবার কাছেও টাকা পাঠাতাম কিন্তু কথা বলার সুযোগ কম হতো, আমার বাবা মা গ্রামে থাকতো সেখানে টেলিফোন নেই বললেই চলে। যখন টেলিগ্রাম এ টাকা পাঠাতাম তখন একবার শুধু কথা হতো। আরর সারামাস অপেক্ষা করতে হতো পরের মাসের।
রোজা চলে আসছে কাজের কোন বিরতি নেই। প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। এই টুইনটাওয়ার নির্মাণাধীন অবস্থায় শতশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কেউ পড়ে গিয়ে, কেউ মেশিনের কোন ত্রুটির কারনে। কিছু মানুষ তো ঢালাইয়ের সাথে মিশে গিয়ে টুইনটাওয়ার এর পিলার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজকের বিশ্বের সেরা টুইনটাওয়ার কে.এল.সি.সি নির্মান হয়েছে হাজারো শ্রমিকের ঘাম, রক্ত, আর আত্মহুতির সাথে। চোখের সামনে মরতে দেখেছি, আবার দেখেছি মনের কষ্টে কত প্রবাসীদের আত্মহত্যা করার করুন দৃশ্য। দেখেছি আপন মানুষ হারিয়ে যাবার যন্ত্রনায় প্রবাসে বসে দিনের পর দিন কেদে যেতে। আজ রবিবার কাজের কিছুটা চাপ কম আছে। পাবলিক ছুটির দিন তাই অনেক বসরাও আসেনি। আমি কাজের জায়গায় বসে আছি। রবিন কোথায় যেন গেছে, বলে যায়নি। রোজা রেখেছি তাই একটু পিপাসার্ত বটে।
এমন সময় এক চাইনিজ মেয়ে সিগারেট জালিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকে যাচ্ছে সমানে। আমি তাকে বাংলাতে বললাম “সিগারেট অন্যজায়গায় গিয়ে খান” সে আমার কথা বুঝতে পারেনি তা আমিও বুঝেছি, হাতের ইশারাও দিলাম সেটাও বুঝলো না। আমি জানিনা মালয়েশিয়ান ভাষা, জানিনা ইংরেজিও, তাকে কোনভাবেই বুঝাতে পারছিলাম না। সে আমার কথা না বুঝে আমাকে মালয় আর ইংরেজি মিশ্রিত কি কি যেন বলে গেলো। আশে পাশে কেউ নেই যে মেয়েটাকে একটু বলবে আমি রোজা আছি সিগারেট ফেলে দিন। মেয়েটি কি যে বলতেছে কিছুই বুঝিনা, আমি যা বলতেছি সেওকিছু বুঝেনা মহাবিপদ মনে হয় এমনি হয়। দুই পক্ষ চুক্তি করতে বসেছে কিন্তু কেউ কারো কথা না বোঝার কারনে যুদ্ধ লেগে গেলো। আমার অবস্থায় তাই হলো, আমি তার মুখ থেকে সিগারেট নিয়ে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পিষে দিলাম। সে ক্ষিপ্ত হয়ে, “আইমাই চাওও খাও” বলে কি সব বললো তারপর আমার মাথার চুল ধরে মাথা ঝাকাতে লাগলো।
মাথায় কিছুটা বেথা পাচ্ছিলাম তাই নিজেকে বাচাতে গিয়ে তাকে দিলাম এক ধাক্কা সে গিয়ে পড়লো সিমেন্ট এর বস্তার উপর। আমার দিকে আবার যখন ছুটে আসতেছিলো মারার জন্য। আমি কি পাগল নাকি এই চাইনিজ মেয়ের হাতে মাইর খাবার জন্য অপেক্ষা করবো। দিলাম চোখ নাক বন্ধ করে এক দৌড়, এসে থামলাম আমাদের বাংগালী ইনচার্জ এর কাছে তার পেছনে লুকিয়ে তাকে বলতে লাগলাম “দেখুন স্যার এই মাইয়া আমার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাইতেছিলো। আমি রোজা ছিলাম তাই তাকে বললাম দূরে গিয়ে খান, সে বাংলা ভাষা বুঝেনা আমি তার কথা বুঝিনা অবশেষে তার সিগারেট আমি জোর করে ফেলে দেই সে কারনে আমাকে মারতে আসতেছে” আমার কথা শুনে ইনচার্জ পাগলের হুহু করে হাসতে লাগলো। ততক্ষনে মেয়েটি এসে গেছে রফিক ভাই চাইনিজ মেয়েকে হাত দিয়ে থামিয়েছেন অবশ্য কিন্তু তার হাসি থামাতে পারছেন না। অবশেষে হাসি থামিয়ে “মালয়েশিয়ান ভাষায় মেয়েটিকে কি যেন বললো।
তারপর সে থামলো এবার তার মুখে রাগ দেখা যাচ্ছে না মিটি মিটি হাসছে। এক মেয়েটিও হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হি হি করে হেসে উঠলো। তারা দুজন যখন হাসতেছে আমি গোমড়া মুখ নিয়ে থাকলে কি হয় তাই আমিও তাদের সাথে উচ্চস্বরে হুহু করে হেসে তাল মিলাতে লাগলাম। সেদিনের সেই ঝগড়া আজো আমার কাছে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখের দিন বলে আমি মনে করি। ধীরে ধীরে সেই চাইনিজ মেয়ে লিলিং আমার জীবনের অন্যতম নারী হয়ে গেলো। লিলিং চাইনিজ লেবারদের ইনচার্জ ছিলো, কিন্তু আমার সাথে তার সম্পর্ক ছিলো অন্যরকম। সময় পেলেই দুজনে আড্ডা জমিয়ে দিতাম। ছুটির দিনে তার গাড়ি করে ঘুরতে চলে যেতাম বিভিন্ন জায়গায়। দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেলো, টুইনটাওয়ার এর কাজ সম্পুর্ন শেষ হবার পথে। আমিও মালয়েশিয়ান ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেছি। এখন সব ধরনের মনের কথা ব্যক্ত করতে পারি লিলিং সহ সবার কাছে।
রবিন ও পিছে পড়ে থাকেনি, এক ইন্দোনেশিয়ান মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করেনি শুধু কাবিন করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। রবিন আর তার স্ত্রী থাকে এক সাথে আমি অন্যসব মানুষদের সাথে থাকি আর লিলিং তখন থাকতো আমপাং এ। দিন যত গড়ায় লিলিং ততই আমার নিকটে আসে একদিন সে আমার জীবনের কিছু তেতো সত্য কথা জানতে চেয়েছিলো। আমি কিছু বলেছিলাম কিছু লুকিয়েছিলাম, আমি যে কথা লুকিয়েছি সে খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলো। একদিন তার আজগুবি এক স্বপ্নের কথা প্রকাশ করলো আমার কাছে। সে বাংলাদেশ দেখতে চায়, ঘুরতে চায়বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যরূপের মাঝে। কিন্তু আমি ছিলাম মালয়েশিয়াতে অবৈধ চাইলেই তো আর বাংলাদেশে যেতে পারিনা। তাই লিলিং নিজে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ এম্বাসীর থেকে পাসপোর্ট বানিয়ে তার কোম্পানীর নামে ভিসা লাগিয়ে দিয়েছিলো। সেই সমস্ত কাজ করতে আরো দুবছর লেগে গেলো। আমি প্রথম যে টুইনটাওয়ার নির্মানের কাজ করেছিলাম সে টুইনটাওয়ার ইতিমধ্যে বিশ্বে সর্বস্তর স্থান দখল করে নিয়েছে। হোটেল, শপিংমল, অফিস মিলিয়ে টুইনটাওয়ার টি এখন বিশাল বড় বাণিজ্যিক ভবনে পরিনত হয়েছে।
দেশ বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থীর ভিড় জমে আজকাল টুইনটাওয়ার এর সামনে। মালয়েশিয়া উন্নত থেকে আরো উন্নত হতে লাগলো ঘোড়ার দৌড়ের পাল্লার মত। ভিসা আসার এক বছর পর সিদ্ধান্ত নিলাম লিলিং কে নিয়ে বাংলাদেশে আসবো। আমি একা নই সাথে রবিন আর তার ইন্দোনেশিয়ান স্ত্রী ফাইজা ও আসবে। আমাদের টিকেট কনফার্ম হলো, দুদিন বাদেই আমরা চারজন আসছি বাংলাদেশে। নতুন এক পরিচয় নিয়ে। আমরা চারজন অপেক্ষা করছি মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স এর এম.এইচ-০৭ এর নম্বর বিমানটির। যে বিমান আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে মালয়েশিয়া এয়াএয়ারপোর্ট থেকে বাংলাদেশে। জীবনে প্রথম আমি বিমানে ভ্রমণ করতে যাচ্ছি অনুভুতি অন্যরকম, এ অনুভুতি ব্যক্ত করার মত নয়। সাথে রয়েছে অজানা আরো কিছু স্মৃতি যে স্মৃতি রয়েছে আমার জন্মভুমিতে। উর্বর মাটিতে দুলে যাওয়া সোনালী ধানের সেই প্রিয় শৈশব।
সন্ধ্যা অবধি মাঠে খেলার অপরাধে বাবার কঞ্চিবাশের লাঠি নিয়ে আমার পেছনে দৌড় পারা। অসুস্থ সময়ে মায়ের সেবা পাওয়া, মা যখন কথায় কথায় ওরে আমার লক্ষ্মী সোনা বলে কপালে গালে অঝোর চুমুর ভালোবাসায় জরিয়ে রাখার না ভোলা স্মৃতি। আজ ছয় বছর পর আবার বাবাকে দেখবো মাকে দেখবো আমার ছোটবোন গুলো আজ নিশ্চয় অনেক বড় হয়েছে হয়ত মা সহ সবাই দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে খোকা আসবে, এখনি চলে আসবে এই ভাবনায়। আরে এতকিছুর ভিড়ে তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম সুমির কথা, নাহ নাহ তাক্র ভোলা সম্ভব না, আমার রক্তের প্রতিটা কণিকা তে তার বসবাস। হৃদয় পিঞ্জিরায় বন্ধি করা সোয়াচান পাখি। তাকে কি করে ভোলা যায়। তার গাল ফুলিয়ে কান্নাকরা, হাতে মেহেদি দিয়ে আমার সামনে এসে বলা “দেখোতো আজ আমার মেহেদি কত লাল হয়েছে।”
অভিমানের মান ভাংগাতে তাকে বুকে জরিয়ে নেওয়া, কপালে কাজল টিপ পড়িয়ে দেওয়া, ঝড়োবাদল দিনে একসাথে ভিজে ভিজে স্কুল থেকে আসা বৃষ্টির পানি যখন তার নাক বেয়ে ঠোটে এসে জলজল করতো কি অপরুপই না লাগতো তাকে। তাকে ভোলা কি সম্ভব নাকি? এরই মধ্যে লিলিং আমার গায়ে হালকা থাপ্পড় মেরে “কি ভাবছো” জিজ্ঞেস করলো মালয়েশিয়ান ভাষাতে। আমি মুখে মুচকি হাসিয়ে নিয়ে বললাম কিছুনা। হঠাৎ লিলিং এর যেন কি হয়ে গেলো, আমাকে জরিয়ে ধরলো পরম আবেশে এর আগে লিলিং এমনটা কখনো করেনি। কোন কথা বললো না সে চুপচাপ জরিয়ে ধরে আছে। এমন কান্ড দেখে রবিন বলে উঠলো “লিলিং তো দেখছি তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে” বলে হেসে দিলো। লিলিং চোখ পাকিয়ে বলতে ভাংগা ভাংগা বাংলা শব্দ এক করে আধোকাচা বাংলাভাষায় উত্তর দিলো “আমি বাংলা বুঝি বলতে বেশি পারিনা”।
লিলিং এর উত্তর শুনে রবিন একটু ভেবাচেকা খেয়ে গেলো, রবিন এর স্ত্রী ফাইজাও এতদিনে অনেক বাংলাভাষা শিখে গেছে। তার বুঝতে মোটেও কষ্ট হয়নি আমাদের কথা। সবাই একসাথেই হেসে উঠলাম, এ আনন্দ যেন কয়েকবিংশ শতাব্দি পর একবার আসে, যা বলে প্রকাশ করা সম্ভব না। আমাদের ফ্লাইট এর সময় হয়ে গেলো। চার ঘন্টার বিমান সফর কাটিয়ে রাত ৯টা নাগাত আমরা বাংলাদেশে এসে পৌছালাম। আমরা সর্ব প্রথম রবিনের বাসায় গেলাম। তার মা বাবার সাথে কথা বলে সেদিন আমরা সবাই সেখানেই থাকলাম। রবিনের বিয়েতে তার মা বেশি খুশি নন, সে তো বাংগালী বউ চাইতো যে তার সাথে থাকবে তার সাথে কথা বলবে, তার সংসারের কাজে হাত দিবে। কিন্তু রবিন কি করলো এক ইন্দোনেশিয়ান কে বিয়ে করলো, এমন ছেলের বউ পেলো সে যার সাথে একটু কথাও বলা যাবেনা কিন্তু ফাইজা যখন ভাংগা ভাংগা বাংলাভাষায় বলে উঠলো “আম্মা কেমন আছেন” তখন রবিনের মায়ের মুখে যে হাসি দেখেছিলাম সে হাসি সে আনন্দের বর্ণনা নাইবা দিলাম। আমাদের সাথে দুজন বিদেশিনী এসেছে তা নিয়ে পাড়ামহল্লায় হৈহুল্লোড় হয়ে গেছে। সকাল হতে, পাশের বাসার ভাবী, খালা খালু সবাই দেখতে আসছে আমাদের নয় আমাদের সাথে আসা দুই বিদেশিনী কে।
পরেরদিন দুপুর বেলা রবিন কে রেখে আমি আর লিলিং গাজীপুর সালনার জন্য রওনা হলাম। আমার বাসা গাজিপুর চৌরাস্তা থেকে টেম্পু দিয়ে মিনিট দশেক গেলেই সালনা। তার থেকে একটু ভেতরে চেয়ারম্যান বাড়ি বললে সবাই চিনে। চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে পাচ মিনিট উত্তরে হেটে গেলে একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে তার পেছনেই আমাদের বাসা। বাসার সামনে এসে উপস্থিত হতেই মা ছুটে আসলেন, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে উঠলেন, এক নাগারে কতগুলো চুমু দিয়েছিলো তা গুনতে হলে আমার ইলেক্ট্রনিক মেশিন দরকার হবে। আমাকে টানতে টানতে সবাইকে ডাকতে লাগলেন। আমার ঘরে আমার বোন আর মাবাবা সহ চারজন মানুষ থাকার কথা কিন্তু আমি উঠানে আসতে দেখতে পেলাম ত্রিশ জনের বেশি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মা আত্মীয়স্বজন এর কাউকে বাদ রাখেনি ডাকতে, বাদ দেয়নি পাশের বাসার খালা, আন্টি ভাবীদের ডাকতেও।
মহিলারা এই একটি কাজ খুব ভালো করতে পারে, কোন সুখের দিন তাদের জীবনে আসলে পুরো গ্রামকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবে, কিন্তু দুখের দিনে কাউকে ভুলেও জানাতে রাজিনা। আমার মায়ের বেলা তার ব্যতিক্রম না। সবাই আমাকে পেয়ে এতই আনন্দিত হয়েছে যে লিলিং এর কথা ভুলেই গিয়েছে সবাই। লিলিং এর কথা তুললো বাবা “আরে সুমন বিয়াশাদী করছোস নাকি এই চাকমা মেয়েরে” আমি একটু অবাক হলাম চাকমা কেন বলতেছে, কত সুন্দর চাইনিজ পুতুল এর মত দেখতে লিলিং তাকে কিনা এক ঝাটকায় চাকমা বানিয়ে দিলো বাবা। আমি একবার লিলিং এর দিকে তাকিয়ে মেলানোর চেষ্টা করলাম, আসলে কাটিং টা চাকমাদের সাথে মিলে, কিন্তু আমি কখনো সেভাবে নজর দেইনি। বাবা আবার ধমকের সুরে বলতে লাগলো “কিরে কথা কস না কেন?” আমি একটু ভড়কে গেলাম, মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে লিলিং এর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
সবাই আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, বাবা তো এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছে যেন আমাকে গিলে খেয়ে ফেলবে। আমি নিজেকে একটু সাহসী করে বলতে লাগলাম “বাবা এর নাম হচ্ছে লিলিং আমি যে কোম্পানীতে কাজ করি, সেই কোম্পানীর বস”। লিলিং এর দিকে তাকিয়ে বললাম “সে আমার বাবা, আর উনি হচ্ছেন মা”। লিলিং সবাইকে আধোকাচা বাংলায় বললো “আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন আপনারা”। সবাই এমনভাবেই অবাক হলো যেন দিনদুপুর এ কোন ভ্যালকিবাজির খেলা দেখেছে। বাবা উত্তর নিলেন। তারপর আমি সংক্ষেপে লিলিং এর কথা বললাম আর তার বাংলাদেশ দেখার ইচ্ছার কথাও জানালাম। তারপর গিয়ে সবাই ক্ষ্যান্ত হলো, তাদের প্রশ্নের ঝড়ের এতই বেগ ছিলো ভেবেছিলাম এর উত্তর দিতে হয়ত আজ আমার ব্রেইন স্টোক করবে কিন্তু এমনটা হলোনা। সারা বিকেল কেটে গেলো নানা রকম কাজে। লিলিং আবার বেশি ঝাল দেওয়া তরকারি খেতে পারেনা তার জন্য আমাকেই রান্না করতে হলো তারমত করে।
পরের দিন সকাল বেলা লুঙ্গি আর সেন্টু গেঞ্জি পড়ে ব্রাশছাড়া আংগুল দিয়ে আর পোড়া কয়লা দিয়ে দাত মাঝতেছিলাম উঠানে দাঁড়িয়ে। লিলিং এসে আমাকে এমন অবস্থায় দেখে খানিক অবাক হলো কারন এমনভাবে সে আমাকে আগে দেখেনি, তার আগ্রহ আমার পোশাকের থেকে হাত দিয়ে কয়লা দিয়ে দাত মাজার দৃশ্যে বেশি প্রবল ছিলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো “এটা কি করো” আমি মুচকি হাসি নিয়ে বললাম “ইটস বাংগালি ব্রাশ, ট্রাই দিস” সে হাসিতে ফেটে পড়লো হাসিমাখা মুখেই বললো “রেইলি”। আমি মাথা ঝাকিয়ে হ্যা উত্তর দিলাম। কিছুক্ষন পর সেও আংগুল আর কয়লা দিয়ে আমার সাথে দাত মাজতে লাগলো, এক বিদেশিনী কে বাঙ্গালী দাত ব্রাশ করাতে পেরে ভেতরে ভেতরেই এক আনন্দের ঢেউ বয়ে গেলো। কিছুক্ষন ব্রাশ আর কিছুক্ষন হাসাহাসিতে দিনটা ভালোই শুরু হয়েছিলো। কিন্তু দিনের মধ্যভাগে এসে মনটা কেমন জানি মরে গেলো, সুমিকে দেখে। সুমি আসছে আমাদের বাড়িতে, আমি তার সাথে কথা বলতে চাইনি সে নিজেই এসে বলতে লাগলো “কেমন আছো সুমন” তার কন্ঠের আওয়াজ কান পর্যন্ত আসতেই মনে পড়ে গেলো সেই পুরানো সব কথা।
উত্তর দেবার মধ্যে শুধু ভালো আছি বলে ঘরে চলে গেলাম, পালটা কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। ঘরের সুকেসে আজো সাজানো রয়েছে সুমির হাতে বানানো পুতুল জোরাখানা, রয়েছে শৈশবের কিছু অষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো এমন সব জিনিস যা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার মনকে কাদানোর জন্য যথেষ্ট। আমি সেগুলো দেখে যাচ্ছিলাম সুমি কয়েকবার ডাক দিয়েছিলো আমি উত্তর দেইনি, সে যখন চলে যাচ্ছিলো তখন শুধু একটি কথাই বললাম “আজো অন্তরের কোন জায়গায় জানি তুমি বাস করো। বের করে দিতে চেয়েছিলাম অনেকবার কিন্তু আমি পারিনি, হয়ত আজো ভালোবাসি বলে।” কথাটি বলে ঘুরে তাকালাম সুমির দিকে। তার চোখজোড়া ভর্তি জল, ছলছল করছে। শাড়ির আচল দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে সোজা বের হয়ে চলে গেলো সে। লিলিং সবকিছুই লক্ষ করলো, আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো কি কে ছিলো সে। মনের কষ্টটা দ্বিগুন রুপ ধারন করলো এতগুলো বছর তো সব লুকিয়েছি আজ কেন জানি লুকাতে ইচ্ছে করছে না।
লিলিং কে বললাম “তুমি রেডি হও তোমাকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে যাবো” লিলিং তার রুমে গিয়ে পরিপাটি হয়ে বের হলো। তাকে নিয়ে গাজীপুর ন্যাশনাল পার্কে চলে গেলাম। সেখানে এক বাগানের সামনে কিছু বসার স্থান আছে সেখানে গিয়ে বসে একটি সিগারেট এ আগুন ধরিয়ে টানতে লাগলাম। লিলিং আবার প্রশ্ন করলো সুমির কথা, আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলতে লাগলাম। সুমি আমার প্রথম প্রেমের নারী। একসাথে স্কুলে পড়তাম, আর সারাটা বিকেল তার সাথেই খেলার ছলে কেটে যেতো। কখনো পুতুল বিয়ে কখনো দুজন নকল স্বামী স্ত্রী সেজে। আমি পড়ালেখায় মোটেও ভালোছিলাম না, আমার পাস করতে হলে সুমির খাতা নকল করা ছাড়া আর কোন রাস্তা ছিলোনা। সুমিও সব সময় আমাকে তার খাতা দেখাতো। আমাদের বাল্যকালে আমাদের চলাফেরা কথাবার্তা নিয়ে কোন সমস্যা ছিলোনা। সমস্যা তখন হতে লাগলো যখন আমরা বড় হতে লাগলাম। আমি পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ালেখা করে বাবার সাথে দোকানের কাজে লেগে গেলাম।
সুমি তখন একাই স্কুলে যেতো। আমি সারাদিন তার অপেক্ষা করতাম কখন সে আসবে আর আমি তার সাথে খেলতে যাবো। এই অপেক্ষা আমাকে বড্ড কষ্ট দিতো। ধীরে ধীরে আমরা আরও বড় হতে লাগলাম, আর সমাজের চোখে আমাদের ব্যবধান নজরে পড়লো। সুমি যখন কলেজে উঠলো তখন সুমির আর আমার চলাফেরা কেউ মেনে নিতে পারলোনা। কিন্তু দুজনেই ছিলাম একজন আরেকজনের অন্তরঙ্গ। আমাদের চলাফেরা যখন কেউ ফেরাতে পারছিলোনা তখন সুমির বাবা সুমির বিয়ে ঠিক করে দেয় তখন আমি একটি ভুল কাজ করেছিলাম। আমি সুমিকে নিয়ে মাওনা চলে যাই পালিয়ে, আমার কাছে কোন টাকা পয়াসা ছিলোনা, মাওনা পর্যন্ত হেটেই গিয়েছিলাম। রাত যখন গভীর হতে লাগলো আমার ভয় তত বাড়তে লাগলো, কোথায় যাবো কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
তখন আমিমি আবেগ থেকে বাস্তবতায় আসি, সুমিও বুঝতে পেরেছিলো এখানে রাত কাটানো সম্ভব না। এই এলাকাটা এমনিও ভালোনা, চুরি ছিনতাই খুন ধর্ষন এই এলাকায় প্রায় হয়। যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগলো তখন আমাদের চোখে বেশ কিছু খারাপ কাজের নজিরা পাই। কেউ নেশা করতেছে কেউ ঘোরাঘুরি করতেছে। তাদের নিয়ত কোন ভাবেই ভালোনা। দুজন মানুষ যখন গাঞ্জা টানতে টানতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতো লাগলো। আমরা ভয় পেয়ে দৌড়াতে লাগলাম। তারাও আমাদের পিছু দৌড়াচ্ছিলো তারপর এক রিক্সাওয়ালাকে পেয়ে তার কাছে সব খুলে বললে সে আমাদের সালনা নিয়ে আসে। ফিরে আসার পর, সুমির বাবা শালিশ ডাকে, তার মেয়েকে আমি জোর করে ভাগিয়েছি এই অপবাদ দিয়ে। সেদিন আমার মা বাবাকে সবাই অনেক অপমান করে, বাবা আমাকে বেদম মার মারে। প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন বাবার মার খেয়ে।
তারপরের দিন আমি আবার সুমির বাসায় যাই সেদিন সুমির বিয়ে, আমি সরাসরি সুমির সামনে গিয়ে বলি “তুই না বলছিলি তুই আমাকে বিয়ে করবি তাহলে অন্যকাউকে আজ কেন বিয়ে করতেছিস।” সুমির বাবা কোথা থেকে এসে আমাকে চড় মেরে বসলো, তার বাবা যখন আমাকে মারার জন্য লাঠি নিয়ে আসতেছিলো তখন সুমি আমাকে বলে “আমার কসম লাগে তুই এখান থেকে চলে যা, অনেক দূরে চলে যা, যেন কোনদিন তোর ছায়াও আমাকে না দেখতে হয়”। আমি সেখান থেকে চলে আসি, বাবা এই খবর শুনে আমাকে আবার অনেক মারধোর করে, সেদিন আমাকে এতই মেরেছিলো যে আমাকে হাসপাতাল এ নিয়ে যেতে হয়েছে। তারপর সুমির বিয়ে হয়ে যায়, বাবা আমাকে তার এক বন্ধুর সাথে কথা বলে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সেই যে সেদিন দেখা হয়েছিলো, আর আজ দেখা হলো, মাঝখানে ছয় বসন্ত পেড়িয়েছি, আজ তাকে দেখে পুরানো সে কথা মনে পরে গেলো। লিলিং মুখে কিছুই বললো না, শুধু আমাকে জরিয়ে ধরে আমার ঠোটে একটি চুমু দিলো। আমি কিছু বলার শক্তি পেলাম না। শুধু লিলিংকে জরিয়ে ধরে রইলাম অনেকক্ষন।
পুরো তিনমাস আমি আর লিলিং ঘুরে বেড়ালাম বাংলাদেশে। লিলিং এর আপন বলতে তার এক ভাই আছে। বাবামা অনেক আগেই গত হয়েছে। বাংলাদেশে এসে স্বজনপ্রীতি দেখে, পরিবারের ভালোবাসা পেয়ে সে কোনভাবেই যেতে চায়নি দেশ ছেড়ে। রবিন এর সাথে যোগাযোগ করলে সে জানায় সে আর মালয়েশিয়া যাবেনা। ফাইজা কে নিয়ে খাবার হোটেল এর ব্যবসা করবে বাবা মায়ের সাথেই থাকবে। আমি আর লিলিং চলে গেলাম মালয়েশিয়াতে।কিন্তু লিলিং আগের মত নেই সে পরিবর্তন হয়ে গেছে। বার বার সে বাংলাদেশে আসতে চায়, একদিন সে আমাকে যে কথা বললো তাতে তো আমার কানকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমাকেবিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলো, কিন্তু আমি মুসলমান সে অন্যধর্মের এটা কিভাবে সম্ভব। আমি নাকোজ করে দিলে, সে মুসলমান হবার কথা জানায়, কিন্তু শর্ত একটাই সে বিয়ের পর মালয়েশিয়া তে থাকবে না বাংলাদেশে থাকবে। আমি সব কথা আমার বাবা মায়ের কাছে জানালাম, তারা প্রথমে একটু সংকোচ করলেও পরে রাজি হয়।
আর এত ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতাও আমার নেই। এমন ভালোবাসা পাবার জন্যই তো মানুষ বেচে থাকে শত লাঞ্ছনার শিকার হয়েও। অবশেষে এক বছরের মধ্যে আমরা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসলাম। লিলিং মুসলমান হলো, এবং আমরা বিয়ে করলাম। আমাদের ছোট সংসারে সুখের অভাব ছিলোনা। রবিন এর মতো আমি খাবার হোটেল না দিলেও পাইকারী চালের আড়ত দিয়ে বসেছি। কিন্তু সুখের ঘরিতে দুঃখের কাটা হচ্ছে সেকেন্ডের কাটা। যা বার বার ঘুরে আসে। আমাদের বিয়ের পাচ বছর কেটে গেছে, ছোটএকটি কন্যা সন্তান আছে আমাদের। তার নাম মাফুজা ইশতিয়াক। দেখতে কিছুটা মায়ের মত কিছুটা আমার মতই হয়েছে। না একে চাইনিজ বলা যাবে নাইবা বাংগালি বলা যায়। আমাদের সাংসারিক জীবনে টুকিটাকি সাংসারিক ঝামেলা ছাড়া আর কোন ঝামেলাই হয়নি আমাদের মাঝে। লিলিং কয়েকদিন ধরেই অসুস্থ তাকে ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট করিয়েছে।
আজ তার রিপোর্ট হাতে পাবো, অবশেষে রিপোর্ট এ যা পেলাম তার থেকে বরং আমার মরন ভালো ছিলো। লিলিং এর রিপোর্ট তার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বেশিদিন সময় নেই তার হাতে। আমার সপ্ন সুখের সংসার যেন মুহুর্তেই ভেংগে যেতে লাগলো। এই খবর লিলিং পাবার পর বায়না ধরেছে যেখান থেকে সব শুরু হয়েছিলো সেখানে আবার যাবে। মানে মালয়েশিয়ার টুইনটাওয়ার এর কাছে। এটাই তার শেষ স্বপ্ন। ডাক্তারের ভাষ্যমতে তার শত চিকিৎসা করালেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না। আমি আবার মালয়েশিয়া যাবার জন্য ট্যুরিস্ট ভিসার এপ্লাই করলাম ভিসা পেতে পেতে মাস খানেক কেটে গেলো। রবিন এই খবর শোনার পর আমার থেকে বেশী কষ্ট যেন সে পেয়েছিলো।
আমার সাথে রবিন আর ফাইজাও যাবে মালয়েশিয়াতে, আমরা চারজন আবার বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট এ উপস্থিত হলাম। চারজনে আবার পাড়ি জমালাম মালয়েশিয়াতে। মালয়েশিয়া আসার পর লিলিং আরোও দুর্বল হয়ে পড়লো। বার বার গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠা, মলমুত্রের সাথে রক্ত ক্ষয়, কাশিতে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি বেড়েই যেতে লাগলো। পনেরদিন ছিলাম মালয়েশিয়াতে আমরা সে সমস্ত জায়গা ঘুড়েছি যেখানে রয়েছে আমাদের দুজনের হাজারো স্মৃতি। আজ আমাদের চারজনেরই দেশে ফিরে যাবার কথা। যাবো চারজনই কিন্তু লিলিং যাবে লাশ হয়ে।